প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৯ || nill cafer diary

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৯
সুমাইয়া জাহান

তূবাকে ডাকতে ডাকতেই আরমান সিকদারে চোখ সিড়ির দিকে গেলো।সেখানে নীলিমা চৌধুরী মানে নীরের মা দাড়িয়ে আছে।নীলিমা চৌধুরীকে দেখেই আরমান সিকদারের চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠলো।এতো বছর পর আবার সেই প্রিয় মুখ!আরমান সিকদারের মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আছলো,
—- নীলিমা!!
নীলিমা চৌধুরীরও চোখ ছলছল হয়ে উঠলো।বহুবছর পর সেই প্রিয় মুখ থেকে প্রিয় ডাকটা যে বড্ড আপন লাগছে।ইচ্ছে করছে সব রাগ অভিমানের দেয়াল ভেঙ্গে ছুটে যাই সেই মানুষ টার কাছে।কিন্তু ভাগ্যের সেই নির্মম পরিহাসে সেটা আর এখন সম্ভব না।অতীতের স্মৃতি গুলো মুনে পরতেই নীলিমা চৌধুরী নিজেকে সামলিয়ে মুখে গম্ভীর ভাব এনে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বয়ে নিচে নামতে নামতে গম্ভীর গলায় বললো,

—- মিস্টার আরমান সিকদার তো দেখি আজকাল ভদ্রতা ভুলে গেছে।কিন্তু আমি যে অভদ্রতা মেনে নিবো না মিস্টার আরমান সিকদার! আমাকে মিসেস চৌধুরী বলে ডাকবেন আর না পারলে ডাকার প্রয়োজন নেই।
নীলিমার কথাটা আরমান সিকদার বুকে তীরের মতো ঘাতলো।তারপরও নিজেকে সামলিয়ে মুখে গম্ভীর ভাব এনে বললো,
—- সরি সরি মিসেস চৌধুরীর ভুলে বলে ফেলসি! আর এমন ভুল দ্বিতীয় বার হবে না মিসেস চৌধুরী।
—- হুম তা বুঝলাম। হঠাৎ এতো বছর পর চৌধুরী বাড়িতে আপনার পদধূলি পরলো কেন?
—- আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মিসেস চৌধুরী এ বাড়িতে আমার মেয়ে আছে। আমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।সেদিন রাগের মাথায় আমার মেয়েকে আমি উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়েছি তাই এখন ও আপনার বাড়িতেই আছে।আমি আমার মেয়েকেই ফিরিয়ে নিতে এসেছি।
নীলিমা চৌধুরী সোফায় বসলো।একটু ভাবার ভান করে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- ও হ্যাঁ আপনার মেয়ে তো এখন আমার বাড়ির পুত্রবধূ! তা আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন বসুন।আপনি এখন চৌধুরীবাড়ীর সমন্ধি বলে কথা আপনার কি কোনো অযত্ন হতে দিতে পারি!তা কি যেন বলছিলেন?আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন তাই না!কিন্তু ও তো এখন তূবা সিকদার নেই ও তো একবছর আগেই তূবা চৌধুরী হয়ে গেছে।হ্যাঁ এতোদিন আমরা কাউকে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি। তাই এতোদিন আপনার বাড়িতেই ছিলো।কিন্তু এখন তো আর মানবো না!চৌধুরী বাড়ির বউ চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে।
আরমান সিকদার এবার রেগে গেলেন বেশ রেগেই বললেন,
—- আমার মেয়ে কখনোই চৌধুরী বাড়ির বউ হতে পারে না।আমি এই বিয়ে মানি না।একটা মিথ্যে কাগজ দেখিয়ে যা খুশি বললেই হবে!আমার মেয়েকে আমি এখুনি নিয়ে যাবো! দেখি কার কতো ক্ষমতা আছে আমাকে আটকানোর!
নীলিমা চৌধুরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই একই রকমভাবে বসে শান্ত গলায় বললেন,
—- চিৎকার করে বললেই সত্যি বদলাবে না মিস্টার আরমান সিকদার! যেটা সত্যি সেটা সত্যিই থাকবে।

