রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৮ || নাফিসা মুনতাহা পরী

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৮
নাফিসা মুনতাহা পরী

পরী নীলের দিকে কিছুটা ঝুকে যেতেই নীল চমকে ওঠে ভূত দেখার মত। বেশ ঘাবড়ে যায় ছেলেটা। পরী কি করতে চাইছে! পরী এমন ভাবে নীলের দিকে ঝুকে পড়েছে যে, দুর থেকে কেউ দেখলে নিশ্চত বলবে, পরী নীলকে লীপ কিস করছে।
নীল একদম নিঃস্বাস বন্ধ করে ফেলেছে। নীলের চোখের নিচে কাগজের ছোট্ট টুকরোর মত কিছু একটা লেপ্টে আছে। সেটা তুলে নীলের চোখের সামনে ধরে পরী বলল-
~” এটা গালে লেগে ছিল। এখন নিঃশ্বাস নিতে পারো। আর আমার দিনকাল এতো খারাপ পড়েনি যে তোমায় লিপকিস করতে যাব।”
পরীর কথা শুনে নীল ভ্রুজোড়া কুচকালো। নিঃশ্বাস বন্ধ করেছি ঠিক আছে তাই বলে লিপকিস! এটা অসম্ভব! কিছুতেই এমন ভাববোনা আমি। এমন ভাবনার কোন মানে আছে!
নীল গলাটা ঝেড়ে মুখে গম্ভীরতা এনে রুক্ষভাষী গলায় বলে উঠলো-
~” আপনি পাবনা মেন্টাল হসপিটালের কত নাম্বার ওর্য়াডের পেশেন্ট ছিলেন! দয়া করে আমাকে বললে আমি আপনাকে সেখানে পৌছে দিতাম! কারন আমার মনে হচ্ছে আপনি হারিয়ে গেছেন সেখান থেকে।”
পরী তার দাঁতের সমস্ত পাটি জোড়া বের করে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো যেন। তারপর ক্ষনিকের জন্য থেমে বলল-

~” এই জন্য কবিগনেরা বলেছেন, রতনে রতনরে চেনে। যেমন তুমি আমায় চিনেছো। আমি তো শুধু একাই পাগল কিন্তু আমার মনে হয় তোমার ১৪ গোষ্ঠীই ঝাক্কাস পাগল।”
পরী আর নীলের কথার মাঝেই শুভ্র উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। তারপর বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো-
~” নীল, এতরাত অবদি তুই কই ছিলি! রাত ১২টা পার হয়ে গেছে আর তুই কোন সাহসে এতরাতে বাসায় আসিস! কাকি কি তোরে শাসন করেনা?”
শুভ্রের কথা শুনে নীল হচকিয়ে উঠে ঘুরে শুভ্রের দিকে চাইলো। নীল প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল শুভ্রের এমন চেহারা দেখে। ফর্সা গাল রাগে লাল হয়ে গেছে শুভ্রের। নীল কিছু বলতে যাবে এমন সময় পরী ফস করে মুখ দিয়ে বলে উঠলো-
~” ১৪ পিড়ির আর একজন পাগল আইসা খাড়া হইছে। বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা….।”
শুভ্র সম্পর্কে পরীর এমন মন্তব্য শুনে নীল খপ করে পরীর হাতটা চেপে ধরে। এমন কাজ শুভ্রের নজর এড়ালো না। এহেন কান্ডে শুভ্রের মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে গেল। নীলের কোন উত্তর না পেয়ে শুভ্র এত জোড়ে ধমক দিল নীলকে যে, নীল সহ পরী দু’জনেই ভয়ে কেঁপে উঠলো।
নীল শুভ্রের বাধ্য হলেও পরী কখনো শুভ্রের বাধ্য নয়। তাই পরক্ষনেই পরী চেঁচিয়ে উঠে বলল-
~” আমরা কোথায় যাব না যাব, তার কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে মি.শুভ্র! সবাই আপনার ভয়ে আপনাকে হুযুর হুযুর করলেও আমি পরী আপনাকে মানি না। তাই ফার্দ্দার আমার সামনে এমন তখম দেখাতে একদম আসবেন না। সাবধান করে দিলাম।”

