অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৩ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৩
Ishita Rahman Sanjida

বিরাট হলরুমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মুহূর্তেই সব কোলাহল বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চস্বরে মিউজিক বাজছে না। কেউ নাচানাচি করছে না। রঙ বেরঙের লাইট গুলো বন্ধ করে সাদা লাইট জ্বালানো হয়েছে। ফলে চারিদিক দিনের মতোই ঝকঝকে করছে। বারের প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি ইশান আর মীরার দিকে। ইশান এখনও মীরাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর মীরা ইশানের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এতো জোরেই ধরেছে যে মীরা ইশানের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না।

অনেক চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দিলো। ইশান মীরাকে শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে।
ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে ইশানের গালে তিনটা থাপ্পর মেরে দিলো আর ইশান কিছু বলল না উল্টে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল!!সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইশান তো এরকম না?? এতোক্ষণে তো ইশানের রেগে যাওয়ার কথা ছিল। যে ইশানের দিকে মেয়েরা তাকালে সে রেগে যেতো তাকে একটা মেয়ে থাপ্পর মেরেছে আর ইশান কিছু বলছে না??

ইশান জড়িয়ে ধরাতে মীরাও অবাক হয়েছে। হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরার মানে কি??তাও আবার এতো গুলো মানুষের সামনে। অন্যসময় হলে মীরা লজ্জায় পরতো কিন্তু এখন সে রেগে আছে খুব। তাই আপাতত লজ্জাগুলো চোখ থেকে সরিয়ে পায়ের নিচে রেখেছে। মীরা এখনও ছোটাছুটি করছে। নিজেকে ছাড়াতে না পেরে কেঁদে দিলো। চোখ দিয়ে তার গলগল করে ঝরণার মতো পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। যাদের থেকে দূরে সরতে চায় তারা কেন ওর এতো কাছে আসছে??কেন??

মীরা নিজের মনকে সায় দিল,নাহ মীরা এদের উপর মায়া করবি না। এরা খারাপ মানুষ। তোর মনি’মায়ের থেকে সতের বছর কেড়ে নিয়েছে। এরা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। মীরা ইশানের শার্ট টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,’ছাড়ুন আমাকে?? এতগুলো মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা করছে না আপনার?? আমাকে ছোঁয়ার এতো সাহস পেয়েছেন কোথায়?? ছাড়ুন আমাকে??’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইশান মীরাকে ছাড়ার পরিবর্তে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে। মীরার এখন অস্বস্তি হচ্ছে। এসব করছে কি ইশান??সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই এখনও ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। যেন কোন সিনেমার শুটিং চলছে আর সবাই হা করে গিলছে আর মজা নিচ্ছে। এখন এদের মুখ দিয়ে হাজার মাছি গেলেও এরা টের পাবে না?? কিন্তু লন্ডনে মাছি আছে?? থাকবে না কেন??আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এই জঘন্য জায়গায় মাছি আসতেও নাক সিঁটকায়। মীরা আবার ইশানেকে ছাড়তে বলে। কিন্তু সে ছাড়লো না।

‘তুই বাংলাদেশে ফিরে যাসনা মীরা??’
ইশানের শীতল কন্ঠে মীরা কেঁপে উঠলো। এই কন্ঠটা কেমন যেন লাগছে মীরার। কেমন নেশা জড়ানো কন্ঠ যা কোন মেয়েকে পাগল করে দিতে পারে। কিন্তু মীরা ভেবেই নিয়েছে যে সে পাগল হবে না। কিছুতেই না। ইশান নামক ব্যক্তিটাকে তো তার ঘৃনা করতে হবে। পাহাড় পরিমান ঘৃণা। মীরা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,’আমাকে সবার সামনে আর হাসির পাত্রী বানাবেন না। দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।’

