জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৩ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সৌহার্দ্যর প্রশ্ন শুনে তুর্বী মুহূর্তেই থমকে গেলো। এই প্রশ্নটা ওর মন আর মস্তিষ্কে ভীষণভাবে ধাক্কা দিল। আমাকে জীবনে এমন অনেক প্রশ্ন থাকে যার উত্তর আমাদের মন জানে কিন্তু মস্তিষ্ক মানতে চান না। সত্যিই কী তুর্বী ভালোবাসে স‍ৌহার্দ্যকে? তুর্বীর মস্তিষ্ক বলছে এই প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে এখনো ধোঁয়াশা। কিন্তু মন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে যে ‘না’, এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা, স্পষ্টভাবে জানা। আজ যেনো মস্তিষ্কের চেয়েও মন বেশী দাপটের সাথে তার কথা জানাচ্ছে তুর্বীকে। এসব ভাবতে ভাবতেই সৌহার্দ্য বলে উঠল,

” কী হল বল? চুপ থাকলে তো হবে না তুর। ও সরি তুর্বী। তুমি আমার ওপর অধিকার খাটাবে। আমি কার সাথে মিশবো সেটা নিয়ে তদারকি করবে। আমার পার্সোনাল লাইফেও নাক গলাবে। অথচ একটা সময় ছিলো যখন আমাদের সো কল্ড রিলেশনশীপ চলছিল। তখনতো আমার গায়ে কেউ চিপকে থাকলেও তোমার যায় আসতো না তাইনা? আমাকে নিয়ে তোমার কোন ইন্টারেস্টও ছিলোনা। কজ ইউ ডিডেন্ট লাভ মি। আর এখন তো আমাদের কোন সম্পর্কও নেই। তাহলে এখন তোমার এতো প্রবলেম কীসের? বাই দা ওয়ে, এটা আবার জেলাসির এক্সপিরিমেন্ট না তো?”
তুর্বী অবাক কন্ঠে বলল,
” সৌহার্দ্য?”
সৌহার্দ্য হালকা হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” হোয়াট? প্রেমের এক্সপিরিমেন্ট করতে পারলে জেলাসির এক্সপিরিয়েন্স করাটা কী খুব বেশি অস্বাভাবিক, মিস? আমার তো মনে হয় তুমি পৃথিবীর সব কিছু নিয়েই এক্সপিরিমেন্ট করতে প্রস্তুত আছো।”
তুর্বী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। ওর সবকথাই জেনো এই মুহূর্তে কন্ঠনালিতে আটকে গেছে। সৌহার্দ্যও যে এভাবে মনে আঘাত দিয়ে দিয়ে কথা বলতে জানে সেটা তুর্বীর জানা ছিলোনা। কান্নাগুলো ভেতরে জমে একপ্রকার দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে আজ। আচ্ছা সৌহার্দ্যর নরমাল এই কথাগুলোতে ওর কষ্ট এতো কেনো হচ্ছে? তবে সত্যিই কী ভালোবাসে এই লোকটাকে। তা না হলে এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেন হবে? কেন সৌহার্দ্যর সামান্য কটু কথা ওকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে? কেন সৌহার্দ্য ওর জন্যে এতোটা মূল্যবান হবে। এটা কী ভালোবাসা না? তুর্বী প্রচন্ড কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

” সৌহার্দ্য আমার মনে হয় আমি তোমাকে..”
কিন্তু পেছন থেকে ডাক পরায় ওরা দুজনেই তাকাল। দোলা ওরা ডাকছে ওদের। সৌহার্দ্য একপলক তুর্বীর দিকে তাকিয়ে চলে গেল। তুর্বী ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারল না। চোখ ভিজে উঠল ওর। কী হচ্ছে ইদানীং এসব? এগুলো কেমন অনুভূতি? এরকম তো আগে কখনও হতোনা? গত দু-বছর সৌহার্দ্যকে রোজ মনে পরলেও এরকম কষ্ট হতোনা যতটা গত এক সপ্তাহ ধরে ওর হচ্ছে। ও কী চায় নিজেই বুঝতে পারছে না আবার যা হচ্ছে তা মানতেও পারছেনা। কী করবে এখন ও? আর ওর চোখ দিয়ে এতো জল কেন পরছে? এতো ছিঁচকাঁদুনে কবে থেকে হলো ও? অদ্ভুত!

বিকেলের দিকে তুর্বী, রিখিয়া আর শাফিন গ্রামে ফিরল। সৌহার্দ্য আর বিহানকে ইনভাইট করেছে শাফিন। এবং ওদের কালকেই চলে আসার জন্যে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা বলেছেও আসবে। আসার সময় বিহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রিখিয়ার দিকে। রিখিয়া শুধু ভেবে চলেছে ও কী করবে? কোন দিকে যাবে ও এখন? এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত? ওদেরকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শাফিন চলে গেল। রিখিয়া আর তুর্বী দুজনেই অন্যমনষ্ক হয়ে বাড়িতে ঢুকলো। দুজনের মনের মধ্যেই যে দুরকমের চিন্তা কাজ করছে। ওদের দুজনেরই ধ্যান ভাঙলো রিখিয়া আর শাফিনের মায়ের ডাকে। শাফিনের মা বলল,

” ওহ যাক তোরা চলে এসছিস? এই দেখতো রিখিয়ার জন্যে এই হারটা এনেছি। বিয়ের দিন পড়ার জন্যে।”
বলে রিখিয়াকে ধরে বসিয়ে গলায় হারটা পরিয়ে দেখতে লাগল। রিখিয়া তাকাল ওনার দিকে। চোখেমুখে কত খুশী! কত আনন্দ! দু-দিন পর তার ছেলের বিয়ে! এই আনন্দ ওর নষ্ট করে দেবে? তুর্বী অনুভূতিহীন ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। ওর মন-মস্তিস্ক কিছুই কাজ করতে চাইছেনা এখন। কিছুক্ষণ থেকে সন্ধ্যার দিকে শাফিনের মা চলে গেলেন। সন্ধ্যার পর থেকে রিখিয়ার পুরোটা সময় নিজের পরিবারের মানুষগুলোর খুশি দেখছিল। জাহানারা বারবার রিখিয়াকে কখন কী পরাবে? কী কী হবে সেসব নিয়ে কথাবার্তা বলছিল, সে-কি উৎসাহ তার। রেজাউল একে ওকে ফোন দিচ্ছেন।

বেশ ভালো আছেন এখন উনি। ওর ভাই ভাবীও খুব আন্তরিক হয়ে সবকিছু করছে। ওনাদের মধ্যেও সেই উচ্ছাস দেখা দিচ্ছে। এসব রিখিয়ার ভেতরটা গুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ যেটুকু ভেবেছিল সেটুকুও মুছে ফেলল মন থেকে। কী ভাবছিল ও? শুধু নিজের কথাই? দু দুটো পরিবারের আশা-ভরসা, আনন্দ, সম্মান সবকিছুই এই বিয়েকে ঘিরে। কত খুশি এই দুই পরিবারের মানুষগুলো। ও পারবেনা এতোটা স্বার্থপর হতে। কখনও না। রিখিয়াকে এভাবে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখে রেজাউল ইসলাম এসে মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললেন,

” তুমি খুশিতো মা?”
রিখিয়া চোখ তুলে তাকাল নিজের বাবার দিকে তারপর মলিন হেসে বলল,
” আমি খুব খুশি বাবা।”
রেজাউল ইসলাম হেসে রিখিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। রিখিয়া বাবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। সত্যিই মানুষ খুব অদ্ভুত, বুকে কষ্টের বিশাল এক পাহাড় রেখে কত সহজেই কৃত্রিম হাসি হেসে বলতে পারে, আমি ভালো আছি, খুশি আছি। মানুষ সত্যিই রহস্যময়। এরা ছলনাপ্রিয়। নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যেই পুষে রাখতে বেশি পছন্দ করে। হোমো স্যাপিয়েন্স নামক এই প্রাণীটির হাসির আড়ালে থাকা কান্না, আর কান্নার আড়ালে থাকা হাসিকে শনাক্ত করা হয়তো পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটি।
রিখিয়া বিছানা গুছিয়ে বসতেই তুর্বী এসে রাগ নিয়ে বসল বিছানাতে। তারপর রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুই এই বিয়েটা করবি-ই?”
রিখিয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” করতে হবে তুর। এখন এই অবস্থায় আর পেছন ফিরে তাকানো সম্ভব নয়। আমি বিয়ে করছি। আর এতেই সবার ভালো হবে।”
তুর্বী ভ্রু কুচকে বলল,
” আর তোর?”
রিখিয়া তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে বলল,
” আমার কথা ছাড়ো!”
তুর্বী এবার রেগে বালিশটা সাইডে ছুড়ে রেখে বলল,
” ছাড়বো কেন? মরে যাবি তুই কালকে? রিখু ছাড়ো বললেই ছাড়া যায়না। বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে কী হবে? দু-দিন হাঙ্গামা হবে। পাড়া-প্রতিবেশি কিছুদিন এটা-ওটা বলবে। কিন্তু আলটিমেটলি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই বিয়েটা করলে তোদের তিনজনেরই জীবন শেষ হয়ে।”
রিখিয়া মাথা চেপে ধরে বলল,
” তুর প্লিজ! আমি অনেক কষ্টে, নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে মনকে একদিকে স্হির করেছি। আমাকে আর দ্বিধায় ফেলোনা। প্লিজ! আমি আর পারছিনা। সত্যিই আর পারছিনা।”
বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল রিখিয়া। তুর্বী রিখিয়ার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে চলে গেলো। সত্যিই রিখিয়ার ওপর মানসিক চাপটা বড্ড বেশি পরে যাচ্ছে। একটা মেয়ে আর কত সহ্য করবে।

বিহান খাটে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। সৌহার্দ্য ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে বিহানের দিকে একপলক তাকালো। টাওয়েলটা রেখে দিয়ে বিহানের পাশ দিয়ে বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। তারপর বলল,
” তো কী ঠিক করলি? সত্যিই তুই কিচ্ছু করবিনা?”
বিহান কপাল থেকে হাত সরিয়ে সৌহার্দ্য দিকে তাকাতে বলল,
” আমি আগেই বলেছি আমার হাতে আর কিছুই নেই। সবটা রিখিয়ার হাতে। ও যা চাইবে সেটাই হবে।”
” তোর কী মনে হয় ওর আর কোন নিজস্ব চাওয়া আছে? ও যা করবে ওর আর শাফিনের পরিবারের কথা ভেবেই করবে।”
” তাহলে আমিও ওদের ক‍থাই ভাবব।”
সৌহার্দ্য রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছুই বলল না। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর বিহান বলল,
” কাল যাবি না ওখানে?”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
” তুই সত্যিই যেতে চাস?”
বিহান ঠোঁটে ক্লান্ত এক হাসি ফুটিয়ে বলল,

” হুম চাইতো! ওকে হলুদ শাড়িতে কাঁচা ফুলের সাজে কেমন লাগে, মেহেদী রাঙা হাতদুটো কেমন লাগে, আলতা রাঙা পা দুটো কেমন লাগে, লাল শাড়িতে বউয়ের সাজে কেমন লাগে সেটা দেখার বড্ড লোভ হচ্ছে। এরপর তো ওর দিকে ওভাবে তাকানোর অধিকার আমার থাকবেনা। শেষবারের মত মনভরে ওকে দেখার জন্যে হলেও যাবো।”
” যদি ওকে দেখে ওকে পাওয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে?”
” ভালোবাসলে পাওয়ার ইচ্ছে করতে নেই। শুধু ভালোবাসার মানুষটার ভালো রাখার চেষ্টা করতে হয়। হোক কাছে টেনে কিংবা দূরে সরিয়ে দিয়ে।”
” এতোটা ভালোবাসতে কবে থেকে শিখলি?”
” দিন-ক্ষণ গুনে রাখিনি।”
সৌহার্দ্য বিহানের মাথায় হাত রেখে বলল,
” অনেক বকবকর করেছিস এবার ঘুমো। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।”
বলে সৌহার্দ্য বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বিহানও চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমানোটা সত্যিই খুব প্রয়োজন এখন।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫২

তুর্বী নদীর পারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। চাঁদের আলোতে হালকা আলোকিত চারপাশ। নদীর জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা শুধু কলকল আওয়াজ আসছে। মনটা ভীষণ খারাপ। একেতো রিখিয়ার এরকম অবস্থা তারওপর সৌহার্দ্যর প্রতি ওর অনুভূতি। সৌহার্দ্যর সাথে কাটানো সব মুহূর্তেগুলো খুব বেশি মনে পরছে। SR এর সাথে ঝগড়া, ওদের প্রথম দেখা, SR এর ওকে কিডন্যাপ করা, সৌহার্দ্যর ওর বস হয়ে আসা, এরপর ওদের রিলেশন, সৌহার্দ্যর ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পরা, ওর সৌহার্দ্যকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় সৌহার্দ্যর সেই অসহায় চাহনী, ছলছলে চোখ। সব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুর্বী। সত্যিই ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল ছেলেটাকে। তাই হয়তো আজ সেই কষ্টটা ও ফেরত পাচ্ছে।

রিখিয়া বলেছিল তুমি যাকে ভালোবাসবে তার কথাই সারাক্ষণ মাথায় ঘুরবে, না চাইতেও তোমার ভাবনায় সারাক্ষণ তার যাওয়া আসা চলবে, তার জন্যে তুমি ফিল করবে, তার কষ্টে তুমি কষ্ট পাবে, তার দেওয়া সামান্য আঘাতও তোমাকে শেষ করে দেবে, তাকে তুমি অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবেনা। এখন তুর্বী বুঝে গেছে ও ভালোবেসে ফেলেছে সৌহার্দ্যকে। এই দু-বছরে বারবার সৌহার্দ্যকে মনে পরাটা শুধু মায়ার জন্যে ছিলোনা। ভালোবাসা ছিল। হ্যাঁ তুর্বীও আজ ভালোবেসেছে। কাউকে ভীষণভাবে ভালোবেসেছে। ভালোবেসে ফেলেছে সৌহার্দ্য নামক পুরুষটিকে।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৪