জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫০ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫০
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

ইগো আর রাগ দুটোই ভীষণ ভয়ংকর। দুটোই মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ইগোস্টিক মানুষগুলো নিজের ইগো স্যাটিসফাই করতে যা ইচ্ছে করতে পারে। আবার রাগের বসে এটা বুঝতেই পারেনা সে কী করছে। মায়ার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিহানের সেদিনের থাপ্পড় আর কথাগুলোতে হিংস্র হয়ে উঠেছিল ও। সকলের সামনে এই অপমান ওর ইগোকে এতোটাই হার্ট করেছে যে ও রাগে উন্মাদ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই তীব্র রাগের বসে ও ভুলেই গেছিল যে দোষটা ওর-ই ছিল। শুধু মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন বিহানকে ওর জায়গাটা দেখাতে হবে। ও যেমন সবার সামনে অপমানিত হয়েছে। বিহানকেও হতে হবে। নিজের গায়ে কলঙ্ক লাগিয়ে হলেও বিহানকে চরম অপমানের শিকার করবে ও। আর ও মনে মনে এরকম কিছু ভাবল যেটা সত্যিই খুব ভয়ংকর ছিল।

মায়াদের বাড়িতে ওর ফুপির বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। যেহেতু সৌহার্দ্যর শফিক রায়হান মায়ার মামা, আর বিহানের মা আসমা মায়ার খালা হয়। তাই দুই পরিবারকেই যেতে হয়েছিল অনুষ্ঠানের দিন। হলুদের রাত আর বিয়ের রাত। দুদিন থাকার দরকার পরবে। বিহান এখন অনেকটাই রিল্যাক্স কারণ মায়া ওকে এখন আর ডিসটার্ব করেনা। ও ভেবেছিল মায়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বা লজ্জিত হয়ে সরে এসছে। সৌহার্দ্যর সাথেও এ বিষয়ে কথা হয়েছিল ওর। ওরা ভেবেই নিয়েছিল মায়ার প্রবলেম সলভব। তাই বিনা সঙ্কোচেই পরিবারের সবার সাথে গিয়েছিল মায়াদের বাড়ি।

অদ্ভুতভাবে মায়া তখনও বিহানের সামনে আসেনি বা ওকে জ্বালাতন করেনি। প্রথমদিন কোন ঝামেলা ছাড়া ভালো-ই কেটেছিল। পরেরদিন বাড়িতে একেবারে কাছের আত্মীয় ছাড়া সব চলে গেল। সৌহার্দ্য ওর বাবার সাথে গেছে কনের বাড়িতে। বিহানের শরীরে একটু জ্বর জ্বর ছিল। তাই ও যায়নি। এমনিতেও আগামীকাল ওরা বাড়ি ফিরেই যাবে। রাতে বেশ অনেকটা ক্লান্তি নিয়ে বিহান রুমে ঢুকলো। ওয়াসরুম থেকে এসে টেবিলে রাখা পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। অসুস্থ আর ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও। কিন্তু সকালে উঠে যে ও এরকম কিছুর সম্মুখীন হবে সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি। ও ভাবতেও পারেনি পরবর্তী সকাল ওর জীবনে এরকম অন্ধকার নিয়ে আসবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকালে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল বিহান। এখনো ঘুম পুরোপুরি কাটেনি ওর। কোনরকম উঠে বসে চারপাশে তাকিয়ে দেখে বাড়ির সবাই ওর রুমে। ও বেশ অবাক হল। চোখ কচলে চারপাশে তাকাল। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখল মায়া ছেড়া পোশাক, এলোমেলো চুল, একপ্রকার বিদ্ধস্ত অবস্থায় গুটিয়ে ওর মা-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বিহান নিজের শরীরে ঘাড়েও হালকা জ্বালা অনুভব করল। কিন্তু ওর দৃষ্টি বাকি সবার দিকে। সবাই এই রুমে কেন?