ইশান মীরার কথার তোয়াক্কা না করে চোখ বন্ধ করেই বলল,’আই লাভ ইউ মীরা। আই রেইলি রেইলি লাভ ইউ। আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি আর নিতে পারছি না। আমার জীবন থেকে সব চলে যাচ্ছে। প্লিজ মীরা।’
উপস্থিত সবাই ইশানের কথায় অবাক। থাপ্পর খেয়ে শেষমেশ প্রপোজ করে দিলো!! জীবনে বোধহয় এই প্রথম দেখলো সবাই।
ইশানের এহেম কথায় ভড়কে যায় মীরা। তবে সে ভাবে এগুলো সবই ইশানের নাটক। ক্ষমা পাওয়ার জন্য নাটক করছে। কিন্তু এখন তো ইশানের থেকে ছাড়া পেতে হবে। আর ইশান তো ছাড়ছেই না। মীরা আলতো করে ইশানের পিঠে হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ইশান,,,,,,’

মীরার এরকম নরম কন্ঠে হাত আলগা হয়ে এলো ইশানের ভাবলো হয়তো মীরা তার অনুভূতি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু মীরা ইশানকে অবাক করে দিয়ে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। এবং সাথে সাথে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইশানের গালে। এক হালি পূরণ হয়ে গেল। থাপ্পর খেয়ে ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো তার লাল হয়ে গেছে। রাগের কারনে নয় অনুসুচনার কারণে ওই চোখে এখন কোন রাগ স্পষ্ট নয় সেখানে ভালোবাসা জন্মেছে।

ভালোবাসা আড়ালে রাগগুলো সব চাপা পড়ে গেছে। মীরা তেজি কন্ঠে বলল,’এসব নাটক পর্দায় গিয়ে দেখাবেন আমাকে না!!আমি এসব নাটক দেখতে আসিনি। আমার পাসপোর্ট আমার ফেরত চাই। না হলে এর পরিনাম ভালো হবে না। ভাববেন না যে আমি সেই আগের মীরা??আমি এখন সেই আগের মীরা নই। একটুতেই কান্না করি না। কেউ বকলে বা আঘাত করলে কাঁদতে কাঁদতে মনি’মায়ের কাছে গিয়ে বিচার দেই না। নিজের বিচার এখন আমি নিজে করতে শিখে গেছি। আমাকে পাঁচ বছরের মীরা ভাবলে ভুল করছেন আপনি।’

ইশান চুপ করে মীরার কথাগুলো শুনছে। ইশানের পেছনে ওর বন্ধুরা সব দাঁড়িয়ে আছে এমনকি জিনিয়াও। সবাই মীরার কাজে অবাক হয়ে গেছে। যারা বাঙালি তারা কিছু কিছু বুঝতে পারলেও ওখানকার মানুষেরা হা করে রয়েছে। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না। ইশান ভেজা গলায় উওর দিলো,’মীরা আমি,,,’
‘আমার পাসপোর্ট কোথায়?? আর কোন সাহসে আমার পাসপোর্টে হাত দিয়েছেন??আমি আপনার মুখ দেখতে চাই না বলেই তো চলে যেতে চাইছি তাহলে কেন যেতে দিচ্ছেন না?? এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মরে যাব এখানে থাকলে।’

মীরার কথাগুলো ইশানের ভেতরটা যেন জ্বালিয়ে দিলো। চোখে পানি পূর্ণ ইশানের শুধু গড়িয়ে পড়া বাকি। কিন্তু চোখের পানিগুলো গড়িয়ে পড়তে চাইছে না। তারাও বেঈমানি করছে ইশানের সাথে। মীরাকে ইশানের কষ্ট গুলো দেখাতে চাইছে না। ইশান ধরা গলায় বলল,’মীরা আমি চাই তুই,,,,!!!’
ইশান তার কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই মীরা বলে উঠলো,’কি চান আপনি??আর আপনার কোন চাওয়াকে আমি গুরুত্ব দেব তা ভাবলেন কি করে??’

