জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৪ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৪
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

ভালোবাসা! যার নির্দিষ্ট কোনরকম কোন সজ্ঞা নেই, না আছে কোন ব্যাখ্যা। ভালোবাসা একেকজনের কাছে একেকরকম হয়। কিন্তু ভালোবাসলে কখনও না কখনও মন ঠিক বলে ওঠে ‘ভালোবাসি’। কারো মন খুব তাড়াতাড়ি বলে, কারো খুবই দেরীতে। ঠিক যেরকম তুর্বীর মন আজ চিৎকার করে বলছে, ‘ভালোবাসি। ভালোবাসি স‍ৌহার্দ্যকে।’ হঠাৎই একটু জোরে বাতাস বইতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সেই বাতাসকে অনুভব করল তুর্বী। ভালোতো অনেক আগেই বেসে ফেলেছিল। কিন্তু আজ সেই ভালোবাসাকে মন খুলে অনুভবও করতে পারছে। জীবনটাকে কোনদিনও ও সিরিয়াসলি নেয়নি। প্রচন্ড এক্সপেরিমেন্টাল একটা মেয়ে ছিল।

এসব প্রেম-ভালোবাসা ওর দু-দিনের খেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে নিজেকে সিরিয়াস করে নেওয়ার পরেই হয়তো ভালোবাসা নামক অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হলো ওর মন। কিন্তু এখন কী করা উচিত ওর? সৌহার্দ্যকে বলবে নিজের মনের কথা? খুব বেশি দেরী হয়ে যায়নি তো? সৌহার্দ্য কী মেনে নেবে ওকে আবার? সৌহার্দ্যর যে বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে তারবেলা? সৌহার্দ্যকে হঠাৎই ভীষণ মিস করছে তুর্বী। কালতো আসবে ওরা। কিন্তু তবুও একটাবার সৌহার্দ্যর গলা শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। বেশিকিছু না ভেবে সৌহার্দ্যকে ফোন করল।

বিহানকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দ্য। তুর্বীর কথাই ভাবছিল। আজ তুর্বীর ওর ওপর ওরকম অধিকার খাটানোটা নাড়িয়ে দিয়েছে সৌহার্দ্যকে। সদ্য সামলে নেওয়া মনটাকে আবার এলোমেলো করে দিয়েছে। এমন ব্যবহার কেন করল তুর্বী? তবে কী তুর্বী ওকে ভালোবেসে ফেলেছে? আজ তুর্বীর সাথে ওর ওভাবে কথা বলতে ভালো লাগেনি। কিন্তু ওর কী হয়েছিল নিজেই জানেনা। তবে ও তুর্বীর চোখে ওর প্রতি কিছুতো একটা দেখেছে আজ। এসব ভাবতে ভাবতেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল যে তুর্বীরই ফোন। ও কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে ফোনটা রিসিভ করল। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” হ্যাঁ বল!”
ওপাশ থেকে তুর্বী চুপ করে রইল কয়েকসেকেন্ড। সৌহার্দ্যও অপেক্ষায় আছে তুর্বীর উত্তরের। কিন্তু তুর্বীকে চুপ থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
” সমস্যা কী? চুপ করে আছো কেন? কল করেছ, কিছু বলবে?”
তুর্বী এবারও চুপ। ও ভাবছে একসময় এভাবেই কথা বলত তুর্বী সৌহার্দ্যর সাথে, ওদের সম্পর্ক চালাকালীন সময়ে। অসময়ে সৌহার্দ্য ফোন করলেই বলত, ‘কল দিলে কেন? কিছু বলবে?’ তখন সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, ‘ না, রাখছি।’ আজ ও বুঝতে পারছে মানুষ শুধু দরকারে-ই ফোন দেয়না। প্রিয় মানুষটার সাথে মনের কথাগুলো বলতেও ফোন করে। সত্যিই কত অদ্ভুত হয় মানুষ। নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে ঠিকই, কিন্তু সময় চলে গেলে। যদি সময় থাকতে মানুষ নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারত তাহলে জীবনটা কত সুন্দর হতো। নিজেকে স্বাভাবিক করে তুর্বী নিচু গলায় বলল,