আর মায়ার-ই বা কী হয়েছে? ও ওর বাবা-মার দিকে তাকিয়ে দেখল ওনারা ক্ষীপ্ত, ঘৃণামাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পাশে শফিক রায়হানও দাঁড়ানো। উনি কখন এল? আর সৌহার্দ্য কই? হঠাৎ ঘুম থেকে উঠায় আর উঠেই আচমকা এসব চোখের সামনে দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। ও কিছু বলবে তার আগেই আমিনুর সপাটে একটা চড় বসালো ওর গালে। বিহানের চোখের ঘুমটুকু কেটে গেল। ও অবাক হয়ে তাকাল ওর বাবার দিকে। ওর গায়ে এর আগে কোনদিনও ফুলের টোকাও দেয়নি ওর বাবা। সেখানে সকলের সামনে চড় মারাতে ও হতভম্ব। ও অবাক হয়ে কিছু বলবে তার আগেই মায়া আরও জোরে কেঁদে ফেলল। বিহান ভ্রু কুচকে তাকাল মায়ার দিকে। মায়ার মা কেঁদে দিয়ে বলল,

” নিজের খালাতো বোনের সাথে এরকম জঘন্য কাজ করতে লজ্জা করলোনা তোর? আমার মেয়েটার এতোবড় ক্ষতি কীকরে করলি?”
বিহানের ভ্রু আরও কুচকে গেল। কী করেছে ও?রুমেই সবাই কানাঘুষা করেই যাচ্ছে। বিহান ভ্রু কুচকেই বলল,
” মানে! কী হয়েছে?”
আমিনুর আবারও একটা থাপ্পড় মারল বিহানের গালে। এরপর রাগে ফেটে পরে বললেন,

” কুলাঙ্গার! তোর জন্যে আজ আমার মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশে গেল। নিজের-ই খালাতো বোনের সাথে_ ছিঃ।”
বলে ঘৃণিত দৃষ্টিতে একবার বিহানের শরীরের দিকে তাকালো। বিহান নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর শরীরে টিশার্ট নেই। সেটা দেখে বেশ অবাক হল ও। ওর যতদূর মনে পরছে রাতে ও টিশার্ট পরেই ঘুমিয়েছিল। আরও অবাক হল ওর শরীরে নখের আচর দেখে। সবাই নানারকম কথা শুনাচ্ছে। ও আবার মায়ার দিকে তাকিয়ে মায়ার পোশাকের অবস্থা দেখে বুঝতে পারল সবাই কী ভাবছে। তখনই মায়া ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

” মা, বিশ্বাস কর আমি এই রুমে আসতে চাইনি। ভাইয়া ডেকেছিল আমাকে। আমি ভেবেছিলাম কোন জরুরি কথা বলতে ডাকছে। কিন্তু আমি ভেতরে এসে ঢুকতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দরজা বন্ধ করে দিল।”
বলে জোরে কেঁদে উঠল। বিহান হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেদিনের সেই ব্যবহারের বদলা মায়া এভাবে নেবে? মায়া আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি চিৎকার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরে আর ঐ রুমালটা দিয়ে মুখ বেঁধে দিয়েছিল।”
সবাই তাকিয়ে দেখল সত্যিই বিহানের রুমালটা নিচে পরে আছে। মায়া বলল,

