অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৬ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৬
Ishita Rahman Sanjida

পিহুর এহেম কথায় ইশান খাওয়া বন্ধ করে দিল। প্লেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমনিতেও খিচুড়ি খেতে ওর ভালো লাগছে না। অনেক দিন না খাওয়ার ফলে অভ্যাস নেই। তবুও সে অনেক কষ্টে খাচ্ছিল কিন্তু পিহুর কথায় আটকে গেল ইশান। বলল, ‘এখনও তো আরও একটা কেস করা বাকি তুমি এখনই কেস তুলতে বলছো!!’
ইশানের কথায় পিহু অবাক হয়ে বলল,’কেস করা বাকি মানে??’

ইশান পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেলো। তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’মানে আব্বু তো কেস করেছে এখন আমার কেস করা বাকি।’
‘এভাবে বলতে হয়না ইশান ওনারা তোমার দাদা দাদী হন।’
‘সেজন্যই তো কম করছি তা না হলে তো!!!’
পিহু কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল,’তাহলে কি??’
‘কিছু না। এতদিন পর আমি আবার তোমার কাছে ফিরে এসেছি। এখন এসব বলার সময় নয়। আমি তোমার কাছে এসব কথা বলতে আসিনি।’

মুহিত পিহু আর ইশানের কথা শুনে মীরার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,’ইশান ভাইয়া এসেছে এখন তুমি আউট। দেখবে ইশান ভাইয়া তোমাকে আন্টির কাছে ঘেঁষতে দেবে না। ডোন্ট ওয়ারি আমি আছি তো। এই কয়দিন তুমি আমার সাথে সময় কাটাবে। আফটার অল জুনিয়র হাজবেন্ড।’
মীরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’তুই আবার শুরু করেছিস চুপ যা।’
‘ওকে ওকে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মীরা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। এখানে থাকলে মুহিত ওর মাথা চিবিয়ে খাবে তাই মীরা উঠে গেল। মীরা হাত ধুয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রেডি হয়ে বের হলো মীরা। ইশান আর মুহিত সোফায় বসে টিভি দেখছিল। মীরা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে পিহুর রুমে গেল। পিহুর থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়। মীরা যেতে নিলে ইশান ডেকে উঠলো,’কোথায় যাস মীরা??’
মীরা কথা বলল না চুপচাপ জুতো পরতে লাগলো। ইশান আবার জিজ্ঞেস করতেই মুহিত বলল,’আরে আমি বলছি। বউ কই যাও??’

মীরা বলল,’ভার্সিটিতে, কিছু কাজগপত্র আনা লাগবে। মাস্টার্স এ ভর্তি হবো তো তাই।’
ইশান চট করে দাঁড়িয়ে বলল,’আমি যাবো।’
‘কেন??’
‘একটু ঘুরে আসতাম ওই আরকি।’
‘আমি কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি। আপনার যাওয়ার দরকার নেই।’
পিহু রুম থেকে বের হতে হতে বলল,’যেতে চাইছে যখন নিয়ে যা না??একটু ঘুরে আসুক।’
মীরা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছু বলল না। মুহিত বলল,’আমি ও যাবো।’
ইশান এটার ভয়ই পাচ্ছিল। এই মুহিত ওর পিছু ছাড়বে না দেখছি। ইশান মুচকি হেসে বলল,’ছোট মানুষের কোথাও ঘুরতে যেতে নেই। তুই আম্মুর কাছে থাক। আসার সময় তোর জন্য চকলেট নিয়ে আসবো কেমন??’

