ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৭ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৭
Mahfuza Akter

বাইরে ভারী বর্ষণ। থেমে থেমে মেঘের হিংস্র গর্জন শোনা যাচ্ছে। এই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আভাসের বাড়িতে উঠেছে নাতাশা। আভাস শ্রুতি এবং নিজের জন্য খাবার নিতে এসেছিল। হঠাৎ মেইনডোরের দিকে নজর যেতেই দেখলো অনেকটা ভিজে জবজবে হয়ে ভেতরে ঢুকছে নাতাশা। নাতাশাকে দেখেই আভাসের মেজাজটা চরম ভাবে বিগড়ে গেছে। বিড়বিড় করে বললো,

—লজ্জা-শরমের ছিটেফোঁটা নেই এই মেয়েটার মধ্যে! বোধ হয়, আরিহা খান ফোন দিয়ে জানিয়েছে। তাই দুনিয়ার সব বাদ দিয়ে আমার লাইফটা হেল করে দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছে। যত্তসব!
আভাস একটা বড় ডিশে প্রয়োজনমতো খাবার বেরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। নাতাশা পেছন থেকে বলে উঠলো,
—তুমি নাকি বিয়ে করেছো?
আভাস পা থামিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
—করলে করেছি। তাতে তোর কী?
নাতাশা কাঁদো কাঁদো ফেস করে মাথা নিচু করে বললো,
—আমার দিকটা তুমি একবার ভাববে না, আভাস? আমি সেই ছোট থেকে তোমাকে……..

নাতাশার কথার মাঝেই আভাস সশব্দে হাতে থাকা ডিশটা ডাইনিং টেবিলে রাখলো। আকস্মিক শব্দের ঝমঝমানিতে নাতাশা খানিকটা কেঁপে উঠে মুখ বন্ধ করে ফেলে। আভাস নাতাশার দিকে এগিয়ে গিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—নির্লজ্জতার কয়েকটা ক্যাটাগরি আছে। বাট ইট’স আ ম্যাটার অফ গ্রেট রিগ্রেট দ্যাট ইউ ডোন্ট একজিস্ট ইন অ্যানি অফ দোজ ক্যাটাগরি। রাদার, তুই সেগুলো থেকে অনেক হায়ার লেভেলে বিলং করিস। ইউ নো, মানুষের মিনিমাম সেল্ফ-রেসপেক্ট থাকা উচিত। কিন্তু তুই? একাধিক বার তোকে আমার নাম দিয়ে সম্বোধন করতে নিষেধ করেছি না? আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার সাহস কোত্থেকে পাস তুই? ইট’স দ্য লাস্ট ওয়ার্নিং ফর ইউ। আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা আর দ্বিতীয় বার করবি না।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

টেবিল থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে হনহন করে হেটে নিজের ঘরে চলে গেল আভাস। রাগে-দুঃখে-অপমানে নাতাশার চোখে পানি চলে এসেছে। হিংস্র স্বরে বললো,
—আমাকে এতোগুলো কথা বলে ঠিক করলে না, আরহাম খান আভাস। ঐ মেয়েটার জন্যই এমন করছো, তাই না? আমিও ওকে দেখে নিবো।

আভাস ঘরে এসে দেখলো শ্রুতি বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানো দেখছে। হুটহাট তীক্ষ্ণ গর্জনের সাথে ছড়িয়ে পড়া আলোকচ্ছটা গুলো মনের মধ্যে অন্য রকম একটা শিহরণ উদ্রেক করে। শ্রুতি হয়তো সেটাই উপভোগ করছিলো।
আভাস হালকা হেসে শ্রুতিকে জিজ্ঞেস করলো,
—বিদ্যুৎ চমকালে ভয় পাও না তুমি?
শ্রুতি তার সরু ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বললো,
—ভয় পাওয়ার কী আছে?
আভাস শ্রুতির পাশে বসে বললো,
—ঐ যে মুভিতে দেখোনি? নায়িকারা বাজ পড়লো ভয়ে নায়ককে জড়িয়ে ধরে!
এমন উদ্ভট কথা শুনে শ্রুতি আর না হেসে পারলো না। হেসেই বললো,

