প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৭ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৭
সুমাইয়া জাহান

বাগানে আসতেই চোখ দুটো আমার রসগোল্লা থেকেও মনে হয় বড়ো হয়ে গেছে।এইটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।বাগানে একটা ফুচকার স্টল তার পাশেই নীর দাড়িয়ে আছে।ফুচকার স্টল টা দেখে আমার এমন অবস্থা না!স্টলের পাশে থাকা নীরকে দেখে আমার এমন অবস্থা। নীড় একটা লুঙ্গি পরে আছে তাও আবার দুই ভাজ করা হাঁটু পর্যন্ত।ও জীবনে কোনোদিন লুঙ্গি পরাতো দূরের কথা স্পর্শ করেছে কিনা সন্দেহ। আবার লুঙ্গির সাথে একটা সাদা গেঞ্জি আর মাথায় একটা লাল রঙের গামছা বাঁধা। হাতে একটা প্লেট আর চামচ যেইটা দিয়ে এতোক্ষণ আওয়াজ করছিলো।ওকে এখন দেখতে একজন কৃষকের থেকে কম লাগছে না।
কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। তারপরই কেমন মাথা ঘুরতে শুরু করলো।মাথায় হাত দিয়ে পরে যেতে নিলে নীর তারাতাড়ি এসে আমাকে ধরে ফেললো।আমার মুখ স্পর্শ করে ব্যাস্ত গলায় বললো,

—- তূবা!এই তূবা কি হয়েছে তোর?শরীর খারাপ লাগছে?
আমার কাঁপা কাঁপা হাত টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
—- আমায় একটা চিমটি কাট তো!
নীর অবাক চোখে একবার আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—- কি হয়েছি কি তোর এমন পাগলের মতো বকছিস কেন?
আমি বিরক্ত হয়ে একটা ঝাড়ি মেরে বললাম,
—- তোকে চিমটি কাটতে বলছি আগে চিমটি কাট পরে কথা বলবি!
নীর আমার কথায় আরো অবাক চোখে তাকাতেই ওর দিকে হাত টা আরো একটু এগিয়ে দিলাম।নীর একটা চিমটি কাটতই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে হাত ডলতে ডলতে বললাম,
—- আহ্ এতো জোরে চিমটি কাটলি কেন?একটা চিমটি কাটতে বলেছি বলে কি এতো জোরে কাটবি?কমনসেন্স নেই!
নীর এখনো আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি কিছুক্ষণ হাত ডলতে ডলতে নীরের কথা মনে পরতে দ্রুত ওর দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে অবাক চোখে বললাম,
—- ভার্সিটিতে তো কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না তাহলে তুই এমন কৃষকের গেটআপ নিয়েছিস কেন?তোর শরীর ঠিক আছে তো! এই সন্ধেবেলায় তুই এগুলো কোন নাটকের রিয়াসেল করছিস?
নীরের এবার বোধগম্য হলো আমি এতোক্ষণ এরকম করার কারণ ওর গেটআপ।একটা ফুস করে শ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- আমি ভেবেছিলাম তুই ফুচকার দোকান আর আমাকে ফুচকাওয়ালার গেটআপে দেখলে খুশি হবি।আর নিজের মৌনব্রত ভাঙ্গবি।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি বুঝতেই পারনি এভাবে তুই যে আমাকে দেখলে এমন পাগলের মতো বিহেভ করবি!
ওকে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
—- নিজেতো ফুচকাওয়ালা সাজতে গিয়ে কৃষক সেজেছিস আর আমি কিছু বললেই পাগল হয়ে গেলাম!
নীর নিজেকে ঠিকঠাক করে উঠে ইনোসেন্ট ফেইস করে বললো,
—- ফুচকাওয়ালার মতো দেখতে লাগছে না?
ওর কথায় আমি আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।ফিক করে হেসে দিলাম।হাসতে হাসতে বললাম,
—- মন্দ লাগছে না কিন্তু! ফুচকাওয়ালা কৃষক।
বলতে বলতেই আবারও হাসিতে ফেটে পরলাম।
আর এদিকে নীরের তূবার হাসি দেখতে ভিষণ খুশি হলো।এতোক্ষণ এতো কিছু করেছে শুধুমাত্র এই হাসিটার জন্যই!তূবা ফুচকা খেতে ভালোবাসে। তখন ফুচকার কথা মনে আসতেই ওর লোক দিয়ে একটা ফুচকার স্টল আনিয়েছে।তারপর ইউটিউব দেখে লুঙ্গি পরা শিখে লুঙ্গি পরেছে।আর এইরকম গেটআপ নিয়েছে তূবার মুখে এই হাসি টা দেখার জন্য। অবশেষে তূবার মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হলো নীর।তূূবার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গলো নীরের!