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

এমন অসভ্যতামি তে একটা ভয়ানক আঘাত আছড়ে পড়ল পরীর মুখে। হাত থেকে ফোনটা ছিটকে গিয়ে পড়লো ফ্লোরে। পরী একহাত ওর গালে লাগিয়ে ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো। শুভ্র তখনো রাগে ফুসছে। এমন কান্ডে নীল একদম চুপসে গেছে। কিন্তু পরী না দমে চিৎকার দিয়ে উঠলো-
~” আপনি কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তুললেন? আপনাকে কে এমন কাজ করার অনুমতি দিয়েছে! আপনি আমার বাবা, আমার বড় ভাই, না আমার স্বামী! যার জন্য আমার গায়ে হাত তুললেন?”
পরী কথাগুলো বলে আর স্থীর হয়ে থাকতে পারলোনা। ওখানেই নীলের সামনে কেঁদে উঠলো।
শুভ্রও চুপ না থেকে হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো-
~” অসভ্য বাজে মেয়ে একটা! তোমায় কে রাইট দিছে বড়দের সাথে এমন করে তর্ক করার! এই তোমার শিক্ষা!”
শুভ্র আর পরীর মাঝে এই প্রথম তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায়। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেনা। এদের চিৎকারে বাসার অনেকে বের হয়ে এলো। সাথে নীলিমা, নিঝুম সহ শুভ্রের বাসার সবাই এলো। নীলিমা এসে পরীকে ধরে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পরী মোটেও ছাড়ার পাত্রী না। এতদিনের সমস্ত রাগ শুভ্রের উপর ঝাড়তে লাগলো। উনি পাইছেটা কি! যা ইচ্ছা তাই বলবে নাকি! আমার সম্মান নেই! আমার সম্মান নিয়ে উনি খেলা করবেন আর আমি ছেড়ে দিব! টাকার গরম দেখান আমায়! আপনার টাকার নিকুচি করছি আমি।

পরী,পরী মা আমার চুপ করো বলে নীলিমা ওরে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যেতেই শুভ্র বলল-
~” কাকি ওরে ছেড়ে দেন। দেখি ওর কতবড় গলার জোড়। ও আমায় চেনে! ওর এই অসভ্যতামির জন্য ওকে আমি ঠিক কি কি করতে পারি, সেটা কি ও জানে!”
মারিয়া শুভ্রকে পিছন দিক থেকে টেনে ধরতেই পরী থমকে তাকালো মারিয়ার পানে। এই প্রথম ও মারিয়াকে দেখলো। সত্যই মেয়েটা দারুন সুন্দরী। কিন্তু পরীর ভিতর চাপা ক্ষোভটা যেন জ্বলজ্বল করে বেড়ে গেল।
মারিয়াকে দেখে নীলিমা পরীকে একদম গেটের কাছে টেনে আনলো। সাথে নীল ও নিঝুমও পরীর কাছে এসে দাড়ালো। আর পরীতো রেগে ফিকরে কেঁদেই চলছে।
নীলিমা অবাক চোখে শুভ্রর দিকে চেয়ে আছে। মারিয়া আর শুভ্রের মা শুভ্রকে টেনে উপরে নিয়ে যাচ্ছে। শুভ্র থেমে নেই। বিয়াদপ মেয়ে রাত ১২টার পর বাসায় এসে ঢুকবে আবার মুখে মুখে তর্কও করবে। মেয়ে মানুষ এত অসভ্য হয় কিভাবে?
কথার এক পর্যায়ে শুভ্র থেমে গেল। কারন ততক্ষনে পুরো বিলডিং এর মোটামুটি সবাই বের হয়েছে। মারিয়া জিবনেও শুভ্রকে এতোটা উত্তেজিত অবস্থায় দেখেনি। মেয়েটা এসব দেখে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। শুভ্র মারিয়ার দিকে একবার চেয়েই ওর মাকে বলল-
~” ওকে বের হতে দিছেন কেন! ওকে নিয়ে ফ্লাটে যান।”

