অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৫ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৫
Ishita Rahman Sanjida

লন্ডন উওর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের রাজধানী শহর। শহরটি গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ইংল্যান্ড নামক প্রশাসনিক বিভাগের টেমস নদীর তীরে অবস্থিত। রাতের লন্ডনকে এক স্বপ্নের শহর মনে হবে। কোথাও এতটুকু অন্ধকার নেই। সবখানে কৃত্রিম আলোতে পরিপূর্ণ। যেকোন বাংলাদেশি প্রথমবার লন্ডন গেলে অবাক হয়ে যাবে। কারণ এত সাজসজ্জা আমাদের বাংলাদেশে নেই। ইশান ও অবাক হয়েছিল এতসব দেখে।

শীতের সময় যখন স্নো ফল হতো তখন ইশান খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়তো। কিন্তু এখন সে এতে অভ্যস্ত। লন্ডন থাকতে থাকতে সে বাংলাদেশের চেহারা ভুলে গেছে। এখন যদি সে বাংলাদেশে যায় নির্ঘাত হারিয়ে যাবে। ভেনিসে সে বাবার সাথে থাকে।
এখানে ইফাজের বড় একটা দোতলা বাড়ি আছে। পরিবার সহ সে এখানেই থাকে। এই সতেরো বছরে তার অনেক নাম ডাক হয়েছে। ভেনিসের সবাই ইফাজকে এক নামে চেনে। বড়বড় বিজনেসম্যানদের সাথে তার ওঠাবসা। সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে সে। অফিস থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে অফিস।

অনেক রাত করে বাড়ি ফেরার দরুন ইফাজ এখনও ঘুমাচ্ছে। এলার্ম ঘড়িটা শব্দ করেই যাচ্ছে। ইফাজ একহাতে সেটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আজকে সে হাঁটতে বের হবে না খুব ক্লান্ত সে। একটু পরেই ইশান এলো। ইশান ইফাজকে ডাকতে সে বলল যাবে না। তাই ইশান একাই বেরিয়ে পড়লো। কানে ইয়ারফোন গুজে দৌড়াতে লাগল রাস্তায়। শুধু ইশান নয় আরও অনেকে বের হয় দৌড়াতে। ইশান একটা হাতাছাড়া গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরেছে। জিম করা সিক্স প্যাক বডি ফর্সা শরীর তার। একদম বাবার মতো সুদর্শন হয়েছে সে। অবশ্য ইফাজ ও এখনও কম সুদর্শন নয়। মেদহীন পেট মাথাভর্তি চুল একদম সুদর্শন যুবকের মতোই দেখতে। শুধু চুলে আর দাঁড়িতে পাক ধরেছে। বাবা ছেলে একজায়গায় দাঁড়ালে কেউ বলবে না যে এরা বাবা ছেলে। এ নিয়ে কম কথা শোনেনি ইফাজ। একথা শুনলেই ইফাজ শুধু হেসেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইশান দৌড়ানোর সময় খেয়াল করলো যে কিছু মেয়েও ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। সবার কাছে এটা সিম্পল হলেও ইশানের কাছে এটা মোটেও সিম্পল নয়। কারণ এরকমটা মাঝে মধ্যেই হয়। এর আগে তো পাঁচটাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল। ইশান হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সাথে মেয়েগুলোও দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইশান যেই মুহুর্তে পিছনে তাকালো অমনি সবগুলো দৌড়ে পালালো। ইশান আবার দৌড়াতে লাগল। লন্ডনের অনেক মেয়েরাই ইশান বলতে পাগল। কেউ কেউ ইশানের সম্পত্তির জন্য আবার কেউ কেউ ইশানের জন্য। তবে আজ পর্যন্ত কেউ ইশানকে সামনাসামনি প্রপোজ করার সাহস পায়নি। তার কারণ হলো গোমড়ামুখো ইশান। কখনোই কেউ ইশানের মুখে হাসি দেখেনি। কেন সে হাসে না সেটা সবার অজানা। এমনকি ইশানের বন্ধুমহলের কেউই মনে করতে পারবে না যে কোনদিন ইশান শেষ হেসেছিল। তবে এবিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে না। এতে ইশান যদি আরো ফুঁসে ওঠে।

তবে ইশানের বন্ধুদের কাছে অনেক মেয়েরাই ইশানের ব্যপারে কথা বলে। মূলত ইশানকে পটানোর জন্য। একবার কয়েকটা মেয়ে লাভ লেখার দিয়েছিল ইশান তখন রেগে গিয়ে ওদের কান ধরে ওঠবস করিয়েছে শুধু তাই না মেয়েগুলোর অর্ধেক চুল পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল। খুব ঝামেলা করেছিল ইশান সেদিন। সেই থেকে প্রপোজ করা তো দূরের কথা কোন মেয়ে ইশানকে গুডমর্নিং পর্যন্ত বলার সাহস পেতো না। শুধু দূর থেকেই আকর্ষণ বিকর্ষণ করে। মেয়েদের কাছে এখন ইশান মানেই বম কাছে গেলেই ঠুস করে ফুটে যাবে।

জগিং শেষে ইশান বাড়িতে ঢুকলো। ইফাজ খাবার টেবিলে বসে আছে। ইশানের জন্যই বসে আছে। ইশান গিয়ে চেয়ার টেনে বসে ইশানের দাদু ও এসেছে কিন্তু দাদি আসেনি। তিনি কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ। রুমে বসেই খাওয়া দাওয়া করে। ইফাজ নিজ হাতে ইশানের প্লেটে খাবার তুলে দেয়। শত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও ইশানকে সে ঠিকই সময় দেয়। কি আর করবে??মা তো নেই ওকেই সব করতে হয়। ইশান খাচ্ছে আর বারবার ইফাজের দিকে তাকাচ্ছে। ইফাজ বেশ বুঝতে পারছে যে ইশান তাকে কিছু বলতে চাইছে। ইফাজ ইশানকে নির্ভয় দিয়ে বলে,’কি বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমার অফিস আছে।’

ইশান একটু ইতস্তত করে দাদুর দিকে তাকালো তারপর ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’আব্বু আমার স্টাডি তো শেষ। তাই আমি চাচ্ছি,,,’
ইশানকে বলতে না দিয়ে ইফাজ বলল, ‘অফিসে জয়েন হতে চাও??বেশ তো কাল থেকেই না হয়,,,’
ইশান ইফাজকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’না আব্বু আমি অন্যকিছু বলতে চাচ্ছি!!’

ইফাজ হাতের স্পোন প্লেটে শব্দ করে রেখে ইশানের দিকে তাকালো। তারপর বলল,’বলো কি বলবে??’
ইশান ইফাজের চোখে চোখ রেখেই বলল, ‘আব্বু আমি বাংলাদেশে যেতে চাই কিছুদিনের জন্য।’
ইফাজ গম্ভীর মুখে ইশানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,’মায়ের কাছে যেতে চাও??’
ইশান মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বলল,’তাহলে তো আরও আগেই যেতাম। তুমি তো জানো ওনাকে আমি ঘৃণা করি। উনি কিছুতেই আমার মা হতে পারে না। আমি অন্য কারণে যেতে চাই।’
‘যতোই হোক পিহু তোমার মা। মায়ের নামে বাজে কথা তোমার মুখে মানায় না।’

ইশান ইফাজের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তোমার তো স্ত্রী। তাহলে তুমি কেন তাকে ঘৃণা করো??কেন তাকে ছেড়ে এতো বছর ধরে এখানে পড়ে আছো??কেন সেদিন ডিভোর্স পেপারে সাইন করলে??’
‘ইশান,,,’ ইফাজ রেগে বলতেই ইশান খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর বলল,’আমি তোমার ছেলে। তোমার রক্ত আমার শরীরে বইছে। তাই জেদটা তোমার মতো। তবে আমার মনে হয় আমার জেদটা তোমার থেকেও বেশি। তুমি সেদিন নিজের জিনিস ফেলে এসেছো কিন্তু আমি সেটা করবো না। আমার জিনিস আমার চাই সেটা যেকোন মূল্যে হোক। আমি পরের মাসে বাংলাদেশ যাচ্ছি। দ্যাটস ফাইনাল।’
ইশান নিজের রুমে চলে গেল। ইফাজ ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। কি এমন ফেলে এসেছে সে বাংলাদেশে যা আনা এতো জরুরী??আর এতো দিন পর মনে পড়লো সেই জিনিসের কথা??

ইফাজের এখানে কিছু করার নেই। একরোখা হয়েছে ইশান যা বলে তাই করে ছাড়ে। মা না থাকলে যা হয় আরকি!! কিন্তু ইফাজের চিন্তা যদি ইশান বাংলাদেশে যায় এবং পিহুর মুখোমুখি হয় তাহলে তো কেলেংকারি হয়ে যাবে। যা নয় তা বলবে পিহুকে সে। কিন্তু ইফাজ জানে না যে মীরা আছে পিহুর সাথে। ইশান যদি ঘুর্ণিঝড় হয় তো মীরা সাইক্লোন। ওদের দুজনের মুখোমুখি সংঘর্ষে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।

ইফাজ খাবার টেবিল ত্যাগ করে অফিসে চলে গেল। ইশান নিজের রুমে রেডি হচ্ছে। গায়ের গেঞ্জি খুলে শার্ট পড়ে বোতাম লাগাতে গিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। ঘাড়ের কাছের দিকটায় আলতো করে হাত বুলালো। এখানেই তো মীরা জোরে কামড়ে দিয়েছিলো। তিনদিন পর্যন্ত জায়গাটা লাল হয়ে ছিলো। ইশান মীরার রং পেন্সিল গুলো থেকে একটা পেন্সিল না বলে নিয়েছিল। তাতেই মীরা ওকে চোর বলে আখ্যায়িত করে তার শাস্তিস্বরূপ কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। তবে দাগটা নেই। সময়ের সাথে সাথে তা মিলিয়ে গিয়েছে।

পুরোনো কথা মনে পড়তেই ইশানের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। এই হাসি ইশানের আয়না আর ইশান ই দেখলো শুধু। এমনকি ইফাজ ও কখনো ইশানকে হাসতে দেখেনি। রেডি হয়ে ইশান বেরিয়ে গেল। সারাদিন লন্ডন শহর ঘুরে রাতে বাড়িতে ফেরে সে। এটাই হলো ইশানের প্রধান কাজ।

ইফাজ অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে। ফাইলপত্র সব একপাশে ফেলে পিহুর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। গোলাপি রঙের শাড়ি আর খোপায় গোলাপ লাগানো। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে পিহু। শাড়িটা ইফাজ কিনে দিয়েছিল ওদের তৃতীয় তম বিবাহ বার্ষিকীতে। আজ এতো বছর পরও ইফাজের স্পষ্ট মনে আছে। অল্প বয়সী পিহুকে সেই সাজে এখনও অপরুপ লাগছে। ইফাজ ভাবছে পিহু এখনও আগের মতোই আছে কি?নাকি ওর মতো পিহুর চুলেও পাক ধরেছে??এটা নিয়ে পিহু কতো হাসাহাসি করতো অথচ আজ সত্যি ইফাজের চুলে পাক ধরেছে তা দেখার জন্য পিহু নেই। ইফাজ আজও পিহুকে আগের মতোই ভালোবাসে। যতই রাগ দেখাক না কেন?? ভালোবাসা তো মিথ্যা নয়। পিহুর নেহালের সাথে বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়ই। ছেলে মেয়ে হয়েছে কি??এসব মনে পড়তেই মাথায় আগুন ধরে গেল তার। ছবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। রাগ হচ্ছে খুব এখন। চোখ বন্ধ করে রাগ দমনের চেষ্টায় আছে ইফাজ। আস্তে আস্তে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের কাজে মন দিলো ইফাজ।

আজকের প্রকৃতি যেন খুশির আমেজে মেতে উঠেছে। তাই হালকা বাতাস বইছে আকাশে চাঁদ উঠেছে আর তার সাথে বেলি ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। পিহুর মনটা এতে ভালো হয়ে গেল। জানালার গ্রিল ধরে আকাশের পানে চেয়ে রইল। ইফাজের কাঁধে মাথা রেখে কতদিন চাঁদ দেখেছে সে। কিন্তু এত বছরে সেই ইচ্ছা মরে গেছে। তবে এখন আর পারছে না পিহু ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে ইফাজের কাছে। কিন্তু তা বোধহয় আর সম্ভব হবে না। এটা ভাবতেই পিহুর চোখের কোণে পানি জমে উঠলো। সে খুব করে চেয়েছিল ইশানকে দেখতে। তার ছেলেটা কত বড় হয়েছে তা পিহু দুচোখ ভরে দেখতো। কিন্তু তা আর হবে না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো পিহু। আর একটু পর পর কেশে উঠছে। বেশি কাশির ফলে পেট ও গলা ব্যথা হয়ে গেছে। মীরা পিহুর কাশির শব্দে ওর রুমে আসলো। এগিয়ে এসে বলল,

‘মনি’মা তুমি ওষুধ খাওনি??’
পিহু আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। মীরা ওষুধ হাতে নিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। পিহু চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলো। মীরা আবার বলল,’ভালো ডক্টর দেখাতে হবে তোমাকে। কয়েকদিন যাবৎ কাশি বেড়েই চলছে তোমার।’
পিহু এবার মীরার দিকে ঘুরে তাকালো বলল, ‘আমাকে নিয়ে তোর অতো ভাবতে হবে না। ডক্টর আমি দেখিয়েছি। বয়স হয়েছে অসুখ তো হবেই।’
মীরা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,’কে বলেছে তোমার বয়স হয়েছে?? তুমি তো এখনও যুবতি মেয়ের মতোই রয়েছো। আর বয়সে হলেই বুঝি অসুখ বাড়ে??’

পিহু কিছু বলাই আগেই কলিং বেলের শব্দ এলো। পিহু মীরা দুজনেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। মীরা দরজা খুলতেই দেখলো মুক্তা সামির আর মুহিত এসেছে। মীরাকে দেখেই মুহিত চোখ মারে। মীরাও‌ আগুন চোখে মুহিতের দিকে তাকায়। পিহু মীরাকে নাস্তা রেডি করতে বলে মুক্তা আর সামিরকে নিয়ে রুমে চলে গেল। মুহিত মীরার পেছন পেছন গেল জ্বালাতন করবে বলে।
পিহু মুক্তা আর সামির গম্ভীর মুখে বসে আছে। পিহু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,’আমি চাই খুব শিঘ্রই মীরাকে বিয়ে দিতে। অন্তত বেঁচে থাকতে মীরার বিয়ে দেখতে চাই। মেয়েটাকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে চাই যে আমার মীরাকে সুখি রাখবে।’

সামির চুপ করে আছে কিন্তু মুক্তা পিহুর কথায় একটু বিরক্ত নিয়ে বলে,’এসব কি বলছিস পিহু??সামান্য একটু অসুখেই কি মানুষ মরে নাকি??’
পিহু ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘যেদিন ডাক আসবে সেদিন তো যেতেই হবে।উপরওয়ালা যদি এই অসুখের কারণে আমার মৃত্যু লিখে রাখে তাহলে হবে।’
‘কিন্তু ডক্টর বলেছে অপারেশন করালে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘যদি ঠিক না হয়??আমি যদি মরে যাই??’

‘সবসময় নেগেটিভ চিন্তা কেনো করিস বলতো?? তোকে অপারেশন করাতে হবে। তুই তো ইফাজ আর ইশানকে দেখতে চাস। ওদের সবটা বলতে চাস। তাহলে কেন অপারেশন করাতে চাইছিস না??’
পিহু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,’পৃথিবীর সব মানুষ কোন না কোন অপূর্ণতা নিয়ে দুনিয়া ছাড়ে। কেউ কখনো বলতে পারবে না যে আমি সব পূর্ণতা পেয়েছি। তাহলে আমি এটুকু অপূর্ণতা নিয়ে মরলে সমস্যা কি??’
মুক্তা হতাশ হয়ে বলে,’পিহু এরকম জেদ ধরিস না??’

সামির বলল,’তোমার মীরাকে সবটা জানানো দরকার পিহু। তারপর মীরা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।’
পিহু সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,’নাহ, মীরাকে কিছু জানাবেন না মেয়েটা কষ্ট পাবে।’
সামির‌ আবার বলল,’কিন্তু একদিন না একদিন তো মীরা ঠিকই সব জানতে পারবে তখন কি হবে??’
‘জানি না কি হবে কিন্তু আমরা যতদিন পারব মীরার থেকে সবটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবো। আপনি একটা ভালো ছেলে দেখুন। আমি মীরার বিয়েটা দিয়ে শান্তিতে মরতে চাই।’
মুক্তা আবার বলল,’তোকে অপারেশন করতে হবে নাহলে যদি হিতে বিপরীত হয় তবে তোর বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’

‘আর যদি অপারেশন করতে গিয়ে আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে???’
মুক্তা কিছু বলার আগেই মীরা নাস্তা নিয়ে আসলো। মুক্তা সাথে সাথে স্বাভাবিক হলো। মীরাকে কিছু বলতে গেলেই পিহু চোখের ইশারায় বারবার বারণ করলো তাই মুক্তা কিছু বলল না। মুক্তাকে দেখে মীরার কেমন যেন সন্দেহ হয়। কারণ মুক্তা সবসময় কোন না কোন বিষয়ে রেগেই থাকতো। মুখ দিয়ে তার সবসময় আগুন বের হতো। কিন্তু কয়েকমাস ধরে মুক্তা কেমন পানির মতো হয়ে গেছে। বেশি কথা বলে না কারো সাথে। মীরা এর কারণ বুঝতে পারে না। মুহিতকে জিজ্ঞাসা করলে সেও কিছু বলতে পারে না।

পরেরদিন হসপিটালে এসেছে মুক্তা আর পিহু। মূলত পিহুর চেকআপ করানো জন্য। দিনদিন পিহুর শরীর আরো দূর্বল হয়ে পড়ছে। মীরার থেকে এসব লুকিয়ে রাখা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মীরার বিয়েটা দিতেই হবে। মুক্তা পিহুকে বসিয়ে গেছে রিসেপশনে। পিহু বসে বসে অপেক্ষা করছে। তখনই একটা লোক এসে পিহুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’আপনি পিহু না??’
পিহু চমকে তাকায় লোকটার দিকে। কিন্তু চিনতে পারলো না। লোকটার মুখভর্তি দাড়ি। মাঝেমাঝে কিছু সাদা দাঁড়িও রয়েছে।বয়স যে পন্ঞ্চাশের বেশি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।পিহু দাঁড়িয়ে বলল,’জ্বি আমি পিহু। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না। আপনি আমাকে চেনেন কিভাবে??’

লোকটা স্মিত হেসে বলল,’আপনি হয়তো আমাকে ভুলে গেছেন কিন্তু আমি ভুলিনি। পাপ তো মনে রাখতেই হয়।’
লোকটার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না পিহু। লোকটা আবার বলল, ‘আপনি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারছেন না তাই তো??আমি সবটা খুলে বলি তাহলে। আসলে আমি এখানে এসেছি আমার মেয়ের জন্য। আমার মেয়ে হসপিটালে ভর্তি। সুইসাইড করতে চেয়েছিল সে। তার হাজবেন্ড তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সে আমার মেয়ের সাথে আর থাকবে না বলেছে। এই কষ্ট সে সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে সে।’

পিহু এবারও লোকটার কথা বুঝলো না। কি বলছে এসব?? ওনার মেয়ের গল্প শুনে পিহু কি করবে??ওর তো কিছু করার নেই।লোকটা আবার বলতে লাগলো,’সেদিন ইফাজ ইচ্ছে করে ডিভোর্স পেপার আপনাকে পাঠায়নি!!’
ইফাজের নাম শুনে পিহু চমকালো। এই লোকটা কিভাবে এসব জানে??আর ডিভোর্সের কথা এসব কি বলছে??পিহু জিজ্ঞাসা করল,’আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।’

‘ আমি বলছি শুনুন তাহলে, আমি হলাম সেই উকিল যে আপনার আর ইফাজের ডিভোর্স করিয়েছিল। ইফাজের বাবার কথায় আমি ডিভোর্স পেপার রেডি করে নিয়ে ইফাজকে দিয়ে বলি যে, পেপারটা পিহু মানে আপনি পাঠিয়েছেন। আর তাই ইফাজ সাইন করেছিল। অন্যথায় সে সাইন করতো না। আর তারপর ইফাজের সাইন দেখে আপনি ও সাইন করলেন। এজন্য মোটা অংকের টাকা পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আপনারা দুজন কষ্ট পেয়েছিলেন। আপনারা অভিশাপ না দিলেও আপনাদের চোখের পানি আমাকে অভিশাপ দিয়েছে বলেই আজ আমি এই অবস্থায় পড়েছি।

ডিভোর্সের মানে যে কতটা ভয়ংকর তা আজ বুঝতে পারছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি আপনাদের সাজানো সংসার ভেঙ্গে দিয়েছি। আপনার সাথে যে এত বছর পর এভাবে দেখা হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারিনি। ইফাজের সাথে দেখা করার ইচ্ছা আছে তবে ও তো এখন লন্ডন থাকে। কন্ট্র্যাক করতেও পারছি না।’
পিহুর চোখ থেকে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়লো। বলল,’এখন এসব বলে কি লাভ??যতি সতেরো বছর আগে সব বলতেন তাহলে আমার এই অবস্থা হতো না।’

পিহু আর কিছু বলতে পারলো না। গলায় যেন কাঁটা বিঁধে আছে। তাড়াতাড়ি সে চলে গেল।আর লোকটা পিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। পিহুর লোকটাকে অসহ্য লাগছে। এতদিন পর এসেছে পাপ মোচন করতে। ইচ্ছে করছিল ঠাঁটিয়ে চড় মারতে লোকটার গালে। কিন্তু পিহু তা করলো না। ক্ষমাও করবে না তাকে পিহু। কি ভেবেছে সবাই??পিহু কি ক্ষমার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে নাকি??যে চাইবে তাকে ক্ষমা করে দেবে??পিহু ঠিক করলো আর কাউকে সে ক্ষমা করবে না। আজকাল ঘর ছাড়া বাইরের সবকিছু পিহুর অসহ্য লাগে।

তবে আজকের ঘটনায় পিহু আর মন খারাপ করে বসে রইল না। সে এখন শক্ত হয়ে গেছে। অধিক শোকে সে পাথর হয়ে গেছে।
দুদিন পর সামির একটা ভালো সম্বন্ধ নিয়ে এলো মীরার জন্য। ছেলে ভালো চাকরি করে পরিবার ভালো আর কি চাই??পিহুও রাজি হয়ে গেল। বিকেলে মীরাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। পিহু সকালে মীরার হাত ধরে সবটা বুঝিয়েছে। মীরা তো রাজি হতেই চাচ্ছিল না। মীরার এক কথা সে পিহুকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। পিহু নিজের কসম দিয়ে মীরাকে চুপ করিয়েছে।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৪

বিকেলে মীরাকে পিহু নিজের হাতে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। মুক্তাও চলে এসেছে। সামির আর মুহিত পাত্রপক্ষের সাথে আসবে। পাত্র সামিরের চেনা আত্মিয়দের একজন। মীরার চুল খোঁপা করে দিলো পিহু। কিন্তু সমস্যা হলো খোপায় তো ফুল দিতে হবে নাহলে সুন্দর লাগবে না। পিহুর পছন্দ গোলাপ ফুল। তাই সে মীরার কাছে মুক্তাকে রেখে বেরিয়ে পড়লো গোলাপ কিনতে।

কিন্তু একঘন্টা পার হয়ে গেছে এখনো পিহু আসছে না। মীরার তো চিন্তা হচ্ছে। ওদিকে পাত্রপক্ষ চলে এসেছে। তাদের আপ্যায়ন করছে মুক্তা। কিন্তু পিহু আসছে না কেন??মীরা পিহুকে ফোন দিচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। অনেক বার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ হলো। কিন্তু অপরপাশে থেকে আসা কথাগুলো শুনে মীরার কলিজা শুকিয়ে গেলো। পাত্রপক্ষের সামনে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো মীরা।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৬