—– তুই এতো সুন্দর একটা গেটআপ নিয়েছিস একটা সেলফি না তুললে কেমন দেখায়!ওদিকে চল!
কথাটা বলেই নীরের হাত ধরে ফুচকার স্টল টার সমানে দাঁড় করিয়ে আমিও পাশে দাড়িয়ে একটা সেলফি তুলতে নেওয়ার আগেই নীর ফোনটা হাত থেকে নিয়ে কড়া গলায় বললো,
—- আমি শুধু তোর মৌনব্রত ভাঙ্গানোর জন্যই এই গেটআপ নিয়েছি তাই বলে তুই যা খুশি তাই করবি?
—- বেশি না শুধু একটা সেলফি তুলবো।প্লীজ এমন করিস না শুধু একটা সেলফি তুলতে দে!প্লীজ প্লীজ প্লীজ! শুধু একটা!
খুব অনুরোধ করে একটা সেলফি তোলার অনুমতি নিয়েই ছাড়লাম নীরের থেকে।অবশেষে সেলফি তুলতে পারলাম।কিন্তু এই নীরকে সেলফিতে এক ফোটাও হাসিও ফোটাতে পারলাম না।ব্যাটা সেলফির ভিতরে একদম ইনোসেন্ট ফেইস করেই রইলো।তাও ভালো একটা সেলফি তো তুলতে পারলাম।” আমার ফুচকাওয়ালা কৃষক বর আমাকে ফুচকা ট্রিট দিচ্ছে ” ক্যাপশন দিয়ে পিকটা ফেসবুকে আপলোড করে দিলাম।আমাকে ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেই পাশ থেকে নীর সন্দিহান গলায় ভ্রু কুঁচকে বললো,

—- কি করছিস তুই?
—- পিকটা আপলোড দিচ্ছি।
ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়েই বললাম।কিন্তু নীর আমার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে চিৎকার দিয়ে বললো,
—– কি কি কি কি কি কি?????
ওর চিৎকারে বিরক্ত হয়ে ফোনটা পাশে রেখে দুই হাত কোমরে রেখে বললাম,
—- তুই কি কানা হয়ে গেছিস?শুনতে পাস না!এমন করছিস যেন ছবি আপলোড দেওয়া জীবনে প্রথম শুনছিস!
নীর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
—- আমার সম্মান এইভাবে শেষ করতে পারলি?
ওর কথার উত্তরে কিছু বলতে যাবো আর আগেই ফোনের টুং টাং শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো।বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই লাফিয়ে উঠলাম।নীরের দিকে ফোনটা ধরে বললাম,
—- এই দেখ তোর একটা পিক এ দুই কে রিয়েক্ট আসছে মাত্র পাঁচ মিনিটেই। আমার কোনো পিকে ঘন্টার পর ঘন্টায়ও দুইশো রিয়েক্ট হয় না আর তোর একটা পিকে পাঁচ মিনিটেই দুই কে রিয়েক্ট!দেখ তোকে কতো পপুলার বানিয়ে দিলাম!
নীর ফোনটার দিকে একবার তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে পরলো।

—- হ্যাঁ পপুলার তো করেছিস এতোটাই পপুলার বানিয়ে দিয়েছিস যে মুখই দেখাতে পারবো না।দুই কে রিয়েক্ট আর দুই কেই হা হা রিয়েক্ট।
চোখ মুখ খিঁচে কথা গুলো বললো নীর।এদিকে আমার আমি ওর কান্ড দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।
??
একটা কমেন্ট দেখে রাগ উঠে গেলো আমার।একটা মেয়ে লিখেছে,
” আমার ক্রাস বেবি টাকে এভাবে কেন সাজিয়েছো আপু?ওর তো খুব কষ্ট হচ্ছে!???”
কমেন্ট টা দেখে নীরের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম।নীর ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- আবার আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস কেন?আমি আবার কি করলাম?যা করার তা তো তুই করলি!
কমেন্ট টা ওকে একবার দেখিয়ে।ওর গেঞ্জি খামছে ধরে ঝাঁঝালো গলায় গলায় বললাম,
—- সত্যি করে বল মেয়েটা কে? তোর জন্য কান্না করে ভাসাচ্ছে কেন?এইরকম কয়টা আছে সত্যি করে বল?
নীর আমার এমন আকস্মিক আক্রমণের হকচকিয়ে গেলো।নিজেকে সামলিয়ে মাথা নেরে বললো,
—- আমি সত্যি জানি না মেয়ে টা কে।
আমি চোখ মুখ খিঁচে বললাম,
—- তাহলে মেয়েটার তোর জন্য এতো দরদ উথলে উঠছে কেন?
নীর আমার মুখে ফু দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
—- তাতে তোর কি?
এবার ওর কান্ডে আর কথায় হকচকিয়ে উঠলাম।এরমধ্যে নীর আবার বলে উঠলো,
—- বললি না তো তাতে তোর কি?
নীরের কথার উত্তর না দিয়ে দাড়িয়ে পরলাম।ওর এই প্রশ্নের উত্তর কি আমার কাছে সত্যি আছে?নাকি নেই! সে পরে ভেবে দেখবো এখন এই দরদওয়ালীকে উত্তর টা দিয়ে নেই।
” ছোটো বোন তুমি ক্যাপশন টা দেখো নেই মনে হয় এটা আমার বর আর তোমার জিজু। আমার বরকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য আমি আছি।তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।?”
এবার লমেয়েটা আমার কমেন্টে সেড রিয়েক্ট দিয়েছে।মনে হয় তার ক্রাস ববিকে আমার বর বলাতে বুকে লেগেছে। আমি মনে মনে একটা পৈশাচিক হাসি দিলাম।তারপর ওখান থেকে চলে যেতে নিলেই নীর ডাক দিলো,

—- ফুচকা গুলোকি আমি একাই খেয়ে নেব?
ফুচকা কথা বলার জন্য আর গেলাম না।আসলে আমি আর যা এর উপর রাগ দেখাই না কেন ফুচকার উপর কখনো রাগটা দেখাতে পারি না।ফুচকার কথা বললেই সব রাগ গলে পানি হয়ে যায়।প্রতিবারের মতো এবারও নীরের উপর থাকা রাগটা ফুচকার জন্য গলে পানি হয়ে গেছে।তবুও একটু রাগ নিয়েই ফুচকার কাছে গিয়ে বললাম,
—- কই ফুচকা কি আমাকেই বানিয়ে খেতে হবে!
নীর আমার কথায় খুশি হয়ে বললো,
—- না না আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
তারপর একটু পর পর মুখে আংগুল দিয়ে ভেবে ভেবে প্রায় দশ মিনিট ধরে একটা ফুচকা বানিয়ে আমার হাতে দিলো। আমিও খুশিমনে ফুচকা টা নিয়ে মুখে পুরতেই আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে।খুব কষ্টে ফুচকা টা গিলেই পানির উপর ঝাপিয়ে পরলাম।একের পর এক পানির গ্লাস শেষ করলাম।নীর আমার অবস্থা দেখে ব্যাস্ত হয়ে বললো,
—- কি হয়েছে তোর ঝাল একটু বেশি হয়েছে?
আমি চোখ মুখ খিঁচে বললাম,
—- শুধু ঝাল বেশি হলে কোনো প্রবলেম হতো না! আমি একটু ঝাল খেতে পারি কিন্তু প্রচন্ড ঝাল আর লবণ দিয়ে ঠাসা থাকলে মানুষ কি করে ঠিক থাকে?
নীর মাথা চুলকে বোকা হেঁসে বললো,

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৬

—- আমি ফুচকাওয়ালা সাজলেও আসলে তো আমি ফুচকাওয়ালা না!তাই কিভাবে জানবো ফুচকা কিভাবে বানাতে হয়!ঠিক আছে এবার আরেক টা বানিয়ে দিচ্ছি মেবি এটা ঠিকঠাক হবে।
নীর আবার ফুচকা বানাতে যাওয়ার আগেই আমি ওর হাত ধরে ফেললাম অনুরোধের সুরে বললাম,
—- দয়া করে তুই আর একটা ফুচকাও বানাস না!তোর ওই ফুচকা আর একটা খেলে আমার এক মিনিট কেন সেকেন্ডও লাগবে না উপরে যেতে।তাই প্লীজ তুই আর ফুচকা বানাস না!আমি নিজেই বানিয়ে খেতে পারবো।এমনকি তোকেও খাওয়াবো কিন্তু তুই প্লীজ বানাস না!
??
আবির হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে পাতলা স্যুপ খাচ্ছে। খাচ্ছে বললে ভুল হবে ওকে ওর এক বন্ধু খাইয়ে দিচ্ছে।পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা তাই নিজে খাওয়ার মতো অবস্থায় ও নেই। আবিরই হলো সেই ছেলে যাকে কালকে রিমি পিটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছে।আবির স্যুপ খেতে খেতেই হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যেতেই এই ব্যান্ডেজ করা শরীর নিয়েই এক লাফ দিয়ে উঠে দরজার সামনের মানুষ টার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- বিশ্বাস করেন আপু আমি যদি আগে জানতাম আপনি এই হসপিটালে থাকেন তাহলে জীবনে কোনোদিন এইখানে আসতাম না।প্লীজ আপু আমাকে এবারের মতে কমা করে দেন!কথা দিচ্ছি এই জায়গা কেন এই দেশ থেকেই আমি চলে যাবো।প্লীজ আপু শুধুমাত্র এই একবারের জন্যই ক্ষমা করে দেন!

আশেপাশে থাকা সব লোকজন মিলে আবিরকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও কেউ ছাড়াতে পারলো না।ও শুধু একটাই কথা বলে যাচ্ছে,
—- আপু প্লীজ ক্ষমা করে দেন!
কিছুক্ষণ কথা বলার পরই আবির সেন্সলেস হয়ে পরে।আসেপাশের মানুষ এতোক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
আবির কাকে দেখে এমন করলো? ?

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ৮