অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৬ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৬
Ishita Rahman Sanjida

প্রতিটা মানুষের জীবনে কখনো এমন ঘটনা ঘটে যা মানুষের পৃথিবী থামিয়ে দেয়। যেরকমটা আজ মীরার হয়েছে। স্তব্ধ হয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনের শাড়ির আঁচলটা ফ্লোর ছুঁয়েছে। যত্ন করে বেঁধে দেওয়া খোপাটাও খুলে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে। মীরা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতেছে। কিছু বুঝতে পারছে না সে। তার মনি’মা তো ভালোই ছিল তাহলে হঠাৎ করে কি হয়ে গেল??এরই মধ্যে মুক্তা সামির আর মুহিত চলে এলো। মীরা ওদের সাথে কথা বলল না। একধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।

তখন একটা লোক পিহুর ফোন রিসিভ করে জানায় যে পিহু নাকি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। মীরা তাই ছুটে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে কিছু লোক পিহুকে হসপিটালে নিয়ে আসে। মীরা গিয়ে দেখে রাস্তায় গোলাপের পাপড়ি গুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে। তারপর রক্ত ও আছে। মীরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। ভাবে পিহু বোধহয় এক্সিডেন্ট করেছে। কিন্তু হসপিটালে এসে জানতে পারে যে পিহু এক্সিডেন্ট করেনি। তাহলে কি হয়েছে পিহুর??এটা জানার জন্যই মীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তা সাহস করে আর এগিয়ে গেল না মীরার কাছে।

একটু পর ডক্টর বেরিয়ে আসলো। সে সোজা মুক্তার দিকে এগিয়ে গেল। এবং বলল, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি যে পেশেন্টকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে রাখতে। ওনার শরীরের আরো অবনতি হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে হবে।’
ডক্টরের কথা শুনে মীরার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। মুক্তাকে একটানে সরিয়ে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’কি যা তা বলছেন আপনি??অপারেশন করাতে হবে মানে??কি হয়েছে আমার মনি’মায়ের??’
শেষ কথাটা মীরা চিৎকার দিয়ে বলল। সামির মীরাকে সরিয়ে ডক্টর কে বলল,’এখন পিহু কেমন আছে??’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘কন্ডিশন বেশি ভালো নয়। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল মাথায় আঘাত পাওয়াতে জ্ঞান হারিয়েছে। অক্সিজেন চলছে জ্ঞান ফিরতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগবে।’
‘এখন দেখা করা যাবে।’
‘জ্ঞান যেহেতু ফেরেনি দেখা করে কোন লাভ হবে না। জ্ঞান ফিরুক তারপর না হয় দেখা করেন।’
ডক্টর চলে যেতেই মীরা মুক্তাকে শক্ত করে ধরে বলল,’আন্টি এসব কি বলছে ডক্টর?? আমার মনি’মায়ের কি হয়েছে??তোমরা কি জানো বলো??’
সামির বলল,’মীরা একটু শান্ত হ। এটা হসপিটাল।’
মীরা চিৎকার দিয়ে বলল,’শান্ত হবো না আমি। তোমরা কেন আমাকে কিছু বলছো না??মনি’মায়ের কি হয়েছে বলো না??’

সামির মীরাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আজকে তোকে সব বলব। আর কিছু লুকানোর নেই।’
মীরা সামিরের হাত ধরে বলল,’বলো না আঙ্কেল কি হয়েছে মনি’মায়ের??’
সামির স্বর নিচু করে বলল,’ছ’মাস আগে পিহুর জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়েছে।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে পিছনের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল মীরা। ওর দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গেল। শরীর কাঁপতে লাগলো মীরার। সামির আবার বলতে লাগলো,’পিহু তোকে এসব জানাতে বারন করেছে। তাই আমি আর তোর মুক্তা আন্টি তোকে কিছু জানাইনি। কিন্তু সবসময় পিহু তোর থেকে এসব আড়াল করে রাখতো। প্রায়ই এই কারণে পেটে ব্যথা হয় পিহুর। শরীর দূর্বল হলেও তোকে বুঝতে দিতো না। ডক্টর তাড়াতাড়ি অপারেশন করাতে বলেছিল। কিন্তু পিহু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। আজ হঠাৎ করে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

