জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৭ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সৌহার্দ্য তখন থেকে বিহানের রুমে নক করে যাচ্ছে কিন্তু বিহান খুলছে না। বিহান রেগে গেলে যে কতটা ভয়ঙ্কর কিছু করতে পারে সেটা বোঝা কঠিন। আসার পথে জ্যামে আটকে গেছিল। আর আজকের জ্যামটা আরো বেশিই সময়ের জন্যে ছিল। সৌহার্দ্যর এখন ভীষণ টেনশন হচ্ছে, রাগের বশে যদি ছেলেটা উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে? এসব চিন্তা করে আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। বেশ অনেকটা সময় পর বিহান দরজা খুলল। বিহানকে দেখে সৌহার্দ্য চমকে উঠল। বিহান চোখ কচলে একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

” কী শুরু করলি বলত? কাল সারারাত লকাপে ছিলাম তাই ঘুমোতে পারিনি। একটু ঘুমোচ্ছিলাম ভাই। তুইও পাশের রুমে ঘুমিয়ে পরতি। সবে একটু ঘুমিয়েছি।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ বিহানের চোখমুখ একদম স্বাভাবিক। ওকে দেখে মনেই হচ্ছেনা কিছু হয়েছে। সৌহার্দ্য অবাক হয়ে কিছু বলবে তার আগেই বিহান বলল,
” এভাবে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছিস কোন দুঃখে? উঠিয়ে যখন ফেলেছিস আমি খাবার ওর্ডার করে দিচ্ছি। খেয়ে তারপর আবার ঘুমাব। আয় রুমে আয়।”

বলে ভেতরে চলে গেল বিহান। আর সৌহার্দ্যও বেশ অবাক হয়েই ভেতরে ঢুকল। বিহান আয়েশ করে বিছানায় বসে খাবার ওর্ডার করে চুপচাপ বসে গেমস খেলতে শুরু করল। সৌহার্দ্য সুক্ষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। এতোবড় একটা ঘটনার পরেও বিহানের শান্ত থাকাটা ভালো লাগছেনা সৌহার্দ্যর কাছে। এটা কেমন যেন ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা মনে হচ্ছে। ও বিহানের হাত থেকে ফোনটা একটানে নিয়ে গেল। বিহান ভ্রু কুচকে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য ফোন রেখে দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কী চলছে তোর মাথায়?”
বিহান ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হেসে টি-টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
” সে তো সারাদিন আমার মাথায় কতকিছুই চলে। কেন বলত?”
” দেখ রিখিয়ার কিন্তু এসবে কোন দোষ নেই। ওর জায়গা থেকে ও একদম ঠিক ছিল। ওকে প্লিজ ‘মায়া…”
বিহান পানি খেতে খেতে এতক্ষণ সৌহার্দ্যর কথা শুনছিল। সৌহার্দ্য এটুকু বলতেই বিহান থামিয়ে দিয়ে বলল,
” এসব ছাড়। খাবার আসছে খেয়ে বাড়ি চলে যা। মামু জানলে রেগে যাবে।”

তখনই সৌহার্দ্যর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের নাম্বারটা দেখে সৌহার্দ্য ফোনটা কেটে দিতে নিলেই বিহান বলল,
” রিসিভ কর। আর ফোন লাউডে দিস। অনেকদিন নিজের প্রশংসা শোনা হয়না।”
বলে আবারও লম্বা হাই তুলল। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করলেও লাউডে দিলো না। কিন্তু বিহান নিজেই লাউডে দিয়ে দিল। ওপাশ থেকে সৌহার্দ্যর বাবা শফিক রায়হান বললেন,
” কোথায় আছো তুমি? নিশ্চয়ই ঐ লোফার টার ফ্লাটে? এক্ষুনি বেড়িয়ে এসো। মান-সম্মান যেটুকু ছিল সব শেষ করে দিয়েছে।”

সৌহার্দ্য একপলক বিহানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” শুধু কাল রাতের নিউসটাই দেখেছ নাকি সকালের টাও দেখেছ?”
শফিক রায়হান হুংকার দিয়ে বলল,
” সবই দেখেছি। সকালের নিউসটা সত্যি নাকি তুমি তোমার ক্ষমতা দিয়ে সত্যি বানিয়েছ সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।”
বিহান নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য বেশ অবাক হল নিজের বাবার কথায়। এতটা অবিশ্বাস? একটা ঘটনা, শুধু একটা ঘটনা, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে সবচেয়ে ঘৃণ্য করে তুলতে পারে? তখন ওপাশ থেকে আরেকটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো,

