ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৫ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৫
Mahfuza Akter

ক্লাসে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে শ্রুতি। কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন সিনিয়র স্টুডেন্ট এসে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে কারা কারা পারফর্ম করবে তাদের নাম জানিয়ে গেছে। সেই লিস্টে গানের পারফর্মারদের মধ্যে শ্রুতির নামও আছে। শ্রুতির মাথা পুরো হ্যাং হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবেই যে, তার নামটা কে দিলো? তার চেয়েও বড় কথা হলো শ্রুতি কখনো ভার্সিটির কোনো প্রোগ্রামে আসে না আর গান গাওয়া তো দূরে থাক! আর এবারে আসার তো প্রশ্নই আসে না। কারন এবার আভাস থাকবে।

শ্রুতি নিজের ভাবনা চিন্তাকে সাইডে রেখে ব্যাগ হাতে নিয়ে আরাফ আহসানের রুমে চলে গেল। আজ যে আর ক্লাস হবে না, সেটা শ্রুতি বুঝতেই পারছে। তাই আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই।
শ্রুতি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করে বললো,

—স্যার, মে আই কাম ইন।
আরাফ আহসান শ্রুতিকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
—আরে অদ্রিতা, এসো, এসে বসো। আমি আগেই জানতাম, তুমি আসবে।
শ্রুতি বসতে বসতে বললো,
—স্যার, জানতেন মানে?
—হুম, জানতাম। এখন বলো, কী গান সিলেক্ট করলে?
শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,
—স্যার, আপনি আমায় একথা বলছেন? আপনি তো আমার ব্যাপারে সবটা জানেন! তারপরও আমায় গান গাইতে বলছেন?

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—হ্যাঁ, গান গাইতে কী সমস্যা? গান গাইলে কেউ তোমার ফেস দেখতে চাইবে না। আর আমি জানি যে, তোমার গানের গলাও অনেক ভালো। নিজের ট্যালেন্ট গুলোকে আর লুকিয়ে রেখো না। কোনো সমস্যা হলে তো আমি আছি।
—কিন্তু স্যার, আমি গান গাইলে সবার কাছে আমি পরিচিতি পেয়ে যাবো। আর আমি চাই না এতো ফেমাস হতে।
—নিজের মুখটাকে আড়ালে রেখেও ফেমাস হওয়া যায়। আমি বুঝতে পারছি যে, এখনো সময় আসেনি তোমার চেহারাটা কাউকে দেখানোর। আর তোমার চেহারা কেউ দেখতেও চাইবে না, কারন তুমি আড়ালে থেকেই গান গাইবে। শুধু তোমার নামটা শুনবে সবাই, কিন্তু কেউ তোমায় দেখবে না।
শ্রুতি আর বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। মূল কারণ যে আভাস, সেটা তো স্যারকে বলা যাবে না! অন্য কোনো বাহানাও খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করে প্রশ্ন করলো,
—স্যার, সব টিচাররাই কি প্রোগ্রামের সময় থাকবে?
—সবাই-ই থাকবে, শুধু আভাস থাকতে পারবে না।
শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,

—কেন?
—আভাস এসব হট্টগোল পছন্দ করে না। এখন পর্যন্ত কোনো ইভেন্টে আমি ওকে আনতে পারিনি। এবার তো আমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে, ও এসবে থাকতে পারবে না।
শ্রুতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,
—ওহহ, বুঝলাম। স্যার আজ তাহলে আমি আসি।
—আচ্ছা, তবে কাল ঠিক সময়ে চলে এসো। তোমার পারফরম্যান্সের সময় সন্ধ্যায় রেখেছি, এতে তোমার সুবিধা হবে আশা করি।
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়েই দেখলো আভাস আর তন্ময় একসাথে এদিকেই আসছে। আভাসকে দেখে শ্রুতি একদৌড়ে উল্টো দিকের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা থেকে নিচতলায় চলে গেল।
এদিকে তন্ময় সেই কখন থেকে আশেপাশে তাকাচ্ছে আর মনে মনে স্নেহাকে খুঁজছে। আভাস সেটা লক্ষ করে বললো,
—স্নেহা আজকে আসেনি আজ ক্লাস হবে না ভেবে।
তন্ময় থতমত খেয়ে বললো,

—স্নেহা আসেনি তো আমার কী? তুই ওর কথা আমায় বলছিস কেন?
—বুঝি, বুঝি! আমি সব বুঝি। তোমার চোখ দুটো যে তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো তার প্রেয়সীকে খুঁজছে সেটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি! তবে তিক্ত হলেও সত্য যে, সেটা আমারই বোন।
তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বললো,
—তোর বোন যে একটা বদের হাড্ডি! সেটা কে দেখবে শুনি? আমাকে তো বিয়ের আগেই একদন্ড শান্তি দেয় না! বিয়ের পর যে কী করবো গড নৌস ওয়েল।
আভাস ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো,
—ওকে, তো আমার বোনকে তোর বিয়ে করা লাগবে না। আমি অন্য ছেলে দেখছি।
তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—হারামি কোথাকার! শুধু ভার্সিটিতে আছি বলে কিছু বলতে পারছি না আশেপাশের স্টুডেন্টরা কী বলবে এটা ভেবে! নয়তো একটা কিল-ঘুষিও মাটিতে পড়তো না।
—ও, তাই।
বলেই হাসতে লাগলো আভাস।

বাসায় পৌঁছে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল শ্রুতি। শায়লা রুবাইয়াত শ্রুতির পেছন পেছন গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে! মনে তো হয় না একটা ক্লাসও করেছিস!
শ্রুতি বিরক্ত হয়ে বললো,
—উফ মা, এদিকে আমার টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে, আর তুমি ক্লাস নিয়ে পড়ে আছো?
—কেন? কী হয়েছে আবার?
শ্রুতি ওর মাকে সবকিছু খুলে বললো। শায়লা রুবাইয়াত স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন,
—ভালোই তো হয়েছে! তোকে তো কেউ দেখছে না আর আভাসও আসবে না! সমস্যা কোথায়?
—আমি শুধু স্যারের কথা ভেবে রাজি হয়েছি। আরাফ স্যার আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। ওনার জন্যই আমি পড়াশুনা এখনো কন্টিনিউ করতে পারছি। তাই ভাবলাম, এইটুকু তো করাই যায়।

পরেরদিন বিকেলে একটা ব্লু কালার গাউন পরে ক্যাম্পাসে এলো শ্রুতি। মুখে সেই নিকাব বাঁধা, গোল্ডেন কালারের হিজাব আর পা পর্যন্ত লম্বা গাউনে অনেকটাই আলাদা লাগছে আজ তাকে। শ্রুতি স্টেজের সামনে একটা চেয়ারে বসে আশেপাশে তাকিয়ে আভাসকে খুঁজতে লাগলো। সামনেই সব টিচাররা আলাদাভাবে বসেছেন, কিন্তু সেখানে কোথাও আভাসকে দেখা যাচ্ছে না।
শ্রুতি মনে মনে ভাবলো, আভাস হয়তো সত্যিই আসে নি।
সন্ধ্যার পরপরই শ্রুতির পারফরম্যান্সের পালা। অদ্রিতা রুবাইয়াতের নাম এনাউন্সড হতেই শ্রুতি স্টেজের পিছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ালো। আরাফ আহসান শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—অল দ্য বেস্ট, মাই ডিয়ার। একদম ভয় পাবে না। আমি এখানেই আছি।

শ্রুতি মলিন হেসে মাথা নাড়িয়ে স্টেজে উঠতে লাগলো।সাথে স্টেজের আলো নিভে গেল। শ্রুতি হারমোনিয়ামের সামনে গিয়ে বসতেই স্টেজ পার্টি স্মোক দিয়ে ধোঁয়াশা করে দেওয়া হলো আর বিভিন্ন কালারের লাইট জ্বলে উঠলো। শ্রুতি স্পিকারটা মুখের সামনে রেখে গাইতে লাগলো,
“একটুকু ছোঁয়া লাগে……..
একটুকু কথা শুনি…।”
শ্রুতির গানের কন্ঠ শুনেই কেউ একজনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো, চোখ দুটো বন্ধ করতেই অক্ষিকোটর থেকে মোটা দুটো অশ্রু বিন্দু বের হয়ে গাল ছুঁইয়ে গড়িয়ে পড়লো।
“একটুকু ছোঁয়া লাগে,
একটুকু কথা শুনি।
তাই দিয়ে মনে মনে….
রচি মম ফাল্গুনী।
একটুকু ছোঁয়া লাগে,
একটুকু কথা শুনি।”

শ্রুতি চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে, একটা ছেলে একটা মেয়ের পেছনে চুপিসারে এসে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে দিলো। মেয়েটা ছেলেটার হাতের ওপর হাত রেখে বললো,
—“ধলা বিড়াল। ”
ছেলেটা মেয়েটার চোখ ছেড়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা ছেলেটার গাল টেনে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।
শ্রুতিও হেসে চোখের পানি মুছে গাইতে লাগলো,

“কিছু পলাশের নেশা……
কিছু বা চাপায় মেশা…..
কিছু পলাশের নেশা,
কিছু বা চাপায় মেশা।
তাই নিয়ে সুরে সুরে,
রঙে-রসে জাল বুনি।
তাই নিয়ে সুরে সুরে,
রঙে-রসে জাল বুনি।
রচি মম ফাল্গুনী….
একটুকু ছোঁয়া লাগে
একটুকু কথা শুনি।”

উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে শ্রুতির গান শুনছে। এতো সুন্দর কন্ঠ শুনে সবারই তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সামনে থেকে শুধু হারমোনিয়ামটাই একটু-আধটু দেখা যাচ্ছে কিন্তু হারমোনিয়ামের পেছনে বসা মানুষটিকে একদমই দেখা যাচ্ছে না ধোয়ার কারণে।
শ্রুতি গানের পরবর্তী অংশ শুরু করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ কোনো পুরুষালি কন্ঠ গেয়ে উঠলো,
“যেটুকু সময় আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে,
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।”
শ্রুতি চোখ বড়বড় করে আশে পাশে তাকালো। শ্রুতির আর বোঝার বাকি নেই যে, এটা কার গলা। ভীত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে আর ঢোকের পর ঢোক গিলছে সে। হঠাৎ নিজের হাতের ওপর কারো উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো, কেউ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে দুহাত ধরে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। শ্রুতি পেছন ফিরে তাকিয়ে আভাসকে দেখে ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে।
“যেটুকু সময় আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে,
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।

যেটুকু যায় যে দূরে…….
ভাবনা কাঁদায় সুরে…….
তাই নিয়ে যায় বেলা
নুপুরেরও তাল গুনি।
রচি মম ফাল্গুনী,
একটুকু ছোঁয়া লাগে,
একটুকু কথা শুনি।”

গান শেষ হতেই আশেপাশের সবার করতালি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চারপাশে। এদিকে শ্রুতিকে কিছু বলার বা করার সুযোগ না দিয়ে আভাস ওর হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। শ্রুতি বারবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে, কিন্তু আভাস ওর হাত আঠার মতো ধরে রেখেছে। আরাফ আহসানের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনিও দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন যে, আভাস আর শ্রুতির মাঝে কোনো কানেকশন আছে।
এদিকে তন্ময় স্নেহাকে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আছে। এখানে মানুষজনের আনাগোনা কম, তাই কেউ দেখতেও পাচ্ছে না।

—তোমাকে আজ এতো সেজেগুজে আসতে বলেছে কে? এটা ভার্সিটি, কোনো বিয়ে বাড়ি না যে তোমার নাচ দেখবে কেউ!
তন্ময়ের চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথা শুনে স্নেহা বিরক্ত হয়ে বললো,
—আপনি জানেন, আমার নাচ দেখার জন্য সবাই ওয়েট করে আছে? আমি তো আজকে ‘মেরা সাইয়া সুপারস্টার’ গানে নাচ দেওয়ার জন্য এসেছি।
তন্ময় চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
—হোয়াটটটট???

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৪

স্নেহা তন্ময়ের রিয়েকশন দেখে কতক্ষণ নিজের হাসি চেপে রাখলো। তারপর আর না পেরে হো হো করে হেসে দিলো। স্নেহার হাসি দেখে তন্ময় বুঝতে পারলো যে, ও এতোক্ষণ মজা করছে। তন্ময় স্নেহার ওড়না নিজের হাতে বেঁধে বললো,
—যতোক্ষণ এখানে থাকবে, আমার সাথেই থাকবে। এটাই তোমার শাস্তি।
স্নেহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
—আমি আমার ফ্রেন্ডসদের কাছে যাবো। আমাকে ছেড়ে দিন।
—নেভার, নো এপ্লিকেশন উইল বি গ্রেন্টেড। আমার সাথেই থাকবে তুমি।
স্নেহা আরো কিছু বলতে যাবে এমনসময় দেখলো আভাস একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে তাদের পাশ দিয়েই কোথায় যেন যাচ্ছে।

স্নেহা ভাইয়া, ভাইয়া বলে ডাকলেও শুনছে না। তন্ময়ও স্নেহার সাথে সাথে ডাকলো, কিন্তু আভাস কোনো রেসপন্স না করেই গেইট দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
—ভাইয়া কাকে নিয়ে চলে গেল?
—জানি না? তুমিও যেখানে, আমিও সেখানে।

আভাস শ্রুতিকে গাড়িতে উঠাতে চাইলে শ্রুতি গাড়ির সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আভাস ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো,

—গাড়িতে উঠবে নাকি উঠবে না?
শ্রুতি মাথা নিচু করে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—আমি বাসায় যাবো। আমাকে যেতে দিন, প্লিজ।
আভাস শ্রুতির হাত আরো জোরে চেপে ধরে বললো,
—তোমাকে ভালোভাবে বলেছি, শুনলে না। আমি নিষিদ্ধ কোনো কাজ করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু তুমি বাধ্য করছো। আশেপাশে কতো মানুষজন দেখেছো? এখন যেটা করবো, সেটা তোমার-আমার কারোর জন্যই ভালো হবে না।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৬