অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৫ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৫
Ishita Rahman Sanjida

দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে ঘুরছে। নিস্তব্ধ রুমে এই শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ইফাজ বারবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মুলত সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। পিহু সোফার হ্যান্ডেলে হাত রেখে কপাল ধরে বসে আছে। ইশান তার মায়ের পাশে বসে আছে। মীরা দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে মীরার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সে সবটাই পিহুর উপর ছেড়ে দিয়েছে। আজ যা করার পিহুই করবে। কিন্তু এত অপেক্ষা কিসের??কি করতে চাইছে ইফাজ তা কেউ বুঝতে পারছে না।

মুহিত একপাশে নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টান টান উত্তেজনা কাজ করছে ওর মধ্যে। এরকম উত্তেজনা ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সময় ও হয়না। দাঁতে নখ কাটছে সে। সামির আর মুক্তাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
ইতিমধ্যে ইফাজ কয়েকবার কাউকে ফোন করেও ফেলেছে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ভেঙ্গে কেউ একজন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। লোকটাকে দেখে ইফাজ উঠে দাঁড়ালো। ফর্মাল পোশাক পরা মধ্যবয়স্ক লোকটার হাতে একটা ফাইল। লোকটাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। পিহুর মধ্যে এখন আর কোন সংশয় দেখা যাচ্ছে না। সে নরমাল ভাবেই বিহেভ করছে। ইফাজ সবার দিকে তাকিয়ে বলল,’এরপরের সব প্রশ্নের উত্তর ইনি দেবেন।’

লোকটাকে দেখিয়ে বলে ইফাজ। লোকটা ইফাজের দিকে তাকাতেই ইফাজ কিছু ইশারা করলো। লোকটা মাথা নেড়ে ফাইল থেকে একটা পেপার বের করে পিহুর দিকে এগিয়ে দিল। পিহু কিছুক্ষণ পেপারের দিকে তাকিয়ে থেকে কম্পিত হাতে পেপারটা নিলো। পুরো পেপারটাতে চোখ বুলিয়ে সে অচেনা লোকটার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।ইফাজের দিকেও তাকালো পিহু। চোখে তার বিষ্ময়ের ছাপ। লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনার আর ইফাজ খানের ডিভোর্স ক্যান্সেল করা হয়েছে। কোর্ট থেকে অনুমোদন নিয়েই এসেছি আমি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লোকটার কথায় বোঝা গেল তিনি একজন উকিল। উকিলের কথা শুনে মীরা অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। ডিভোর্স ক্যান্সেল করা হয়েছে মানে??এতবছর পর এসে এসব কি করতে চাইছে ইফাজ??বিয়ে ডিভোর্স কি কোন ছেলেখেলা নাকি?? মীরা ঝড়ের গতিতে এসে পিহুর হাত থেকে পেপারটা নিয়ে নেয়।পেপারে বড় করে নীল কালির সিল মারা। পুরোটা পড়ে মীরা বুঝতে পারলো যে সত্যি ডিভোর্স ক্যান্সেল করা হয়েছে। মীরা চকিতে তাকিয়ে কঠোর সুরে বলল,’এটা কি কোন খেলা??বিয়ে আর ডিভোর্স কি এতোটা সহজ মনে হয় আপনাদের??আর সতের বছর পর ডিভোর্স ক্যান্সেল করার মানে কি??এটা কি হাস্যকর বিষয় না?? ইসলামের দৃষ্টিতে এটা নিষিদ্ধ। আপনারা কি জানেন না??’