” না আসলে__ রিখিয়া আর বিহানের ব্যাপারেই কিছু বলার ছিল।”
সৌহার্দ্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। এরপর দু আঙুল দিয়ে নিজের নাক ঘষে বলল,
” সেটাই! আমাকে তুমি নিশ্চয়ই প্রেম নিবেদন করতে ফোন করবে না। হুম বল, কী বলবে?”
সৌহার্দ্য কথাগুলো তুর্বীর মনে সুঁচের মত ফুটছে। চোখে জল চলে এলো ওর। এতো কঠোর কেনো হচ্ছে সৌহার্দ্য? এভাবে মনে আঘাত করতে ছেলেটা কবে থেকে শিখলো? চোখ মুছে তুর্বী বলল,
” ওদের ব্যাপারে কী করবে ভেবেছ?”
সৌহার্দ্য দরজা দিয়ে একবার ঘুমন্ত বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এখন আমাদের হাতে আর কিছুই নেই। আমাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব ছিল আমরা করেছি। এখন করার হলে একটা জিনিসই করা যায়, শাফিনকে সবটা বলে দেওয়া যায়।”
” সেটাও সম্ভব নয়। রিখিয়া সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে ও বিয়ে করবে। এবার ওর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারব না। মেয়েটা আর কত মানসিক চাপ নেবে?”
” সেটাই! তাই আমাদের আর কিছুই করার নেই। ওপরওয়ালা ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে।”
তুর্বী চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎই ও বলে উঠল,
” আমাকে কী এখনও ভালোবাসো সৌহার্দ্য?”

সৌহার্দ্য চমকে উঠল। হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছে কেন? এই মেয়ে চায়টা কী? বারবার ওর ভেতরের অনুভূতিকে জাগিয়ে দিয়ে আবার আঘাত করে সেটাকে রক্তাক্ত করতে? ওকে কষ্ট দিয়ে কী শান্তি পায় তুর? পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলল,
” তাতে কী তোমার কিছু যায় আসে?”
” এভাবে কথা বলছ কেন? নরমাল একটা প্রশ্ন করেছি। তুমি দোলাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছ। ওকে ভালোবাসো বা পছন্দ হয়েছে তাই? না-কি তোমার পরিবারের পছন্দ তাই?”
সৌহার্দ্য কঠিন গলায় বলল,
” আই থিংক দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।”
” সৌহার্দ্য আমি __”
সৌহার্দ্য ফোনটা রেখে দিল। ওর এসব কথা শুনতে অসহ্য লাগছে। ওর পুরোনো ঘায়ে বারবার ইচ্ছে করেই আঘাত করছে মেয়েটা। যা বলার সরাসরি বললেই তো হয়। এভাবে পুরোনো ঘা খোঁচানোর মানে কী? ওকে মানুষ মনে হয়না না-কি?
সৌহার্দ্য এভাবে ফোন রেখে দেওয়াতে তুর্বী মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলো। ফোনটা রেখে দিয়ে হাটু ভেঙ্গে বসে পরল ওখানে। আচ্ছা সেদিন যদি সৌহার্দ্যকে ফিরিয়ে না দিতো? যদি নিজের গোপন অনুভূতিকে সেদিনই খুঁজে পেত? তাহলে কী খুব ক্ষতি হত? আজ ওকে এভাবে কাঁদতে হতো? এরকম আবেগপ্রবণ ও কোনদিনও ছিলোনা। কিন্তু সময় ওকে এরকম তৈরী করে দিল! সত্যি সময় অনেক শক্তিমান!

পরেরদিন সৌহার্দ্য আর বিহান গ্রামে এলো। সবার প্রথমে ওরা রিখিয়াদের বাড়িতে গিয়ে-ই উঠল। ওদের আসার খবর শুনে শাফিনও চলে এলো! বিকেলবেলা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে, আত্মীয়রাও সব আছে। বিয়েবাড়ি তাই স্বাভাবিকভাবেই একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়ে আছে চারপাশে। কিন্তু সৌহার্দ্য, তুর্বী, রিখিয়া, বিহান চারজনই চুপচাপ বসে আছে। চারজনেরই ভীষণরকম মন খারাপ। ওদের কারো মনেই কোন আনন্দ নেই। সবার সামনে চেষ্টা করেও মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। ওদের ভেতরটা কীভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে শুধু ওরাই জানে। অথচ নিজেদের ভেতরকার এই তীব্র ব্যাথা কারো সামনে প্রকাশ করাও ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বললেন,
” কী ব্যাপার? পরশু বাড়িতে বিয়ে! আর আজ তোমরা এমন মুখ গোমড়া করে আছো কেন?”

এরপরই সবার নজর পরে ওদের দিকে। আর স্বভাবতই নানারকম প্রশ্ন করা শুরু করে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে বাধ্য হয়েই হাসিমুখে আড্ডায় অংশগ্রহণ করতে হল। রিখিয়া আর বিহান একটু পরপরই একে ওপরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। সেই দৃষ্টিতে একেওপরকে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা ছিল, ভেতরের সমস্ত কষ্টের আর্তনাদ ছিল। যে আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। মনের গহীনেই চাঁপা পরে গেল সেই চিৎকার। সারাবিকেল আড্ডা দেওয়ার পরে ঠিক করা হল যে, রাতে বিহান আর সৌহার্দ্য শাফিনদের বাড়িতেই থাকবে। রিখিয়াদের বাড়িটা ছোট। তারওপর এতো মেহমান আছে তাই এখানে থাকতে সমস্যা হবে। শাফিন ওদের দুজনের সাথে এমনভাবে মেলামেশা করছে যেন ওরই বন্ধু। শাফিনের এরকম ব্যবহার সৌহার্দ্য আর বিহান দুজনকেই মুগ্ধ করেছে।

রিখিয়া মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শাফিন এসে মাথায় টোকা মারল। রিখিয়া ঘুরে তাকিয়ে দেখে শাফিন মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। শাফিন ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” কী হয়েছে? মন খারাপ কেন? এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে তাই? না-কি তোমার সেই ভালোবাসার মানুষটার কথা মনে পরছে।”
রিখিয়া শাফিনের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
” দুটোই।”
শাফিন রিখিয়ার দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
” আমাদের বিয়ের পরও এরকমই ভালোবাসবে তাঁকে?”
রিখিয়া এবারেও কোন ভনিতা না করে বলল,
” ওনাকে ভোলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসতে পারব কি-না। সেটা জানিনা। আপনার খারাপ লাগলেও এটা সত্যি ”
শাফিন কপালে স্লাইড করে হেসে বলল,
” আমি কিন্তু এই রাগ করিনি। সবটা জেনে বুঝেই রাজি হয়েছি আমি। তাই তুমি সারাজীবন তাকে ভালোবাসতেই পারো আমি না করব না। আমাকে ভালো না বাসলেও সমস্যা নেই। কিন্তু হ্যাঁ আমায় ভালোবাসতে কিন্তু বাঁধা দিতে পারবেনা। মনে থাকবে?”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৩

রিখিয়া কিছুই বলল না শুধু মলিন একটা হাসি দিল। শাফিনও হেসে চলে গেল। এতক্ষণ দূর থেকে ওদের দেখছিল বিহান। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল ওর। মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এখনই এতো কষ্ট হলে বাকিটা সময় কীকরে সহ্য করবে ও? রিখিয়ার চোখ ওর দিকে পরতেই। বিহান চোখ সরিয়ে নিলো। রিখিয়া এগিয়ে বিহানের কাছে গেল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মলিন, লালচে মুখটার দিকে।অনেকটাই কষ্ট পেয়েছে হয়তো ছেলেটা। চোখ ছলছল করে উঠল ওর। অসহায় কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছেন আপনি?”
বিহান চমকে তাকালো। দ্রুতই নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে, ঠোঁটে কোনরকম জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,
” হুম? হ্যাঁ! ঠিক আজি আমি।”
রিখিয়া মাথা নিচু করে কম্পিত কন্ঠে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ।”
বিহান রিখিয়ার হাত ধরে একদম নিজের সামনে আনলো। এরপর চোখদুটো নিজের হাতে যত্ন সহকারে মুছে দিয়ে বলল,
” তোমার কোন দোষ নেই রিখিয়া। কোন অন্যায় করোনি তুমি। বরং আমার করা অন্যায়ের ফল ভোগ করছ। ক্ষমার যোগ্য নই আমি। তবুও পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
রিখিয়া করুণ চোখে তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। এরপর কিছু একটা ভেবে চোখ মুছে দ্রুত চলে গেল ওখানে থেকে। বিহান রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরল একফোটা অশ্রুকণা।

রাত বারোটা বাজে। গ্রামে রাত বারোটা মানেই মধ্যরাত! সৌহার্দ্য নদীর পারের মাচাটার ওপর বসে অপেক্ষা করছে তুর্বীর জন্যে। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎই তুর্বী ওকে মেসেজ করেছে এখানে আসার জন্যে। কিছু একটা বলতে চায় ও। সৌহার্দ্য বেশ অবাক হয়েছে। এমন কী বলতে চায় তুর্বী যে এতো রাতে ডাকল ওকে? এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী এসে হাজির হল ওখানে। হাটুতে দুহাত রেখে হাফাচ্ছে ও। সৌহার্দ্য মাচা থেকে নেমে ভ্রু কুচকে বলল,
” হঠাৎ এতো রাতে কেন ডাকতে কেন? কী হয়েছে?”
তুর্বী এখনও হাফাচ্ছে স‍ৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে। এতোটাই হাফাচ্ছে যে কথাই বলতে পারছেনা। শুধু তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে রেখেই হাত ভাজ করে বলল,
” কী হয়েছে বলবে? কুকুরে তাড়া করেছিল না-কি? এভাবে হাফাচ্ছো কেন? কিছু বলার থাকলে বল। না হলে আমি গেলাম।”
তুর্বী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা ঢোক গিলে হাফানো কন্ঠেই বলল,
” বিয়ে করবে আমাকে?”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৫৫