—আপনিকে নিজেকে হিরো আর আমাকে হিরোইন ভাবেন নাকি? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে যেনে রাখুন, আপনার হিরোইন অনেক সাহসী। জীবনটা সিনেমা নয়, মিস্টার খান। কতো কিছুই তো ফেস করলাম এই ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে! তাই আমার মতো মেয়ের ভয় পাওয়াটা অসম্ভব রকমের অস্বাভাবিক।
আভাস শ্রুতির ভারি কথা গুলো শুনে একটু আহত হলো। তিক্ত হলেও তাকে সত্যিটা মানতেই হবে যে, শ্রুতির জীবনটা একদমই অস্বাভাবিক। যার কারণে তাদের দাম্পত্য সম্পর্কটাও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। লোকসমাজে তুমুল তিরস্কারের শিকার তাদের হতেই হবে। সেটা কীভাবে ঠেকাতে হবে, সে বিষয়ে আভাস আগাম পরিকল্পনা করেই রেখেছে।

আভাস আর কথা না বাড়িয়ে শ্রুতিকে নিয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে শ্রুতি দেখলো আভাস বিছানায় দুটো বালিশ ও একটা ব্ল্যাংকেট রেখে কোলবালিশ গুলো কাবার্ডে ঢুকাচ্ছে। শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,
—আরে আপনি এসব সরাচ্ছেন কেন? কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাবেন কীভাবে?
আভাস নিজের কাজ করতে করতে বললো,
—কোলবালিশ দিয়ে কী করবো? বউ থাকলে কোলবালিশ লাগে না, বুঝেছো?
শ্রুতি চোখ বড়বড় করে বললো,
—মানে?
—মানে বুঝতে চাও। তাহলে মুখে না বলে প্র্যাক্টিক্যালি দেখাই।
বলেই বাঁকা হাসি দিয়ে শ্রুতির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো আভাস।
শ্রুতি বিছানায় বসেই পেছাতে পেছাতে বললো,
—থাক, থাক। আমার কিছু বোঝা লাগবে না, দেখাও লাগবে না।
আভাস এগুতে এগুতে বললো,

—ভয় পাচ্ছো? কাল রাতে কোথায় ছিল এই ভয় গুলো তোমার? নাকি কিছু খেয়ে-টেয়ে ওমন রণচণ্ডী হয়ে গেছিলে?
শ্রুতি কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,
—দেখেন, আপনি এভাবে আমার কাছে আসলে কিন্তু আমি জোরে জোরে কান্না করবো!
আভাসের অনেক হাসি পাচ্ছে শ্রুতির অবস্থা দেখে। সে শ্রুতির কানে ফিসফিস করে বললো,
—আমাকে কি তোমার এতোটাই খারাপ মনে হয়? তুমি এখনো এতো ছোট রয়ে গেছো ভাবতেই অবাক লাগছে! শেষে কিনা একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলাম!!!
শ্রুতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

—আমার বয়স এখন একুশ। আমায় কোন এঙ্গেলে ছোট মনে হয় আপনার?
আভাস বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শ্রুতিকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—যাইহোক, আরেকটু বড় হয়ে নাও। এখনো অনেক কাজ বাকি আপনার। শুধু সংসারধর্ম পালন করলেই তোমার চলবে না, মিষ্টিপাখি। ভুলে যেও না তোমার কালো অতীতটাকে। সেই অন্ধকারকে ঠেলে একটা আলোকিত জীবন গড়ে তুলতে হবে তোমায়। তোমাকে প্রমাণ করে দিতে হবে একটা দূর্ঘটনাই জীবনের পথচলায় ইতি টানতে পারে না। সমাজ আজও যেকোনো অঘটনের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করে। কেন জানো? তারা মনে করে, মেয়েরা দূর্বল ও অসহায়। তোমাকে তাদের এই ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়ে দিতে হবে সবাইকে। পারবে তো?
শ্রুতি সম্মতি জানিয়ে বললো,