” ভাইয়া আমাকে হুমকিও দিয়েছে যাতে কাউকে এসব না বলি।”
বলে ওর মায়ের কাধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বিহান বাকি সবার দৃষ্টি দেখেই বুঝে গেল সবাই মায়ার কথা বিশ্বাস করেছে। না করারও কারণ নেই। ব্যাপারটাই এভাবেই সাজানো। পুরো ব্যাপারটায় ও এতোটাই হতভম্ব যে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেনা। মায়ার ভাই এসে বিহানের মুখে একটা ঘুষি মারল। নাক দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে গেল বিহানের। কিন্তু সে ওর বড় তাই তাকে কিছু না বলে নিজের মামার দিকে তাকাল। শফিক রায়হানের দিকে তাকাতেই ও থমকে গেল। যে মামা ওকে বুকে জড়িয়ে রাখত ওকে মার খেতে দেখেও সে কিছুই বলছে না। সেও ওকে ঘৃণার চোখে দেখছে। তার চোখ ছলছল করছে কিন্তু তাতেও তীব্র ঘৃণাও আছে। বিহান শফিক রায়হানের হাত ধরে কম্পিত কন্ঠে বলল,

” মামু বিশ্বাস কর, ও মিথ্যে বলছে আমি এরকম কি__”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শফিক রায়হান হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন। বিহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওনার দিকে। ও ওর মা মিসেস আসমার কাছে গিয়ে বলল,
” মা তুমিতো আমার কথাটা বিশ্বাস কর। আমি জানিনা ও কী বলছে। আমি কিছু করিনি মা। সত্যিই আমি জানিনা কী হয়েছে।”

আসমা চোখ ভর্তি জল নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। বিহানের চোখ এখন চারপাশে সৌহার্দ্যকে খুঁজছে। ও জানে একমাত্র সৌহার্দ্য-ই আছে যে ওর কথা শুনবে।সবাই নানারকম অপমানজনক কথা বলছে ওকে। মায়ার ভাইয়েরা ওকে আরও কয়েকটা ঘুষি মারল। বিহান সবাইকে অনেকবার সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এসবের কিছুই জানেনা। কিন্তু আশেপাশে পরে থাকা সব প্রমাণ, মায়ার কান্না সব মিলিয়ে ওরকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই বিহানকেই দোষী ভাববে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে ছিঃ ছিঃ করছিল, এমন কোন খারাপ কথা নেই যেটা বিহানকে বলেনি, মায়ার ভাইয়েরা জঘন্যভাবে মেরেছে ওকে কিন্তু কেউ বাধা দেয়নি।

এরকম অপমানিতবোধ ও এর আগে কোনদিন করেনি। লজ্জায় অপমানে বিহানের চোখ-মুখ লালচে হয়ে উঠেছে। মায়ার মা শুধু কাঁদছিলেন। মেয়ের সাথে এতোবড় দূর্ঘটনা তারওপর বিহানও ওপার বোনের ছেলে। রাগে ফেটে পরে মায়ার বাবা পুলিশ কেস করার কথা বলেছিল। হঠাৎই মায়া প্রচন্ড কেঁদে কেঁদে বলল, ও সুইসাইড করবে, এই অপমান নিয়ে ও বাঁচতে পারবেনা। ওর কান্না যে কারো হৃদয়ে লাগবে। সেখান তো ওর পরিবারের লোক ছিল। বিহান শুধু হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মায়ার দিকে। আর দেখছিল একটা মেয়ের অভিনয়ের দক্ষতা।

অনেক অস্বস্তিকর হৈ চৈ পূর্ণ ভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। অনেকের অনেক অপিনিয়নের পর। সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয় সেটাই হল। যেহেতু ব্যাপারটা পরিবারের মধ্যেই আছে বাইরে পৌঁছায় নি। তাই মায়ার কথা ভেবে আর মায়ার মায়ের অনুরোধে পুলিশ কেস করা হয়নি। তবে বিহানকে চরমভাবে হেনস্তা করা হয়েছিল সেটা সত্যি। মায়ার বাবা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বিহানের বাবাকে বলেছিল, আপনার ছেলেকে নিয়ে বিদায় হন এ বাড়ি থেকে। শফিক রায়হান বিহানের কলার ধরে টানতে টানতে ও বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসছিল। আর বিহান? প্রথমেই ঘুম থেকে উঠে এমন আকস্মিক ঘটনা। ও এখনো বুঝতে পারছেনা ব্যাপারটা কী হয়েছিল আসলে। ওর শরীরে নখের আচর, টিশার্ট খুলে ফেলা। কীভাবে সম্ভব? ও টের পেলোনা কীকরে? আদোও কী কিছু করেছিল যা ওর মনে নেই। তারওপর ওর বাবা, মা, মামুর ওর কোন কথা না শুনেই ওর কথা না শোনা সব মিলিয়ে একপ্রকার অনুভূতিহীন হয়ে গেছিল ও। নিজের হয়ে কিছু বলার মত অবস্থাতেই ছিলোনা ও।