মীরার প্রশ্নের ঝুলি শেষ হওয়ার পর উকিল মুখ খুললেন। তিনি বললেন,’হ্যা জানি। ইসলামী বিধানে স্বামী স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে গেলে পরবর্তীতে তারা আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে আরেকটা কথাও আছে,বিবাহের আগে ছেলে মেয়ে উভয়ের মতামত জানা দরকার তেমনি ডিভোর্সের আগেও দুজনের মতামত নেওয়া জরুরি। নাহলে এই বিয়ে বা ডিভোর্স এর কোন মানেই হয় না। এটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। কিন্তু পিহু আর ইফাজ খানের ডিভোর্সটা জালিয়াতি করে হয়েছে। যা আইনের কাছে অপরাধজনক কাজ। তাই এই কেসটা আবার সামনে আনা হয়েছে। সব প্রমাণ আর সাক্ষীর ভিক্তিতে কোর্ট এই ডিভোর্স ক্যান্সেল করেছে। পিহু যদি ডিভোর্স দিতে চান তাহলে তাকে পুনরায় ইফাজ খানকে ডিভোর্স নোটিশ পাঠাতে হবে। এবং দুজনের মতামত নিয়ে আবার নতুন করে ডিভোর্স অ্যারেন্জ করতে হবে। তবেই ওনাদের ডিভোর্স সম্পূর্ণ হবে।’

পিহু এবার কিছুটা রেগে যায়। সত্যি তো এতো বছর পর এসবের মানে কি??সে বলে উঠলো, ‘আমি এসব বিশ্বাস করি না। সতের বছর পর ডিভোর্স পেপার কিভাবে ক্যান্সেল হয় এটাই আমি বুঝতে পারছি না। এখন এসব করার দরকার কি??আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।’
ইফাজ বলল,’যেই ডিভোর্সটাকে ডিভোর্স বলে গণ্য করা না হয় সেই ডিভোর্স দিয়ে কি হবে??আর উনি তো সবটা বলেই দিয়েছেন। তুমি যদি ডিভোর্স দিতে চাও তবে নতুন করে সবকিছু অ্যারেন্জ করা হবে। তোমার আমার সম্পূর্ণ মতামতে। তবে এখানে আমার মতামত কিছু না সবটাই তোমার ইচ্ছায় হবে।’
‘কে বলেছে আমি সেদিন নিজের ইচ্ছায় সাইন করিনি??আমি নিজের ইচ্ছায় পেপারে সাইন করেছিলাম। আমিও চেয়েছি ডিভোর্স হোক। আমি না চাইলে কেউ আমাকে দিয়ে সাইন করাতে পারতো না।’

ইফাজ পিহুর দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল,’ভেবে বলছো তো??’
পিহু চোখ নামিয়ে বলল,’হ্যা আমি ভেবেই বলছি।’
‘তাহলে চোখ নামিয়ে নিলে যে?? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো।’
পিহু তাকালো না। চোখ বন্ধ করে অশ্রু ফেললো। ইফাজ আবার বলল,’সেদিন আমি তোমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠাইনি পিহু।আর না তুমি পাঠিয়েছিলে। কিন্তু আমি জানতাম তুমি পাঠিয়েছিলে তাই সাইন করে দিয়েছিলাম। তুমিও সেটা ভেবে সাইন করেছিলে। যদি জানতে আমি ডিভোর্স পেপার পাঠাইনি তাহলে তুমি কি সাইন করতে??’

ইফাজের প্রশ্নের জবাব দিলো না পিহু। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে পিহু। ইফাজ বলল,’আমিও যদি সব জানতাম তাহলে সাইন করতাম না। কিন্তু কয়েকজনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা দুজন দুজনকে ভুল ভেবেছিলাম। এভাবে তো সব ছেড়ে দেওয়া যায় না।’
পিহু চোখ তুলে ইফাজের দিকে তাকালো বলল,’তাই বলে এতবছর পর ডিভোর্স ক্যান্সেল নোটিশ আমি মেনে নিতে পারছি না।’

এবার উকিল সাহেব মুখ খুললেন। বললেন, ‘এটাই আইন মিস পিহু। সতের বছর কেন সাতাশ বছরের পুরনো কেস আবার কোর্টে নতুন করে তোলা হয়। আপনারা সেটা না জানলেও আমরা সে বিষয়ে অবগত। কিছু কিছু কেস দশ বছর ধরেও চলে। আবার তারও বেশি চলে। আবার কিছু নির্দোষ মানুষ বিনা কারণে সাজা পায়। তাদেরকেই আবার কয়েকবছর পর মুক্তি দেওয়া হয় সব প্রমাণের ভিত্তিতে। তখন প্রশ্ন হয় বিনা দোষে সে কেন এতদিন সাজা ভোগ করলো??

তবে তখন তো আর কিছু করার থাকে না। সময় বহমান সে চলে গেলে তাকে আর ধরে রাখা যায় না। আবার অনেকে জালিয়াতি কেস করে। ধনসম্পদ জালিয়াতি করে কেড়ে নেয়। এসব কেসও চলে বছরের পর বছর। একসময় দেখা যায় কঙ্খিত ব্যক্তি তার সম্পদ ফিরে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু পেছনে সে কতগুলো বছর হারিয়ে বসেছে। সেরকম জালিয়াতি আপনাদের সাথে করা হয়েছে যার কারণে আপনার জীবন থেকে এতগুলো বছর চলে গেছে। তাইতো ইফাজ খান এবিষয়ে কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে উকিল আপনাদের ডিভোর্স করিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে কেস করা হয়েছে। এমনকি ইফাজ খান তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে কেস করেছেন। এবং সম্পর্কে ছেদ ধরানোর জন্য নেহালের বিরুদ্ধে ও মামলা করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই সবাই কে কোর্টে হাজির করা হবে।’

এমনটা শোনার জন্য পিহুসহ কেউই প্রস্তুত ছিল না। ইফাজ ওর বাবা মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে!!পিহু অবাক হয়ে বলল,’কি??ইফাজ ওর বাবা মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে!! কিন্তু কেন??’
ইফাজ বলে উঠলো,’কারণ আমাদের সম্পর্কের ফাটল ধরিয়েছে ওনারাই। তাই শাস্তি ওনাদের প্রাপ্য। আমার পাপের শাস্তি তো আমি এতবছর ধরে পেয়ে এসেছি। তাহলে বাকিরা কেন শাস্তি পাবে না??সবাই শাস্তি পাবে।’

পিহু বিচলিত হয়ে বলল,’এভাবে নিজের বাবা মায়ের উপর কেস করাটা ঠিক হয়নি তোমার।আর তুমি কি ভেবেছো এসব করলেই আমি তোমার কাছে ফিরে যাব?? কখনোই না। আমি আর নিতে পারছি না। এতদিন পর এসে কি বোঝাতে চাইছো তুমি?? আমাকে আবার নিজের জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারবে না তুমি। অনেক হয়েছে আমি আর পারছি না। সব কথা শেষ হলে আসতে পারো তোমরা।’

ইফাজ জানতো পিহু এরকমটাই বলবে। এতবছরের অভিমান এক নিমিষেই ভাঙবে না। তাই ইফাজ বলল,’আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসিনি। সেটা আমি আগেই বলেছি। আর আমি জানি আমি চাইলেও তুমি আমার সাথে যাবে না। এতবছর পর এসব আশা করা যায় না পিহু। এবার সব সিদ্ধান্ত তোমার উপর। তুমি ঠিক কি চাও সেটা তোমাকে বলতে হবে। আমি আর তোমার সামনে আসবো না। তুমি না চাওয়া পর্যন্ত। তবে একটা কথাই বলব আমাকে ক্ষমা করা যায় না?? আমি কি সত্যি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই?? আমি শুধু তোমার কাছে ক্ষমা চাই। এর থেকে কিছু না। আমি আবার তোমার প্রিয়জন হতে চাই না। সামনের বছর গুলোতে না হয় তোমার অপ্রিয় হয়েই থাকলাম। তবুও ক্ষমা তো পাবো। নাহলে যে আমার মরেও শান্তি হবে না।’

পিহু প্রতুত্যরে কিছু বলল না। সবার সামনে থেকে চলে গেল নিজের রুমে। খুব ক্লান্ত লাগছে পিহুর। সে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়ল। ওর জীবনটা এমন কেন হলো?? ভাগ্য কেন ওর সাথে পরিহাস করলো??ওর তো কোন দোষ ছিল না। কি চেয়েছিল সে??একটা ছোট্ট সংসার। যেখানে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে সে। কিন্তু আল্লাহ এই তুচ্ছ চাওয়াটাকে অনেক বড় করে দেখেছেন। তাই এতো কিছু করেছেন।

পিহু রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ইশান ঢুকলো রুমে। এতক্ষণ সে কিছুই বলেনি। বাবা মায়ের ঝামেলা তাদেরকেই মেটাতে দিয়েছে। কিন্তু কিছুই যে মিটেনি। ইশান ওর মায়ের সামনে গিয়ে বলল,’আমি জানি আম্মু তুমি এতদিন কষ্ট করেছো। কিন্তু বিশ্বাস করো আব্বুও অনেক কষ্টে ছিল। আমি সেটা দেখেছি। তখন আমি কিছুই করতে পারিনি। তবে আজ কিছু করতে চাই। ছেলে হিসেবে বাবা মায়ের জন্য কিছু করা উচিত আমার।তাই তোমাকে বলছি ফিরে চলো আম্মু।’

পিহু ইশানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,’তোর এই আবদার আমি মানতে পারছি না। এতদিন যেভাবে ছিলাম বাকি দিনগুলো সেভাবেই কাটিয়ে দেব।’
ইশান আর এই বিষয়ে কথা বলল না। শুধু বলল,’আমি চলে যাচ্ছি আম্মু। তবে কালকে আবার আসবো। তোমার সাথে অনেক সময় কাটানো বাকি আছে। যদিও সময় অনেক টা চলে গেছে তবুও। আসি আম্মু।’

ইশান রুম থেকে বের হয়ে গেল। পিহু ইশানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলল। ইফাজ ইশানের জন্য অপেক্ষা করছিল। ইশান আসতেই ইফাজ বলল,’চল ইশান।’ এটুকু বলে ইফাজ মীরার দিকে তাকালো তারপর মীরার কাছে গিয়ে বলল, ‘পারলে তোমার ভালো আব্বুকে মাফ করে দিও। তোমার ভালো আব্বু খুব খারাপ।’

মীরা ইফাজের মলিন মুখটার দিকে তাকালো। চোখ দুটো টলমল করছে ইফাজের। পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ার আগেই সে বেরিয়ে গেল। ইশান একবার মীরার দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল।
সবাই চলে যেতেই মীরা বড় করে শ্বাস ফেললো। এতো কথা শুনতে শুনতে সেও ক্লান্ত হয়ে গেছে। মীরা আস্তে করে সোফায় গিয়ে বসল। একহাত হ্যান্ডেলের উপর রেখে চোখের পানি ফেলতে লাগল। মুক্তা মীরার পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,’চিন্তা করিস না মীরা যা হওয়ার তা হবেই।’
মীরা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো বলল,’আর কি হওয়ার বাকি আছে আন্টি??আমি এখন কোন দিকে যাবো??কি করবো ওই মানুষটাকে নিয়ে??মনি’মা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে। না থাকতে পারছে একা আর না পারছে তার স্বামীকে কাছে টানতে। পৃথিবীটা এতো ভুলে ভরা কেন?? বলতে পারো যে সত্যের জয় এতো দেরিতে কেন হয়??’

মুক্তা গভীর শ্বাস ফেলে বলে,’এটাই দুনিয়া। সত্য তাড়াতাড়ি সবার সামনে আসে না। সত্য বের করতে করতে সারাজীবন টাই পার হয়ে যায়।’
সামির এগিয়ে এসে বলল,’সবকিছু পিহুর উপর ছেড়ে দে। পিহু নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।’
মীরা মাথা নাড়লো শুধু। সামিররা কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল। থাকতে চেয়েছিল মুক্তা কিন্তু মীরা থাকতে দিলো না। সবাই চলে যেতেই মীরা ধীর পায়ে পিহুর রুমে গেল। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে পিহু। মীরা নিঃশব্দে পিহুর সামনে গিয়ে বসলো। পিহুর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। মীরাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিহু ভাঙা গলায় বলল,’কিছু বলবি??’

মীরা মাথা নাড়িয়ে না বলে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মীরা বলল,’আমার দেওয়া শর্তের জন্য কি তুমি ওদের ফিরিয়ে দিলে??আমি তোমাকে তো বললাম যে সবটা তোমার ইচ্ছায় হবে। তাহলে তুমি ওদের ফিরিয়ে দিলে কেন??’
পিহু পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোর কি মনে হয় আমি এখনো বাচ্চা?? ভালো মন্দ সবকিছু বিচার করার ক্ষমতা আমার আছে। তাই আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না।’
মীরা কাতর কন্ঠে বলল,’তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে মনি’মা। আমি বুঝতে পারছি। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পারো। যেহেতু তোমাদের ডিভোর্স ক্যান্সেল করা হয়েছে।’
‘মীরা তুই এখান থেকে যা।’ মীরা তবুও বসে রইল দেখে পিহু খিটখিটে মেজাজের স্বরে বলল,’আমাকে একা থাকতে দে।’

মীরা নত স্বরে বলল,’রাত হয়ে গেছে তো।খাবে না?? ওষুধ খেতে,,,,’
মীরা আর বলতে পারলো না। তারমধ্যেই পিহু ধমকে বলল,’একদিন খাবার ওষুধ না খেলে আমি মরে যাব না। চিন্তা করিস না আমি এতো তাড়াতাড়ি মরবো না। ভাগ্যের লিখন এখনও শেষ হয়নি আমার। আল্লাহ আরো অনেক কিছু আমার কপালে লিখে রেখেছে। যার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার মৃত্যু নেই। যা এখান থেকে।’

মীরা গোমড়া মুখে বের হয়ে গেল। পিহু যে আজকে কিছু মুখে তুলবে না তা মীরা বেশ বুঝতে পারছে। মীরাও কিছু খেলো না। লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম তো চোখে ধরা দিচ্ছে না মীরার। এপাশ ওপাশ করছে সে। বারবার আজকে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়ছে। পিহু আর ইফাজের জীবন একটা ধোঁয়াশার মধ্যে পড়েছে। যেখান থেকে পথ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। পিহুও নিশ্চয়ই আজকে ঘুমাবে না??আর ইফাজ সেও কি ঘুমাতে পারবে?? মীরার মনে এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ইফাজের জন্য কিছুটা হলেও খারাপ লাগছে। যদিও এই খারাপ লাগা আরো আগে থেকেই হয়েছিল কিন্তু মীরা তা প্রকাশ করেনি। কঠোর হয়েছিল তখন। এখন আর পারছে না। মনটা বারবার অস্থির হয়ে পড়ছে।

রাত জিনিসটা কিছু মানুষের জন্য খুব খারাপ। সবার জন্য সব রাত ভালো হয় না। কিছু মানুষের জীবনে রাত মানেই অতীতে ডুবে যাওয়া। যা মনকে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। দিনে কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও রাতে থাকা যায় না। রাতটা না থাকলে হয়তো অতীত জিনিসটাই মনে পড়তো না। সৃষ্টিকর্তা
এজন্য হয়তো রাতের ব্যবস্থা করেছেন। অতীত পাপ পূণ্য ভেবে তার পথে চলার জন্য আহ্বান করেছেন। কিন্তু এই রাতকে ক’জন কাজে লাগায়??

আজকের রাতে চারজন মানুষের চোখ থেকেই ঘুম উড়ে গেছে। আশেপাশে তাকালে হয়তো ওদের মতো আরো অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যাদের রাত নির্ঘুম কাটে। ইশান নিজের রুমে শুয়ে আছে। একটু আগে সে ইফাজের রুম থেকে এসেছে। ঘুমায় নি ইফাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আর এই নির্ঘুম ই ইফাজের অতীত ধরে টানছে। যা ক্ষণে ক্ষণে ইফাজকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। তবে সে তার কথা রাখবে। পিহু না চাওয়া পর্যন্ত সে পিহুর সামনে কখনোই যাবে না। বাকি জীবন একসাথে না ই বা থাকলো অন্তত ক্ষমা তো পাবে??এটাই ইফাজের কাছে অনেক।

সকাল আটটায় মীরার ঘুম ভাঙল। ভোর ভোর চোখটা লেগে এসেছিল তার। ঘুম ভাঙলো আটটায়। একপ্রকার জোর করেই উঠেছে মীরা। রাতে না খাওয়ার দরুন খিদে দলা পাকিয়ে আসছে। পেটের ভেতর গুড়ুম গুড়ুম করছে। মাথাটা ধরেছে খুব। এক কাপ চা হলে ভালো হতো। ফ্রেশ হয়ে মীরা পিহুর রুমে উঁকি দিলো। পিহু ঘুমাচ্ছে,শেষ রাতে ঘুমানোর জন্য বোধহয়। মীরা রান্নাঘরে পা বাড়াতে কলিং বেল বাজলো। মীরা দরজা খুলতেই মুহিত দাঁত বের করে হাসলো। মীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’দেখ আজকে মজার মুডে নেই বকবক করে মাথা খারাপ করবি না। এমনিতেই মাথা ধরেছে।’

মুহিত মুখে হাসি রেখেই বলল,’আমি তো তোমাকে জ্বালাতে আসিনি। আমাকে কি ওমন মনে হয়??আমি তো খিচুড়ি নিয়ে এসেছি। মা পাঠিয়েছে।’ বলতে বলতে হাতের বড় টিফিন বক্স দেখালো সে। বড়বড় চার বাটিওয়ালা বক্স দেখে মীরা বড়বড় চোখে তাকিয়ে বলল,’এতো খিচুড়ি দিয়ে কি করব আমি??রাক্ষস ভাবিস আমাকে আর মনি’মাকে??’
মুহিত ভেতরে ঢুকে টেবিলের বক্স রেখে বলল, ‘তো কি হয়েছে??আমিও খাবো।’
‘তুই খেলেও শেষ হবে না। তুই বস আমি চা করে আনছি। তুই খাবি??’
মুহিত মাথা নাড়িয়ে বলল,’মন্দ হয় না খেলে।’

মীরা রান্নাঘরে চলে গেল। ততক্ষণে পিহু উঠে গেছে দেখে মীরা পিহুর জন্যও চা বসালো। চা নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথেই আবার কলিং বেল বেজে উঠল। মীরা আর মুহিত একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো। পিহু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো ইশান দাঁড়িয়ে আছে। পিহুকে দেখে সে মুখে হাসি টেনে বলে,’গুডমর্নিং আম্মু।’
ইশানকে দেখে পিহুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ইশানকে ভেতরে আসতে বললো। ইশান এসেই মীরা বিপরীতে বসলো। মীরা আর মুহিত ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশান মুচকি হেসে বলল,’গুড মর্নিং।’

সাথে সাথে মুহিত দাঁত কেলিয়ে বলল,’গুড মর্নিং ভাইয়া।’
ইশান ভ্রু নাচিয়ে বলল,’এন্ড মীরা।’
মীরা উওর না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মীরার হয়ে মুহিত বলল,’মীরা আপুর ব্যাড মর্নিং। মাথা ব্যথা করছে তো।’
বলতে বলতে মুহিত চায়ের কাপে চুমুক দেয়।ইশান কিছু বলল না। পিহু ইশানের মাথায় হাত রেখে বলল,’কি খাবি??বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে এসেছিস??’
ইশান মাথা নাড়িয়ে কিছু বলার আগেই মীরা বলল,’আমাদের বাড়িতে ওয়াইন বা বিয়ার কিছুই নেই। গরীব মানুষ তো বড়লোকদের পানিয় আমাদের বাড়িতে থাকে না।’
মীরার কথা শুনে ইশান তব্দা খেয়ে গেল। মীরা যে ওর হাঁটে হাড়ি ভেঙ্গে দেবে এটা শিওর ইশান। পিহু অবাক হলো বলল,’কি??ইশান বিয়ার খায়??’

ইশান পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’না আম্মু তুমি মীরার কথায় কান দিও না। আমি চা খাব।’
পিহু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আগে চা দিচ্ছি তারপর মীরার থেকে সব শুনব।’
পিহু চলে যেতেই ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’কি করলি তুই??? সবেমাত্র আম্মুর কাছে এসেছি আর তুই তাড়িয়ে দিতে চাইছিস??’
মীরা কিছু বললো না। চুপচাপ নিজের চা শেষ করে উঠে দাড়ালো। এবার একটু শান্তি হচ্ছে।চা খাওয়ার সাথে সাথে মাথাব্যথা গায়েব তার। কাপ নিয়ে উঠে যেতে যেতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,’খিচুড়ির সাথে ডিম ভাজা খাবি??’

‘অবশ্যই।’ মুহিত ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি খাবেন ভাইয়া। আমার বউ কিন্তু খুব ভালো ডিম ভাজে।’ বলেই হাসতে লাগলো মুহিত। ইশান কিছুক্ষণ মুহিতের দিকে তাকিয়ে রইল। বউ কাকে বলছে মুহিত??আর ভালো ডিম ভাজতে তো যে কেউ পারে এতে এত প্রশংসা করার কি আছে?? মীরা ততক্ষণে চলে গেছে। ইশান কি খাবে না খাবে তা নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। ইশানের জন্য তো পিহু আছে।
ইশান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’বউ কে??’
‘কে আবার ওই যে চায়ের কাপ নিয়ে গেল। আমার সিনিয়র বউ।’
ইশান একটু নড়েচড়ে বসে বলল,’তা বউ হলো কবে থেকে??’
মুহিত সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছে। তাই মনে মনে আমরা বিয়েও করে ফেলেছি। এতদিন তো মনে মনেই সংসার করলাম। এখন সত্যি সত্যি সব করবো।’

মুহিতের কথা শুনে ইশানের রাগ হলো। এইটুকু ছেলের মুখের বুলি দেখো। যেন ত্রিশ বছরের ব্যক্তি। আবার সে মীরাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। ইশান বিড়বিড় করে বলল,’তোর সংসার করা জনমের তরে ঘুচিয়ে দেবো।’
মুহিত কান পেতে শোনার চেষ্টা করে বলল,’কি বললেন শুনতে পাচ্ছি না।’
‘বয়স কত তোর??এই বয়সে বিয়ে??’
মুহিত ভাব নিয়ে বলল,’বয়স সতের এজন্য তো অপেক্ষা করছি। আর চার বছর যেতে দাও তারপর হবে।’
‘তারপর কি হবে??’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৪

‘আমার বিয়ের বয়স হবে। তারপর সিনিয়র বউকে বিয়ে করে সুন্দর সংসার পাতবো।’
ইশান নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলল,’জাস্ট কুল ইশান। এই পাগলের প্রলাপ তো শুনলে চলবে না তুই যে জন্য এসেছিস সেটা কর।’
এসব কথা সে মনে মনে আওড়াচ্ছে। তবে মুখে বলল,’তোর বিয়ের বয়স হতে হতে মীরার বিয়ে হয়ে এক হালি বাচ্চা হয়ে যাবে।’

এক হালি শব্দটা আবারো মুহিতের মস্তিষ্কে ধাক্কা খায়। এর আগেও ইশান এক হালি ভালোবাসার কথা বলেছিল আর এখন এক হালি বাচ্চা?? কিন্তু মুহিত কিছু বলার আগেই পিহু চা নিয়ে হাজির হয়। তাই মুহিত চুপ করে গেল। তবে সে ভেবে নিয়েছে যে এরপর সব ইশানের থেকে জেনে ছাড়বে।
ডিম ভেজে টেবিলে সাজিয়ে মীরা সবাইকে খেতে ডাকলো। মুহিত দৌড়ে গিয়ে মীরার পাশে বসলো। আর ইশান পিহুর সাথে বসলো। ইশানের কেন জানি মুহিতকে সহ্য হচ্ছে না। কত সুন্দর ক্লোজ সে মীরার সাথে।অথচ মীরা ইশানের সাথে একটু হেসে কথাও বলেনি কখনো। মীরা আর মুহিত এটা ওটা বলছে আর খাচ্ছে। এটা দেখে ইশানের আরো রাগ হলো তবে তা প্রকাশ করলো না। আপাতত চুপ থাকাটাই বেটার।

ইশানের ভাবনার মাঝেই পিহু বলে উঠলো, ‘ইশান তোর বাবাকে বলিস সে যেন তোর দাদা দাদির কেসটা তুলে নেয়।’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৬