ও কি স্বাধে নেমে এসেছে! কেন অচেনা একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া বাধিয়েছিস! এত রাতে সিনক্রিয়েট না করলেই কি নয়! সবাই বের হয়ে তোর তামশা দেখছে। এতে মানসম্মানের কিছু রইলো? কেন এমন করছিস! ওদের মেয়ে ওরা শাসন করবে। এতে তুই কেন বা হাত ঢুকাবি! ওরা যা পারে তাই করুক। আর মেয়েটা ওদের বাসার মেহমান। তারসাথে এমন ব্যবহার করা তোর উচিত হয়নি। কথাগুলো বলে শাকিলা বেগম মারিয়াকে নিয়ে চলে গেল।
মা চলে যেতেই শুভ্র আবার নিচে নামলো। ততক্ষনে সবাই যার যার ফ্লাটে চলে গেছে। পরী দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। শুভ্রকে দেখে নীলিমা নীল এবং নিঝুমকে চলে যেতে বলল। নীলিমা শুভ্রর দিকে এক নজরে চেয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সেখানে শুভ্র দাড়িয়ে নেই, দাড়িয়ে আছে পরীর পিতা কামরুল হাসান। এমন ব্যবহার নীলিমার সাথেও করেছিল কামরুল সাহেব। এখনো করে। নীলিমার চোখ ছলছল করে ওঠে। পিতার কর্মের শাস্তি মেয়ে প্রতিদিন মিনিটে মিনিটে পাচ্ছে। কিন্তু পিতার কোন খোঁজই নেই।
পরীকে রেখে নীলিমা শুভ্রের একদম কাছে গিয়ে দাড়াল। তারপর চাপা কন্ঠে বলে উঠলো-
~” পরী দোষ করেছে, সেটা আমাকে বলতে পারতে! শুধু শুধু এত মানুষজনকে না জড়ালেই পারতে শুভ্র!”
নীলিমা আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ্র মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
~” কাকি, পরীর কাছ থেকে নীলকে একটু দুরেই রাখবেন। আমি যেন দেখিনা নীল পরীর আসেপাশে রয়েছে।”

নীলিমা গাল শক্ত করে শুভ্রের দিকে একবার শুধু চাইলো কিন্তু কিছু না বলে পরীকে শুধু একবার ডেকে উপরে চলে গেলেন।
পরী ওভাবেই দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। শুভ্রের মনে ওর জন্য দয়া হলো কিনা বোঝা গেলোনা। শুভ্র হঠাৎ পরীর কাছে গিয়ে ওর হাতটা টেনে গাড়ী পার্কিং করার জায়গার দিকে নিয়ে গেল। তারপর বলল-
~” বাহিরে বেড়ানোর অনেক সখ জেগেছে তোর তাই না! চল, কত ঘুরবি আজ সেটা দেখেই ছাড়বো। সারা রাত পুরো শহর তোরে ঘুড়িয়ে দেখাবো।”
শুভ্র পরীর হাত ধরতেই পরী শুভ্রের হাত ঝিটকে ফেলে দেয়। আশেপাশে কেউ নেই। তারমানে শুভ্র ওকে যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যবহার করবে। মাথাটা হঠাৎ ঝিম ধরে উঠলো। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সামনের দিকে চেয়ে দেখে শুভ্র কঠিনমুখে ওর দিকেই চেয়ে আছে। পরী হঠাৎ অসহায়ের মত বলে উঠলো-
~” আমি নীলকে কিস করিনি! তোমাকে রাগানোর জন্য ওমন করেছিলাম। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এমন কাজ কখনো করবোনা।”

শুভ্রের এক সেকেন্ডও লাগলোনা পরীকে নিজের বুকের ভিতর আকরে ধরতে। কতকাল সময় পরে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো ওদের মধ্যে। পরীও সব ভুলে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো সমস্ত শক্তি দিয়ে। শুভ্র ঐ অবস্থায় পরীর ঘাড়ে মুখ ডুবালো। কিছু বলতে যাবে এমন সময় মারিয়ার ডাক শোনা গেল। আধা বাংলায় উচ্চস্বর ভেসে আসছে, শুভ্র তুমি কোথায়!
মারিয়ার কন্ঠ শুভ্রের কানে না পৌছালেও পরীর কানে ঠিকি পৌছায়। শুভ্রের বুকে দু’হাত দিয়ে গায়ের শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা মারে। অপ্রস্তুত শুভ্র দুরে সরে যায়। পরীর এমন ব্যবহারে শুভ্র রেগে গিয়ে পরীর দিকে চাইতেই পরী চট করে এক কোনায় নিজের মুখ চেপে ধরে দেয়ালের গায়ে লেপ্টে গেল। মারিয়া প্রায় শুভ্রের কাছে চলেই এসেছে। শুভ্রের এবার যেন হুশ ফিরলো। চোখের পানি দ্রুত মুছেই পিছন ফিরে মারিয়ার দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
~” তুমি এখানে? কেন এসেছ এখানে!”
~” এতরাত হয়ে যাচ্ছে আর তুমি বাহিরে! তাই ডাকতে আসলাম। তুমি এখানে কি করছো?”
তেমন কিছু নয় বলে শুভ্র মারিয়াকে নিয়ে উপরে উঠে গেল। শুধু পিছনে ফিরে একবার পরীর দিকে চাইলো। অন্ধকারে পরী যেন মিশে গেছে দেয়ালের গায়ে।
মারিয়া আগে উঠছে শুভ্র পিছনে। নীলদের ফ্লাটে আসতেই শুভ্র চট করে দু’বার কলিংবেল বাজিয়েই দ্রুত উপরে চলে গেল।
কলিংবেলের আওয়াজে নীলিমা দরজা খুলে কাউকে দেখতে পেলোনা। ভেবেছিল পরী এসেছে। পরীকে না পেয়ে নীচে নামতেই দেখে পরী ধীর পায়ে উপরে উঠে আসছে। নীলিমা আর কোন কথা না বলে রুমে চলে আসলো। পরীর অস্বস্তিবোধ করতে পারে তাই রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বসে রইল। কাছে নিঝুমও ছিল। মুখে আঙ্গুল পুরে নিঝুমকেও চুপ থাকতে বলল।