ইশান আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। মীরা আবার বলল,’কষ্ট হচ্ছে তাই না?? খুব কষ্ট হচ্ছে?? আমার ও হয়েছিল ফেলে আসা বছর গুলোতে। আমিও মনি’মায়ের মতো আশায় ছিলাম যে একদিন আপনারা ঠিকই আসবেন কিন্তু না আপনারা এলেন না। মনি’মায়ের কষ্ট দেখে আমিও কষ্ট পেতাম খুব। কিন্তু এই কষ্টগুলো কেউ দেখতে আসতো না। আর না কেউ সান্তনা দিতো। আর আপনি এখন আপনার কষ্ট দেখাতে এসেছেন??কি ভেবেছেন আমি আপনার কষ্ট দেখে গলে যাব??নাহ, আমি এখন শক্ত হয়ে গেছি। আঘাত পেতে পেতে এখন আর কোন আঘাত আমাকে কাবু করতে পারে না। আপনি যতটা কষ্ট পাচ্ছেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্টের আমরা পেয়েছি। আমাদের কষ্টের নিচে আপনার কষ্টগুলো খুবই তুচ্ছ।’

কথাগুলো বলতে বলতে মীরা কেঁদে ফেলেছে। এতদিন ইশান মীরার কঠোরতা দেখলেও আজ মীরার দূর্বলতা সে খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে। মীরা নিচের দিকে চোখ নামিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ইশান আস্তে করে মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আলতো করে মীরার হাত ধরলো। মীরা চোখ তুলে ইশানের দিকে তাকাতেই ইশান মীরার চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর মীরার হাতে ওর পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল,’তোর কষ্টের দাগ হয়তো মুছতে পারবো না। বাট আই প্রমিস তোর কষ্টের ভাগিদার হয়ে সারাজীবন থাকবো। আমি তোকে আটকাবো না। তুই যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস তোর পাশে সবসময় আমাকে পাবি। আর খুব শিঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে।’

মীরা আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ পাসপোর্ট নিয়ে বের হয়ে এলো। সবাই এতক্ষণ উৎসুক জনতার মতো সব দেখছিল।
মীরা চলে যেতেই ইশান বের হয়ে গেল। ইশানকে কেউ কিছু বলার সুযোগ পেল না।
বাড়িতে ফিরে মীরা নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। ইশানের কথাগুলো বারবার মনে পড়লেও তাতে পাত্তা দিচ্ছে না মীরা। তাকে যেতে হবে। গভীর রাতে বাড়িতে ফিরলো ইশান। বারে না থাকলেও গাড়ি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে সে। তাই এতো দেরি হয়েছে তার। বাড়ি ফিরতেই ইফাজের মুখোমুখি হলো সে। ইফাজ এতক্ষণ ইশানের অপেক্ষা করছিল। ইশানকে দেখেই ইফাজ বলে উঠলো,’কি হয়েছে ইশান??তুই নাকি মীরার পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিস??’
ইশান মাথা নিচু করে বলল,’মীরা এখানে এসেছিল??’
‘হ্যা এসেছিল। কিন্তু তুই এসব করছিস কেন??’

ইশান চোখ তুলে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’আব্বু আমি আম্মুর কাছে যেতে চাই। ক্ষমা চাইবো আমি। মীরা বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছে আমিও ওর সাথেই যেতে চাই।’
ইফাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,’আমিও যেতে চাই কিন্তু মীরার সাথে যদি যাই তাহলে ও হয়তো সাবধান হয়ে যাবে। এমনিতেই মীরা আমাদের উপর রেগে আছে। অভিমান হয়েছে ওর। তাই আমি চাচ্ছি আগে মীরা যাক তারপর আমরা যাব। পিহুর সম্পূর্ণ ঠিকানা জেনে তারপর আমরা যাব। পিহু আমাদের ঠিকই ক্ষমা করবে।’

ইশান টলমল চোখে তাকিয়ে বলে,’ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি আর এসবের নিতে পারছি না। দাদা দাদী এসব কেন করলো আমাদের সাথে। সব মিথ্যের নিচে সত্যি টা ঢেকে রেখে কি হলো??সেই তো সবটা বের হয়ে গেলো মাঝখান থেকে এতগুলো বছর হারিয়ে গেল অদূরে। কিচ্ছু পেলাম না আমি।’

ইশান নিজের রুমে চলে গেল। ইফাজ কপালে হাত রেখে সোফায় বসে পড়লো। আজ তো কিছুতেই তার ঘুম আসবে না। ক’দিন ধরে রাতগুলো খোলা চোখেই পার করে ইফাজ। নিজের বাবা মায়ের করা পাপের শাস্তি আজ ওদের চারজনকে পেতে হচ্ছে। না পিহু ভালো থাকতে পেরেছে আর না ইফাজ। ইশান আর মীরার মধ্যে তো উল্টো অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় ইফাজের মাথা ধরে গেছে। খাওয়া দাওয়া তো ঠিকমত করছে না তার উপর এতো চিন্তা। কবে জানি ইফাজ পাগল হয়ে যায়??ইফাজ তৎক্ষণাৎ চিন্তা করলো যে পাগল হওয়া যাবে না। তাহলে পিহুর কাছে ক্ষমা চাইবে কিভাবে??একটার পর একটা চিন্তা ইফাজকে গ্রাস করেই যাচ্ছে।

সোফায় হেলান দিয়েই সে বসে রইল। দুটো মানুষ তাদের সুখের জন্য চারজন মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করলো। এখন তো সবকিছু ঠিক হতে গিয়েও হবে না। সেদিনের পর থেকে ইফাজ ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ওনাদের সামনেও যায় না ইফাজ। হঠাৎ করে সামনে পড়ে গেলেও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। ওনারা ইফাজের সাথে কথা বলতে চাইলেও ইফাজ চায় না। আর ইশান তো আগে থেকেই ওর দাদির সাথে কথা বলে না। এখন ওর দাদাও যুক্ত হয়েছে তাতে।

আজকে মীরার ফ্লাইট। সেদিনের পর মীরা আর ইশানকে দেখেনি। তিনদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলছে মীরা। সাবরিন ও সাহায্য করেছে মীরাকে। এই তিনদিন জিনিয়ার সাথেও তেমন কথা হয়নি মীরার। কি ই বা বলবে??যার বাড়িতে থাকছে খাচ্ছে তাকে কি কিছু বলা যায়??আর জিনিয়া তো ওর বন্ধুর কথা শুনেছে এটা স্বাভাবিক। মীরা লাগেজ টেনে নিয়ে নিচে আসলো। জিনিয়া মীরার জন্যই অপেক্ষা করছিল। জিনিয়ার মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। এতদিন একসাথে থেকেছে আর এখন চলে যাচ্ছে। ও আবার একা হয়ে যাবে। মীরা জিনিয়ার সামনে যেতেই সে বলে উঠলো,’আই মিস ইউ হানি।’
তারপর একটু থেমে আবার বলল,’এন্ড ইশান,,,, হি লাভ ইউ। প্লিজ ডোন্ট গো!!ইশান,,,’

মীরা জিনিয়াকে কিছু বলতে দিলো না চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলো তারপর লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’Thank you for letting me stay at your house for so long. And bye!!.’
জিনিয়া মুচকি হেসে বলল,’হোপ টু সি ইউ অ্যাগেইন।’
মীরা সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ক্যাব ডেকে তাতে চড়ে বসলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো মীরা। দেড় মাসের বেশি কাটিয়েছে লন্ডনে সে। ছেড়ে যেতে কেমন যেন লাগছে মীরার। চারিদিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু ইশান বা ইফাজ কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তাহলে কি সত্যি ওরা মীরার পিছু ছেড়ে দিলো?? হবে হয়তো?? তবে এতে মীরার কিছু যায় আসেনা। আবার অন্যরকম লাগতেছে। উসখুস করছে সে। ইয়ারপোর্টে আসতেই সাবরিনের দেখা। সে এতক্ষন মীরার জন্যই অপেক্ষা করছিল। মীরা ক্যাব থেকে নেমে সাবরিনের কাছে গেল। সাবরিন হাসি মুখে বলে,’খুব খারাপ লাগছে তুমি চলে যাচ্ছো বলে। আর কবে দেখা হবে কে জানে??’

‘তুমি যখন বাংলাদেশ যাবে অবশ্যই দেখা করবে??’
‘আচ্ছা তুমি যদি কখনো লন্ডন আসো তাহলে আমার সাথে দেখা করো কিন্তু??’
সাবরিনের কথা শুনে মীরা হাসলো।বলল,’আমি আর আসবো না লন্ডনে। তাছাড়া আমার কাজ তো শেষ এখানে আবার কেন আসবো??’
সাবরিন মুচকি হাসি দিয়ে বলে,’ভাগ্য যদি টেনে আনে তাহলে আবার আসতে পারো। বাই দা ওয়ে ইশান কোথায়?? এখনও আসেনি?? তুমি চলে যাচ্ছো ওর তো আসার কথা??’
মীরা মাথা নিচু করে বলে,’আমি বারন করেছি আমার পিছু আসতে। আমার এসব আর ভালো লাগছে না।’

‘আমার মনে হয় ইশান তোমার প্রতি উইক। নাহলে ওভাবে বারভর্তি মানুষের সামনে তোমাকে লাভ ইউ বলল তাও হাগ করে। আমার তো ভাবতেই কেমন যেন লাগছে!!’
মীরা সাবরিনের দিকে অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’এটা আমার দেখার বিষয় না। আমি শুধু এতটুকু জানি যে আমি ইশান নামক ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে চাই।’
‘তোমার কি মনে হয় ইশান এতো সহজে সব ভুলে যাবে??আর‌ ইফাজ খান কি তোমার মনি’মায়ের কাছে যাবে না?? তখন কি হবে??’

‘ওনারা অবশ্যই মনি’মায়ের সাথে দেখা করবে। কিন্তু মনি’মাকে ওদের কাছে ফিরে যেতে দিতে আমার মন চায় না। তবে যদি মনি’মা চায় আমি বারন করব না। আমি বারন করার কে??মনি’মায়ের আপন কেউ না। আর মনি’মা চাইলে যেতে পারে। জানো সাবরিন আমি ওনাদের ক্ষমা করতে পারছি না। আমার মন চাইছে না। এতগুলো বছর ধরে মনি’মা নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছে। কষ্ট পেয়েছে সেটা আমি দেখেছি। এজন্য আমার মন টানছে না ওদের প্রতি।’

‘তবে আমার মনে হয় ইফাজ খানও এতদিন কষ্ট পেয়েছে। নাহলে তো নতুন করে সংসার শুরু করতো। কিন্তু তিনি তা করেননি। ছেলেকে নিয়েই এতবছর কাটিয়ে দিয়েছেন।’
মীরা চোখ বন্ধ করে দম ফেলল। সাবরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,’তাহলে উনি এতবছরে একবার ও মনি’মায়ের খোঁজ নিলো না কেন??’
‘সেটা ইফাজ খান ভালোভাবে বলতে পারবে। আমার মনে হয় তোমার তার কথা শোনা উচিত??’
‘আমাকে ওনার কথা শোনার জন্য পাঠানো হয়নি। মনি’মা আমাকে যে জন্য পাঠিয়েছে তা শেষ। এনি ওয়ে আমার ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে। আসি,বাই।’

মীরা চলে যাচ্ছে সাবরিন সেদিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে মীরা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। সাবরিন ও চলে গেল। শুধু রয়ে গেল ইশান। সে এতক্ষন এখানেই ছিল। গেটআপ চেঞ্জ করে আসায় মীরা আর সাবরিন ওকে চিনতে পারেনি। ইশান তো ওদের দূর থেকেই নজর রাখছিল কাছে গেলে হয়তো চিনতে পারতো?? তাহলে আরেক ঝামেলা শুরু হয়ে যেতো। তাই ইশান সেদিকে আগায়নি।
ইশান পারলো না মীরাকে আটকাতে আর না পারলো তার অভিমান ভাঙাতে। তবে ইশান তার হাল ছাড়বে না। শেষ চেষ্টা সে করবেই করবে আর তা যেভাবেই হোক না কেন??

