জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫২ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

বিহান আর রিখিয়া আজ যেন নিজের মধ্যেই নেই। এই দু-বছরের জমানো দুঃখ, অভিমান, অভিমান, ভালোবাসা সব একসাথে বেড়িয়ে আসছে। বেশ অনেকটা সময় একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দুজনেরই হুশ ফিরলো। রিখিয়ার মনে পরল ও কারো হবু বউ। আর বিহানেরও মনে পরল যে রিখিয়ার আর তিনদিন পর বিয়ে। তৎক্ষণাৎ একে ওপরকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। কী অদ্ভুত সময়চক্র! অাড়াই বছর যাবত যারা একে ওপরের আড়ালে একে ওপরকে সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছে। তারা আজ নিজেদের অনুভূতি একে ওপরের কাছে স্বীকার করলেও তারা আজ একে ওপরের কাছে থাকতে সংকোচ বোধ করছে। বিহান অনেকটা ইতস্তত করে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আ’ম সরি।”
রিখিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। এরপর ছুটে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। বিহান ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পুরো ব্যাপারটাতে হতভম্ব হয়ে গেছে ও। ও আর রিখিয়া এতোটা কাছাকাছি ছিল ভাবলেও অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। ওপরদিকে রিখিয়া অন্য রুমে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা ওর জন্যে ঠিক কী ছিল সেটা শুধুমাত্র ওই জানে। কতগুলো দিনের অপেক্ষার ফল ছিল কিছুক্ষণ আগের সেই মুহূর্ত। কিন্তু এই আনন্দ, এই অনুভূতি, এই ভালোবাসার আদোও কোন ভবিষ্যৎ আছে কী? আজ পরিস্থিতি এমন জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে যে ওদের ভাবতে হচ্ছে এরপর ওরা কী করবে? কী করা উচিত হবে এখন? ওরা কী সত্যিই একে ওপরের হতে পারবে কোনদিন?

রাতে সৌহার্দ্য আর বিহান এক রুমে আর পাশের রুমে তুর্বী আর রিখিয়ার থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তুর্বী খেয়াল করল যে রিখিয়া মন খারাপ করে বসে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। ও মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছে যে বিহান আর রিখিয়ার মধ্যকার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। এখন এরা দুজন অন্য চিন্তায় চিন্তিত। তুর্বী রিখিয়ার পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
” কী হয়েছে?”
রিখিয়া অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকাল তুর্বীর দিকে। আজ রিখিয়ার সত্যিই নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ও তুর্বীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তুর্বী অবাক হয়নি। ও খুব ভালো করেই চেনে রিখিয়াকে আর তার আবেগ কে। তাই আলতো করে রিখিয়ার কাঁধে হাত রাখল। রিখিয়া ভাঙা গলায় বলল,
” তুই জানিস উনি আজ নিজের মুখে বলেছে উনি আমাকে ভালোবাসেন। ওনার মুখে এই কথাটা শোনার জন্যে আমি কত ছটফট করতাম। কিন্তু আজ? আজ আমি কী করব?”
রিখিয়া তুর্বীকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কী করবি মানে? শাফিনকে গিয়ে বলে দিবি যে তুই বিয়েটা করতে পারবি না। ইউ লাভ সামবাডি এলস। সিম্পল!”
” নো, নট সো সিম্পল।আর তিনদিন পর আমার বিয়ে। কার্ড বিলি করা হয়ে গেছে। শাফিন ভাইদের বাড়িতে কাল পরশু থেকে গেস্ট আসতে শুরু করবে। বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?”
” বুঝেছি! কিন্তু রিস্ক নিতে হবে রিখু। না হলে কিছুই হবেনা। বিহান এমনিতে অনেক কষ্ট পেয়েছে নতুন করে আর কোন কষ্ট দিস না।”
রিখিয়া দু হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আমাকে ভাবতে হবে। হুটহাট কিছু করতে পারব না আমি।”
তুর্বী একটা হতাশ শ্বাস ফেলে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পরল। আর রিখিয়াও তুর্বীর পাশ দিয়ে শুয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল।

সৌহার্দ্য আর বিহান পাশাপাশি টানটান হয়ে শুয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি সিলিং এর দিকে। দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,
” কী ভাবলি?”
বিহান সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আমার তো এখানে আর ভাবাভাবির কিছু নেই। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোরা ওকে আমার ফিলিং জানিয়েছিস। কাল আবেগের বসে আমিও ওকে বলে দিয়েছি যে ভালোবাসি। ব্যাস! হয়ে গেছে। ও আমার সম্পর্কে আমার অনুভূতি সম্পর্কে ক্লিয়ার। এখন আমার দিক থেকে আমি ক্লিয়ার আছি।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তারমানে তুই এখন কিছুই করবি না?”
বিহান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” এখানে এখন আমার আর কিছুই বলার বা করার নেই। আমি রিখিয়ার ওপর আর কোনরকমের মানসিক প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারব না। এমনিতেই সবাইকে ভালো রাখার যাতাকলে অনেক পিসেছে মেয়েটা। আমি ওকে নতুন কোন দ্বিধায় ফেলব না। ইমোশানালি কোন প্রেশার দেবো না। এবার ও সেটাই করবে যেটা ওর মন ওকে করতে বলবে। আমি বা অন্যকেউ না।”
সৌহার্দ্য আর বলার মত কিছুই খুঁজে পেলোনা। ওদের দ্বারা যতদূর করা সম্ভব ওরা করেছে। এবার বাকি কাজ হয় রিখিয়া বিহানকেই। নয়তো কিছুই করার থাকবে না।

শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে শাফিন এর জন্যে অপেক্ষা করছে সৌহার্দ্য, বিহান, তুর্বী, রিখিয়া আর দোলা। শাফিন আসছে রিখিয়া আর তুর্বীকে নিয়ে যেতে আর কিছু কেনা কাটা করার আছে বিয়ের জন্যে। বিহান আর রিখিয়া দুজনেই একদম চুপ হয়ে গেছে। কাল থেকেই কিছু একটা ভেবেই চলেছে ওরা। আর এদিকে তুর্বীর মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে কারণ সকাল সকাল দোলা এসে হাজির হয়েছে ওখানে। এখানো বিয়ের ডেট অবধি ঠিক হয়নি। সব জায়গায় এই মেয়ের হাজির হওয়ার কী আছে? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। একটু পর পর শুধু আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে সৌহার্দ্যকে কিন্তু কিছুই বলতে পারছেনা। সৌহার্দ্যর সেদিকে খেয়াল নেই। এরমধ্যেই শাফিন চলে এল। তুর্বীর চোখ শাফিনের দিকে পরতেই ও বলে উঠল,
” ঐতো শাফিন ভাই চলে এসছে।”

তুর্বীর কথায় সবাই শাফিনের দিকে তাকাল। শাফিন এসে সৌহার্দ্য, বিহান আর দোলার সাথে হাত মিলিয়ে পরিচিত হল। বিহান শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। এই তবে সেই শাফিন? যে তার প্রেয়সীকে নিজের করে নেবে? রিখিয়ার ওর শুধু তাঁর অধিকার থাকবে। ওর চেয়ে কোন অংশে কম বলা যায় না ছেলেটাকে। ব্যবহারও কী চমৎকার। আচ্ছা রিখিয়াকে কী ওর চেয়েও বেশি ভালোবাসে শাফিন? হয়তো বাসে। না হলে এতোগুলো বছর অপেক্ষা করবে কেন? কিন্তু শুধুমাত্র অপেক্ষার সময় দিয়েই কী ভালোবাসা মাপা যায়? হয়তো যায়! শাফিন রিখিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,
” তো ম্যাডাম! এবার চলুন!”

রিখিয়া মলিন হেসে হাটা শুরু করল। সবাই মিলে একসাথেই মলে ঢুকলো। তুর্বীর কোনদিকেই মনোযোগ নেই। ওর ফোকাস শুধু সৌহার্দ্য আল দোলার দিকে। ওরা দুজন হাসাহাসি করছে, কেনাকাটা করছে যেটা সাধারণ চোখে দেখলে খুবই নরমাল। কিন্তু তুর্বীর এখন আর এসব মোটেও সহ্য হচ্ছেনা। ও নিজেই এখন বুঝতে পারছে যে ও জেলাস। ওর মনে হচ্ছে সৌহার্দ্যর ওপর শুধু ওরই অধিকার। ওর মানে ওর। সেখানে এই মেয়ে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? আর বিহানেল দৃষ্টি রিখিয়া আর শাফিনের দিকে। শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে রেখেছে। এটা-ওটা বলছে। শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে নিয়ে একটা শাড়ির কাছে গেল। শাড়িটা রিখিয়ার গায়ের ওপর দিকে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫১

” ওয়াও! দারুণ মানিয়েছে। আমাদের বিয়ের পরেরদিক সকালে তুমি এটাই পরবে।”
রিখিয়া একবার তাকাল বিহানের দিকে। বিহান ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ওর চোখে প্রিয়জনকে অন্যকারো সাথে দেখার কষ্টটা স্পষ্ট।
এদিকে হঠাৎ কোন এক কথার মধ্যে দোলা হাসল হাসতে হাসতে সৌহার্দ্য হাত আকড়ে ধরল। তুর্বীর মেজাজ এমনিতেই চটে ছিল আরও চটে গেল। ও সোজা ওদের কাছে গিয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। কটমটে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। তুর্বী সৌহার্দ্য হাত ধরে টেনে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। এরপর ঝাড়া দিয়ে হাথ ছেড়ে বলল,

” এমনিতেতো এতো আদর্শের কথা বলতে। এখন সেসব কোথায় গেল? বউ হয় ও তোমার? এখনো তো বিয়েও হয়নি এতো ঢলাঢলি কীসের একে ওপরের সাথে। মনে হচ্ছে যেন ওনাদেরই একা বিয়ে হবে দুনিয়াতে আর কারো বিয়ে হবেনা। আর এই? তুমি না আমাকে আমাকে ভালোবাসতে? সব ভালোবাসা এতো দ্রুত শেষ? এবার দেখলে আমি ঠিকই বলেছিলাম? কোনকিছুই চিরকাল থাকেনা। যেমন তোমার ভালোবাসা থাকেনি।”
সৌহার্দ্য এতক্ষণ ভ্রু কুচকে শুনছিল তুর্বীকে। এবার ও একটু হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে একটু চেচিয়েই বলল,
” কিন্তু তুমিতো ভালো বাসোনি রাইট? তাহলে আমি কার সাথে মিশছি, কার সাথে ঢলাঢলি করছি, কাকে বিয়ে করছি, তাতে তোমার কী? হু আর ইউ? কীসের জোরে বলছো এসব? ভালোবাসো আমাকে? বলো? ভালোবাসো?”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৩