নিজের প্রতি এতটা বিরক্ত লাগতে লাগলো যে মনে হয় এখুনি কিছু একটা করে ফেলবে পরী। দরজা খোলায় ছিল। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ডাইনিংরুমে দেখলো কেউ নেই। সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে পার্স ছুড়ে ফেলে রুমে লাইট জ্বালালো। ঐ অবস্থায় ওয়াসরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রুমে এসে বসে পড়লো। যার জন্য ঘর ছাড়লাম সেই আবার চোখের সামনে হাজির। আমি আর কোথায় যাব! কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কথাগুলো ভাবতেই ওর চোখ ছলছল করে উঠলো।
বিছানা থেকে উঠে পার্সটা কাছে এনে ফোন খুঁজতে লাগলো পরী। কিন্তু ফোন খুজে পেলোনা। ওর মনেই নেই শুভ্রের থাপ্পড়ে ফোনটা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেছে। শেষে পাগলের মত ফোন খুঁজতে লাগলো। ফোন কোথায় রাখছি আমি বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো পরী।
নীলিমা রুম থেকে বের হয়ে নীলের রুমে উকি দিয়ে দেখলো, নীল মাথা নিচু করে বসে আছে। পা টিপে ছেলের রুমে প্রবেশ করেই গলার খানিকটা আওয়াজ তুলে জিঙ্গাসু কন্ঠে বলল-

~” নীচে পরীর সাথে ঠিক কি হয়েছিল রে নীল!”
নীল মাথা তুলে মায়ের দিকে চাইতেই ওর চোখ দিয়ে টপ করে পানি পড়ে গেল। মায়ের সামনে চোখের পানি পড়াতে সে বেশ লজ্জাবোধ করলো। কিছু বলতে গিয়ে শুধু ঠোট কেঁপে উঠলো কিন্তু কোন শব্দ বের হলোনা। ছেলের এমন পরিস্থিতি দেখে নীলিমা নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বের হতেই নীল স্ব-শব্দে বলে উঠলো-
~” আম্মু তোমার ভাতিজী কে একটু বলো, যেখানে সেখানে নিজের দম্ভ না দেখাইতে। সব জায়গায় সবাই তা মেনে নিবেনা বলেই আজ এমন লজ্জাকর ঘটনা ঘটলো। সবার সামনে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়েছে। শুভ্র ভাইয়ার সাথে কোন সাহসে সে লাগতে গেছে। তার সাহস কি একটু বেশিই না! তাকে মুখে লাগাম দিতে বলবা।”
নীলের কথায় নীলিমা থেমে গিয়ে পিছন ফিরে ভ্রু কুচকে নীলের দিকে চেয়ে বুঝলো নীল বেশ বিরক্ত পরীর উপর। তারপর হতাশা গলায় বলল-
~” যেদিন সব কিছু বুঝতে শিখবি তখন আর এমন অভিযোগ করতে পারবিনা। আর তুই যে শুভ্রের ভক্ত সেটা তোর চ্যাল চলন দেখেই বোঝা যায়। তাই তার দোষ তোর চোখেই পড়েনা।”

~” মা তুমি পরী আপুর দোষ সবসময় লুকাও। আমি মোটেও ভাইয়ার অন্ধ ভক্ত না। যা চোখে দেখেছি তাই বললাম। হঠাৎ এমন উত্তেজিত না হলেই সে পারতো!”
নীলিমা কোন কথার জবাব না দিয়ে চলে যেতেই পরীর ফোনটা নীল ওর মায়ের হাতে দিয়ে বলল-
~” ফোনের টার্চ ফেটে গেছে। ওনাকে ফোনটা দিয়ে দিও।”
হুম বলে নীলিমা বের হয়ে পরীর রুমে এসে দেখলো পরী ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো রুম অন্ধকার কিন্তু চাঁদের আলো যেন ওর রুমে ঠিকরে পড়ছে। সেই অালোয় ঘুমন্ত পরীর মুখটা অদ্ভুদ রকম সুন্দর দেখাচ্ছে। নীলিমা থাই লাগিয়ে দিয়ে পর্দাটা টেনে দিয়ে পরীর গালে একটা কিস করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
আন্টি চলে যেতেই পরী চোখ খুলল। চোখ দিয়ে তার নোনাজল বের হতে লাগলো। মাও তাকে কখনো এমন করে আদর করেনি। বালিশের কাছে রাখা ফোনটা নিয়ে বাবার নাম্বার ডায়েল করতে যাবে এমন সময় দেখলো, ফোনের স্কীনে চির ধরেছে। কিছুক্ষন ওভাবে ফোন নিয়ে বসে রইলো। তারপর আবার বাবাকে কল দিতে গিয়েই হাত থেমে গেল। বাবাকে কল দিতে সাহসে আর না কুলিয়ে মাকে কল দিল। পরপর কয়েকবার কল গেল কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ আর রিসিভ করলো না।
অবশেষে অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে পরী ঘুমিয়ে পড়লো।

৩দিন পর,
পরীর একটা জবের এক্সাম আছে। সকাল থেকে রেডী হচ্ছে। দ্রুত গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হতে হবে। নওগাঁ থেকে আরো কিছু বান্ধবীরাও আসবে রাজশাহীতে পরীক্ষা দিতে। তার ভিতর ফোনের স্কীনটাও বদলাইতে হবে। কোন রকম ফোনটা চালাইছে এ ক’দিন। তাড়াহুড়া করে আন্টিকে বাই বলেই আধা ছুটে দরজা পেরিয়ে দৌড় দিল পরী। নিচে নেমে বড় গেটটা পেরিয়ে যেতেই মনে হলো একটা থাম্বার সাথে ধাক্কা খেল। ফাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল। পরীও পড়ে যেতেই কেউ যেন ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।
গেল গেল, মানসম্মান সব আমার গেল। এতগুলো মানুষের মাঝে পড়ে গেলে আর সম্মান থাকবেনা আমার। কিন্তু আমিতো থাম্বার সাথে ধাক্কা খেয়েছি। থাম্বার আবার হাত গজাইলো ক্যামনে! ঘোর কলিযুগ এসেছে বলে পরী সামনের দিকে চাইতেই দেখলো টাউজার পড়া দু’টো পা। এত সময় আছে নাকি আমার! থাম্বার সাথে ধাক্কা খাইলাম না গাড়ীর সাথে ধাক্কা খাইলাম! হাত জোড়ে একটা ঝিটকানি দিয়েই ফাইলটা কুড়ে নিতেই দেখলো ফোনের বারোটা বেজে গেছে। যতটুকু চলতো সেটাও আর চলছেনা। এ যেন মরার উপর খাড়া দেওয়া।

চোখে দেখতে পারেন না! চোখ কি পকেটে তুলে রেখে রাস্তায় চলাফেরা করেন, নাকি টিনের চশমা পড়ে ঘোরেন! আমার ফোন যে ভেঙ্গে ফেললেন তার দাম দিবে কে শুনি! এমনি টাকা পয়সার অভাবে রিক্সাই চড়তে পারিনা তার উপর এত ক্ষতি! আমার ক্ষতি কে পোষাবে শুনি! কথাগুলো বলে সামনে তাকিয়েই পরী চোখ যেন চড়ক গাছে উঠে গেল। না চাইতেও মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দে বের হল, শুভ্র!
পরীকে আর পায় কে! চাচা আপন প্রান বাঁচা বলে পরী উল্টা পথে হাটা শুরু করলো।
আমি জানি নাকি! হুতুমপেচাঁর সাথে ধাক্কা খাইছি! জানলে আর ওখানে দাড়িয়ে এত কথা শোনাতাম বলে গটগট করে রাস্তা চলতে লাগলো পরী।
শুভ্র জগিং শেষ করে কেবল বাসায় ঢুকতে যাবে সেই সময় এমন ঘটনা ঘটে গেল। এত সকালে সে যায় কোথায় বলে পরীর নাম ধরে একবার ডাক দিল শুভ্র। পরী আর থামে! পিছনে মনে হচ্ছে চেঙ্গিস খান তার বাহিনী নিয়ে দাড়িয়ে আছে ওর উপর হামলা করার জন্য। তাই দ্রুত পা চালালো পরী।
শেষে ডেকে যখন হলোনা তখন শুভ্রও পিছন নিলো পরীর। খানিকটা দুরে যেতেই এক ফ্রেন্ডের সাথে শুভ্রের দেখা হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল গল্প। শুভ্র যতই কথা কেটে সামনে যেতে চায়, তার ফ্রেন্ড ততই গল্পের মধ্য তাকে ডুবায়।

খানিকটা দুরে, সামনের মোড়ে ফোন ঠিক করার দোকানে পরী দাড়িয়ে ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বার বার নিজের হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে সময় দেখতে লাগলো।
কিছু সময় বাদে ফোন ঠিক করে পরীর হাতে দিয়ে দোকানদার বলল-
~” ভাবী দেখেন তো, ফোনটা ঠিক আছে নাকি!”
পরী কপাল কুচকে দোকানদারের দিকে চেয়ে বলল-
~” আমি আপনার কোন পাতানো ভাইয়ের বউ যে আমায় ভাবী বললেন! হুস আছে না বেহুশের কিছু খাইছেন?”
~” স্যরি আপা, বোরখা পড়ে আছেন তো তাই ভাবী বলেছি। ভুল হয়ে গেছে।”
~” আচ্ছা ঠিক আছে। বিল কত হইছে!”
দোকানের ছেলেটা মুচকি হেঁসে বলল-
~” আপনি আমাদের এখানকার মেয়ে না। আপনার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আপনার কথার তেজ দেখলে মনে হবে আপনি আমাদের এলাকার স্থানীয় মেয়ে।”

দেখেন ভাই, আমার এত সময় নেই আপনার সাথে খোসগল্প করার। কত টাকা দিতে হবে জটপট বলে দিন। আমি খুব ব্যস্ত আছি বলেই পরী ছেলেটার দিকে চাইলো।
~” বেশি না, এই তের’শ টাকা দিলেই চলবে! অন্যজন হলে ষোল’শ টাকার ১টাকাও কম নিতাম না। আপনি বলেই তিন’শ টাকা ছাড় দিলাম।”
তের’শ টাকা, মগের মুল্লুক নাকি বলেই পরী ওর মাথায় হাত দিল। আমাকে বিক্রি করলেও এতটাকা এখন আমি দিতে পাবোনা। আপনি পাগল হইছেন! আমি অপরিচিত বলে বেশি টাকা খসানোর ধান্দা তাইনা! আপনাদের এলাকার মানুষ দেখি ১নাম্বারের ধান্দাবাজ। এত টাকা আমি দিতে পারবোনা বলে ফাইলের ভিতর থেকে আটশত টাকা বের করে ছেলেটিকে দিল। এর থেকে এক টাকাও আমি বেশি দিতে পারবোনা। আমার যাওয়ার ভাড়া শুধু আছে। আসবো কিভাবে সেই ভাড়াও নেই।
~” ফোনের টার্চ ছাড়া কত কি চেঞ্জ করে দিলাম। বললাম না আপনি বলে দাম কমাইছি! আর সকাল বেলা বাঁকিও আমি দিতে পারবোনা। আপনি টাকাটা শোধ করেই যান। নাহলে ফোনটা জমা দিয়ে যান। টাকা দিয়ে ছেড়ে নিয়ে যাইয়েন।”

~” পাগল হইছেন নাকি! ফোন কেন আপনাকে জমা দিব! ফোন ছাড়া বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে! সম্ভব না আপনার কথা মানা। এই টাকা নিলে নেন না নিলে এই টাকাটাও হারাবেন। আর যদি আরও টাকা পেতে চান তাহলে আগামীকাল অবদি অপেক্ষা করতে হবে।”
~” আমরা ধান্দাবাজ, না আপনি ধাপ্পাবাজ! বললাম না আপনি বলে অনেক ছাড় দিয়েছি।”
জুতার বারি খাওয়ার মন চাইছে আপনার! জুতার বারি দিয়েই সোজা করবো আপনাকে। আমি আপনার কে হই তার জন্য আমাকে ছাড় দিতে গেছেন! আমি কি আপনাকে বলেছি ছাড় দিতে! আর আমি শুধু আপনাকে বলেছি টার্চ বদলাইতে। তাহলে আপনি কার হুকুমে আরও সব চেঞ্জ করতে গেছেন! ফাজলামি শুরু করছেন? অপরিচিত বলে আমাকে গাধা বুঝ বোঝাবেন আর আমি সেটাই বুঝবো! কথাগুলো বলেই ছেলেটার সাথে ঝগড়া বেঁধে গেল পরীর। দোকানে কয়েকজন জড়ো হতেই শুভ্র দ্রুত দোকানে এসেই জিঙ্গাসা করলো কি হয়েছে।
আর বলেন না ভাইয়া, মেয়েটা এত ঝগড়ী কি বলবো আপনাকে! কোন এলাকার মেয়ে যে আল্লাহ্ ভালো জানে বলে সব খুলে বলল শুভ্রকে।

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৭

আমি ঝগড়ী! আপনার মা ঝগড়ী, বোন ঝগড়ী, আপনার পুরো ১৪ পিড়ীই ঝগড়াটে। উচিত কথা বললেই ঝগড়ী তাইনা! অপরিচিতদের থেকে কত এমন ভাবে চিটিংবাজী করে টাকা কামাইছেন! কবরে যাইতে হবেনা! সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে ঢুকতে হবে না! কবরের ঠান্ডা মাটি বুকে পড়বেনা! আল্লাহ্কে ভয় করুন বলেই পরী শুভ্রের দিকে চাইতেই ওর সব তেজ ঠুস হয়ে গেল। শুভ্রের রাগী লুক দেখে পরী বিড়বিড় করে বলল-
~” আমি তো ঠিক কথায় বলেছি। তাহলে রাগ কারে দেখায়!”
শুভ্র ষোল’শ টাকা গুনে গুনে ছেলেটিকে দিয়ে বলল-
~” এই কটা টাকার জন্য একটা মেয়ের সাথে এমন ভাবে কেউ কথা কাটাকাটি করে!”
ভাইয়া আপনি বলে তারে ছেড়ে দিলাম বলতেই পরী শুভ্রের হাতে ওর ফোনটা গুজে দিয়ে ছেলেটির হাত থেকে ওর দেওয়া আটশত টাকা কেড়ে নিয়ে শুভ্রকে বলল-

~” আপনি যখন টাকা দিছেন তখন ফোনটা আপনার কাছেই রাখেন। টাকা হলে ছেড়ে নিয়ে যাব।”
আমি ফোন রাখতে বললাম তখন সব দোষ আমার হয়ে গেল। এখন যে আপনি ভাইয়ার কাছে ফোন বন্ধক রাখছেন তার বেলায়! কথাগুলো বলে পরীর দিকে প্রশ্ন ছুড়লো ছেলেটি।
পরীও সাথে সাথে সামনের কাচের ডেক্সের উপর থাবা বসিয়ে বলল-
~” টাকা পেয়েছিস চুপ যা। আমার এলাকায় হলে গলায় এতক্ষনে জুতা ঝুলিয়ে দিতাম।”
কথাগুলো বলে পরী গটগট করে সামনের দিকে হেটে চলে গেল।
এই মেয়ে আমার সম্মান আর রাখবেনা বলে শুভ্র রাস্তায় নামলো। পরী পিছন ফিরে দেখলো শুভ্র আবার ওর পিছু নিয়েছে। তাই আরও দ্রুত পা চালাতেই ভিষন জোড়ে একটা বিকট শব্দ হলো। দুর থেকে একটা বৃদ্ধের আর্তচিৎকার ভেসে এলো। এখুনি ছেলেটা এখান থেকে গেল আর এর ভিতরই এমন দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আল্লাহর এত জলদি হুকুম হলো!
বৃদ্ধের কন্ঠ পরীর কানের দোড়গোড়ায় পৌছাতেই ওর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো অজানা এক তীব্র যন্ত্রনায়। শুভ্র বলেই পিছন ফিরলো পরী……….।

রক্তক্ষরণ অপেক্ষা পর্ব ৯