কলিং বেল বাজতেছে বিরতিহীন ভাবে। মুহিত চোখ কুঁচকে ফেলে। কারণ সে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতেছিল। টান টান উত্তেজনা এর মধ্যে কে তাকে বিরক্ত করে?? চোখমুখ কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো মুহিত। টিভির দিকে চোখ রেখেই দরজার কাছে এগিয়ে এলো। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই চোখদুটো তার রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। কারণ মীরা দাঁড়িয়ে আছে।মুহিত ভাবছে ও স্বপ্ন দেখছে না তো??হাত দিয়ে বারবার চোখ ঘষতে লাগলো সে। মুহিতের এহেম কান্ডে মীরা বিরক্ত হলো। জোরে মুহিতের হাতে চিমটি কেটে বলল,’স্বপ্ন নয় সত্যি। আমি সত্যি এসেছি। বাইরে আমার লাগেজ আছে যা নিয়ে আয়।’
মীরা মুহিতকে পাশ কাটিয়ে একপ্রকার দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো পিহুর সাথে দেখা করার জন্য। মনটা ওর খুশিতে ভরে গেছে। আজকে অনেক দিন পর পিহুকে দেখবে। রুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখলো পিহু খাটে আধশোয়া হয়ে বসে বই পড়ছে। মীরার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। জোরেই বলল,’মনি’মা,,,’

পিহু চমকে মীরার দিকে তাকালো। মীরাকে দেখে পিহু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে মীরাকে এই সময়ে একদম আশা করেনি। মীরা দৌড়ে গিয়ে পিহুকে জড়িয়ে ধরে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এতদিন পর মীরা শান্তিতে শ্বাস ফেলতে পারছে। পিহু এখনও শকের মধ্যে রয়েছে। কি থেকে কি হয়ে গেল?? মীরা চলে এসেছে??পিহু মীরার মাথায় হাত রেখে বলল,’তুই চলে এসেছিস!!আমাকে একবারও জানালি না??আর হঠাৎ চলে এলি যে??’

মীরা চুপ করে রইলো। চোখ বন্ধ করে আছে সে। এতদিন পর পরিচিত মানুষটার ঘ্রাণ পাচ্ছে মীরা। মন ভরে সেই ঘ্রাণ শুষে নিচ্ছে সে। তখনই রুমে মুহিত আর মুক্তার প্রবেশ। মুহিত লাগেজ টেনে এনে একপাশে রাখলো। মীরার উওর না পেয়ে পিহু মুক্তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই মুক্তা বলে উঠলো,’আমরা জানতাম মীরা আসবে কিন্তু আজকেই যে আসবে তা জানতাম না। তোকে সারপ্রাইজ দিবে বলে মীরা আমাকে কিছু বলতে দেয়নি।’

মুক্তার কথা শুনে পিহু মীরাকে ওর কোল থেকে টেনে তুলে বলল,’আমাকে বলে আসলে কি হতো??আমি কি বারণ করতাম??দিনদিন তুই এতো পাজি হচ্ছিস কেন মীরা??’
পিহুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মীরা বলল, ‘আগে বলো তুমি কেমন আছো?? এতদিন আমি কিভাবে যে থেকেছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। তো ফাইনালি আমি তোমার কাছে আসতে পারলাম।’
পিহু একটু হাঁসফাঁস করতে লাগলো। কয়েকবার দরজার দিকেও তাকালো। মীরা তা বেশ বুঝতে পারছে। সে বলল,’কেউ আসেনি। না তোমার ছেলে আর না তোমার এক্স হাজবেন্ড।’
পিহুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। এরপরও কি ওরা সত্যি আসবে না। জীবনের শেষ পর্যায়ে কিন্তু কারো দেখা ও পাবে না?? ভাবতেই পিহুর বুকটা কেঁপে উঠলো। সে বলল,’তুই ওদের কিছু বলিসনি??মানে আসতেও তো বলতে পারতি??’