আবিরের সাথে দেখা করার পর আমরা আবার ভার্সিটি আসলাম।আবিরের মনের ভয়টা এখন অনেক টাই কমেছে।আবিরের বাবা-মা থেকে জানতে পারলাম আবির নাকি ছোটো বেলা থেকেই মানসিক ভাবে দুর্বল। তাই একটুতেই ও ভয় পেয়ে যায়।তাই রিমি ওকে কাল ওভাবে মারাতে একটু বেশিই ভয় পেয়ে গেছিলো তাই এতোটা সমস্যা হয়ে গেছে।এরকম সমস্যা আবিরের এর আগে অনেক বার হয়েছে আর অনেক বার হসপিটালে ভর্তিও হতে হয়েছে।রিমি আবিরের মা বাবার কাছেও অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে ওর ব্যবহারের জন্য। আবিরেট যেহেতু এর আগেও অনেকবার এই সমস্যা হয়েছে তাই উনারাও এনিয়ে বেশি কিছু বলেননি।আবিরের কন্ডিশন এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেক টাই ভালো। ডক্টর বলেছেন আর তিনদিন পরই আবির কে রিলিজ করে দেওয়া হবে।সব কিছু ভালোই ভালোই শেষ হয়ে গেছে এতেই সবাই খুশি।

ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে আমি আর রিমি কেন্টিনে এসেছি।নীরের এখনো একটা ক্লাস বাকি আছে তাই ওর জন্য আমাকে আবার অপেক্ষা করতে হবে।রিমি আমাকে একা ছেড়ে আর যায়নি। নীর আসা পর্যন্ত আমার সাথেই থাকবে।তাই সময় কাটাতেই আমাদের এখানে আসা।আমি দুই টা কফি অডার করলাম।কফি খেতে খেতেই রিমি বললো,
—- আচ্ছা তূবা তুই কি নীর ভাইয়ার সাথে বিয়ে টা এখনো মেনে নিসনি?
আমি রিমির কথায় কিছুক্ষণ ভেবে নিলাম তারপর বললাম,
—- না মানার তো কিছু নেই।আমার তো কারো না কারো সাথে বিয়ে হতোই!নীরের সাথেই না হয় হয়েছে।নীর তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমরা দুজন দুজনকে ভালোভাবেই চিনি জানি।ওকে আমি স্বামী হিসেবে পেয়ে খুশি।আমিও ওকে একটু একটু পছন্দ করতাম।তাই মেনে না নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।তবে নীর এতো নাটক করে বিয়ে টা করাতে আমার একদমই ভালো লাগেনি।ও তো পারতো আমার বাড়ি গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে।বাবা ভাইয়ু কি ওকে ফিরিয়ে দিতো?তখন তো খুব সহজেই বিয়েটা হতে পারতো!এখানে এতো নাটক করার কি আছে আমি বুঝি না বাপু!
রিমি আমার কথায় একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

—- এর পিছনে হয়তো কোনো কারণ আছে!তাই এতো নাটক করে বিয়েটা করতে হলো।
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—- কারণ আছে না ছাই!আমার কতো ইচ্ছে ছিলো আমার বিয়েতে কতো মজা করবো কতো কিছু করবো!হ্যাঁ কয়দিন আগে আমার ওই না হওয়া বিয়ের সময় সব কিছুই হয়েছিলো কিন্তু আমার তো ওই গোমড়া মুখি পত্রটাকেই পছন্দ হয়নি তাই রাগ করে কোনো কিছুই করিনি।আর নীর তো এক নাম্বারের বজ্জাৎ!কি চালাক রে বাবা! বিয়েতে টাকা খরচ হওয়ার ভয়ে আমার থেকে লুকিয়ে একবছর আগেই সাইন নিয়ে বিয়ে করে ফেললো!
কথা গুলো বলেই ঠোঁট উল্টো করে মুখ ফুলিয়ে মুখে দুই হাত রেখে বসে রইলাম।আমার কথা শুনে রিমির তো হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাওয়ার উপক্রম!
নীর এতোক্ষণ তূবার সব কথাই শুনছিলো।আসলে আজ শেষ ক্লাসটা তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেছে। তাই তূবাকে নিতে কেন্টিনে ঢুকছিলো।তখনই তূূবার কথা শুনে দাড়িয়ে পরে।নীর এটা জেনে খুব খুশি হলো যে নীরকে তূবা মেনে নিয়েছে।এতোদিন একটা অপরাধ বোধ কাজ করতো নীরের মনে তূবার জন্য।নীর শুধু মনে হতো তূবা হয়তো নীরকে নেনে নেয়নি।শুধুমাত্র বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে বলে ওর সঙ্গে থাকছে।কিন্তু আজ তূবার কথায় মন অনেক টা হালকা হয়ে গেছে।তবে তূবার শেষের কথা গুলো শুনে নীরের বড্ড হাসি পাচ্ছে। তূবার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বললো,

—- চিন্তা করো না বউ তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করার জন্যই তোমার বর হাজির আছে।তবে সেটা এখন সম্ভব না।আগে তো……
কথাটা আর শেষ করলো না নীর।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তূবার দিকে এগিয়ে গেলো।
আমি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম।তখনই নীর আসলো আমাদের দিকে।নীর আসতেই আমরা দুজন উঠে পরলাম।নীর এসেই বললো,
—- চল চল!আমার আজকে তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। আর রিমি ভাবি তুমিও আমাদের সাথে চলো আমরা যাওয়ার পথে তোমাকে ড্রপ করে দিবো।
রিমিও আর কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলো আমাদের সাথে যেতে।রিমিকে পথে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আমরা চৌধুরী বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
??
বাড়ির দরজার সামনে আসতেই আমি থমকে গেলাম।আর এগোতে পারলান না।সামনে বাবা দাড়িয়ে দাড়িয়ে মামনীর সাথে কথা বলছে।আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নীর ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—- দরজার সামনে এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?যদিও খাম্বার সমান লম্বা হতে পারিসনি এখনো!
—- ওই দিকে দেখ!

আংগুল দিয়ে ইশারা করে বাবাকে দেখিয়ে বললাম।আমার আংগুল বরাবর সামনের দিকে বাবাকে দেখতেই নীরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।নিজের রাগ দাঁতে দাঁত চেপে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে আমাকে রাগী গলায় বললো,
—- তূবা এখানে এক সেকেন্ডও আর না দাঁড়িয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে যা।
হঠাৎ নীরের এমন রাগ দেখে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ও আমার সাথে রেগে কথা বললো।সেইদিন বিয়ের আসরে প্রথম আর আজ আবার।এছাড়া কোনো দিন ও আমার সাথে রেগে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—- কেন?ওই দিকে দেখ বা……
আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
—- তুই আমাকে সত্যি কারে বন্ধু ভাবিস তো?যদি ভেবে থাকিস তাহলে আমার এই কথাটা তুই রাখবি!কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ নিজের ঘরে যা।আর যদি তা না করিস তাহলে ভাববো তুই কোনোদিন আমাকে বন্ধু ভাবিসই নি।
—- কিন্তু……..
—- আর কোনো কিন্তু নেই। তোকে যেতে বলেছি মানে তুই যাবি।
এবার বেশ রেগে বললো কথাটা নীর। তাই আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আজ ওর রাগের কাছে চুপসে গেলাম।তাই আর কিছু না বলে উপরে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম।বাবার উল্টো দিক দিয়ে আসার কারণে বাবা আমাকে দেখেনি।কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন টা রয়েই গেলো কেন এসেছে বাবা?বাবার রাগ তো এতো তাড়াতাড়ি ভাঙ্গার কথা না!বাবা একবার রেগে গেলে তো সেই রাগ ভাঙ্গতে অনেক সময় লাগে!তাহলে কেন এসেছে এখানে বাবা?এইসব প্রশ্ন ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরে চলে এলাম।

তূবা উপরে চলে যেতেই নীর আরমান সিকদারের দিকে এগিয়ে আসলো।এসেই একটা ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে বললো,
—- আজ কি এমন ঘটলো যে স্বয়ং আরমান সিকদার কে চৌধুরীবাড়ীতে পা রাখতে হলো?
আরমান সিকদার পিছনে ঘুরে নীরের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—- চৌধুরীবাড়ীর লোকেদের তো অন্যের আপন জন কেরে নেওয়ার পুরোনো অভ্যাস আছে।তাই এবার আর আপন জন কে চিরতরে হারিয়ে ফেলার আগেই নিয়ে যেতে আসলাম।বারবার তো আর আপনজন কে হারাতে দিতে পারি না!তোমার মায়ের থেকে শুনলাম তূবা তোমার সাথে ভার্সিটি গেছে।তাহলে তো তোমার সাথেই বাড়ি ফেরার কথা!কোথায় আমার মেয়ে?আমার মেয়েকে আমাকে দিয়ে দেও আমি চলে যাই।
—- সেকি আপনি ওকে দেখতে পাননি ওকে?ও তো আপনার সামনে দিয়েই এইমাত্র উপরে চলে গেলো।অবশ্য দেখবেন কি করে আপনি তো আবার চোখে কালো কাপড় বেধে ঘুরে বেড়ান!
নীরের কথায় আরমান সিকদার খুব রেগে গেলো।আর জোরে রেগে বললো,

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৮

—- একদম বাজে কথা বলবে না……
—- কুল মিস্টার আরমান সিকদার! এটা ভদ্রলোকের বাড়ি এখানে চিৎকার দিয়ে কথা বলবেন না!আপনার মতো একজন ভদ্রলোককে নিশ্চয় এর থেকে বেশি কিছু বলা লাগবে না!
আরমান সিকদার নীরের৷ কথায় এবার অপমানিত বোধ করলো।রাগটাকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- তূবা কখনোই আমাকে দেখে আমাকে এড়িয়ে চলে যাবে না।
নীর কিছু না বোঝার ভান করে বললো,
—- তা তো আমি যানি না! তূবা তো আপনাকে দেখেই কিছু না বলে উপরে চলে গেলো।আপনি ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন তাই না!ওকে আপনাকে একটা শেষ সুযোগ দেই আপনি তূবাকে ঢাকুন! ও যদি আজ আপনার ঢাকে বের হয়ে আপনার সাথে যেতে চায় তাহলে আপনি ওকে নিয়ে যাবেন।আমি আপনাকে কোনো বাঁধাই দিবো না।কিন্তু আজ যদি তূবা আপনার না যায় তাহলে কোনোদিনও ও আপনি ওকে নিতে আসবেন না।
নীরের কথায় নীলিমা চৌধুরীর কোনো ভাবান্তর নেই যেন কিছুই হয়নি।তিনি আগের মতোই আরমান সিকদার নীরের কথা শুনছেন।আরমান সিকদারের নীরের কথাটা ঠিক হজম হলো না।কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো।তারপরও মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য নীরের দেওয়া শর্তে রাজি হয়ে গেলেন।আর বাবার ডাকে তো তূবা নিশ্চিত নিচে আসবে তাই আর কথা না বাড়িয়ে তূবাকে ডাকতে লাগলো,

—- তূবা মামনী তাড়াতাড়ি নিচে আসো।আমি তোমাকে নিতে এসেছি।আমাকে ক্ষমা করে দেও মামনী আমি রাগের মাথায় তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি।মামনী তাড়াতাড়ি নিচে আসো আমি তোমার জন্য ওয়েট করে আছি।তূবা মামনী!!
এমন করে তূবাকে অনেকবার ডেকে চলেছে আরমান সিকদার।কিন্তু তূবা নিচে নামা তো দূর একবারের জন্য সারাও দেয়নি।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ১০