বাড়ি ফিরেই শফিক রায়হান ওকে ড্রয়িংরুমে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর সোজা ওপরে চলে যান। বিহান এবার কেঁদে ফেলল। ও উঠে ওর মার কাছে গিয়ে বলল,
” মা আমি মায়ার সাথে কিচ্ছু করিনি। তুমিতো জানো আমাকে..”
অাসমাও এবার ওর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।ফুপিয়ে কেঁদে দিয়ে বললেন,
” লজ্জা করছেনা তোর এসব কথা বলতে? ওকে তোর রুমে যে অবস্থায় আমরা দেখেছি। আর তুই নিজে যেভাবে ছিলি তারপরও এসব কথা বলিস কীকরে?”
বিহান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিজের মায়ের দিকে। তখন শফিক রায়হান নিজের হাতে একটা বড় মোটা লাঠি নিয়ে এলেন। বিহান হতবাক হয়ে যায়। উনি বিহানের দিকে এগিয়ে আসতেই বিহান কান্নামাখা কন্ঠে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৯

” মামু আমার কথাটা শোন প্লিজ। আমি__”
কি শফিক রায়হান ওর কোন কথা না শুনে একের পর এক বেল্টের আঘাত করতে শুরু করশ ওর গায়ে। আমিনুর আর আসমা নির্বাক হয়ে দেখছিল শুধু। কারণ একজন ধর্ষকের জন্যে শুধুমাত্র লাঠির এই আঘাতগুলো যথেষ্ট শাস্তি নয়। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তবুও থামতে চাইছেন না উনি আজ। প্রথমে আর্তনাদ করলেও পরে আস্তে আস্তে চুপ হয়ে বিহান। এরপর ধীরে ধীরে স্হিরও হয়ে গেল। তখনই স‍ৌহার্দ্য দৌড়ে ভেতরে এল। ওর কাজ পরে গেছিল তাই আজ সকালেই বরের বাড়ি থেকেই চলে গেছিল। কিন্তু পরে ওর এক কাজিন গোটা ঘটনা ওকে বললে ও আর একমুহূর্ত দেরী না করে বাড়ি চলে আসে। এসে বিহানকে এভাবে মারতে দেখে। ও দ্রুত এসে বিহানকে দুহাতে আগলে নেয় যার ফলে ওর গায়েও দুটো আঘাত লাগে। শফিক রায়হান রাগী কন্ঠে বললেন,

” তুই সর আজ ওকে মেরে ফেলবো আমি।”
সৌহার্দ্য ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
” মারতে বাকি কী রেখেছ? আর একটা আঘাত করবেনা ওর গায়ে।”
” তুমি জানো তোমার গুনধর ভাই কী করেছে?”
” না জানিনা। তবে এটুকু জানি, তোমরা যেকারণে ওকে মারছো সেটা ও করেনি। আর করতে পারেনা।”
কথাটা বলে সৌহার্দ্যকে ধরে উঠিয়ে রুমে নিয়ে যেতে গেলেই। শফিক রায়হান চেচিয়ে বলে উঠলেন,
” খবরদার ওকে আমার বাড়ির ভেতরে ঢোকাবে না। একজন ধর্ষককে আমি আমার বাড়িতে জায়গা দেবোনা। আমার চোখের সামনে থেকে সরাও ওকে।”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫১