জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৯ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৯
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সন্ধ্যার পর অনেকটা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরল সৌহার্দ্য। ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে দেখল যে কেউ-ই নেই। টাইটা একহাতে আলগা করতে করতে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসল। মিসেস নাহার হাতে করে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে ওর পাশে বসলেন। সৌহার্দ্য গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে বলল,
” তুমি নিয়ে এলে কেন? আর কেউ ছিলোনা?”
” আমি-ই আসছিলাম রান্নাঘর থেকে। আসছি যখন তাই নিয়ে এলাম।”
সৌহার্দ্য পানিটা খেয়ে একটা শ্বাস ফেলল। তারপর নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আজ তো বৃহস্পতিবার। আপুই আসেনি?”
মিসেস নাহার আচল দিয়ে নিজের মুখ মুছতে মুছতে বললেন,

” না, আজ ওদের বাসায় মেহমান আছে। তাই এই সপ্তাহে আসবে না।”
সৌহার্দ্য কিছু বলল না। তখনই শফিক রায়হান, আমিনুর খান আর মিসেস আসমা নিচে নেমে এলেন। নিজের ফুপা-ফুপিকে এ বাড়িতে দেখে সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে উঠে চলে যেতে নিলেই মিসেস আসমা বললেন,
” এখনো রেগে থাকবি আমাদের ওপর? অনেকতো হল।”
সৌহার্দ্য কঠিন গলায় বলল,
” আমি কারো ওপরেই রেগে নেই। আমি টায়ার্ড, তাই রুমে যাচ্ছি।”
বলে সৌহার্দ্য যেতে নিলেই আমিনুর বলে উঠলেন,
” পিচ্চু কেমন আছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৌহার্দ্য থেমে গেল। বেশ অনেকটাই অবাক হয়ে তাকাল আমিনুরের দিকে। যেন কানে খুব অবিশ্বাস্য কিছু শুনে ফেলেছে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” পিচ্চু? আজ আবার ও পিচ্চু হয়ে গেল? তাছাড়াও ও কেমন আছে সেটা জানার ইচ্ছা তোমাদের কবে থেকে হল?”
আসমা করুণ স্বরে বলল,
” ও আমাদেরও ছেলে বাবা। এটা ভুলে যাস না।”
সৌহার্দ্য আবারও হাসল। এরপর নিজের হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল,
” তো এটা তোমাদের আজ মনে পরল? যে পিচ্চু তোমাদের নিজের ছেলে?”

আসমা মাথা নুইয়ে ফেললেন। চোখে নোনাজল জমা হল ওনার। বিহান তো ওনার নিজের ছেলে। ন-মাস গর্ভে ধারণ করেছে। এমনতো না যে সে তার ছেলেকে ভালোবাসেনি। বা এখনো বাসেনা। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান কী হয় সেটা একজন মা-ই জানেন। কিন্তু নিজের সন্তানের এতো ঘৃণ্য অপরাধ মেনে নিতে পারেন নি বলেই তো এই দূরত্ব। বুকে পাথর চেপে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজের ছেলেকে। শফিক রায়হান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
” ওকে আমরা কোনদিনও ভুলিনি। ভোলা সম্ভবও না। ভালোবেসেছি। হয়তো একটু বেশিই ভালোবেসেছি। তাই ওর করা অপরাধকে ক্ষমা করতে পারিনি। কিন্তু এখনতো ও অনেকটা সময় কেটে গেছে। আর যা বুঝলাম নিজেকে শুধরে নিয়েছে। তাই…”

শফিক রায়হানের কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্য বলল,
” কিছু কিছু সময় আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরে আমাদের পরিবারকে, বাবা-মা কে, তাদের সাপোর্ট কে। কিন্তু ঐ সময়টাতেই যখন তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয় না? তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। একটা সময় ওর তোমাদের খুব প্রয়োজন ছিল বাবা। কিন্তু তখন তোমরা ওর দিকে ফিরেও তাকাও নি। আজ তাকাতে চাইছ। মজার ব্যাপার হল, আজ আর ওর কাউকে প্রয়োজন নেই। ও এখন একা বাঁচতে শিখে গেছে।”
এইটুকু বলে সৌহার্দ্য নিজের রুমে চলে গেল। বাকিরা অনেকটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর যাওয়ার দিকে। সত্যিই কী মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছিল? কিন্তু ঐ পরিস্থিতিতে ওনারা কী করতে পারতেন? একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার পরেও যদি ছেলেকে শাসণ না করত সেটাকী স্বার্থপরতা হতো না?

মানুষ ভাবে। সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভোগে। কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। অনেকসময় নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যেতে থাকে। কিন্তু পথ পায়না। দেখতে দেখতে আরও দুটো দিন কেটে গেল। এই দুইদিনে চারজনের অবস্থা চাররকম ছিল। সৌহার্দ্য নিজেকে তুর্বীর স্মৃতি থেকে দূরে রাখবে না-কি নিজের ভাইকে সামলামে সেটাই ভাবছিল। বিহান ওপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকলেও নিজের ভালোবাসাকে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলার কষ্টে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরেছে। রিখিয়া বিহানকে ওসব কথা বলার জন্যে অপরাধবোধে ভুগছে। ওকে গিয়ে সরি বলবে কীকরে সেটাও ভাবছে।

আর তুর্বী এই দুইদিনে বারবার সৌহার্দ্যর কথা মনে পরেছে। ওদের একসাথে কাটানো এমন কোন মুহূর্ত নেই যেটা ও মনে করেনি। অনেক চেষ্টা করেও সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে সেটা ও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেনা। তিনটাদিন ছটফট করে কেটেছে ওর। নিজের ভেতরকার এরকম অপরিচিত আর অদ্ভুত অনুভূতির আবির্ভাব দেখে নিজেই অবাক হয়েছে ও। তারওপর রিখিয়া আর বিহানের ব্যাপারটা নিয়েও ওকে ভাবতে হয়েছে। রিখিয়ার বিয়েটাও এগিয়ে আসছে। সবার তোরজোড়, শাফিন, শাফিনের বাড়ির সকলের এত উৎসাহ দেখে ভয় লাগছে ওর। সত্যিই বিয়েটা হয়ে যাবে না তো? সব মিলিয়ে দমবন্ধকর ভাবে কেটেছে এই দুটো দিন ওদের।

বিহান দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেড়ে সোফায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছিল। এমন সময় সৌহার্দ্য এলো। ডুপ্লিকেট চাবি থাকায় আর কলিংবেল বাজাতে হয়নি। বিহান সৌহার্দ্যর দিকে না তাকিয়েই টিভি দেখতে দেখতে বলল,
” আজ হঠাৎ এই সময়ে?”
সৌহার্দ্য বিহানের পাশে বসে ওপরের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে বলল,
” তোর কাছে আসতে এখন আমাকে সময় দেখে আসতে হবে?”
” না তা-না। দুপুরে খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ অফিসে খেয়ে নিয়েছি।”
বিহান কিছু না বলে চ্যানেল ঘোরাতে লাগল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ পনেরো মিনিটের মত দুজনেই চুপ ছিল। হঠাৎ বিহান বলল,
” কিছু ভেবেছিস?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বিষয়ে বলতো?”
বিহান এবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” দোলাকে তো বিয়ে করছিস না। তুর্বীও তো এখানেই আছে। ওর সাথে সবটা ঠিক করে নেওয়া যায় না? ট্রায় করে দেখ? কে জানে হয়তো ও এখন অন্যকিছু ভাবছে।”
স‍ৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” এবার আমি নিজে থেকে ওকে কিছু বলব না। ওকে নিয়ে আর কোন স্বপ্নও দেখব না। কে বলতে পারে আমি এখন নিজে থেকে কিছু বললে এ মেয়ে আবারও আমায় রিজেক্ট করে দেবে। হয়তো আবার আমার স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে দেবে। বারবার একই ধাক্কা হজম হবেনা আমার।”
বিহান কিছু বলবে তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। বিহান অবাক হল। এরকম সময় আবার কে আসবে? সৌহার্দ্য উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে তুর্বী আর রিখিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসল। কারণ ও জানতো আজ তুর্বী আর রিখিয়া আসবে। স‍ৌহার্দ্য হাসি মুখে বলল,
” চলে এসছো? ভেতরে এসো।”

তুর্বী আর রিখিয়া একে ওপরের দিকে একপলক তাকাল। এরপর ভেতরে এলো। বিহান কে এসছে দেখার জন্যে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ওদের দুজনকে দেখে চমকে গেল। অনেকটা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল। রিখিয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই সেদিনের কথা মনে পরল। অপরাধবোধে রিখিয়ার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না চোখ সরিয়ে নিল। রিখিয়া বিহানের চোখের ভাষা পড়তে পেরে একটু অবাক হল। যেখানে আজকে অপরাধবোধ ওর মধ্যে থাকার কথা সেখানে বিহান নিজেই অপরাধবোধে ভুগছে। সত্যিই ছেলেটা বদলে গেছে। সৌহার্দ্য বলল,
” কী হল তোর বাড়িতে মেহমান এসছে আর তুই স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেলি যে?”

বিহান একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল তারপর আবার রিখিয়া আর তুর্বীর দিকে। ওদের হঠাৎ আগমনের কারণ বুঝতে পারছেনা ও। আসলে এই দুদিন অনেক ভেবে রিখিয়া ঠিক করেছে যে ও এসে বিহানকে সরি বলবে সেদিনের ব্যবহারের জন্যে। তুর্বীকে বলার পর তুর্বীতো আকাশের চাঁদ পেলো হাতে। যেভাবেই হোক ওদের আবার একে ওপরের মুখোমুখি তো করাতে পারবে। তাই সৌহার্দ্যর সাথে যোগাযোগ করে রিখিয়াকে নিয়ে চলে এসছে এখানে। স‍‍ৌহার্দ্য ওদের হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো রেখে দিয়ে তুর্বীর হাত ধরে বলল,
” চল, তোমার সাথে আমার কিছু ইম্পর্টেন্ট কথা আছে, ফাস্ট!”
তুর্বীও কথা না বাড়িয়ে সৌহার্দ্যর সাথে ব্যালকনির দিকে চলে গেল। রিখিয়া এবার বিহানের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” ভালো আছেন?”
বিহান নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” সবার খারাপ থাকার কারণ ভালো কীকরে থাকে বলোতো?”
রিখিয়া এবার একটু অসহায় কন্ঠে বলল,
” সেদিনের ব্যবহারে জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত।”
” তোমার দুঃখিত হওয়ার তো কোন কারণ আমি দেখছিনা রিখিয়া। যা করার আমি করেছি। তোমাকে আমি আঘাত করেছি। তোমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান আমি করেছি। তাই তোমার আমাকে ওসব বলা অস্বাভাবিক বা ভুল কিছু না।”
রিখিয়া কিছু বলল না। বিহান সোফায় রাখা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বিয়ের শপিং হচ্ছে?”
রিখিয়া নিচু কন্ঠে বলে উঠল,
” হুম।”
এরপর বেশ অনেকটা সময় দুজনেই চুপ ছিল। হঠাৎ বিহান বলল,
“আচ্ছা তুমি বস। আমি আসছি।”
কথাটা বলে বিহান দ্রুতপদে রুমে ঢুকে গিয়ে দরজা লক করে দিল। ও আর নিজের ছায়া রিখিয়ার জীবনে পরতে দেবেনা। রিখিয়া ঠিকই বলেছে ও যার জীবনে থাকে তার জীবনটাই ছন্নছাড়া হয়ে যায়। তাই ও যতটা সম্ভব দূরে থাকবে রিখিয়ার থেকে। এটাই ভালো হবে রিখিয়ার জন্যে।

সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাইরে খুব জোরে ঝড় হচ্ছে। প্রচন্ড বৃষ্টি আর বজ্রপাত বিকেলেই শুরু হয়ে গেছিল। তাই তুর্বী আর রিখিয়া আর যেতে পারেনি আজ। বাধ্য হয়েই থেকে যেতে হল বিহানের বাড়িতে। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে কাল ফিরবে। ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসে আছে সৌহার্দ্য, তুর্বী আর রিখিয়া। বিহান এখনো দরজা খোলনি। সৌহার্দ্য অনেকবার ডেকেছে। কিন্তু বিহান শুধু একবার বলেছে ওকে না ডাকতে ও না-কি ঘুমাবে। ঘুম ভাঙলে নিজেই খুলবে। তাই কেউ আর ডাকেনি। কিছক্ষণ মৌনতার পর তুর্বী বলল,
” সৌহার্দ্য, মায়া কে? সেদিন বিহান বলছিল এই নামটা। বিহানের পাস্টের সাথে মায়ার কী সম্পর্ক।”
সৌহার্দ্য গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলল,

” অনেক আগের ঘটনা সেটা। যদিও তার প্রভাব ওর জীবন থেকে এখনো যায়নি। সেই একটা ঘটনা ওর গত সাতটা বছর নষ্ট করে দিয়েছে। শেষ করে দিয়েছে ওকে।”
এবার রিখিয়ারও প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে জানতে যে বিহানের সাথে এমন কী হয়েছিল। তাই ও কৌতূহল নিয়ে বলল,
” কী হয়েছিল? আই মিন একটা মেয়ে ওর সাথে কী এমন করেছিল যে বিহানের জীবনের এতবড় ক্ষতি হয়ে গেল?”
সৌহার্দ্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” অভিযোগ! ধর্ষণের অভিযোগ! ইয়েস ওর বাবা-মা গোটা পরিবার, আগের বন্ধুবান্ধব, সবার কাছে ওর একটাই পরিচয়। আ রেপিস্ট।”
রিখিয়া কেঁপে উঠল। এটা হতেই পারেনা। ও জানে বিহান আর যাই হোক কোন মেয়েকে রেপ করার মত জঘন্য কাজ করবেনা। তুর্বীতো কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে শুধু তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। রিখিয়া কম্পিত কন্ঠে বলল,
” প-প্লিজ সবটা খুলে বলুন।”
সৌহার্দ্য বিহানে রুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল সেই ঘটনা।
অতীত ____

বিহান আর সৌহার্দ্য তখন ওনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। সৌহার্দ্যর পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক থাকলেও বিহানের ধ্যাত গ্যান সবই ছিল ছবি আঁকা। ওর আঁকা ছবির জন্যে সবাই ওর খুব প্রশংসাও করতো। দুষ্টু হলেও, বিহান সকলেরই আদরের ছিল। বিহানের মামা আর সৌহার্দ্যর বাবা শফিক রায়হানের কলিজার টুকরো ছিল বিহান। সৌহার্দ্যর চেয়ে কোন অংশে কম ভাবতো না বিহানকে। বিহানের খালাতো বোন ছিল মায়া। ঐ ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো। একদিন ক্যাম্পাসের মাঠে বিহান সৌহার্দ্য ওরা আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ ভরা ক্যাম্পাসে সকলের সামনে মায়া বিহানকে প্রপোজ করে বসে। বিহান প্রথমে বোকা বনে গেছিল এমন ঘটনায়। সৌহার্দ্যও বোকার মত তাকিয়ে ছিল। কিন্তু বিহান মায়াকে শুধু বোনের চোখেই দেখতো তাই খুব ভদ্রভাবে নিষেধ করে দেয়।

