অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৮ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৮
Ishita Rahman Sanjida

মীরা একধ্যানে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে সেই ছোট ইশানের সাথে কোন মিল সে পাচ্ছে না। জোরে মিউজিক বাজছে আর এতসব মানুষের শোরগোলের মধ্যে মীরার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তারপর আবার ইশান। সব মিলিয়ে মীরার অবস্থা করুণ। হঠাৎ ওর পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা ওর গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। মীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই মেয়েটা বলে উঠলো,’ওদিকে এতো দেখো না তাহলে তোমার মাথার চুল আর মুখের দাঁত একটাও থাকবে না।’

মীরা কোন জবাব দিলো না সবটাই ওর কাছে ধোঁয়াশা। মেয়েটা হেসে বলল,’ক্রাশ খেলে নাকি ইশানের উপর??’
মীরা মাথা নাড়িয়ে না বলতেই মেয়েটা অবাক হয়ে বলে,’সেকি লন্ডনের সব মেয়েরা উঠতে বসতে ইশানের উপর ক্রাশ খায় আর তুমি??বাই দা ওয়ে তুমি কি লন্ডনে নতুন??’
মীরা ছোট করে উওর দিলো,’হুম’
‘ওহ তাই এখানকার মানুষ সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না।’
মীরা আবার ইশানের দিকে তাকালো তারপর আবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,’ওই ছেলেটাকে তোমরা এতো ভয় পাও কেন??’

মেয়েটা মুখে হতাশ ভাব ফুটিয়ে বলল,’তুমি দেখছি সবটাই জেনে ছাড়বে। তবে জেনে রাখা ভালো।চলো বসে কথা বলি। তুমিও বাঙালি আর আমিও বাঙালি।’
মীরা মেয়েটার সাথে একটা টেবিলে গিয়ে বসে তবে ওর মনটা শুধু ইশানের দিকে। যদি এটাই সেই ইশান হয়?? মেয়েটার থেকে সব জানতে হবে। ওর ভাবার মাঝখানে মেয়েটা বলে উঠলো,’আমি শ্রাবনি আর তুমি??’
মীরা মুচকি হেসে বলল,’আমি মীরা।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্রাবনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,’নাইস নেইম। আমি এখানে ফ্যামেলি সহ থাকি। এখানেই পড়াশোনা করছি। তবে অবাক করা বিষয় হলো এই শহরে পদে পদে তুমি বাঙালি পাবে।বলতে গেলে বাঙালিতে লন্ডন শহর ভরে গেছে। বাংলাদেশ অনেক উন্নত করেছে দেখছি।’
বলেই শ্রাবনি হেসে ফেললো। মীরার এখন এসব শুনতে বিরক্ত লাগছে। বারবার সে ইশানের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। শ্রাবনি মীরার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,’হ্যালো এতো দেখো না পরে বিপদে পড়বে।’
মীরা এবার সত্যি বিরক্ত হলো। তারপর বলল,’ওই ছেলেটা সম্পর্কে একটু ক্লিয়ার করে বললে ভালো হতো। তোমার কথা আমি বুঝতেছি না।’

শ্রাবনি এক চুমুকে বিয়ারের বোতল শেষ করে টেবিলের উপর রেখে বলা শুরু করলো,’ওই ছেলেটা হচ্ছে ইশান। মেয়েদের একদম সহ্য করতে পারে না। বলতে পারো মেয়ে মানুষে তার এলার্জি। মনে হয় ওর রক্তে সমস্যা আছে। কিন্তু ইশান কেন যে মেয়েদের পছন্দ করে না তা কেউ জানে না। এমনকি ওর বন্ধুদের কেউও না। বখাটে ছেলে একটা।যাকে বলে বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। প্রতিদিন বারে এসে মদ গেলা আর পার্টি করাই তার স্বভাব। যদি কোন মেয়ে ওকে পাঁচ মিনিটের বেশি দেখেছে তো তার লাইফ শেষ।এর আগে তো পাঁচজন মেয়ের চুল কেটে দিয়েছিল। ইশানের ফ্রেন্ড জিনিয়া ঠিক ওর মতো করে। জিনিয়া মেয়েটাও ঠিক ওইরকম ই। আমরা তো সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার বারে আসি কিন্তু জিনিয়া প্রতিদিন আসে। সারারাত পার্টি করে মাতাল হয়ে বাড়িতে ফেরে। জিনিয়াকে বাইরে থেকে দেখলে সবাই মেয়ে ভাববে তবে ওর ভেতরের ইঞ্জিন পুরো ছেলেদের।’

বলেই শ্রাবনি হাসতে লাগলো। মীরার অস্বস্তি হচ্ছে। ইশান এতোটা বিগড়ে গেছে??মনি’মা জানতে পারলে তো খুব কষ্ট পাবে। তৎক্ষণাৎ মীরা নিজেকে বলল,’ছিঃ মীরা এসব কি ভাবছিস??এটা ইশান না ও হতে পারে। লন্ডনে কি একটাই ইশান??আরো অনেক ইশান ও তো থাকতে পারে।’
মীরা শ্রাবনির দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কি জানো যে ইশান আগে কোথায় থাকতো??আই মিন এটাই কি ওর জন্মভূমি??’
শ্রাবনি একটু ভেবে বলল,’সেটা জানি না তবে এদেশের ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় ওকে কখনোই কথা বলতে দেখিনি তাহলে কি করে বুঝবো??’

মীরা ভাবলো একবার ইশানের বাবার কথা জিজ্ঞেস করে দেখি। মীরা কিছু বলার আগেই একদল মেয়ে এসে শ্রাবনিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। শ্রাবনি ওদের সাথে ডান্স করতে চলে গেল। মীরার কেমন যেন লাগছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। শ্রাবনির কথা শুনে কেমন যেন লাগছে। এ কোন জায়গায় এসে পড়লো মীরা। তবে যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে পারবে ততই ভালো। মীরা বিড়বিড় করে সাবরিনকে বকছে কেন সে মীরাকে জিনিয়ার কাছে ছেড়ে গেলো??
মীরা উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো। ইশান পেগের পর পেগ গিলেই যাচ্ছে যা দেখে মীরার বমি পাচ্ছে। গরুর মতো কিভাবে গিলছে দেখো?? হঠাৎ জিনিয়া মীরাকে ডেকে উঠলো,’হানিইইইই কাম হেয়ার।’

জিনিয়ার ডাক শুনেই মীরার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। কারণ ইশানও ওর দিকে চেয়ে আছে। সাথে ওর সব ফ্রেন্ডসরাও তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। মীরা এগোতে চেয়েও পারছে না। ইশান সম্পর্কে ধারণা পেয়ে ওর ভয় হচ্ছে। সত্যি যদি ওর চুল কেটে দেয়??এসব ভাবতেই মীরা নিজের চুলে হাত বুলায়। এমনিতেই কালকে ইশানের সাথে ঝগড়া করেছে। ওকে তো কাঁচা গিলে খাবে। বাংলাদেশ হলে মীরা ভয় পেতো না। কিন্তু এটা যে লন্ডন। তাছাড়া ওর চেনা জানাও কেউ নেই যে ওকে বাঁচাবে। জিনিয়া মাতাল হয়ে ঢুলছে আর মীরাকে হানি হানি বলে ডাকছে। মীরা তার পরনের জামাটা হালকা টানলো। গায়ের ওড়না টেনে ঠিক করলো। যদিও ঠিক আছে তবুও। আস্তে আস্তে করে জিনিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জিনিয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ফ্রেন্ডস দিস ইজ হানি,মাই হোম পার্টনার।এন্ড হানি দে আর মাই ফ্রেন্ডস এ্যালেক্স,হার্স, জ্যাক,হ্যারি এন্ড ইশান।’
মীরা এক এক করে সবার দিকে তাকালো।ইশানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে। কিন্তু আশ্চর্য ইশান ওর দিকে তাকালো না। তবে একবার তাকিয়েছিল। তাহলে কি ইশান মীরাকে চেনেনি??কালকে তো এতো ঝগড়া করলো। মীরা এতে অবাক হলো। ভয়ে ভয়ে সে আড়চোখে ইশানের দিকে তাকাতে লাগল। পরক্ষণে শ্রাবনির কথা মনে পড়ে আর তাকালো না। ওর এত সাধের চুলগুলো খোয়াতে চায় না। তাই ওখান থেকে সরে পড়লো।

মীরার আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে লাঠি দিয়ে সব কটাকে পিটাতে। এরকম পাওয়ার যদি ওর থাকতো তাহলে আজকে এই বারের সবকটা হসপিটালে থাকতো। একা একটা টেবিলে বসে সে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। এভাবে মীরা টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মীরার ঘুম ভাঙল জিনিয়ার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে মীরা তাকিয়ে দেখলো জিনিয়া ঢুলঢুলু চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মীরা উঠে দাড়াতেই জিনিয়া বলল,’লেটস গো হোম হানিইই।’

এই হানি ডাক শুনলে মীরার গা গুলিয়ে আসে। অসভ্য মেয়ে, এমন মেয়ে সে জীবনেও দেখেনি। জিনিয়া ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। মীরার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে সে। জিনিয়ার গা থেকে মদের গন্ধ আসছে। মীরার সহ্য হচ্ছে না। তবুও জিনিয়াকে নিয়ে সে হাটছে। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না মীরা। ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাপ দেখছে। একহাতে ফোন আরেক হাতে জিনিয়াকে ধরে রেখেছে। এভাবে হাঁটা যায় নাকি??জিনিয়া তো পুরো ভর মীরার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাল সামলাতে না পেরে জিনিয়াকে নিয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ে। মীরা দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বেশি ব্যথা পায়নি। কিন্তু সমস্যা হলো জিনিয়াকে সে তুলতেই পারছে না। কিছুক্ষণ টানাটানি করার পর একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে মীরার হাতের উপর দিয়ে জিনিয়ার হাত ধরলো। মীরা চমকে তাকালো। ইশান জিনিয়ার হাত ধরেছে। মীরা কি করবে বুঝতে পারছে না। ইশান জিনিয়াকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে দিল। মীরা ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’হে গার্ল কাম ইন।’

মীরা দ্রুত গিয়ে জিনিয়ার পাশে বসে পড়ল।
ইশান গাড়ি স্টার্ট দিলো। জিনিয়ার বাড়ির সামনে এসে ইশান গাড়ি থামায়। জিনিয়াকে ধরে নিয়ে ওর রুমে নিয়ে যায়। এর মধ্যে মীরার সাথে ইশান একটুও কথা বলেনি।শুধু জিনিয়ার জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত আনতে বলেছে। মীরা শরবত নিয়ে রুমে গিয়ে দেখলো ইশান এখনও যায়নি। মীরা রুমে যেতেই ইশান বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে এসে মীরার সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’আই থিংক,আই ওয়াজ সি ইউ!!’

মীরা শরবতের গ্লাস শক্ত করে ধরলো। তবে কি ইশান ওকে চিনে ফেলল??মীরা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’বাট আই সি ইউ দ্যা ফার্স টাইম টু ডে।’
ইশান কেমন করে যেন মীরার দিকে তাকালো। মীরার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ইশান তাতে পাত্তা দিলো না। চলে গেল। মীরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জিনিয়াকে শরবত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে গেলো। খুব ক্লান্ত সে। ঘড়ি না দেখেই শুয়ে পড়লো মীরা। মীরা ভাবতে লাগলো যে এটা কিছুতেই ইশান হতে পারে না। ইশান তো এরকম ছেলে হতেই পারে না। আবার ভাবলো হতেও পারে। বিদেশে এসে ইশান বদলে যেতেও পারে।

মীরা চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো। এই ছেলেটা যদি ইশান হয় তাহলে তো ভালো। তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে ইফাজকে। আর যদি না হয় তাহলে তো আরো কাঠখড় পোড়াতে হবে মীরার।এসব ভাবতে ভাবতে মীরা ঘুমিয়ে পড়লো।
ইশান নিজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। হাতের আংগুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়িতে ঢুকলো। রুমে যাওয়ার আগে একবার ইফাজের রুমে উঁকি দিলো। ইফাজ ঘুমাচ্ছে ইশান তাই নিজের রুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হলো। তারপর নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। ইশানের কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। মীরাকে সে আগে কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারছে না।
মেয়েদের দিকে বেশিক্ষণ ইশান তাকায় না।তাই সবার চেহারা মনে রাখতে পারে না। মনে থাকবে কি ইশান মনে রাখার চেষ্টা করে না। ইশান তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।

ইশান যেতেই ইফাজ চোখ মেলে তাকায়। ছেলেটা তার উচ্ছন্নে উঠেছে। কোন কথা শুনছে না। যখন যা ইচ্ছা তাই করে। এতরাত করে বাড়িতে ফিরেছে না জানি কোথায় কোথায় থেকেছে??ইফাজের এখন মনে হচ্ছে ইশানকে পিহুর কাছে রেখে এলেই ভালো হতো। অনন্ত ছেলেটা ভালোর পথে চলতো।রাত দুপুরে বাড়িও ফিরত না। ইফাজের এখন খুব চিন্তা হয় ইশানকে নিয়ে। কখন যে কি করে বসে কে জানে?? আবার বায়না ধরেছে বাংলাদেশ যাওয়ার। ইফাজ নিজেও যাবে ইশানের সাথে।

কারণ সে কিছুতেই ইশানকে পিহুর মুখোমুখি হতে দেবে না। ইশান যদি পিহুকে অপমান করে তাহলে পিহু কষ্ট পাবে। তার থেকে বেশি ইফাজ কষ্ট পাবে। যতোই সে পিহুকে ঘৃণা করুক। একটা সময় তো ও পিহুকে ভালোবাসতো। তবে এখনো সে পিহুকে আগের মতোই ভালোবাসে। সেজন্যই তো বাবা মায়ের হাজার চাওয়া সত্ত্বেও ইফাজ বিয়ে করেনি। পিহুর জায়গায় ইফাজ কোনদিন কাউকে বসাতে পারবে না। কখনোই না। তাই এখন ও ইফাজ পিহুর দেওয়া কষ্টগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।
ইফাজ বড় একটা শ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে।

বিছানায় হাত পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে মীরা।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। চুল বাঁধবে কে??পিহু তো বাংলাদেশে রয়েছে। চুল বাঁধতে বিরাট এক অলসতা এসে ভর করে মীরার উপর।
তখন থেকে মীরার ফোনটা বেজে যাচ্ছে। রিংটোনের শব্দে বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে ফেলেছে মীরা। ঘুমের ঘোরেই বালিশের নিচে হাতরে ফোন খোঁজার চেষ্টা চালালো সে। কিন্তু পেল না শেষে বাধ্য হয়েই উঠে বসতে হলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সাবরিন কল করেছে। মীরার ঘুমটা যেন পালিয়ে গেল সাবরিনকে বকা দেওয়ার জন্য।
তড়িৎ গতিতে মীরা ফোনটা রিসিভ করে বলল,’তুমি আমার সাথে কেন এমন করলে সাবরিন??আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যার জন্য তুমি আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলে??’

মীরার কথা শুনে সাবরিন হা হয়ে গেল। সাত সকালে কি হলো মীরার??নাকি ঘুমের ঘোরে বাজে বকছে। আচ্ছা মীরাকে ভুতে ধরেনি তো??লন্ডনে বুঝি ভুত আছে??সাবরিন শান্ত গলায় বলে,’আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না মীরা??কি হয়েছে বললে ভালো হতো??’
মীরা পা ভাজ করে বসে বললো,’এ কোন জায়গায় তুমি আমাকে ফেলে গেলে??ওই জিনিয়া আস্ত একটা খবিশ মেয়ে। এমন মেয়েকে আমি জীবনেও দেখিনি। এই মেয়ের একমাত্র কাজ পার্টি করা আর মদ গিলে পড়ে থাকা। জানো কাল রাতে আমাকে বারে নিয়ে গিয়েছিল।’
সাবরিন উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,’তারপর??’
মীরা একে একে সব খুলে বলল সাবরিনকে।সাবরিন হতাশ হয়ে বলল,’সরি মীরা। আমি জানতাম না জিনিয়া এরকম তাহলে তোমাকে যেতে দিতাম না। তুমি এক কাজ করো কোন একটা হোটেলে চলে যাও।’

‘নাহ সাবরিন। আমাকে ওদের খুঁজে বের করতে হলে জিনিয়ার হেল্প লাগবে। তাছাড়া আমি কালকেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি।’
সাবরিনের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। জিনিয়া কাউচে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। মীরা জিনিয়ার পাশে গিয়ে বসে বলল,’হোয়াট হ্যাপেন্ড??’
জিনিয়া মীরার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,’আ’ম ভেরি সিক।’
‘ওয়াট???’
‘ইয়াহ, ইটস্ হেডেক।’
মীরা মুখ বাঁকিয়ে বললো,’সারারাত মদ গিলে নাচানাচি মাতামাতি করলে তো মাথা ব্যথা হবেই। বেশ হয়েছে আরো খাও মদ।’
মীরার সুদ্ধ বাংলা কথাগুলো জিনিয়া বুঝতে পারলো না। জিনিয়া বলল,’ওয়াট??’
মীরা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে?? মীরা আমতা আমতা করে বলল,’আই প্রেস ইউর হেড??’
‘ইয়াহ শিওর।’

মীরা জিনিয়ার মাথা টিপে দিতে লাগল। এতে জিনিয়া বেশ আরাম পাচ্ছে। কিছুক্ষণ মাসাজ করার পর মীরা জিনিয়াকে বলল,’জিনিয়া আই ওয়ান্ট টু টেল ইউ সামথিং।’
জিনিয়া চোখ তুলে মীরার দিকে তাকালো।মীরা একটু মোচড়ামোচড়ি করে বলল,’আ,,ব জিনিয়া আই ওয়ান্ট টু নো এবাউট ইশা,,,,’
মীরা কথা শেষ করার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। অগত্যা মীরাকে উঠতে হলো। দরজা খুলে মীরা ভিশন অবাক। ওর সামনে ইশান দাঁড়িয়ে আছে। ইশান মীরার দিকে না তাকিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলো। জিনিয়ার পাশে বসে ওর দিকে পার্স এগিয়ে দিয়ে বলল,’ইউ ড্রপড ইউর পার্স ইন মাই কার লাস্ট নাইট।’

জিনিয়া মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,’থ্যাঙ্কস ইশান। হ্যাভ কফি??’
ইশান জিনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘শিওর’
জিনিয়া মীরাকে ডেকে বলল,’হানি কফি প্লিজ??’
মীরার তো রাগ হচ্ছে। এ কোন মাতালদের খপ্পরে পড়লো ও??মীরা স্ফুট স্বরে বলল,’রাত ভরে মাতলামি করে এখন ঢং করা হচ্ছে। এখন কফি খাবে কেন?? আরও চার পেগ মদ গিলতে পারো না?? সাথে এই বিদেশি বাদরটাকেও তো গেলাতে পারো??’
মীরার কথাগুলো ইশানের কানে যেতেই তার কপালে ভাঁজ পড়লো। মেয়েটা বাঙালি??অথচ ইশান তা বুঝতে ও পারেনি। বুঝবে কিভাবে??সে তো ভালো করে মীরার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ভালো করে পরখ করে দেখলে হয়তো বুঝতে পেতো। ইশান মীরার কথা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল,’হোয়াট ডু ইউ সে??’
মীরা তখন কথা ঘুরিয়ে বলল,’নাথিং।’
বলেই রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। যেতে যেতে বলল,’এই একটা শান্তি। বিদেশিদের যতই বাংলা ভাষায় গালাগাল দাও তারা বুঝতেও পারে না।’

মীরা হাসতে হাসতে চলে গেলো। মীরার এই কথাগুলো ও ইশানের কান এড়ালো না। কফি বানিয়ে মীরা ইশান আর জিনিয়াকে দিলো। নিজের কফি নিয়ে সে রুমে চলে এলো। ওখানে থাকা মানেই মাথা ঘুরে যাওয়া। এমনিতেই জিনিয়ার পোশাক মীরার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। মীরা কফি হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খাওয়ার মজাই আলাদা। রেলিং এর উপর দড়ি দিয়ে ফুলের টব ঝোলানো। তবে গাছগুলো প্রায় মরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদিন যাবত পানি দেওয়া হয় না। মীরা রুমে এসে পানির বোতল নিয়ে আবার বারান্দায় গেলো। গাছগুলোতে পানি দিতে লাগল। এখন গাছগুলো তাড়াতাড়ি জীবন ফিরে পাবে। তখনই কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে তাকায় মীরা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ নিচের রাস্তায় চোখ গেল।ইশান ফোন হাতে নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মুখে তার অসম্ভব রাগ। ইশান চেঁচিয়ে বলল,’রাবিশ!!!ইউ ক্যান্ট সি উইথ ইউর আইস?? হোয়াই পোর ওয়াটার অন দ্যা স্কিন??’

মীরা তাড়াতাড়ি পানির বোতল সরিয়ে ফেলে। গাছে পানি দেওয়ার ফলে তা উপচে নিচে পড়ছিলো তা মীরা খেয়ালই করেনি। ইশান ফোনে কথা বলছিল আর তখনই ইশানের উপর পানি পড়লো। ইশান উপরে তাকিয়ে দেখে মীরা গাছে পানি দিচ্ছে। এতেই ওর রাগ হয়। চেঁচিয়ে ওঠে।
মীরা ইশানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,’সরি সরি সরি আই ডিডেন্ট সি ইউ।’
ইশান তো রাগে ফুসে উঠলো। সাথে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো। ইশান ওখান থেকে যেতেই মীরা কটমট করে বলে উঠলো,’তোর ভাগ্য ভালো যে এটা বাংলাদেশ না। তাহলে বুঝিয়ে দিতাম স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ কত প্রকার এবং কি কি??সাদা চামড়ার গরু। তোর মতো কত সাদা চামড়ার গরু কোরবানি হতে দেখেছি। আসছে শালা ইবলিশের খালাতো ভাই।’

মীরা রেগেমেগে রুমে চলে গেল। মীরা আজকে জিনিয়ার সাথে ঘুরতে বের হবে। পথঘাট তো চেনা দরকার তাই না?? তবে মীরা ঠিক করেছে যে আজকের পর জিনিয়ার সাথে সে বারে যাবে না।
লন্ডনের আইকন খ্যাত টাওয়ার ব্রিজে মীরাকে নিয়ে গেল জিনিয়া। অসম্ভব সুন্দর ব্রিজটা। টেমস নদীর উপর এই ব্রিজ যেন রাজকিয় লন্ডনের অভিজাত্যের প্রতীক। দিনের এই সময়ে ব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়। জিনিয়া টিকিট কাটলো। অনেক মানুষের ভিড়ে টিকিট কাটতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে জিনিয়াকে। মীরা তো খুব এক্সাইটেড। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তাই ঝটপট সে কয়েকটা সেলফি তুললো। সাথে সাথে মুহিতকেও সেন্ট করে দিল। মুহিত তখন অনলাইনে ছিল। উদগ্রীব হয়ে মুহিত ভিডিও কল করলো মীরাকে। মীরা ফোন রিসিভ করতেই মুহিত বলে উঠলো,’আরে বউ তুমি আমাকে ছেড়ে একা একা টাওয়ার ব্রিজে উঠে গেছো। আমি তো ভাবছিলাম একসাথে হানিমুনে যাবো। তুমি এটা কি করলা??’

মুহিতের কথায় মীরা হাসলো বলল,’সমস্যা নাই এরপর তোকে এখানে নিয়েই আসব। দেখ কি সুন্দর না এই ব্রিজটা??’
‘তোমার পাশের ওইটা কে??ছেলে না মেয়ে আমি তো বুঝতে পারছি না। আয় হায় তুমি কি ওখানে গিয়ে অন্য বেডার লগে প্রেম করো নাকি??’
মীরা পিছনে তাকিয়ে দেখলো জিনিয়া ওর পিছনে থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।মীরা হেসে বলর,’ওটা মেয়ে।’

‘কি??আমি তো কোমায় চলে যাবো। শেষ মেষ এই দিন দেখাইলা খোদা??’
মীরা হেসে বলে,’এখানে এলে আরো অনেক কিছু দেখতে পেতি!!’
জিনিয়া পেছন থেকে বলে উঠলো,’হু ইজ দিস বয়??’
মীরা বলল,’মাই ইয়ঙ্গার হাজবেন্ড।’
জিনিয়া খুশি হয়ে বলল,’ওহ রিয়েলি??’ তারপর মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,’হ্যালো বেবি। আই লাভ ইউ উম্মাহ।’
জিনিয়া একটা ফ্লাইং কিস দিলো। মুহিত চোখটা বড়বড় করে ফেলছে।
‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই মেয়েছেলে আমাকে কিস দিলো মানা যায় না। আমার গালদুটো চকচক করে রেখেছি সেখানে আমার বউ কিস করবে বলে। শেষমেষ হাফ লেডিসের কিস!!’
মীরা হালকা চোখ গরম করে বলল,’মুহিত চুপ থাক।’

মীরা ফোন কেটে দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে জিনিয়া মীরাকে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে নিয়ে গেল। তখন দিন পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। এই স্ট্রিটটা বেশ সুন্দর। উঁচু উঁচু অভিজাত সব ভবন এবং বড়বড় ব্রান্ডের সব দোকানপাট রয়েছে। পোশাকের দোকান থেকে শুরু করে খাবারের দোকান সহ সব ধরনের দোকানপাট রয়েছ এখানে। মীরা হা হয়ে দেখছে সব। জিনিয়ার সাথে স্ট্রিটের অলিগলি ঘুরছে। এই সৌন্দর্য বর্ণণা করা মীরার পক্ষে সম্ভব নয়। বলতে গেলে বোধহয় সারারাত ফুরিয়ে যাবে।

তবে মীরা বেশ অবাক হলো যে কিছু কিছু দোকানের সাইনবোর্ড এ লেখা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। শ্রাবনি ঠিকই বলেছিল লন্ডনে অধিকাংশ বাঙালি। এতে মীরার বেশ ভালো লাগছে। মীরার দৃষ্টি অনুসরণ করে জিনিয়া বুঝলো এবং বলল,’হানি,জানো এই রাস্তাটা লন্ডনের সবচেয়ে সুন্দর। এটা আমার কাছে মনে হয়। অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। অফিস শেষ করে অনেকে এখানে আড্ডা দিতে আসে। তবে এখানে বেশির ভাগ বাঙালি। বাঙালি রেস্তরাঁ,পোশাকের দোকান। এছাড়া সকালের বাজারে সুরমা নদীর মাছ পর্যন্ত এখানে আসে। সকালে প্লেন বোঝাই করে বাংলাদেশী শাকসবজি এবং মাছ লন্ডন আসে। আমার এটা খুবই ভালো লাগে। বাংলাদেশী সবকিছু আমার ভালো লাগে।’

জিনিয়ার মুখে বাংলাদেশের প্রশংসা শুনে মীরার আনন্দ হলো। গর্ব হলো খুব। নিজের দেশ সম্পর্কে অন্য দেশের কোন মানুষের মুখে সুনাম বড়ই ভালো লাগছে মীরার। রাস্তার পাশে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো ওরা। তবে রেস্তরাঁর চেয়ার টেবিল গুলো সব খোলা আকাশের নিচে। জিনিয়া আর মীরা গিয়ে একটা টেবিলে বসে। জিনিয়া খাবার অর্ডার দিয়ে মীরার সাথে গল্প করছে। এমন সময় পিছন থেকে একজন বলে উঠল,’হেই জেনি!!’
জিনিয়া পেছনে তাকিয়ে বলে,’ওহ এ্যালেক্স।হোয়াট আ সারপ্রাইজ??’

তবে একে একে হার্স,হ্যারি জ্যাক ও এলো। ওরা এসেই ওদের টেবিলে বসে পড়লো। মীরা এদিক ওদিক তাকালো। ইশান কে দেখতে পেল না সে। তাই বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মীরার মনে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ইশান যদি ইফাজের ছেলে হয় তাহলে তো ওর বাংলা জানার কথা। ইশান যখন লন্ডন এসেছে তখন তো ইশানের দশ বছর বয়স। বাংলা ভাষা তো ভোলার কথা নয়। তাহলে কি ওই ছেলে ইফাজের ছেলে নয়???

তাই হবে। কিন্তু ইশান আর ইফাজকে তো ওকে খুঁজে বের করতে হবে। মীরার ভাবনার মধ্যে কখন যে ইশান এসে বসেছে ওর পাশে তা ও খেয়াল করেনি। ভাবনায় ডুবে আছে সে। জিনিয়ার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো মীরার। খাবার এসে গেছে অল রেডি সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ইশানকে দেখে মীরা চমকালো। ইশান আবার কখন এলো??মীরা খাওয়া বাদ দিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইশান প্রগাসে সব খাবার গিলছে। সাথে ওই পেটুক বন্ধু গুলোও গিলছে। বোধহয় বাপের জন্মে এসব খায়নি। হঠাৎ ইশান মীরার দিকে তাকাতেই মীরা দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। চুলে হাত দিয়ে চুল ঠিক করলো। ওই শ্রাবনি একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মনে। এই বুঝি ইশান কাঁচি দিয়ে খপ করে মীরার চুল কেটে দিলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়িতে ফিরে এলো মীরা আর জিনিয়া। আজকে মীরা আর বারে গেল না। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত তাই রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মীরার অতোটা ক্লান্ত লাগছে না। তাই সে রুমে গিয়ে পিহুকে কল করলো। মীরা বারবার পিহুকে উপদেশ দিতে লাগল। এটা করবে না ওটা করবে না। ঠিকমতো খাবে ওষুধ খাবে ব্লা ব্লা। পিহু হুট করে জিজ্ঞাসা করল,’ওদের দেখা পেয়েছিস??’
মীরা আস্তে করে বলল,’এখনো পাইনি তবে পেয়ে যাব খুব শীঘ্রই।’
পিহু হেসে বলল,’তুই ইশানকে দেখলে চিনতে পারবি মীরা???’
মীরা থম মেরে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমার ইশানকে মনে আছে। কিন্তু বড় হয়ে ও কেমন হয়েছে তা জানি না। আমার জানার দরকার ও নেই। আমি শুধু ওদের পাওনা বুঝিয়ে দেব। ইশানকে তোমার দেখার ইচ্ছা থাকলেও আমার একদম নেই।’

পিহু বড় দম ফেলে বলল,’আমার খুব ইচ্ছে হয় ইশানকে দেখতে। ছেলটা কতবড় হয়েছে কেমন দেখতে হয়েছে কিছুই তো জানি না।’
‘দিলে তো আমার মুডটা অফ করে। ফোন করলেই ইশান ইফাজ করে আমার মাথা খাও কেন?? তুমি আমাকে কথা দিয়েছো তা কি ভুলে গেছো??’
‘আমি কিছু ভুলিনি মীরা।’
‘গুড এখন রাখি হ্যা খোদা হাফেজ।’
মীরা ফোন কেটে দিল। তারপর চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়লো।
কেটে গেল আরো পনের দিন। মীরা জিনিয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। মেয়েটা কেমন যেন। সারাক্ষণ বাইরে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে রেডি হয় আবার চলে যায়। মাঝরাতে মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ফেরে। তাই মীরা কিছু বলতে চায় না জিনিয়াকে। কিন্তু মীরা এভাবে ওদের খুঁজবে কিভাবে??এইক’দিন ইশানের সাথে তেমন দেখা হয়নি মীরার। দেখা হবেই বা কিভাবে??মীরা তো বারে যায়না। তবে মাঝেমধ্যে ইশান জিনিয়ার বাড়িতে আসতো। মীরা ইশানের সামনেও যেতো না। সবসময় এড়িয়ে চলতো।

সকাল সকাল সাবরিনের ফোন। তিনদিন পর সাবরিন ফোন করেছে মীরাকে। সাবরিন বলে উঠলো,’মীরা একটা খুশির খবর আছে।’
মীরা সাবরিনের কথা শুনে হেসে বলল,’কি??’
‘আমাদের অফিস থেকে কোন একটা সি বিচে ট্যুরে যাবে। আসলে নতুন যারা জয়েন করেছে তাদের জন্য এই ট্যুর। অন্যরাও যাবে। তুমি যাবে খুব মজা হবে??’
মীরা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে বলল,’আমি যাবো??’
‘কোন সমস্যা হবে না। আমি অলরেডি সব ম্যানেজ করে ফেলেছি।’
‘ওকে ম্যানেজ যখন করেছো তাহলে যাবো।’

সাবরিন খুশি মনে ফোন রেখে দিল। মীরা গিয়ে জিনিয়াকে সব বলল। তারপর নিজের কিছু জিনিস পত্র তার ছোট লেডিস ব্যাগে গুছিয়ে নিলো। একদিনের সফর তাই মীরা বেশি কিছু নিলো না।
পরেরদিন মীরা রেডি হয়ে নিলো। বাসন্তী রঙের একটা লং গাউন পরেছে। ম্যাচিং চুরিও পড়েছে। চুড়িগুলো সে ক’দিন আগে কিনেছে। কানে টপ দুল পরেছে আর গলায় পেন্ডেন। চুলগুলো খোলাই রেখেছে। মীরা বের হয়ে সাবরিনের কাছে যায়। সেখান থেকে ওরা অফিসে যায়। অফিসের বাসে করে সবাই রওনা হয়। সারা রাস্তা দু’জনে গল্প করে আর বাইরের সৌন্দর্য দেখে কাটিয়ে দিলো। সি বিচে যখন পৌঁছালো ততক্ষণে দশটার বেশি বেজে গেছে। বাসেই সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলেছে। তাই এখানে সবাই লাঞ্চ করবে আর সন্ধ্যার পর ফিরে যাবে।
বিচে গিয়ে মীরা লজ্জায় শেষ। সব মেয়েরা ছোট ছোট বিকিনি পরে পানিতে নেমেছে। আর কিছু কিছু মেয়েরা বালুর উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কেউ কেউ ভলিবল খেলছে। মীরার মাথা ঘোরাচ্ছে বলল,’এটা কোথায় এলাম আমি??’
সাবরিন মুখ টিপে হেসে বলল,’এতদিন শুধু মুভিতে দেখেছি এবার সামনাসামনি দেখলাম। কি মেয়ে এগুলো লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে দেখছি।’

মীরা ভাবলো এসব যদি মুহিত দেখতো তাহলে বেচারা লজ্জায় শেষ হয়ে যেতো। ওরা দুজনে সব জায়গায় ঘোরাঘুরি করলো। অনেক সেলফি ও তুললো সাথে ওই মেয়েদের দেখে অনেক হাসাহাসি করলো। দুপুর হতেই সবার ডাক পড়লো যে অফিসের বস সবাইকে ডাকছে। তিনি নাকি কিছু কথা বলবে। অগত্যা সাবরিনের সাথে মীরার যেতে হলো। কিন্তু ওখানে গিয়েই মীরা আরো অবাক হলো। এখানেও ইশান!!চেয়ারের উপর পা তুলে আরামে ফোন ঘাটছে সে। এতটাই মনোযোগ ফোনে তার যদি দুনিয়া উল্টেও যায় সে ফোন নিয়েই পড়ে থাকবে। কিন্তু মীরার ভাবনা ইশান এখানে কি করছে??

এই ছেলেটা কি সবসময় ওর পিছু পিছু যায় নাকি??মীরা সাবরিনকে কিছু বলার আগেই তাঁর চোখ যায় সামনে থেকে আসা তিনজন ব্যক্তির ওপর। মাঝের ব্যক্তিটি আর কেউ নয় স্বয়ং ইফাজ খান।
কথা বলতে বলতে ইফাজ একদিকে আসছে।মীরা দুকদম পিছিয়ে গেল। এতবছর পর ইফাজকে দেখে কেমন যেন লাগলো তার। এর আগে ছবিতে সে অনেকবার ইফাজকে দেখেছে তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি মীরার। মনের অজান্তেই চোখটা পানিতে ভরে এলো তার। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সাবরিনের সেদিকে খেয়াল নেই। ও বসের কথা শুনতে ব্যস্ত। ইফাজ এসেই ইশানের ঘাড়ে হাত রাখলো। ইফাজকে দেখেই ইশান দাঁড়িয়ে পড়লো। ইফাজ ইশানকে কিছু বলছে আর ইশান মাথা নাড়াচ্ছে।

মীরার কাছে এবার সব ক্লিয়ার। এটাই ইশান। মীরার সন্দেহ আজ ঘুচে গেছে। একধ্যানে মীরা ইফাজের দিকে তাকিয়ে রইল। ইফাজ তার কথা শেষ করে মীরার দিকে হেঁটে আসলো কিন্তু মীরার কাছে এসেই সে থেমে গেল।
মীরাকে সুক্ষ্মভাবে পরখ করে ইফাজ বলল, ‘তুমি?? তোমাকে তো চিনতে পারছি না।কে তুমি??’
মীরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। কিন্তু এখানে অনেক মানুষ তাই কিছু বলছে না সে। পাশ থেকে সাবরিন বলে উঠলো,’স্যার ও আমার ফ্রেন্ড তাই নিয়ে এসেছি।’
ইফাজ হালকা হেসে বলল,’গুড।’ তারপর সে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’কি নাম তোমার??’
মীরা কন্ঠস্বর কঠোর করে বলল,’হানি!!’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৭

‘খুব সুন্দর নাম। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে সবাই চলে এসো।’
ইফাজের পিছু পিছু ইশান ও চলে গেল। মীরাকে এখানে দেখে ইশান অবাক হলেও কিছু বলল না। মেয়েদের ব্যাপারে কিছু জানতে সে আগ্রহী নয়। মীরা ইফাজ আর ইশানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সাবরিন মীরাকে ঠেলা দিয়ে বলল,’তোমার নামটা বললে না কেন মীরা??’

সাবরিনের প্রশ্নের জবাব দিলো না মীরা। উল্টে সে বলল,’ওই লোকটা কে সাবরিন??’
‘উনি হলেন আমাদের কম্পানির ওনার ইফাজ খান। কিন্তু তুমি হঠাৎ এরকম হয়ে গেলে কেন??কি হয়েছে তোমার??’
এবারও মীরা কোন কথা বলল না শুধু বলল,’তোমার বসের বাড়ির ঠিকানা আমার চাই সাবরিন। তাড়াতাড়ি আমাকে সেন্ড করো।’
বলেই মীরা হনহনিয়ে চলে গেল। সাবরিন বোকার মতো মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে মীরার কি হলো তা সাবরিন বুঝতে পারছে না।

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৯