মীরার যেন এতে রাগ হলো। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না। সত্যিটা পিহুকে বলতেও পারছে না। কি বলবে??যে তোমার ছেলেকে আমি থাপ্পর মেরে এসেছি আর হাজবেন্ড কেও অনেক কথা শুনিয়ে এসেছি ব্লা ব্লা ব্লা। তাহলে তো পিহুর মন খারাপ হয়ে যাবে তাই মীরা বলল,’আমি কি ওদের কোলে করে আনব নাকি?? ওদের কি হাত পা নেই?? আমার কাজ আমি করে এসেছি। আর কিছু আমি করতে পারবো না।’
মীরার কথা শুনে পিহু হাসলো বলল,’আমার ইশান কেমন আছে মীরা?? অনেক বড় হয়েছে নিশ্চয়ই?? কেমন দেখতে হয়েছে??আর ইফাজ,,,’

মীরা পিহুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’থামো থামো। অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছো। এবার আমি বলি??তারা আসলেই দেখতে পারবে কে কেমন হয়েছে!!! শুধু শুধু আমার থেকে শুনে নিজের মন খারাপ করো না তুমি। কারণ ওদের ভালো দিক বাদ দিয়ে খারাপ দিকই আমি বলতে পারবো শুধু। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবে না তুমি।’
বলেই মীরা আবার পিহুর কোলে মাথা রাখে।পিহু বুঝলো এই মেয়ে তাকে কিছু বলবে না। কিন্তু ওরা আসবে?? সত্যি!! মীরা যখন বলেছে তখন আসবেই বোধহয়। পিহুর বুকটা ধড়ফড় করছে। ইশান আর ইফাজকে দেখে কি রিয়্যাক্ট করবে পিহু?? ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তার। উসখুস করছে। কিন্তু এতে মীরার কোন ভাবান্তর নেই। সে চুপ করে পিহুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।

মুক্তাদের বাড়িতে দুইদিন থেকে মীরা আর পিহু ওদের বাড়িতে চলে আসে। যেহেতু মীরা এখন ফিরে এসেছে এখন সে পিহুর খেয়াল রাখতে পারবে। তাছাড়া পিহুও এখন অনেকটা সুস্থ। ওষুধ চলতেছে শিঘ্রই আরো সুস্থ হয়ে যাবে। সামির মীরা আর পিহুকে দিয়ে গেছে। বাড়িতে এসেই মীরা পুরো বাড়ি গুছিয়ে নিলো। মীরাকে ছাড়া বাড়িটা অমানুষে পরিণত হয়েছিল। আর এখন মানুষের মতো লাগছে।
সারাদিন পিহুর যত্ন নিয়ে তাকে খাইয়ে দিয়ে বিকেল বেলা বসে গল্প করছিল মীরা।

কোথা থেকে যেন মুহিত এসে ওকে টেনে নিয়ে গেল ভেলপুরি খাওয়ার জন্য। মীরা যেতে চাইছিল না পিহু জোর করেই পাঠালো। এতদিন পর এসেছে ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে কেন??তাই মীরাকে মুহিতের সাথে পাঠিয়েছে।

বাড়ি থেকে একটু দূরেই ভেলপুরির দোকান। এই এলাকার সবচেয়ে ভালো ভেলপুরির দোকান এটা। প্রতিদিন অনেক মানুষ এখানে আসে। মুহিত আর মীরা একটা টেবিলে পাশাপাশি বসে আছে। অর্ডার দিয়েছে। মীরা ফোন ঘাটছে মুহিতের বাজে বকবক শুনতে ওর ইচ্ছে করছে না। তাই বলে মুহিত থেমে নেই। পুরো লন্ডনের বর্ণনা শুনতে চাইছে ও। এরমধ্যে ভেলপুরি চলে এসেছে। মীরা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আর ফোন ও টিপছে। হঠাৎ করেই মুহিত বলে উঠলো,’আচ্ছা সিনিয়র বউ ইশান ভাইয়া দেখতে খুব সুন্দর তাই না??মানে অনেক ফর্সা??’

এতে মীরা বিরক্ত হলো। এই কথা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে মুহিত। তখন উওর না দিলেও এখন দিতে হবে নাহলে এই ছেলে ওকে জ্বালিয়ে মারবে। মীরা ভেলপুরি খেতে খেতেই উওর দিলো,’হুম।’
‘চুলগুলো সবসময় সুন্দর করে ব্রাশ করে রাখে।’
‘হুম।’
‘আর চোখে কালো রঙের সানগ্লাস পড়ে থাকে??’
‘হুম।’
‘অনেক লম্বা। আই মিন ছ’ফুট এক কি দুই ইঞ্চি??’
‘মেপে দেখিনি কখনো তবে সেরকমই হবে।’
‘একদম বিদেশিদের মতো দেখতে??’