ইশান মুহিতের গাল হাল্কা টেনে চলে গেল। মুহিত বোকার মতো চেয়ে রইল। ও তো এতোই ছোট নয় যে ওর জন্য চকলেট আনতে হবে। নিশ্চয়ই ইশান ওকে নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু কেন?? কিছু তো গন্ডগোল আছে!!মুহিত মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগলো। ততক্ষণে মীরা বের হয়ে গেছে। ইশানও ছুটলো মীরার পিছু পিছু।
ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে মীরা সাথে ইশানও। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাবে। তারপর ওখান থেকে বাসে করে ভার্সিটিতে যাবে। ইশান হাঁটতে হাঁটতে বলল,’তুই তখন আমার কথার উত্তর কেন দিলি না??’
মীরা কথা বলল না। ইশান আবারো বলল, ‘মুহিত যা জিজ্ঞাসা করে তারই উওর দিস। তাহলে আমার বেলা কেন দিস না??’

মীরা সামনের দিকে চোখ রেখে বলল,’আমার ইচ্ছা আর কিছু??’
‘অনেক কিছু। মীরা আম্মুকে একটু বল না??আ’ম শিওর তুই বললে আম্মু সত্যি সবটা মেনে নেবে। প্লিজ মীরা।’
মীরা হাটা থামিয়ে দিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আপনার মা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। আর রাস্তায় এসে এসব বলার মানে কি??’
‘ওকে ওকে আর বলব না।’

মীরা আবার হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। ইশান চুপ থাকতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে। বাস ও এসে গেছে। কিন্তু বাসের সিট বুকিং হয়ে গেছে। লোকাল বাস তাই গাদাগাদি বেশি। এই বাসে না গেলে দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারবে না। বাসে ঝুলানো হ্যাঙ্গার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। কিন্তু সমস্যা হলো ইশানের। সে তো জীবনেও এই লোকাল বাসে ওঠেনি। তাই ইশানের অবস্থার দফারফা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সে ঘেমে গেছে। শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে তার। ইশান চারিদিকে চোখ বুলায়। একজনের কোলে দুজন বসা প্রায় সিটেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মীরার পিছনেই দাঁড়িয়েছে সে। ইশান অসহায় মুখ করে বলল,’তুই কোথায় নিয়ে এলি আমাকে?? আমার তো দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

মীরা খানিকটা হেসে বলল,’আমরা আপনাদের মতো বড়লোক নই যে গাড়িতে করে চলাফেরা করব। তাই এটাই আমাদের চলাচলের উপযোগী।’
ইশান উপরের দিকে তাকিয়ে বলল,’আল্লাহ রক্ষা করো।’
বলতে বলতেই বাস চলতে শুরু করলো। এতে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রিরা পেছনে হেলে পড়লো। হ্যাঙ্গার ধরে না থাকায় ইশান গিয়ে পড়লো ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির ওপর। মীরা তা দেখে হেসে ফেললো। ইশান ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে বলল,’সরি সরি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি।’
‘সমস্যা নেই। ঠিক মতো দাঁড়ালে এরকম হতো না।’

মীরা পিন্চ মেরে বলল,’ফার্স্ট টাইম লোকাল বাসে তো তাই টাল সামলাতে পারছে না।’
‘কি!!! মানুষ ফার্স্ট টাইম প্লেনে ওঠে, জাহাজে ওঠে আর ইনি লোকাল বাসে??হাস্যকর ব্যাপার।’ বলেই লোকটা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মীরা ঠোঁট চেপে হাসছে। আর ইশানের অবস্থা বেহাল। না পারছে নড়তে না পারছে এখান থেকে বের হতে। বাসের ভেতর কোলাহল। আর চারিদিক থেকে গন্ধ আসছে।একটু পর পর বাস থামছে আবার চলছে। ইশান এতে বিরক্ত। তবুও কিছু করতে পারছে না সে।

কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষে। সাথে সাথে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ে। মীরা সামনে থাকা ব্যক্তির উপর পড়ার আগেই ইশান ধরে ফেলে মীরাকে। মীরা ইশানের দিকে তাকাতেই চট করে মীরাকে ছেড়ে দিল। সব যাত্রীরা ড্রাইভারকে বকতে লাগলো এত জোরে ব্রেক কষার কারণে। শুরু হয়ে ঝগড়া। ইশানের এবার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। এই বুঝি সে জ্ঞান হারাবে। পিছনে তাকিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো মীরা নেই। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে মীরাকে খুঁজলো ইশান। পেয়েও গেলো। ইশান আবারো মীরার পেছনে পেছনে হাঁটা ধরেছে। ভার্সিটিতে গিয়ে দেখলো স্টুডেন্টস দের ভিড়। সবাই একই কাজে এসেছে। মীরা ভেতরে যাওয়ার আগে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’বাইরে অপেক্ষা করুন। ভেতরে এসে যদি কোন গোলমাল করার চেষ্টা করেছেন তো??’

‘কুল কুল মীরা। আমি ওয়েট করছি।’
মীরা চলে যেতে নিলে ইশানের ডাকে আবার ফিরে তাকালো। ইশান মুখে হাসি নিয়ে বলল, ‘সবসময় এতো রাগি রাগি ভাব নিয়ে থাকিস কেন??একটু হাসতেও তো পারিস। রাগলে তোকে সুন্দর দেখায় কিন্তু হাসলে তোকে আরো সুন্দর দেখায় এটা কি জানিস তুই??’
‘নাহ আমি আয়না দেখি না তো তাই জানি না। এরপর আয়নার সামনে হেসে দেখবো কেমন দেখায় আমাকে!!’
মীরা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। ইশান মীরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, ‘কবে যে সব ঠিক হবে??’

মীরা চলে গেল। ইশান পুরো ভার্সিটিতে চোখ বুলায়। ওর ভার্সিটির কাছে এটা কিছুই না। ইশান গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে ফোন ঘাটা ঘাটি করতে লাগলো। আর এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। সব কাগজপত্র আনতে প্রায় দেড় ঘন্টার বেশি সময় লাগলো। ভিড়ের মধ্যে এটা এতো সহজ কাজ নাকি?? তিনতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছাড়লো মীরা। তৎক্ষণাৎ ওর চোখ গেল ইশানের দিকে। বেঞ্চিতে বসে আছে ইশান। সামনে দুটো মেয়ে দাড়িয়ে আছে। একজন ইশানকে পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। ইশান ও ভদ্রতার খাতিরে পানি নিচ্ছে। মীরা কিছুক্ষণ ইশানের দিকে তাকিয়ে রইল। গরমে অস্বস্তি লাগছে মীরার। মীরা আস্তে করে নেমে পড়লো। ইশানকে রেখেই ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেল।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,’থাকুক মেয়ে নিয়ে। ইশশ ভদ্রলোক। মেয়েদের দিকে তাকায় না। এখন দেখ রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে।’

বলতে বলতেই মীরার সামনে একটা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ালো। মীরা বুঝতে পারলো না যে কার গাড়ি এটা। জানালার কাঁচ নামতেই ইফাজকে দেখলো মীরা। ইফাজকে দেখে অবাক হলো মীরা। ইফাজ বলল,’ইশান তোমাদের বাড়িতে মীরা??’
মীরা একবার ভার্সিটির দিকে তাকিয়ে আবার ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’হুম।’
‘আসলে সেই সকালে বেরিয়েছে গাড়ি নিয়ে। ড্রাইভার ফিরে এসেছে কিন্তু ইশান আসেনি। সিমটাও চেঞ্জ করেনি যে ফোন করবো।’

‘ইশান আমাদের বাড়িতেই আছে।’
‘এখানে কেন এসেছো কোন কাজে??’
‘ভার্সিটিতে এসেছিলাম কাজে।’
‘চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।’
রৌদ্রে মীরা ঘামছে। কপালের ঘাম মুছে সে বলল,’নাহ আমি চলে যেতে পারবো।’
ইফাজের জোরাজুরিতে মীরাকে উঠতে হলো।
মীরা মনে মনে ভাবছে ইশানকে তো ফেলে এসেছে বাড়ি চিনে ফিরতে পারবে তো??ফেলে এসে কোন ভুল করলো না তো?? কিন্তু ইফাজকে কিছু বলল না মীরা। ইফাজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,’ইশান কি আজকে ওর মায়ের কাছে থাকবে??’
মীরা মাথা নাড়িয়ে বলল,’জানি না।’

ইফাজ ওর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটা তো প্রায় বাজতে চলল চলো একসাথে লাঞ্চ করি।’
ইফাজের কথায় মীরা অবাক হয়ে গেল। ইফাজ ওকে লাঞ্চের জন্য অফার করছে!! মীরা বলল,’বাড়িতে গিয়ে মনি’মায়ের সাথে খাব। আমার জন্য মনি’মা অপেক্ষা করবে।’
ইফাজ সামনে চোখ রেখেই বলল,’পিহুর জন্য প্যাক করে নিয়ে যেও। এতে পিহু রাগ করবে না আমি যতদূর জানি।’
মীরা কি বলবে ভেবে পেলো না। ইফাজ একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে গাড়ি থামালো। গাড়িতে থাকতেই মীরা পিহুকে ফোন করে জানালো ওর আসতে দেরি হবে।
খাবার অর্ডার দিয়ে ইফাজ মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছো মীরা??’
মীরা ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’এসব বলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছেন??’
‘নাহ তবে জানতে ইচ্ছে করলো।’

‘সতের বছর যেভাবে থেকেছেন আশাকরি বাকি জীবনটা সেভাবেই থাকতে পারবেন।’
মীরার কথা শুনে ইফাজ হাসলো বললো, ‘অসুস্থ থাকলে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। সুস্থ মানুষ কখনোই হসপিটালে থাকতে চায় না। আমার ও সেরকমটাই হয়েছে। এতদিন ভুল নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে হয়ে সেরকম হসপিটালে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু এখন আমার সেই রোগ সেরে গেছে। তাইতো বাড়ি ফিরতে চাইছি।’

ইফাজের কথায় মীরা অনেক বেশি অবাক হলো। এভাবে যে ইফাজ ব্যাপারটা বোঝাবে তা ভাবেনি মীরা। মানুষের ভুল টা অনেকটা রোগের মতোই। কিছু ভুল সর্দি কাশির মতো দুদিনেই ঠিক হয়ে যায়। আর কিছু ভুল ক্যান্সারের মতো যা আজীবন থেকে যায়। এই ভুল নামক রোগ থেকে বের হওয়া যে খুব কঠিন কাজ। মীরা টেবিলের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে লাগলো। ইফাজ মীরাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল,’সরি মীরা আমি একটু বেশি বলে ফেললাম। চলো লাঞ্চ সেরে ফেলি।’

মীরা মাথা নাড়লো। চুপচাপ খেয়ে সে উঠে পড়লো। ইফাজ মীরাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। বাড়িতে এসে মীরা ইশানকে খুঁজল নাহ নেই তাহলে কি ইশান আসেনি??বাড়িতে চলে যায়নি তো??হবে হয়তো। ইফাজ খাবার প্যাকিং করেই দিয়েছিল। মীরা পিহুকে দিয়ে গোসলে চলে যায়। গোসল করে আসতেই পিহু বলল,’ইশান কোথায়??তোর সাথেই তো গেল। তোর এতো দেরি হলো কেন??আর এই খাবার কোথা থেকে এনেছিস??’

মীরা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, ‘তোমার ছেলে চলে গেছে। আর ভালো আব্বু আমাকে আজ লাঞ্চ করতে নিয়ে গেছিলো। আমি যেতে চাইনি জোর করে নিয়ে গেছে। আর তোমার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে।’
মীরার মুখে ভালো আব্বু ডাকটা শুনে পিহু অবাক হলো। কতদিন পর মীরা এই নামে ইফাজকে ডাকলো। পিহুর মধ্যে একটু ভালো লাগা কাজ করলেও তা উবে গেল ইফাজের দেওয়া খাবারের প্যাকেট দেখে কটাক্ষ করে বলল,’তুই গিয়েছিস ভালো কথা আমার জন্য কেন এনেছিস??আমি খাবো না। তাছাড়া আমি রান্না করেছি।’

মীরা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমি রান্না করেছো কেন??’
‘তুই তো বললি তোর আসতে দেরি হবে তাই রান্না করেছি।’
‘থাক তোমার খেতে হবে না যা রান্না করেছো তাই খেও‌।’
পিহু চলে গেল। মীরার আনা খাবারের প্যাকেট ফ্রিজে রেখে দিলো। ওদিকে মীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পিহু আর মীরাকে ডাকলো না। খেয়ে সেও বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

মীরার ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। মীরা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইফাজের কন্ঠস্বর ভেসে এলো,’মীরা ইশান কোথায়?? এখনও তো বাড়ি ফিরলো না। আজকে কি তোমাদের ওখানে থেকে যাবে??তা না হলে আমি গাড়ি পাঠাবো ওকে আনতে।’
মীরাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ইফাজ ওর ফোন নাম্বার নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইফাজের কথা শুনে মীরার মাথা ঘুরে গেল। চট করে ওর ঘুমঘুম ভাব কেটে গেল। কান থেকে ফোন সরিয়ে দেখে নিলো কত বাজে!!ছয়টা প্রায় বেজে গেছে। মীরা দ্রুত খাট থেকে নেমে পুরো বাড়িতে চক্কর দিলো। নাহ ইশান কোথাও নেই তাহলে কি ইশান পথ হারিয়ে ফেলেছে? মীরার এবার টেনশন হচ্ছে। ওভাবে ইশানকে না ফেলে এলেই ভালো হতো। রাস্তাঘাট তো চেনে না। মীরা কিছু একটা বলে ফোন কেটে দিল। কোনরকম রেডি হয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল। পিহুকেও কিছু বলল না।

মীরা রাস্তায় গিয়ে ভাবতে লাগলো যে ইশান কোথায় থাকতে পারে??কিছু একটা ভেবে মীরা ভার্সিটিতে গেল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে। গেইট নিশ্চয়ই আটকে দিয়েছে। তবুও মীরা সেখানেই গেল। কেন যেন মীরার মনে হচ্ছে ইশান ওখানেই আছে। রিকশা থেকে নেমে ভার্সিটির দিকে এগিয়ে গেল সে। দারোয়ান কাকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাকা গুনছে। মীরা এগিয়ে যেতেই দারোয়ান কাকা দাঁত কেলিয়ে বলল,’তুমি এসেছো!!যাও ভেতরে যাও।’

মীরা অবাক হলেও কিছু বলল না। দারোয়ান এমন ভাবে ওকে স্বাগতম জানাচ্ছে যে মীরা বোধহয় কোন প্রেসিডেন্ট। মীরা দ্রুত ভেতরে গেল। লাইটের আলোয় চারিদিক মুখরিত। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে সেই বেঞ্চির কাছে গিয়ে দেখলো ইশান বসে আছে। মীরাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। ইশানের চোখেমুখে ক্লান্তি তবে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। মীরা কিছুক্ষণ ইশানের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি বড্ড বেশি করে ফেলছে সে। তবে মীরা কি জানতো যে ইশান বাড়িতে না ফিরে এখানেই বসে থাকবে??
তাহলে তো ওকে রেখে যেতো না। মীরা কন্ঠস্বর নিচু করে বলল,’সরি। আমার এমন করা উচিত হয়নি।’

মীরার মুখে সরি শুনে ইশানের সব ক্লান্তি গায়েব হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এতক্ষণ কষ্ট করে কেষ্ট মিলে গেছে ওর। ইশান মীরার দিকে এগিয়ে এসে বলল,’তুই আমাকে সরি বললি!! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
ইশানকে উত্তেজিত হতে দেখে মীরা বলল, ‘এতো লাফালাফি করার কি আছে??সরি ই তো বলেছি ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড তো দেইনি। আর এখানে থাকার মানে টা কি?? বাড়িতে কেন গেলেন না?? আমাকে চিন্তায় ফেলতে ভালো লাগে আপনার??’

ইশান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’তার মানে আমার জন্য তোর চিন্তা হয়!!’
মীরা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,’যেহেতু আমি নিয়ে এসেছিলাম দায়িত্ব তো আমার। এখন চলুন রাত হয়ে গেছে আপনার বাবা ফোন করে যেতে বলেছে।’
বলেই মীরা হাঁটা ধরলো। ইশান পিছু পিছু যেতে লাগলো। ইশান হাঁটতে হাঁটতে বলল,’আমি জানতাম তুই আসবি। আমি এটাই দেখতে চেয়েছিলাম যে আমার প্রতি তোর দূর্বলতা ঠিক কতটুকু!!!’
মীরা থেমে গেল ইশানের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,’তাই?? তাহলে কি বুঝলেন??মানে আমার দূর্বলতা কতটুকু??’

‘বুঝতে পারছি না। তবে মনে হয় থার্টি পার্সেন্ট। আচ্ছা মীরা আমার প্রতি কি তোর কোন ফিলিংস নেই???’
‘সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না বা প্রকাশ করতে হয় না। চাপা রাখাটাই বেটার।’
‘তার মানে আমার প্রতি তোর অনুভূতি আছে এবং তুই তা প্রকাশ করতে চাইছিস না।’
মীরা খানিকটা হাসলো বলল,’সেটা আপনার মনে হচ্ছে। কিন্তু কারো অনুভূতি দেখার চোখ নেই আপনার।’
মীরা আবার হাঁটতে লাগলো। ইশান বলল, ‘অনুভুতি বোঝার চোখ নেই আমার!! তুই কিভাবে জানলি??’
‘ওভাবেই।’

‘ওভাবে কিভাবে?? আচ্ছা বাদ দিলাম। মানলাম আমী কারো অনুভুতি দেখতে পাই না কিন্তু তুই?? তুই কেন আমার অনুভূতি দেখতে পাচ্ছিস না??’
মীরা ঘাবড়ে গেল।ইশান ওকে প্রতিটা কথায় আটকে দিচ্ছে। মীরা বলল,’আপনি তো লন্ডনের অনেক মেয়ের ক্রাশ অনেক মেয়েরা ভালবাসে আপনাকে তাহলে তাদের অনুভূতি কেন দেখেন না??’
ইশান হেসে বলল, আমার অনুভূতি সব একজনের মধ্যে আটকে গেছে তাই ওদের অনুভূতি দেখার ইচ্ছা নেই আমার।’
‘আমারও ইচ্ছা নেই কারো অনুভূতি দেখার।’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৫

ইশান কিছু বলতে যাবে তার আগেই মীরা ইশানকে ইশারা করলো রিকশায় উঠতে। সামনে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। মীরা আর ইশান রিকশায় চড়ে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে পৌঁছে যায় ওরা। কলিং বেল চাপতেই মুহিত এসে দরজা খুলে দিল। ইশান হতাশ হলো মুহিতকে দেখে। বিড়বিড় করে বলল,’এই বাচাল কি আমার পিছু ছাড়বে না।’
মুহিতকে দেখে মীরা বলল,’তুই এখানে কি করছিস??আন্টি তোকে আসতে দিলো??’
মুহিত বলল,’ইশান ভাইয়ার কথা বলে এসেছি। বলেছি ভাইয়া আমাকে আসতে বলেছে।’
ইশান অবাক হয়ে বলে,’আমি কখন বললাম এসব??’

‘এটা তো মিথ্যা কথা। আজকে তোমার থেকে এক হালি ভালোবাসার মানে বুঝবো। চলো চলো।’
মীরা নিজের রুমে চলে গেল। ইশান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। একে তো এক বিপদে আছে আর এই বাচালটা ওর পিছনে পরেছে। এটাকে যে কিভাবে সরাবে তা ভেবে পাচ্ছে না ইশান। খুব ক্লান্ত ইশান তাই সোফায় দু’পা তুলে বসতেই মুহিত হুড়মুড়িয়ে ওর পাশে এসে বসে।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১৭