—আপনি যদি পাশে থাকেন, তবে সবকিছুই সম্ভব। আমি বড্ড একা। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আমি অনেক অসহায়।
আভাস হেসে শ্রুতির মাথায় ওষ্ঠ স্পর্শ করে বললো,
—সবসময় তোমার ওপর ছায়া হয়ে থাকবো। সেই প্রস্তুতি নিয়েই তো বিয়েটা করেছি আমি! যেখানে ঘরের শত্রু বিভীষণ, সেখানে তো আমায় মেঘনাদের চেয়েও শক্তিশালী হতে হবে, তাই না?
—আপনার মা তো আমায় দেখে একদমই খুশি হননি! আমার অনেক ভয় করছে, আভাস।
আভাস চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—ভয়ের কিছু নেই। কালকেই ওনার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি আমি।

শ্রুতি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ এলো। আভাস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় একটা বাজে। এই অসময়ে কে আসবে ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। দরজা খুলে যাকে দেখলো, তাতে ওর চোখ মুখ দুটোই ইয়া বড় হয়ে গেল।
—কী হলো? দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? আমি জানি, তোরা এখন সাধারণ জামাই-বউয়ের মতো ব্যস্ত ছিলি না। তাই এতো রাতেই চলে এলাম।
আভাস মিনহার এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এতোরাতে উনি এখানে কীভাবে এলো- এই ব্যাপারে চিন্তা করা বাদ দিয়ে বরং তার বলা কথা গুলো শুনে পুরোই মিইয়ে গেল আভাস।
আভাসকে এমন মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিনহা কড়া গলায় বললো,

—আমাকে কি ঢুকতে দিবি না নাকি? তুই যেসব উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা করছিলি, সেগুলোতে পানি ঢালার জন্যই এখানে এলাম।
আভাস অবাক হয়ে বললো,
—উল্টাপাল্টা চিন্তা মানে?
—বলছি, বলছি। আমায় একটু বসতে তো দে!
—ও হ্যাঁ। আসুন ভেতরে।
মিনহা ভেতরে ঢুকে সোফায় আরাম করে বসলো। শ্রুতি মিনহাকে দেখে তেমন কোনো হেলদোল দেখালো না। বরং জিজ্ঞেস করল,
—কোনো খবর আছে নাকি?
মিনহা হালকা হাসলো। আভাস বোকার মতো তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে, মিনহার মতো এখজন অশীতিপর বৃদ্ধার কাছে কী খবর থাকতে পারে।
হঠাৎ মিনহা বলে উঠলো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৬

—আমি অনেক খুশি হয়েছি রে, শ্রুতি! তোদের সম্পর্কটা শেষপর্যন্ত পূর্ণতা পেল। এই ছেলেটা অবশেষে ঝুকিটা নিলো তাহলে! কিন্তু ও একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলো!
আভাস কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললো,
—কী ভুল সিদ্ধান্তের কথা বলছেন আপনি?
—তুই তোর মাকে এখনি কিছু করবি না।
আভাস অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
—আমি আপনাকে কখন বললাম যে, আমি আমার মাকে কিছু করবো?
মিনহা অট্টহাসি দিয়ে বললো,
—তোদের কিছুই অজানা নয় আমার কাছে। শুধু এটা শুনে রাখ, তোর মা, মানে আরিহা খানের ভেতর অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। সেগুলো শুধু তিনিই জানেন। তাই তাকে হাতছাড়া করিস না। আমার ওপর বিশ্বাস রাখ। তোদের কোনো ক্ষতি কেউ-ই করতে পারবে না। সুতরাং, আমি যেভাবে বলি, সেভাবে চল। ভুলেও আরিহা খানের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে যাবি না। এখনো সময় আসেনি কিছু করার।
বলেই মিনহা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আভাস আটকাতে চাইলে শ্রুতি বাঁধা দিলো। আভাস বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

—উনি এতো কিছু কীভাবে জানেন? তোমাকে যে আমার মা-ই মারতে চেয়েছিল, সেটাই বা উনি জানলো কীভাবে? আমি তো এটা ভেবে ওনার কথা বিশ্বাস করেছিলাম যে, সেদিন আমার নামে তোমার কাছে মেসেজ গিয়েছিল। কিন্তু এখন আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ওনি এসব কিছু জানলেন কীভাবে? আর তোমরাই বা ওনাকে এতো বিশ্বাস করো কেন?
শ্রুতি নির্লিপ্ত ভাবে বললো,
—কারণ উনি কোনো মানুষ না।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৮