ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৬ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৬
Mahfuza Akter

আভাস শ্রুতির গাঁ ঘেঁষে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই শ্রুতি চোখ খিঁচে বন্ধ করে বললো,
—আমি উঠছি, আমি যাবো আপনার সাথে।
আভাস একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। শ্রুতি গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।
এদিকে স্নেহা যতবার আভাসকে ফোন দিচ্ছে, ততবারই সুইচড অফ বলছে। তন্ময়ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। স্নেহা চিন্তিত স্বরে বললো,

—ভাইয়া একটা মেয়েকে কেন ওমন ভাবে নিয়ে যাবে? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, ঐটা ভাইয়াই ছিল তো?
—ঐটা আভাসই ছিল। আমি ওকে দেখেছিলাম ঐ ব্লু শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স পরে আসতে। আর ওর মুখ দেখোনি তুমি, স্টুপিড?
—দেখেছি, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাইয়া শ্রুতিকে ছাড়া তো কারো কথা চিন্তাই করতে পারে না! আর এভাবে হাত ধরে নিয়ে গেল! আমার এখন নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না।
তন্ময় কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—হয়তো ওটা শ্রুতি-ই ছিল!
স্নেহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—যতোসব গাঁজাখুরি কথা-বার্তা। শ্রুতি পাঁচ বছর আগেই মারা গেছে, বুঝেছেন?
—সেটা আমিও জানি, কিন্তু তোমরা শ্রুতির ডেড বডি দেখেছিলে? আমি যতোদূর জানি, তোমরা শুধু শুনেছিলে।
স্নেহা চিন্তিত হয়ে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—হ্যাঁ, সেদিন শ্রুতির জন্মদিন ছিল। ভাইয়া আর শ্রুতি একে অপরকে ভালোবাসতো, কিন্তু কেউ কাউকে কখনো মুখে বলেনি। তাই ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সে ঐদিনই শ্রুতিকে মনের কথা বলে দিবে। কিন্তু ওদের বাসায় গিয়ে দেখে তালা ঝুলানো। শ্রুতির সাথে শুধু ওর মা-ই থাকতো। ভাইয়া ভেবেছিলো হয়তো কোথায় বেড়াতে গেছে, কিন্তু শ্রুতিকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিলো না। এভাবে তিনদিন চলে যায়। ভাইয়া প্রতিদিন দুই-তিন বার করে ওদের বাসায় যেত এই আশায় যে, ওকে পাবে। কিন্তু তিনদিনের দিন ওদের বাসায় গেলে শ্রুতির মাকে পায়। ভাইয়া জিজ্ঞেস করতেই শ্রুতির মা কেঁদে উঠে বলে যে, শ্রুতির এক্সিডেন্ট হওয়ায় ও এই তিনদিন হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিল আর আজ মারা গেছে। শ্রুতিকে ওদের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাইয়া সেদিন একদম পাথর হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কিন্তু একজন মায়ের কান্নারত ও বেদনাবিধুর কথা শুনে অবিশ্বাসও করতে পারছিলো না।”
তন্ময় সবটা মনযোগ দিয়ে শুনে বললো,

—তোমার কথাও সত্যি হতে পারে। হয়তো শ্রুতি সত্যিই মারা গেছে! কিন্তু আভাস কাকে নিয়ে গেল সেটা ও আসলেই জানতে পারা যাবে।

আভাস একটা পার্কের সামনে গাড়ি থামালো। গাড়ি থেকে নেমে শ্রুতির হাত ধরে পার্কের ভেতরে চলে গেল তারা। রাত হয়ে যাওয়ায় পার্ক পুরোটাই ফাঁকা, কোনো মানুষজন নেই। তবে সবজায়গায় লাইট সেট করা থাকায় পুরো পার্টাই আলোকিত।
আভাস একটা খোলামেলা মাঠের মতো জায়গায় নিয়ে শ্রুতির হাত ছেড়ে দিলো। শ্রুতি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আভাসের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন, স্যার?