” বাবান আমি তোমার ফুপা বলছি ওখান থেকে চলে এসো। ওই ছেলের সাথে থাকলে তুমিও নষ্ট হয়ে যাবে।”
বিহান হেসে সৌহার্দ্যকে চোখ মারল। সৌহার্দ্য ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” তোমার ছেলে হয় ও ফুপা।”
বিহানের বাবা আমিনুর খান বললেন,
” দরকার নেই এমন ছেলের যেই ছেলের জন্যে পদে পদে অপমানিত হতে হয় এমন ছেলে না থাকাই ভালো। তাইতো অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। ”
এবার বিহানের মা আসমাও বললেন,
” বাবান আমি বলছি চলে এসো ওখান থেকে। তোমাকে কতবার বলি ওই ছেলের কাছে যেওনা। কেন শোননা? ও নিজে তো জাহান্নামে গেছেই তোমাকেও আমাদের অবাধ্য করে দিচ্ছে।”
নিজের মায়ের গলা শুনে বিহানের যেন আরও হাসি পেল। ভীষণ কষ্টে হাসি চেপে রাখছে ও। সৌহার্দ্য জানে বিহান এভাবে কখন হাসে তাই বলল,
” সরি, বাট কাল দুপুরের আগে আমি আসতে পারব না। রাখছি।”

বলে ফোনটা রেখে দিল সৌহার্দ্য। ফোনটা রাখতেই বিহান শব্দ করে হেসে দিল। এভন ভাবে জেনো ওর সামনে মিরাক্কেল এর লেটেস্ট জোকস্ বলা হয়েছে। এরমধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠল। বিহান হেসে বলল,
” খাবার এসে গেছে, চলো ব্রো, জমিয়ে খাওয়া হবে।”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। কালকের এমন ঘটনার পর এরকম রেগে যাওয়ার পরেও হঠাৎই ছেলেটার এতটা শান্ত, স্বাভাবিক হয়ে যাওয়াটা ভাবাচ্ছে সৌহার্দ্যকে। রাগ যে খুব ভয়ংকর জিনিস, এই রাগের বসে নিয়ে নেওয়া কোন সিদ্ধান্তের পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। এখন বিহানের মাথায় কী চলছে সেটাতো বিহানই জানে। এদিকে তুর্বী মেয়েটা সেই কবে থেকে ওকে নিরন্তর মেসেজ করে, ওর আর.জে পরিচয়ের পেজ টাতেই বড় বড় করে ওকে নিন্দা করে, গালিগালাজ করে পোষ্ট করতেই থাকে, কমেন্ট সেক্শনও ভরিয়ে ফেলে কমেন্ট করে করে। এসব নিয়ে ইদানিং একটু বেশি পরিমাণ বিরক্ত ও। কিন্তু সরাসরি কিছু বলতেও পারছেনা। কারণ ওরা কেউ জানেনা ওই আর.জে SR.

তুর্বী রান্নাঘরে একপ্রকার যুদ্ধ করছে। উদ্দেশ্য কফি বানাবে। কিন্তু কফি বানাতে গিয়ে রান্নাঘর লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। প্রথমেই কফি খুজতে গিয়ে সব এলোমেলো করেছে। এরপর চিনি খুজতে গিয়ে রান্নাঘরে একপ্রকার তান্ডব চালিয়েছে। দুধটা যদিও সহজেই পেয়ে গেছে। তুর্বী রান্নাটা কোনকালেই তেমন পারেনা। সৎ মায়ের কাছে বড় হলেও ওর ওপর অত্যাচার করার কোন সুযোগ দেয় নি। ওকে রান্না করতে বললে কখনই করত না কারণ ওর কলেজ, প্রাইভেট ছিল। কথা না শোনায় ওর সৎ মা মারতে এসছিল কয়েকবার কিন্তু প্রথম প্রথম সহ্য করলেও পরে আর চুপ থাকত না তুর্বী।