মীরা এবার খাওয়া বাদ দিয়ে মুহিতের দিকে তাকালো। সে অনেকটা অবাক হয়েছে। মীরা বলল,’আমি তো তোকে ইশান সম্পর্কে কিছু বলিনি তাহলে তুই জানলি কিভাবে?? তুই তো ইশানকে দেখিসনি??’
মুহিত হাসি দিয়ে বলল,’দেখিনি তবে এবার বোধহয় দেখছি।’

মীরা চোখ বড়বড় করে মুহিতের দিকে তাকালো। ও ইশানকে দেখছে মানে?? মুহিতের চোখ সামনের টেবিলের দিকে। মীরা সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো। মীরা যেন ইলেক্ট্রিক শক খেল। ইশান সামনের টেবিলে বসে আছে। সাদা রঙের শার্ট গায়ে তার। চোখে ব্লাক সানগ্লাস। ইশানকে দেখে মীরা এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলো। ততক্ষণে ইশান মীরার মুখোমুখি এসে বসেছে। ওর হাতে সেই টেডি বিয়ার টা যেটা মীরা ওকে ফেরত দিয়ে এসেছিল। মীরা এক পলক মুহিতের দিকে তাকিয়ে আবার ইশানের দিকে তাকালো। ইশান মুচকি হেসে চোখ থেকে সানগ্লাস খেলে বলল,’আমি এসে গেছি। বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই দেখা হবে।’

মীরা এখনও ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইশান আবার বলল,’সত্যি আমি এসেছি।আব্বুও এসেছে। তুই আমাকে এক হালি থাপ্পর মেরে এসেছিস আর আমি এক হালি ভালোবাসা দিতে এসেছি।’
ইশানের কথায় মুহূর্তেই বিষম খেল মুহিত আর মীরা। এক হালি কলা,ডিম পাওয়া যায় কিন্তু এক হালি যে ভালোবাসা আছে তা মুহিত আজ জানলো। তবে মীরাও এতে অবাক। এক হালি ভালোবাসা। এটা মীরাও আজকে জানলো। দু’জনেই ফ্যালফ্যাল চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের এরকম মুখ দেখে ইশান হাসছে। হাসি থামিয়ে ইশান বলল,’চল বাড়িতে যাই তোকে দরকার।’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১২

‘আমি আপনার বাড়িতে কেন যাবো??’ কাটকাট গলায় বলল মীরা। ইশান বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,’আমাদের বাড়িতে কে যেতে বলেছে তোকে?? তোর বাড়িতে যাবি আসলে আব্বু গেছে তো।আম্মু আব্বুকে দেখেই দরজায় খিল এঁটে বসে আছে আমার সাথেও কথা বলেনি। আর আব্বু ওখান থেকে আসতেও পারছে না। দরজা খোলা রেখে আসবে কিভাবে??যদি চোর ঢোকে?? তুই ছাড়া তো আম্মু বের হবে না তাই অনেক খুঁজে খুঁজে তোর কাছে আসলাম এখন চল।’
ইশানের কথা শুনে মীরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটু জোরেই বলে উঠলো,’কি???’

ইফাজ আসবে এটা মীরা জানতো কিন্তু এভাবে আসবে সেটা মীরা আশা করেনি। মীরা একমুহূর্ত দেরি করলো না। দৌড়ে ওখান থেকে চলে এলো। ইশানও তার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলল মীরার পিছু পিছু।
মুহিত বলেছেন বেচারা ভেলপুরির প্লেটদুটো সামনে নিয়ে বসে রইল। মীরার প্লেট ধরাই রয়েছে। খুব একটা খায়নি সে। এখন এতগুলো ভেলপুরি খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ধুর ধুর,,,এখন কি খাওয়ার সময় নাকি??মুহিত ও চলল ওদের পিছু পিছু।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৪