আভাস শ্রুতির কথা শুনলো নাকি শুনলো না, সেটা শ্রুতি বুঝতে পারছে। কারণ আভাস তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় আভাসের ফর্সা মলিন চেহারাটায় যেন পৃথিবীর সব মায়া আজ জুড়ে বসেছে। চোখ দুটো ছলছল করছে, তবুও আভাস তার লালচে ঠোঁট কামড়ে সেটা গড়িয়ে পড়তে বাঁধা দিচ্ছে। এতো বছর পর নিজের প্রেয়সীকে ফিরে পেয়েছে, যাকে সে এতো দিন মৃত ভেবে এসেছে। মনের মধ্যে খুশি, আনন্দ, দুঃখ, রাগে, অনুতাপের একটা মিশ্র অনুভূতি বিরাজ করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে দাড়িয়েছে যে, তার এখন কী করা উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না।

এদিকে শ্রুতি আভাসের গতিবিধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও কিছু বুঝতে পারলো না। নিজের বর্তমান অবস্থা মনে পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেললো শ্রুতি। এভাবে আভাসের দিকে তাকিয়ে থাকাটা তার জন্য যে ঘোর অন্যায়!
আভাস অনেকক্ষণ যাবৎ নিজের সাথে যুদ্ধ করছে। কাঁদতেও পারছে না, হাসতেও পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু চোখের পানিগুলো আজ প্রচন্ড রকমের ছটফট করছে। আভাস হুট করেই শ্রুতিকে দু’হাতে ঝাপটে ধরে বাহুডোরে আবদ্ধ করলো।

আভাসের আকস্মিক আক্রমণে শ্রুতির পুরো ফ্রিজড হয়ে গেছে। শ্রুতি নিজের হাত দুটো আভাসের পিঠে রাখতে গিয়েও আবার সরিয়ে ফেলছে। ভেতরে ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে তার। আভাসকে ধরতেও পারছে না আবার ছাড়িয়ে নিতেও পারছেনা। হঠাৎ কানে ফুপিয়ে ওঠার শব্দ আসতেই শ্রুতি চোখ বড়বড় করে ফেললো। আভাস কি কাঁদছে? তার কি আভাসকে জড়িয়ে ধরা উচিত?
শ্রুতি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,

—স্যার, আপনি কাঁদছেন কেন?
আভাস ছোট বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে উঠে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
—জাস্ট স্টপ টকিং ননসেন্স। কে তোমার স্যার? আমাকে কি কেন তুমি নতুন শব্দে সম্বোধন করছো? তোমার কি মনে নেই তোমার ধলা বিড়ালের কথা? কেন আমার থেকে এতোদিন দূরে ছিলে? তুমি জানো না, আমি আমার মিষ্টিপাখিটাকে ছাড়া থাকতে পারি না?
শ্রুতি আভাসের কথা শুনে নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। মুখে হাসি, চোখে জল নিয়ে শ্রুতি বললো,
—কেন থাকতে পারেন না তাকে ছাড়া?
আভাস কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—ভালোবাসি তোমায়, বোঝো না তুমি? তোমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয় আমার। মরে যেতে ইচ্ছে করে। জানি না কতোটা ভালোবাসি তোমায়, মিষ্টিপাখি! কারণ এতোটাই ভালোবাসি যে, সেটা পরিমাপ করার সামর্থ্য আমার নেই।

—আগে তো কখনো বলেননি যে, আমায় ভালোবাসেন!
আভাস নাক টেনে বললো,
—সবকথা কি মুখে বলে দিতে হবে তোমায়? তুমি বুঝতে পারোনি কিছু? বোধশক্তি নেই তোমার? আমি তো ঠিকই বুঝেছি যে, তুমি আমায় ভালোবাসো।
শ্রুতি আনমনেই হালকা হাসলো।
—বুঝতে পেরেছি, আমিও আপনাকে……….
প্রকৃতস্থ হতেই শ্রুতির মাথায় এলো যে, সে দুনিয়াদারি ভুলে আভাসের সাথে কী থেকে কী বলছিলো। আর এখন যেটা বলতে যাচ্ছিলো, সেটা তার জন্য কতো বড় ভুল হতো ভাবতেই শ্রুতি আভাসকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জোরে একটা ধারক দেয়। আভাস অপ্রকৃতস্থ থাকায় থাকায় ছিটকে পড়ে যেতে নিলেও একপায়ে ভর করে নিজেকে সামলে নিলো। শ্রুতির দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—শ্রুতি, কী হয়েছে? তুমি এমন………
শ্রুতি আভাসকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—আমি, আমি শ্রুতি নই। আমি অদ্রিতা রুবাইয়াত।

শ্রুতি জানে, আভাসকে এখন এসব বলে লাভ নেই। কারণ আভাস তাকে চিনতে ভুল করেনি। আজ শ্রুতি বেশ ভালো করেই ফেঁসে গেছে। তাই কী থেকে কী বলবে বুঝতে পারছে না।
শ্রুতির কথায় আভাস যেন হাসলো! নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা শব্দ করেই হাসলো সে।
—তুমি বড্ড বোকা, মিষ্টিপাখি। তুমি যে শ্রুতি না, সেটা এখনো আমায় বলছো? তুমি যে মারা গেছো, সেটা আমি প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। যদিও তোমার মায়ের কথা শুনে মনে হয়েছিল তিনি সত্যিই বলছেন, কিন্তু আমার মনে কোথাও না কোথাও একটা সন্দেহ ছিলই। বাট ডু ইউ নো হোয়াট, ভার্সিটির ক্লাসে তোমায় সেদিন প্রথম দেখেই আমি চিনে ফেলেছিলাম।

শ্রুতি অবাক হয়ে আভাসের দিকে তাকালো। শ্রুতির অবাকতা দেখে আভাস বললো,
—অবাক হলেও এটাই সত্যি যে, তোমার চোখ এবং ভয়েস শুনেই আমি তোমায় চিনে ফেলেছিলাম। যদিও তুমি ভয়েস চেঞ্জ করে আমার সাথে কথা বলেছিলে! কিন্তু ঐ যে বললাম না, তুমি বড্ড বোকা। এটুকু বুঝতে পারোনি যে, যে মানুষটা তোমার উপস্থিতি ফিল করতে পারে, সে তোমায় দেখে চিনতে পারবে না?
আভাসের কথা শুনে শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে বললো,

—জানতাম, কিন্তু আপনার থেকে নিজেকে দূরে রাখাই আমার-আপনার জন্য উত্তম। আপনার কাছে আমি সারাজীবন মৃত হয়েই থাকতে চাই।
আভাস বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—কেন?
শ্রুতি ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আঁটকে বললো,
—কারণ আমি এখন আর আগের স্টেজে নেই। আমার অস্তিত্বে যে দুটো কলঙ্কের দাগ লেগে গেছে। আমি আপনার যোগ্য নই, একদমই যোগ্য নই।
—কী বললে? কীসের কলঙ্ক?

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৫

আভাসের কম্পিত কন্ঠ শুনে শ্রুতি চোখ বন্ধ করে বললো,
—আমি নিজের সতীত্ব হারিয়ে ফেলেছি আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। আমি একজন ধর্ষিতা।
বলেই দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো শ্রুতি। শ্রুতির কোন শুনে আভাস পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দুনিয়া উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে তার। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটা আজ…….. ভাবতেই পারছে না সে।
এদিকে শ্রুতি কাঁদতে কাঁদতে আভাসের বিধস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

—হজম করতে পারছেন না, তাই তো? কিন্তু এটাই সত্যি! তবে এটাই শেষ নয়। আরো কিছু হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। যদিও সেটা আপনি সহ্য করতে পারবেন না, আমি জানি। কিন্তু তবুও আজ আমি জানাবো আজকে।
আভাস শ্রুতির কথা শুনে তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। শ্রুতি আঙুল দিয়ে চোখ মুছে বললো,
—জানতে চান আরো কী হারিয়েছি? তো এই যে, দেখুন।
বলেই শ্রুতি এক ঝটকায় নিজের মুখের ওপর থেকে নিকাব তুলে ফেললো। হলুদ আলোয় সেই বাঁ পাশ ঝলসে যাওয়া বিকৃত মুখটা দেখে আভাস কিছুক্ষণ মুর্তির মতো তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করেই বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দু চোখ ঢেকে জোরে চিৎকার দিলো আভাস।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৭