এটা নিয়ে মায়ার ওপর অনেকে হাসাহাসিও করে কিন্তু বিহানের খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিলোনা। ও যথেষ্ট ভদ্রভাবেই ‘না’ বলেছিল। এরপর থেকেই মায়ার জ্বালাতন শুরু হতে থাকে। ক্যাম্পাসে, ফোনে, মেসেজে, সোসাল সাইটে নানাভাবে বিরক্ত করত বিহানকে। বিহান যথেষ্ট ঠান্ডা মাথায় বোঝাত ওকে। কিন্তু মায়া বুঝতে চাইতো না। পাগলের মত বিহানের পেছন পরে থাকতো। সৌহার্দ্যও আলাদাভাবে বুঝিয়েছে মায়াকে। কোন লাভ হয়নি। একপর্যায়ে বিহানের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল। কারণ মায়া অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছিল। ভার্সিটির সবার কাছে বলে বেড়িয়েছে ওরা রিলেশনে আছে। আরও বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা রটিয়ে দিয়েছিল ক্যাম্পাসে। একদিন বিহান রেগে মায়াকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” কী সমস্যা কী তোমার? এটুকু বোঝনা যে আমি তোমাকে পছন্দ করিনা। ক্যাম্পাস জুড়ে মিথ্যে রটিয়ে বেড়াচ্ছো। হোয়াটস ইউর প্রবলেম?”
মায়া বলল,
” আমি তোমাকে ভালোবাসি বিহান। কেন বুঝতে পারোনা? আমার মধ্যে কীসের কমতি আছে? কেন এক্সেপ্ট করবে না তুমি আমাকে? তোমাকে করতে হবে।”
আসলে প্রথমে পছন্দ করে প্রপোজ করলেও পরে যখন বিহান না করে দিয়েছে তখন এটা মায়ার ইগো ইশ্যু হয়ে গেছে। যেকোন মূল্যে ওর বিহানকে চাই এবার। বিহান ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিল না।

নিজের পরিবারের কাউকে এবিষয়ে কিচ্ছু বলেনি শুধুমাত্র মায়ার কথা ভেবে। মায়ার বাবা খুব বদরাগী আর স্ট্রিক্ট। এসব শুনলে মারধোরও করতে পারে মায়াকে। কিন্তু এই না বলাটাই হয়তো ওর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। দিন দিন মায়ার মানসিক অত্যাচারের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছিল। একদিন মায়া এক ভয়ঙ্কর কাজ করে বসল। ওর নিজেল বান্ধবীকে বলল যে, বিহানের সাথে ও রুমডেট করেছে। ওদের প্রেম এখন জমে ক্ষির। আসলে কথাগুলো মায়া শুধু ওর ঐ বান্ধবীকেই বলেছিল শুধুমাত্র নিজের ইগো স্যাটিসফাইট করার জন্যে। যে যেই ছেলে আমাকে রিজেক্ট করেছিল সেই আমার সাথে আজ বেড শেয়ারও করেছে। কিন্তু সেটা আর ওর সেই বান্ধবী নিজের মধ্যে রাখলোনা গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিল। ব্যাপারটা সৌহার্দ্যর আর বিহানের কানে পৌঁছনোর পর দুজনেই রেগে গেল। বিহান এতোটাই রেগে গেছিল যে সোজা মায়ার ক্লাস রুমে গিয়ে ওকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারল। তারপর রেগে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৮

” রাগ কন্ট্রোল করতে পারলাম না তাই গায়ে হাত তুললাম। নইলে তোর মত মেয়েদের ছুঁয়েও দেখেনা বিহান। আর কী বলে বেড়িয়েছিস সবাইকে? আমি তোর সাথে রিলেশনে আছি? আমরা খুব ক্লোজ? রুমডেট করেছি আমরা? ছিঃ আমার রুচি এতোটাও খারাপ না যে তোর মত থার্ডক্লাস মেয়ের সাথে সম্পর্ক করব। তাও রুমডেট! সেটাতে তোরা অভ্যস্ত হতে পারিস, আমি নই।”

এটুকু বলে চলে যেতে নিয়েও বিহান দাঁড়িয়ে গেল। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে পেছনে ঘুরে বলল,
” দেখ, আমি তোমাকে অনেকবার ভালোভাবে বুঝিয়েছে। কিন্তু তুমি শোনোনি উল্টে আরও বেশি বিরক্ত করেছ আমাকে। তোমার সম্মান বা আত্মসম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। সো প্লিজ এরকম জঘন্য কাজ আর করোনা। এতে তুমি নিজেই ছোট হচ্ছো।”
বলে বিহান চলে গেল ওখান থেকে। মায়া গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওখানে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সবাই হাসাহাসি করছে ওকে নিয়ে। কেউ কেউ পিঞ্চ করছে, কেউ খারাপ কথা বলছে। এবার মায়ার চোখে জল চলে এল। তবে কষ্টে নয় রাগে। প্রচন্ড রাগে!

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫০