প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১০ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১০
সুমাইয়া জাহান

তূর্য আজ আজ চৌধুরীবাড়ীতে এসেছে বোনের সাথে দেখা করতে।এই দুই দিন একদম সময় পাইনি কলিজার টুকরো বোনটাকে দেখার।প্রচুর কাজের চাপ ছিলো। এখন তো আবার অফিসে সবকিছু খুব ভালো করে দেখতে হচ্ছে তাকে।যদি একটুও সুযোগ পায় শত্রু পক্ষের লোকেরা তাহলে সিকদার পরিবার সব কিছু হারিয়ে পথে বসতে হবে।শত্রু বাইরের হলে তার সাথে সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করা যায়। কিন্তু শত্রু যদি ঘরেই বন্ধু রুপে থাকে তাহলে তখন তার সাথে লড়াই করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।কথাগুলো ভেবেই তূর্য একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।

বাড়িতে ঢুতেই নীরের সাথে দেখা হয়ে গেলো।নীর তূর্যকে দেখেই একগাল হেসে সালাম দিলো।
—- আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
—- ওয়া আলাইকুমস সালাম।
তূর্যও মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলো। নীর কিছু একটা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো আর তূর্যকে বললো,
—- তূর্য ভাইয়া তোমার ঠিক মনে আছে শেষ কবে আমরা এই চৌধুরী বাড়িতে একসাথে ছিলাম!সেই দিনটা কতো আনন্দের আর ভয়ানক ছিলো!
—- হুম থাকবে না মনে! সেই দিনকি কখনো ভুলা যায়!ওইদিনের পর থেকেই তো সব কিছু বদলে গেলো।আচ্ছা বাদ দে এখন ওগুলো! আমি এখন পরীর সাথে দেখা করতে এসেছি।তাই আগে পরীর সাথে দেখা করবো।পরী কোথায় রে?
—- হুম তুমি আগে তূবার সাথেই দেখা করতে চলো।তারপর তোমার সাথে আমার কিছু কথা আসে।চলো তূবার কাছে নিয়ে যাই!
তারপরই নীর তূর্যকে নিয়ে উপরে উঠে তূবার ঘরের দিকে গেলো।

আজ শুক্রবার তাই আজ ভার্সিটি বন্ধ। আমি আর মামনী মিলে গল্প করছি কিছুক্ষণ হলো।তখনই কেউ আমার ঘরে ঢুকলো। হয়তো নীর এসে কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু নীর নয় সঙ্গে ভাইয়ুও আছে।আমি ভাইয়ুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কতোদিন পর ভাইয়ুকে দেখছি।ভাইয়ুর মুখটা অনেক টা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে এরকম হাল করছে নিজের!আমার দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মামনীও দরজার দিকে তাকালো।আর তাকাতেই মামনীর চোখ ছলছল করে উঠলো।কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে বলে উঠলেন,
—- তুর!!!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

মামনী তূর্য ভাইয়াকে দেখেই মামনী নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়াতে গেলেই নীর তাড়াতাড়ি এসে শক্ত করে মামনীর কাঁধ ধরে চোখ কিছু একটা ইশারা করতেই মামনী নিজেকে সামলে চোখের পানি মুছে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলেন।এখানে থাকলে যে বেশিক্ষণ বেশিক্ষণ নিজেকে সালাতে পারবেন না।মামনীর পিছু পিছু নীরও গেলো।জমামনীকে চলে যেতে দেখে তূর্য ভাইয়াও আড়ালে নিজের গড়িয়ে পরা দুফোঁটা চোখের পানি মুছে ফেললো।আমার আশেপাশে এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ আমি কিছুই জানতে পারলাম না।আমি এক ধ্যানে ভাইয়ুর দিকেই তাকিয়ে আছি।এবার ভাইয়ু আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত দুইটা নিজের মুঠের মধ্যে নিয়ে অপরাধী গলায় বললো,

—- পরীকি তার ভাইয়ুকে একটিবার ক্ষমা করতে পারবে না?
আমি অভিমান করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
—- কেউ ভুল করলে অবশ্যই ক্ষমা করা যায়।কিন্তু কেউ ইচ্ছে করে কিছু করলে তাকে কখনো ক্ষমা করা যায় না।
—- বিশ্বাস কর পরী আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি।সেদিন যদি আমি তোকে বেরিয়ে না যেতে বলতাম তাহলে বাবা তোকে আরো অনেক কঠিন শাস্তি দিতো।আর আমি কি কখনো তোকে কোনো শাস্তি পেতে দিতে পারি?তাই তোকে ইচ্ছে করে ওইসব বলে বের করেছিলাম।প্লীজ আমাকে ভুল বুঝিস না!
—- তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু কিন্তু ফোনে কেন ওইসব বললে?
—- তোর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখনই বাবা চলে আসে সামনে তাই তো তোকে ওইসব বলেছিলাম।তুই কি তোর ভাইয়ুকে চিনিস না?কি করে ভাবলি পরী আমি তোর সাথে ইচ্ছে করে ওইরকম খারাপ ব্যাবহার করতে পারি! এইকয়টা দিন আমার কেমন করে কেটেছে তোর কোনো ধারণা আছে?তুই একমিনিটের জন্য চোখের আড়াল হলে যেই আমি দিশেহারা হয়ে যাই সেই আমি কিভাবে তোর সাথে না দেখা করে না কথা বলে এতোগুলা দিন ছিলাম?এই চিনলি তুই আমাকে পরী?
ভাইয়ু কথাগুলো বলতে গিয়ে ভাইয়ুর চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠলো।আমিও আর অভিমান ধরে রাখতে পারলাম না।ভাইয়ুর বুকে গিয়ে হাউমাউ কেঁদে দিলাম। ভাইয়ু আমাকে থামালো না।কিছুক্ষণ কাঁদতে দিয়ে মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো,

—- এই পাগলী কাঁদছিস কেন?আমি কি মরে গেছি নাকি?
শেষ কথাটা বলার সাথে সাথেই ভাইয়ার মুখ চেপে ধরলাম।রাগী গলায় বললাম,
—- আর একবার যদি মৃত্যু কথা মুখে এনেছো?তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।ছোট্টো বেলায় মাকে হারিয়েছি তবে আমার মাকে একটুও মনে নেই।মায়ের ভালোবাসা মমতা কিছুই মনে নেই। মা কিরকম ছিলো সেটাই জানিনা!শুধু ছবিতে দেখেছি মাকে।কিন্তু মায়ের অভাব আমি কখনো বুঝিনি তোমার জন্য! তুমি আমাকে সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সেই ছোট্ট বেলা থেকে আগলে রেখেছো।এখন যদি তুমিও আমাকে মায়ের মতো ফাঁকি দিয়ে চলে যাও তাহলে তো আমার আর কেউই থাকবে না।তোমরা সবাই পঁচা!সবাই আমাকে ছেড়ে যাও!
কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছে।চোখ দিয়ে শুধু পানি গুলো গড়িয়ে পরছে।ভাইয়ু আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে ভাইয়ুর দিকে ফিরে বললো,
—- পরী একদম কাঁদবি না!আমি পৃথিবীর সবকিছু সইতে পারি কিন্তু তোর চোখের পানি আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না।জেনে রাখ আমি যা কিছু করছি শুধুমাত্র তোর জন্য!
ভাইয়ু আমার সাথে আরো কিছুক্ষন কথা বলে নীরে ঘরের দিকে চলে গেলো।

নীর ঘরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিলো।তখনই তূর্য ঘরে ঢুকলো আর ঢুকেই রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।তারপর নীরের কাছে এসে দাড়ালো।নীর তূর্য কে দেখে ফাইলটা পাশে রেখে বললো,
—- তোমার পরীর সব রাগ অভিমান শেষ হয়েছে?
নীরের কথায় বিনিময়ে তূর্য একটা মুচকি হাসি। তারপর বললো,
—- তুই কি যেন বলবি বলছিলি সেটা বল?
নীর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জানালার দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- কালকে কাকু এসেছিলো এখানে?
নীরের কথায় তূর্য চমকে গেলো।যেন এই ভয়টাই পাচ্ছিলো।
—- নিশ্চয়ই পরীকে নিতে এসেছিলো বাবা!
—- হুম!
—- তারপর কি হলো?
তারপর নীর কালকে আরমান সিকদারের সাথে ঘটে যাওয়া সব বললো।সব শুনে তূর্য চিন্তিত ভাবে বললো,

—- সব তো বুঝলাম কিন্তু পরী কেন বাবার ডাকে নিচে এলো না?পরী তো এমন না!আর ওতো এখনো কিছুই জানে না!তাহলে পরী কেন বাবার ডাকে নিচে নামলো না?
নীর বাঁকা হেসে বললো,
—- তূর্য ভাইয়া তুমি নীর চৌধুরীকে এতো কাঁচা খেলোয়াড় ভাবো!তূবার রুমটা সাউন্ড প্রুফ। তাই বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে যাবে না আর ভেতর কোনো কিছু বাইরে আসবে না।
তূর্য ঠোঁট কামড়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—- পরী তোকে বাবার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেননি?
—- সে করবে না আবার!তোমার বোন মাশাল্লাহ একটু কোনো কিছু পেলেই প্রশ্ন করে কান ঝালাপালা করে দিবে।কালকে হাজার টা প্রশ্ন করে আমার কানের বারোটা বাজিয়েছে।কয়দিন পর দেখবে তোমার ওই বোনের জন্য আমার কানে শোনাই দায় হয়ে যাবে।
তূর্য নীরের কথায় নীরের কান টেনে ধরে বললো,
—- ভুলে যাস না আমি এখন তোর বড়ো শালাবাবু হই।আমার সামনে দাড়িয়ে আমার বোনের নামেই নিন্দে করছিস।আর আমি চুপ করে সব শুনবো!এবার বলতো তুই পরীকে কি বলে শান্ত করেছিস?
নীর ব্যাথা না পেয়েও ব্যাথা পাওয়ার ভান করে বললো,
—- আহ্ ভাইয়া লাগছে তো কানে!আমাকে না ছাড়লে তোমার প্রশ্নের জবাব দিবো কি করে!
তূর্য নীরের কান ছেড়ে দিয়ে বললো,

—- নে ছেড়ে দিলাম এবার বল!
—- তূবাকে বলেছি কাকু চান না তূবা কোনোদিন ওই বাড়ি যাক!সব সম্পর্ক এখানেই শেষ করে দিয়েছেন। এর থেকে বেশি কিছু বলা লাগেনি তোমার আবেগ প্রবল বোন এইটুকু শুনেই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।
—- তুই আমার সহজ সরল বাবার নামে এতো বড়ো বড়ো মিথ্যে কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারলি নীর??
—- ?
—- আরে ওমন করে তাকাস কেন ভাই? আমি তো একটু মজা করছিলাম।মজাও বুঝিস না!
—- এমুহূর্তেও তুমি মজা করার মুডে আছো?তোমরা দুই ভাইবোনই সমান!সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যেও মজা ডুকিয়ে দেও!
—- আচ্ছা ওগুলো বাদ দে এখন বল কাজ কতো দূর এগোলো?ওরা আর কয়দিন আমাদের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াবে?ওদের অপরাধ গুলো তো দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে! ওদের এভাবে খোলা আকাশের নিচে আর বেশিদিন থাকতে দেওয়া যাবে না।সব পর্দার অবসান ঘটাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। সব কিছু যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৯

আরমান সিকদার নিজের রুমে টানানো একটা বড়ো ছবির দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত। অবশ্য এটা নতুন নয় যখনই মন খারাপ হয় তখনই এই ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই ছবির মায়াবী মুখ টা দেখলে যে মনের অনেক কষ্ট হালকা হয়ে যায় তাঁর! এই মায়াবী মুখের মানুষ টা একসময় তার বুকে মাথা রেখে না ঘুমালে ঘুম আসতো না অথচ আজ নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় তার বুকে মাথা না রেখেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে।ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে এলো আরমান সিকদারের।চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।ছেলেরা সহজে কাঁদে না কিন্তু খুব কষ্ট পেলে ছেলেদের চোখেও পানিরা এসে ভীর জমায়।যেমন তূর্য আর আরমান সিকদারের চোখেও আজ পানিরা এসে ভীর জমিয়েছে।

—- কেম চলে গেলে নীলাসা?কেন সেদিন আনন্দ গুলো এক মুহূর্তে ভয়ংকর কালো অতীত হয়ে গেলো?কেন?জানো কাল নীলিমার সাথে আবার দেখা হয়েছিলো।ও আমার কাছে ছুটে চলে না এসে আমার সাথে কড়া গলায় কথা বলেছিলো।আমিও ওকে অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে এসেছি।ভালো করেছি না নীলাসা?
কথাগুলো বলতে বলতে আরমান সিকদারের গলা ধরে এসেছে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে পরতেই চোয়াল শক্ত করে বললো,

—- নাহ্!একবার আমি অনেক কিছু হারিয়েছি আর পারবো না কিছু হারাতে!তূবাকে যে করেই হোক চৌধুরী বাড়ী থেকে বের করে আনতেই হবে!এরজন্য আমাকে যতো নিচে নামতে হয় আমি নামবো!কিন্তু আমার মেয়ে আমি আবারও হারাতে পারবো না!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১১