মীরার স্থির চোখজোড়া দিয়ে পানি পড়তেছে। দেহের সব ভার ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো মীরা। চিৎকার করে কাঁদার আগেই মুক্তা ওর মুখ চেপে ধরে বলল,’হাসপাতালে এভাবে কাদিস না। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা কর মীরা।’
মীরা মুখে হাত দিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু পারছে না। মুক্তাকে শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।!!মন শান্ত হচ্ছে না ওর। চিৎকার দিয়ে কাঁদলে হয়তো মনটা শান্ত হতো। কষ্ট হচ্ছে মীরার খুব। বাবা মায়ের জন্য এভাবে কাঁদেনি মীরা। বাবাকে তো জন্মের পর দেখেনি। মায়ের ভালোবাসা তো স্বল্প সময়ের জন্য পেয়েছিল। কিন্তু পিহু ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়েছে। সতেরো বছর ধরে আগলে রেখেছে। কষ্ট তো হবেই মীরার।

মেঝেতে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিহুর কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল মীরা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। পিহু বেডে টান হয়ে শুয়ে আছে। হাতে ক্যানেলা আর মুখে অক্সিজেন মাস্ক। পিহুকে দেখে আরো কাঁদতে ইচ্ছে করছে মীরার। মীরা তবুও নিজেকে সামলিয়ে টুল টেনে মীরার পাশে বসল। ক্যানেলা লাগানো হাতটাকে আলতো করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

‘আমাকে কেন সবটা বললে না মনি’মা?? তোমাকে ছাড়া তোমার মীরা থাকতে পারবে না। একদম পারবে না। এজন্যই তুমি আমার থেকে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতে তাই না?? পড়াশোনার দোহাই দিয়ে আমাকে আলাদা রুমে পাঠিয়েছিলে কি এজন্যই?? যাতে আমি কিছু জানতে না পারি!!মনি’মা আমি থাকবো কিভাবে তোমার কিছু হয়ে গেলে??আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি আমার আরেক মা। তোমাকে ছাড়া থাকা যে কষ্টকর হবে আমার পক্ষে।’

মীরা ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। ওভাবেই মীরা পিহুর পাশে বসে থাকে। রাতে পিহুর জ্ঞান ফেরে তবে ডক্টর কারো সাথে দেখা করতে বারণ করে দেয়। পিহুর অবস্থা সত্যি ভালো না। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

পরেরদিন পিহুকে বাড়িতে আনা হয়। কিন্তু পিহুর অবস্থা ততটাও ভালো নয়। বয়স আর অসুখের ভারে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে সে। সামির মুক্তা মিলে বিছানায় বসিয়ে দেয় পিহুকে। মীরা পাশে দাঁড়িয়ে কাদতেছে। কাল থেকে কেঁদেই চলেছে সে। পিহু কোমল চোখে তাকালো মীরার দিকে। মীরাকে কাঁদতে দেখে পিহু বুঝে গেছে যে মীরা সবটা জেনে গেছে। চোখের ইশারায় পিহু মীরাকে কাছে ডাকলো।
মীরার প্রথমে খুব অভিমান হয়েছিল পিহুর ওপর কিন্তু এখন আর পারছে না সে। দৌড়ে গিয়ে পিহুর কোলে মাথা রেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। পিহু হাসলো,যেখানে ওর কাঁদার কথা সেখানে মীরা কেঁদে ভাসাচ্ছে। মীরা পিহুর কোলে মাথা রেখে বলল,’আমি তোমার কিছু হতে দেব না। তোমার অপারেশন ভালো ভাবে হবে। ভালো হয়ে তুমি আমার কাছেই থাকবে শুধু।’

পিহু মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,’এভাবে কাঁদলে চলে?? তোকে শক্ত হতে হবে। আমার মীরা তো খুব স্ট্রং তাই না?? তাহলে এতো কাঁদছে কেন??’
মীরা মাথা তুলে পিহুর দিকে তাকায়। তারপর বলে,’তুমি খুব খারাপ মনি’মা। আমাকে কেন বললে না সবকিছু??’
‘সবকিছু বললে কি হবে?? আমাকে বাঁচাতে পারবি??’

মীরা আরো বেশি করে কাঁদতে লাগলো এবার। পিহু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সবসময় কাঁদতে থাকবি নাকি??যতদিন আছি ততদিন তো তোর হাসি মুখটা দেখতে চাই মীরা।’
মুক্তা এবার বিরক্ত হয়ে বলল,’বারবার মরার কথা বলছিস কেন পিহু??মীরা তুই এবার পিহুকে বোঝা?? অপারেশন ওকে করতেই হবে।’

পিহু মুক্তার কথা পাত্তা না দিয়ে মীরার চোখের পানি মুছে দিলো। তাতে কোন লাভ হলো না আবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। পিহু হতাশ হয়ে গেল। রাতে সামিররা চলে গেল। থাকতে চেয়েছিল কিন্তু পিহু বারন করে দিয়েছে। তাই ওরা চলে গেছে। মীরা এক দন্ডও পিহুর কাছ থেকে সরেনি। এখনও পিহুর হাত ধরে ওর পাশে বসে আছে। পিহু মীরাকে আস্তে করে বলল,’আমার টেবিলের ড্রয়ারটা খুলবি??’

মীরা মাথা নাড়িয়ে উঠে গেল। ড্রয়ার খুলতেই একটা ডায়রি পেল সে। মীরা পিহুর দিকে তাকালো। পিহুর ইশারা পেয়ে ডায়রিটা এনে পিহুর হাতে দিলো। পিহু ডায়রি খুলে তিনটা চিঠি বের করলো। তারপর মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’এই চিঠিগুলো ইফাজ আর ইশানের। একটা নেহাল দিয়েছে ইফাজকে আর একটা আমি। আর একটা ইশানের জন্য লিখেছি। প্রথমে এই ডায়রিটা ইফাজকে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তা আমি বোধহয় আর নিজের হাতে দিতে পারব না। কিন্তু তোর কাছে আমার শেষ একটা অনুরোধ।

তুই এগুলো ইফাজ আর ইশানের কাছে যেভাবে হোক পৌঁছে দিস। জানি তুই ওদের ঘৃণা করিস কিন্তু আমি তো পারলাম না। অন্তত আমার কথা ভেবেই তুই ওদের এগুলো দিয়ে দিস।’
মীরার রাগ হচ্ছে আবার কান্নাও পাচ্ছে। পিহু আবার বলল,’চেয়েছিলাম ইফাজ আর ইশানের মুখোমুখি হয়ে সব বলতে কিন্তু খোদা সেই ভাগ্য রাখেনি আমার। তাই তুই দিয়ে দিস।’
মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,’আমি দিতে পারবো না এসব। আর তোমাকেও দিতে দেব না। ওই খারাপ লোক দুজনকে কখনোই তোমার ধারে কাছেও আসতে দেব না। এটা তুমি ভালো করে জেনে রাখো।’

পিহু হয়তো মীরার মুখ থেকে এটা আসা করেনি। করুন দৃষ্টিতে সে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। পিহু আস্তে করে বলল,’তাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না মীরা।’
মীরা পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কি বলতে চাইছো??আমি লন্ডন গিয়ে ওদের সবটা জানাই??’
পিহু স্নিগ্ধ হেসে বলল,’সবটা জানানোর দরকার নেই। শুধু এই চিঠিগুলো আর ডায়রিটা দিলেই হবে।’
মীরা পিহুকে একটা কঠিন শর্ত দিয়ে বলল,’তুমি যদি অপারেশন করতে রাজি হও তাহলেই আমি রাজি!! এবার বলো তুমি রাজি কি না??’

পিহু কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে তারপর আস্তে করেই উওর দিলো, ‘আমি রাজি মীরা।’
মীরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। দৌড়ে গিয়ে পিহুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে, ‘আমি কালকেই সামির আঙ্কেলকে সবটা বলবো। অপারেশনের ব্যবস্থা করতে বলবো।’
পিহু বলল,’তবে আমার একটা শর্ত আছে??’
‘কি শর্ত??’

‘তোর যেদিন লন্ডন যাওয়ার ফ্লাইট আমার সেদিন অপারেশন হবে। আমি কোন রিক্স নিতে চাই না।’
মীরা এবার দোটানায় পড়ে গেল বলল, ‘তোমার অপারেশন হবে আর আমি থাকবো না। এটা সম্ভব নয়। তাহলে তোমাকে কে দেখবে?? আমি এটা মানতে পারছি না।’
‘তাহলে আমিও অপারেশন করবো না। এটাই আমার শেষ কথা।’
‘মনি’মা তুমি বুঝতে পারছো না ওই সময় আমার থাকাটা জরুরি।’
‘মুক্তা সামির মিলে সবটা সামলে নেবে। আর তুই তো বেশিদিনের জন্য লন্ডন যাচ্ছিস না।এই ধর তিনমাস।’

মীরা এবার আকাশ থেকে পড়লো। মৃদু চিৎকার করে বলল,’তিনমাস?? আমি এতদিন থাকবো কিভাবে??’
পিহু গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’তাতে কি হয়েছে??প্রথম লন্ডন যাচ্ছিস ঘুরে দেখবি না?? অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে।’
মীরার এবার ভিশন রাগ হচ্ছে। এ কোন শর্ত আরোপ করলো পিহু??এই শর্ত না মানলে পিহু যে অপারেশন করাবে না। তাই আর কি করার। মীরা রাজি হয়ে রেগে নিজের রুমে চলে গেল। পিহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এবার ওর ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।

বড় ধরনের মিটিং চলছে। পিহু সামির মুক্তা আর মীরা রয়েছে সেখানে। মূলত মীরার লন্ডন যাওয়া নিয়ে। মীরা এতে প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে। মীরা হঠাৎ করেই বলে উঠলো,’আমারও একটা শর্ত আছে মনি’মা!!’
পিহু চমকালো। মীরা আবার কি শর্ত দেবে??মীরা বলল,’তোমার অপারেশন আর আমার ফ্লাইট একদিনেই হবে। তবে আমাকে কথা দাও যে আমি ফিরে আসার পর যদি ইফাজ খান আর ইশান খান তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাদের সাথে তুমি যাবে না। এমনকি কোন কথাও বলবে না ওদের সাথে। তুমি কি রাজি??’

মীরার শর্ত শুনে তিনজনই অবাক হয়ে গেল।পিহু ভেবে পাচ্ছে না যে এখন সে কি বলবে?? অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে। তুই যতদিন না বলবি ততদিন পর্যন্ত আমি ওদের সাথে যাবো না আর কথাও বলবো না।’

মীরার মুখে বাঁকা হাসি ফুটলো। মীরা জানে যে সবটা জানার পর ইফাজ আসবে পিহুকে নিতে তাই সারারাত ভেবে এই শর্তটা খুঁজে বের করেছে। মীরা তো কোনদিন ইফাজের সাথে পিহুকে যাওয়ার অনুমতি দেবে না। কারণ ওই দু’জনকে মীরা এতই ঘৃণা করে যে তা কখনো শেষ হবে না।
অনেকক্ষণ কথা বলার পর মীরাকে সাথে নিয়ে সামির বের হয়। মীরার পাসপোর্ট করার জন্য বের হয় সে। ওরা চলে যেতেই মুক্তা বলল,’তুই কি করতে চাইছিস পিহু? ওর শর্তে রাজি হলি কেন?? এভাবে মীরাকে লন্ডন পাঠানোর মানে কি?? অপারেশন করে তুইও যেতে পারতিস?? মীরাকে কেন পাঠাচ্ছিস??মেয়েটা একা একা গিয়ে কি করবে??’

পিহু একটু হেসে বলল,’আমি চাই মীরা ইফাজ আর ইশানের মুখোমুখি হোক। আমার কোন রাগ অভিমান নেই ওদের ওপর কিন্তু মীরার আছে। আমাকে ছাড়া গেলে মীরা ওর রাগটা ঠিকমতো ঝাড়তে পারবে। মীরার মনটা ও যে খুবই কোমল। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার ধরন আলাদা। ও যতোই রাগ করে থাকুক না কেন??ইফাজ আর ইশানকে ও ঠিকই একদিন ক্ষমা করে দেবে। তাই আমি চাই মীরা ওদের সত্যি জানাক। তাহলে আমার আর যেতে হবে না। ওরাই আমার কাছে চলে আসবে। এভাবে আমরা তো আর থাকতে পারবো না। আমি জানি ইফাজ আর ইশানও কষ্ট পাচ্ছে। তাই তো আমি এসব করছি। এখন মনে হচ্ছে আমার এই রোগটা হয়ে ভালোই হয়েছে কি বলিস??’

‘আর যদি শুনিস ইফাজ আবার বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে??’
পিহু আবার হাসলো বলল,’আমার তা মনে হয় না মুক্তা??’
মুক্তা অবাক হয়ে বলল,’তোর হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার কারণ??’
‘একটা ছেলে সহজেই একটা মেয়ের মনকে বুঝতে পারে না। কিন্তু একটা মেয়ে একটা ছেলের মন সহজেই বুঝতে পারে। ইফাজ পনেরো বছরের আমাকে যেটুকু বুঝেছে আমি তার থেকে আরো বেশি ওকে বুঝেছি। আমার বিশ্বাস ইফাজ নতুন করে সংসার করছে না।’
মুক্তা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পিহুর ভালোবাসার প্রখরতা মুক্তাকে অবাক করে দেয়। এতোটা ভালোবাসা বোধহয় সে কখনো দেখিনি।

মীরার লন্ডন যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মীরার এখন শান্তি লাগছে। কারণ ও পিহুকে যে শর্ত দিয়েছে তা পিহু মানবেই। কিন্তু পিহুর অপারেশনের সময় মীরা থাকতে পারবে না এটা ভাবতেই ওর খারাপ লাগছে।
মীরার লন্ডন যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।আস্তে আস্তে ফ্লাইটের ডেট আর পিহুর অপারেশনের দিন ও এসে গেছে।
যথা সময়ে ইয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে মীরা। মীরাকে পৌঁছে দিতে মুক্তা আর মুহিত এসেছে। সামির হসপিটালে আজকে তো পিহুর অপারেশন। অথচ মীরা আজকে চলে যাচ্ছে। মুখটা গোমড়া করে রেখেছে সে। মুক্তা মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’সাবধানে থাকিস আর তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’

মীরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,’চিন্তা করো না আন্টি। আমি বেশিদিনের জন্য যাচ্ছি না। শুধু ইফাজ খানকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়েই চলে আসব।’
‘পৌছে ফোন করিস আর কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাতে ভুলবি না কিন্তু??’
মীরা মাথা নাড়ল। মুহিত মুখটা ফ্যাকাসে করে রেখেছে। মীরা মুহিতের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’মন খারাপ করিস না আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো। মনি’মাকে ছাড়া তো থাকতে পারবো না তাই তাড়াতাড়ি চলে আসব। আর হ্যাঁ মনি’মায়ের সব খবর আমাকে দিবি। ভিডিও কলে সব জানাবি আমাকে। কালকে ফোন দিয়ে সব জানবো আমি।’

মুহিত শুধু মাথা নাড়ল। খুব খারাপ লাগছে মুহিতের। ও বলল,’তোমাকে ছাড়া খারাপ লাগবে বউ। তোমাকে আর জ্বালাতন করতে পারব না।’
মীরা একগাল হেসে বলে,’ফোনে জ্বালাতন করিস তাহলেই হবে।’
মীরা মুক্তার দিকে তাকিয়ে বলল,’মনি’মায়ের খেয়াল রেখো। আর এখন তাড়াতাড়ি হসপিটালে যাও। আমার টেনশন হচ্ছে খুব।’

ওদের বিদায় জানিয়ে চলে আসে মীরা। প্লেন ছাড়তে ঘণ্টা খানেক বাকি। মীরা তাই বসে আছে। এমন সময় দূর থেকে একটা মেয়ে মীরাকে ডেকে উঠলো। মীরা কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে সেদিকে তাকালো। দেখলো সাবরিন তার লাগেজ টেনে একদিকে আসছে।মেয়েটাকে সে আগে থেকেই চিনতো। লন্ডনে সে বড় একটা জব পেয়েছে। কিন্তু তার বাবা তাকে একা ছাড়বে না বলে রাগারাগী করছিল। কিন্তু সামির আর মীরা সেদিন সাবরিনের বাবাকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করেছে। মীরা বলেছিল সাবরিন ওর সাথেই থাকবে লন্ডন গিয়ে। তাই সাবরিনের বাবা রাজি হয়েছিলেন। সাবনির সেদিন মীরাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলো। সাবরিন মীরার দিকে এগিয়ে গেল। মীরার পাশে বসে বলল,’কেমন আছো মীরা??’
মীরা সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বলল,’ভালো, তুমি কেমন আছো??’

‘ভালো।’
সব ফর্মালিটি পূরণ করে সাবরিন আর মীরা প্লেনে উঠে বসে। মীরা নিজের সিটে বসে হাঁসফাঁস করতেছে। অবস্থা তার নাজেহাল। না জানি পিহুর অপারেশন শুরু হয়ে গেছে কি না??এসির মধ্যেও সে ঘামছে। প্লেন ছাড়তেই মীরা কেঁপে উঠলো। সাবরিনের হাত চেপে ধরলো সে। প্লেন উড়ে চলল ঠিকই কিন্তু মীরার প্রাণভোমরা বাংলাদেশে ফেলে গেল।
পরদিন সন্ধ্যায় প্লেন ল্যান্ডিং করলো লন্ডন শহরে। আরো আগে পৌছাতো কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে প্লেন দেরিতে পৌঁছেছে। মীরা হনহনিয়ে বের হয়ে এলো। অন্যকেউ হলে হা হয়ে লন্ডন শহর দেখতো কিন্তু মীরা তা পারছে না। মীরা বের হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই পিছন থেকে সাবরিন বলে উঠলো,’মীরা আমাকে ফেলে চলে এলে কেন??’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৫

মীরা ঘাড় ঘুরিয়ে সাবরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,’বাড়িতে ফোন করছি।’
‘বাংলাদেশি সিমকার্ড তো চেঞ্জ করতে হবে নাহলে তুমি তো ফোন করতে পারবে না??’
মীরার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল বলল,’তাহলে এখন কিভাবে ফোন করব??আর মনি’মায়ের অপারেশনের কি হলো জানবো কিভাবে??’
‘আগে সিমকার্ড চেঞ্জ করো তারপর বলো। বাই দা ওয়ে তুমি এখন কোথায় যাবে??কোন চেনা জানা মানুষ আছে এখানে??’
‘নাহ আমি হোটেলে উঠবো।’

সাবরিন একটু ভেবে বলল,’তুমি আমার সাথে চলো অফিস থেকে আমাকে যে ফ্ল্যাটে থাকতে দেওয়া হয়েছে তুমি সেখানেই থাকবে।’
‘কিন্তু তোমার তো প্রবলেম হবে।’
‘আরে হবে না। আগে গিয়ে তো দেখি। তুমি আমার উপকার করেছো আর আমি করবো না??’
সাবরিনের সাথে মীরা তার ফ্ল্যাটে গেল। ফ্ল্যাটটা বেশ বড় দুজনের থাকা হয়ে যাবে সব মিলিয়ে।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৭