প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৫ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৫
সুমাইয়া জাহান

—- কিরে তোর রেলগাড়ী অবশেষে এসে পৌঁছাতে পারলো?
ভ্রু কুঁচকে এই কথার মালিককে খুঁজতে লাগলাম।এর জন্য আমাকে বেশি বেগ পেতে হয় নি।কারণ এই কথার মালিক আমার সামনের বেঞ্চ টাতেই বসে আছে।ওকে দেখতে পেয়েই হাতে থাকা বইটা দিয়ে ওর মাথায় একটা বারি মারলাম।আর ওর পাশে বসে পরলাম।ও হচ্ছে আমার ক্লাসমেট রিমি অর্ধেক বন্ধু আর অর্ধেক হবু ভাবি।আমার ভাইয়ু তূর্য সিকদার যাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।আমার যে ভাইয়ু টা সবার জন্য বাঘ সেই ভাইয়ু টাই ওর সামনে আসলে বেড়াল হয়ে যায়।রিমিও ভালোবাসে তবে সারাক্ষণ আমার ভাইয়ুটাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতেই থাকে।
—- এতোদিন হয়ে গেলো আমাকে একটা ফোন করে কিচ্ছু টি জানানোর প্রয়োজনও মনে করলি না?
রিমির কথায় আমার ভাবনার ছেদ হলো।ওর দিকে না তাকিয়ে বই ঠিক করতে করতে বললাম,
—- তোকে জানানোর লোক তো আছেই! তাহলে আমি শুধু শুধু কষ্ট করে আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ করে জানাতে যাবো কেন?

—- তোর বজ্জাৎ ভাই তো শুধু তোর সাথে নীর ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে এইটুকুই বলেছে আর বাকিটা তোর থেকে শুনে নিতে বলছে।তুই নাকি তার ফোন ধরছিস না!
রিমির কথায় আমি ওর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললাম,
—- কেন ধরবো আমি তার ফোন? তুই জানিস আমার কি কি করেছে!
রিমি হতাস হয়ে মুখে দুই হাত দিয়ে বললো,
—- কেউ যদি আমাকে কিছু নাই বলে তবে আমি কি করে জানবো! তোরা দুই ভাই বোনই সমান কেউ বলে তো বোনের থেকে জেনে নেও আবার কেউ কিছু না বলেই জিজ্ঞেস করে জানি কিনা!আমি তোদের দুই ভাই বোনের মধ্যে পরে আলুর ভর্তা হয়ে যাচ্ছি!
—- তোকে আর কষ্ট করে আলুর ভর্তা হয়ে হবে বলছি সব।
তারপরই রিমিকে প্রথম থেকে সব খুলে বললাম।রিমি সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
—- হুম তূর্যের উপর রাগ করাটা তোর স্বাভাবিক। কিন্তু একটু ভেবে দেখ তোর যে ভাই তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে তোর সামান্য কিছু হলে যে পাগল হয়ে যায়। কোনোদিন একটু রাগ করে কথা বলেনি সেই ভাই কেন এমন টা করছে।আর নীর ভাইয়ার সঙ্গে তোকে এতো সহজে চলে যেতে বললো!ব্যাপার টা একটু অদ্ভুত না!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

রিমি তো ঠিকই বলছে ভাইয়ু কেন এমন করছে?ভাইয়ু তো সবসময় আমাকে বিশ্বাস করে।তবে সেদিন কেন বিশ্বাস করলো না?নীরের সাথে কেনই বা চলে যেতে বললো?আর ফোনে ওইভাবেই বা কেন কথা বললো?আর কিছু ভাবতে পারলাম না এরমধ্যেই উদাহরণ স্যার চলে এসেছে।আসলে উনি ক্লাস ঢুকলেই আসলেই পৃথিবীর সব বিখ্যাত মানুষের উদাহরণ শুরু করে দেন।আর সেই উদাহরণ দেওয়া শেষ করেন ক্লাস শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে।তাই ক্লাসের সবাই উনাকে উদাহরণ স্যার নাম হিসেবেই চেনে।যদিও বা উনি উনার এই এতো সুন্দর নাম খানা এখনো জানেন না!কিন্তু ক্লাস কি পুরো ভার্সিটির স্টুডেন্টরাই উনাকে এক নামে মানে উদাহরণ স্যার নামে চেনে।উনার আসল নামটাই কি যেন ছিলো? উফ উনার আসল নামটাই তো ভুলে গেছি! রিমিকে কলম দিয়ে একটা খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
—- এই হবু ভাবি উদাহরণ স্যারের আসল নামটা কি যেন ছিলো?আমার কিছুতেই মনে পরছে না একটু বলনা!
রিমি আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো,

—- হবু ননদিনী আপনার কি মনে হয় এই উদাহরণ স্যার আসল নাম আমার মুখস্থ! এই ভার্সিটির ভর্তি হওয়া থেকে তো উদাহরণ স্যার নামেই জানি!
আমি কলম ঘুরাতে ঘুরাতে উদাহরণ স্যারের নাম ভাবতে লাগলাম।ভাবতে ভাবতে একটা নামও পেয়ে গেলাম আর নামটা পেয়েই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
—- হবু ভাবি গো উদাহরণ স্যারের আসল না মনে হয় ভোজন ।
রিমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—- ভোজন কেন?
—- দেখছিস না স্যারের পেটটা কতো ছোট্ট ওখানে মাত্র দুই হাতি থাকার জায়গা হবে। এতেই তো বোঝা যাচ্ছে স্যার আমাদের কতো কম খায়!কতো শুকনা একজন মানুষ বেশি হলে একশো দশ কি বিশ কেজি ওজন হবে উনার।তাই উনি কম খায় বলে উনার নাম ভোজন স্যারই হবে।
স্যারের নামের বিবরণ শুনে রিমি ফিক করে হেসে দিলো।হাসিটা মনে হয় উদাহরণ স্যারের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তাই স্যার তার উদাহরণ দেওয়া বন্ধ করে রাগী গলায় বলে উঠলেন,
—- কে হাসছে অসভ্যের মতো ক্লাসের মধ্যে?
আমাদের পিছন থেকে একটা ছেলে হুট করে বলে উঠলো,
—- স্যার এই নীল ওড়নাওয়ালা মেয়েটা!
সাথে সাথেই রিমি ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা একটা শুকনো ঢোক গিলো।ছেলেটা রিমিকে দেখে ভিষণ ভয় পেয়ে গেলো।ছেলেটা বেশ ভালো বুঝতে পারছে ভুল জায়গায় ভুল কিছু বলে ফেলছে।স্যার এরমধ্যেই আবার বলে উঠলেন,

—- মিস নীল ওড়না উঠে দাঁড়াও তো!
রিমি ছেলেটার চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালো তোকে দেখে নিবো।তারপর স্যার কথা মতো উঠে দাঁড়ালো। ও দাঁড়াতেই বেশ শান্ত গলায় স্যার বললেন,
—- পুরো পৃথিবীতে হাসির জন্য কোন ব্যক্তি বিখ্যাত ছিলেন?
রিমি বেশ কিছুক্ষন ভেবে কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে বললো,
—- সরি স্যার আমার জানা নেই।
এবার স্যার রেগে বললেন,
—- যখন জানোই না তখন ক্লাসের ভিতর হাসছিলে কেন?
—- সরি স্যার আর হবে না।
—- হুম তাতো বুঝলাম আর হবে না। কিন্তু আজ হতো অন্যায় টা করে ফেলছো তাই একটা শাস্তি তো তোমার পাওনা।উমমম…..শাস্তি হিসেবে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেও। বলতো সরি শব্দ প্রথমে কোন বিখ্যাত ব্যক্তি আবিস্কার করেছেন?
রিমির এবার কেঁদে দেওয়ার উপক্রম।ওকে অপদস্ত করার জন্য স্যার ইচ্ছে করেই এইসব প্রশ্ন করছে এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।রিমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—- স্যার আমার অনেক বড়ো ভুল করেছি।আর জীবনেও কোনো ক্লাসে হাসবো না এবারের মতো ক্ষমা করে দিন প্লিজ!
—- ওকে এবারের মতো ক্ষমা করছি তবে ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসতে পারবে না।
—- ওকে স্যার।

রিমি ঘাড় ঘুরিয়ে কথাটা বললো।স্যারও আবার তার উদাহরণের ঝুলি নিয়ে বসলো।এবাবে আমাদের সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলো।ক্লাস শেষ হতেই তখনকার ওই ছেলেটা চারিদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে খুব সাবধানে ক্লাস থেকে বেরিয়েই একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো।যেই বড়ে মাঠটার দিকে পা বাড়ালো ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা হাত এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে মাঠের ভিতর ফেলে দিলো।ছেলেটা টাল সামলাতে না পেরে মাঠে পরে গেলো।ধাক্কা দেওয়া মানুষ টার দিকে তাকাতেই ছেলেটার আত্মা শুকিয়ে এলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে অনুরোধের সুরে বললো,
—- আপু প্লিজ মাফ করে দিন!বিশ্বাস করুন আপু আমি বুঝতে পারনি ওইটা আপনি ছিলেন।আমি যদি একটুও বুঝতে পারতাম ওইটা আপনি তাহলে জীবন গেলেও আপনার নাম টা বলতাম না!প্লিজ আপু এবারের মতো ক্ষমা করে দিন!

সামনে থাকা রিমি দুই হাত কোমরে রেখে বাঁকা হেসে শান্ত গলায় বললো,
—- তুই ঠিক থাকলে তারপর তো আমার নামটা বলবি!
এরপরই উরাধুরা পিটুনি শুরু করলো রিমি ছেলেটাকে।ছেলেটা তো অসহায়ের মতো ওর পিটুনি খাচ্ছে আর সরি বলে যাচ্ছে। পুরো ভার্সিটির সবাই হা করে এই দৃশ্য দেখছে।আমি ওকে অনেক থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই থামাতে পারছি না।ও তো একের পর এক লাথি মেরেই যাচ্ছে ছেলেটাকে।একটু পরে নীর আসলো।ও এসেই কিছুক্ষণ রিমির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে এখানে।ছেলেটার দিকে তাকাতেই তাড়াতাড়ি আমার সাথে রিমিকে থামাতে লাগলো।
—- আরে আরে রিমি ভাবি ওকে আর মেরো না। দেখো তোমার মার খেয়ে বেচারা আধমরা হয়ে গেছে।এবার থামমো!
নীরের কথায় ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে সত্যি ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ছেলেটার জামাটা টেনে ধরে বললো,
—- নেক্সট টাইম যদি তোকে আমার চোখের সামনে দেখি তাহলে ওইদিনই তোর শেষ দিন হবে।কথাটা মাথায় রাগবি!
রিমি কথাটা বলেই আবারও ছেলেটাকে একটা লাথি মেরে হনহন করে ওখান থেকে চলে গেলো।ও চলে যাওয়ার পর আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম। পাশ থেকে নীর কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,
—- তূবা তোর হবু ভাবির মাথা এতো গরম হলো কেন রে?আর ছেলেটা কি করেছে? আমাকে একটু বলতো!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৪

আমি সব বললাম৷ নীর সব শুনে হাসতে হাসতে শেষ।
—- সিরিয়াসলি! ভুষণ স্যার এই প্রশ্ন গুলো করেছে?
—- ভুষণ স্যার আবার কে?
আমি না বুঝতে পেরে নীরকে উল্টো প্রশ্ন করলাম। নীর আমার প্রশ্ন শুনে হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তারপর বললো,
—- ভুষণ স্যারকে চিনিস না?ওই এতক্ষণ যেই স্যারের কথা বলছিলি উনার নামই তো ভুষণ স্যার।
—- ওহ্!
তারমানে আমার ধরনা করা নামের সাথে অনেকটা মিলে গেছে।ভোজন ভুষন!বাহ আমি খুব জিনিয়াস হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।উফফ নিজের প্রশংসা নিজে করলে কেমন দেখায়!কালকে রিমি বললো ওই প্রশংসা করবে না-হয়! আমার ভাবনার মাঝে নীর আবার বললো,
—- কি এতো ভাবছিস?
—- কিছু না!ছেলেটাকে দেখ খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে।ওকে তো হসপিটালে নিতে হবে।
নীর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটা ফুস করে শ্বাস ফেলে বললো,
—- হুম!

তারপর আরো কয়েক মিলে ছেলেটাকে কাছাকাছি একটা হসপিটালের ভর্তি করে দিলো।ছেলেটার জনমনের মতো শিক্ষা হয়ে গেছে আজকে।জীবনে কোনোদিন আর কাউকে ধরিয়ে দেওয়ার কল্পনাও করবে না।
এতক্ষণ এতো সবকিছুই আড়াল থেকে তূর্য দেখছিলো।আজ তূবা ভার্সিটিতে এসেছে জানতে পেরে বোনের রাগ ভাঙ্গাতে এখানে এসেছিলো।বোনের রাগও ভাঙ্গাবে আর তার প্রিয়সীর সাথেও একবার দেখা করবে।কিন্তু এখানে এসে রিমির এমন রন মূর্তির রুপ দেখে ভয়ে আড়ালে লুকিয়ে গেছিলো।বিরবির করে বললো,
—- বউ তো নয় যেন আগুনের গোলা।উমম টা তো ছেলেদের ক্ষেত্রে বলা হয় তাতে কি আমার বউ উফস সরি হবু বউয়ের ক্ষেত্রে এটা বলাই যায়!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৬