তাই তুর্বীর সাথে টিকতে না পেরে ওর মা এমনিই চুপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন ও কফি বানাচ্ছে রিখিয়ার জন্য কারণ রিখিয়া বাড়ি ফেরার পর থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে। আপাতত বেলকনির ফ্লোরে বসে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখছে। মনটা একটু বেশিই খারাপ ওর। কিছু খায়ও নি। তাই তুর্বী ওর জন্যে কফি আর বিস্কুট নিয়ে যাচ্ছে। অন্যকোন রান্না তুর্বী পারেনা। কোনরকমে কফি বানিয়ে দুটো মগে ঢেলে দিয়ে, একটা হাফ-প্লেটে বিস্কুট নিয়ে ট্রে তে নিয়ে রুমে চলে এল। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে রিখিয়া এখনও মন খারাপ করে বসে আছে। তুর্বী ওর পাশে গিয়ে বসে বলল এরপর কফির মগ নিয়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল,

” বাবাহ। রান্না মানুষ কেমনে করে? আমার তো এই কফি বানাতেই ঘাম বেড়িয়ে গেছে।”
রিখিয়া অবাক হয়ে তাকাল। ট্রে তে রাখা কফি দেখে বলল,
” তুমি কফি বানিয়েছ?”
” হ্যাঁ? তোর কী মনে হয়? আমি পারিনা? আমি চাইলে সব পারি। খেয়ে নে। দেখ, না ভুল করেও করবি না অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি আমি।”
রিখিয়া কিছু না বলে কফির মগ আর হাত একটা বিস্কুট নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করল। তুর্বী এবার রিখিয়ার একটু কাছ ঘেসে বসে বলল,
” মন খারাপ কেন করছিস বলত? এতে তো তোর দোষ নেই? একটা মিসআন্ডারস্টান্ডিং হয়েছিল। ব্যাস! এতে কারো কোন দোষ নেই। এমন কেন করছিস তুই?”
রিখিয়া অস্হির হয়ে বলল,

” তুমি বুঝতে পারছো না। ছেলেটাকে আমি সবার সামনে চড় মেরেছি। মিডিয়া, ক্যামেরার সামনে ক্যারেক্টারলেস, অমানুষ আরো কত কী বলেছি। এমনকি পুলিশে দিয়ে দিয়েছি। কত খারাপ খারাপ কথা লিখেছিল ওনাকে নিয়ে চ্যানেলে। সারারাত কোন দোষ ছাড়াই লকাপে কাটিয়েছে। ব্যাক্তিগত জীবনে উনি যেমনই হোক। এসেছিলেন তো আমাকে সাহায্য করতেই তাই না? আর আমি কিছু না বুঝেই কী করে ফেললাম? সরিটাও বলতে পারলাম না।”
তুর্বী মগটা পাশে রেখে রিখিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,
” দেখ। ছেলেটা হার্ট হয়েছে সেটা আমিও বুঝতে পারছি। যেটা হয়েছে সেটা পুরোটাই এক্সিডেন্ট ছিল। তাই এত চাপ না নিয়ে পরেরবার দেখা হলে ভদ্রভাবে সরি বলে দিবি। সিম্পল।”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৬

” কিন্তু..”
” ছাড়তো এসব। এই শোন, কালকে সকালে ঐ SR এর শো আছেনা। কী যেন নাম?”
” প্রভাতের আলো।”
” হ্যাঁ ওটাই। এতদিন তো সব সোসাল সাইটে জ্বালিয়েছি। সেসব নিয়ে অলরেডি গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর হচ্ছে। কালকে কল করে ইচ্ছেমত ধলাই দেব। ধপবাজি করা না?”
রিখিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুমি হঠাৎ করে ওনার পেছনে কেন পরলে বলবে একটু?”
” কেনো পরবোনা? সবার সাথে ধপবাজি করে বেড়ায়। উনি নাকি সব জানতা। হুহ, অথচ আমার একটা প্রবলেমের সলুশন দিতে পারল না। কাল যদি ওনার পর্দা ফাঁস না করেছি। তো আমার নামও তুর্বী আহমেদ নয়।”
বলে গা দুলিয়ে একটা হাসি দিল তুর্বী। রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” কী উল্টাপাল্টা করতে চাইছ আবার তুমি? দেখ তোমার ওসব উদ্ভবট প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবেনা তাই ওই বেচারাকে প্যারা দিও না।”
তুর্বী কিছু না বলে চুপচাপ কফির মগে চুমুক দিল। ওর মাথায় তো এখন অন্যকিছু ঘুরছে। রিখিয়া যত যাই বলুক। কাল বড়সর একটা কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে ও। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিল ওরটা কেন দিলনা? এটাই দোষ ঐ S.R এর। এবার এমনভাবে শায়েস্তা করবে যে মানুষের সাথে ধপবাজি করার শখ তো মিটবেই তারসাথে আর.জে গিরি করার শখও মিটে যাবে।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৮