ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৭ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৭
Mahfuza Akter

আভাসের চিৎকার শুনে শ্রুতি তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়েই একটু হাসলো। সেই হাসির আড়ালে হয়তো কষ্ট লুকিয়ে আছে, নয়তো তাচ্ছিল্য। নিজের জীবনের বিগত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় শ্রুতি এতোটুকু ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে, বর্তমান সমাজে মেয়েদের বাহ্যিক সৌন্দর্যটা অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ববহ। গুণ, যোগ্যতা আর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তাটা খুব নগন্য। তাহলে কি আভাসও সেই শ্রেণিভুক্ত একজন?

—কী হলো? ভয় পেয়ে গেছেন আমার ফেস দেখে? যখন বুঝতেই পারছেন আমার দু দুটো ডাউন সাইড আছে, তাহলে তো আপনার আর কিছু বলার মতো থাকে না, তাই না?
আভাস শ্রুতির কথা শুনে দু পা পিছিয়ে গেল। চোখ থেকে ধীরে হাত নামাতেই শ্রুতির সেই মুখশ্রী দেখতে পেল সে। শ্রুতি এখনো বসেই আছে, মুখটাও খোলা রেখেছে। শ্রুতির মুখের কথা শুনে আভাসের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু ওর চেহারা দেখার পর সবটা না চাইতেও বিশ্বাস করতে হচ্ছে। একটা মেয়ে কখনো এসব বিষয় নিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না, আর শ্রুতি তো একদমই না। এসব ভাবতেই আভাসের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! এমন কিছু তো সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি! চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে। অশ্রুসিক্ত করুন চাহনিতেই তাকিয়ে আছে সে তার প্রিয় মানুষটির দিকে। কিন্তু সে তো মাটিতে থাকা ঘাসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কোনো পানি নেই, অনুভূতি শূন্য এক মানবীর মতই বসে আছে সে।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

আভাস নিজের আবেগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছে না যে, সে শুনেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। আর শ্রুতি? ও কীভাবে সবকিছু সহ্য করেছে? এতোকিছু ঘটে গেছে তার জীবনে? অথচ আভাস তার ছিটেফোঁটাও জানতে পারলো না!
আভাস শ্রুতির সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। শ্রুতির দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে বললো,
—কীভাবে হলো এসব? কে আছে এসবের পেছনে?
শ্রুতি মুর্তির মতো তাকিয়ে থেকেই বললো,
—কী করবেন এসব জেনে? আপনার তো কোনো লাভ নেই! অহেতুক বাক্যব্যয় করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
—আমি জানতে চাই, সবটা জানতে চাই। সো, তোমাকে বলতে হবে। কীভাবে তোমার সাথে এসব ঘটলো? কে করলো তোমার এতোবড় ক্ষতি?
শ্রুতি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আভাসের দিকে তাকালো। আভাস তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি আভাসের চোখে কৌতূহল দেখলেও আভাসের ভেতরের রক্তক্ষরণ সে দেখতে পারছে না। শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,

—ক্লাস নাইনে থাকতে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল। মনে আছে, সেই দিনের কথা। আপনি রংসাইড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে আমি আপনার গাড়ির গ্লাস ভেঙে দিয়েছিলাম? সেদিন আপনি রেগে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন! আমি তো ভেবেছিলাম আজ আমার শেষদিন। কিন্তু না! আপনি আমার দিকে তাকাতেই আপনার চেহারার রং পাল্টে যায়। আপনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেলে গিয়েছিলেন। পরে বাসায় এসে আপনাকে দেখে জানতে পারি আপনি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। তারপর থেকেই আপনার সাথে আমার খুনসুটি, ঝগড়া আর বন্ধুত্ব হয়। দুই বছর পর আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমরা বাসা চেঞ্জ করি। তবুও আপনার সাথে আমার রেগুলার যোগাযোগ ও দেখা হতো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আর সাধারণ গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সেটা তখনই বুঝেছিলাম, যখন আপনি আমায় মিষ্টিপাখি বলে সম্বোধন করা শুরু করেন।
আভাস অবাক হয়ে বললো,

—তার মানে তুমি ডুবে ডুবে জল খেতে? সবটা বুঝেও না বোঝার ভান করতে? আর আমি কতো চেষ্টা করতাম তোমাকে আমার ফিলিংস গুলো বোঝানোর! অনেকবার চেষ্টাও করেছি তোমায় মুখ ফুটে বলার। কিন্তু তোমার সামনে গেলেই আমার হার্টবিট বেড়ে যেত আর কথা গুলো সব গুলিয়ে যেত। আবার ভয়ও হতো, কারণ তোমার বয়স অনেক কম ছিল। যদি তুমি আমার ফিলিংস গুলো না বুঝো!
শ্রুতি আভাসের কথা শুনে বললো,
—আমি চাইতাম, আপনি নিজে আমায় বলুন। কিন্তু আপনি বলেননি। কয়েক দিন পর আমার জন্মদিনের দুদিন দিন আপনি বলেছিলেন যে, আমায় বার্থডে উপলক্ষে একটা সারপ্রাইজ দিবেন। আমি তখনই বুঝেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার মনের কথা আমায় জানাবেন। কিন্তু জন্মদিনের আগের দিন রাত এগারোটার দিকে আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে।

—মেসেজ? কিসের মেসেজ? কে পাঠিয়েছিল সেটা?
—আননোন নাম্বার থেকে এসেছিল। আর তাতে লেখা ছিল,
“তোমার বাসার সামনে এসো তাড়াতাড়ি। আমি ওয়েট করছি।
~আভাস”
এটা শুনে আভাস শকড হয়ে বললো,
—কিন্তু আমি তো তোমাকে এমন কোনো মেসেজ পাঠাইনি!

—জানি, আপনি পাঠাননি। ওটা একটা ট্র্যাপ ছিল, আর আমিও বোকামি করে সেটাতে পা দিয়েছিলাম। তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে আমি এক দৌড়ে গেইটের কাছে যেতেই দেখলাম আশেপাশে কেউই নেই। কতক্ষন এদিক-সেদিক তাকিয়ে আবার ফিরে যেতে নিলেই কেউ পেছন থেকে আমার নাকে রুমাল চেপে ধরে তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। যখন চোখ খুলি, তখন নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরে আবিষ্কার করি। তখন ছিল রাতের শেষ ভাগ। ঘরে হালকা আলো জ্বলছিল, আমার সামনেই একটা অপরিচিত ব্যক্তি বসেছিল। যদিও তার মুখ আবছা আবছা দেখেছি। আমি ওঠে বসতেই যা দেখি, সেটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারি যে, আমি এখন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নেই।

বলেই হঠাৎ ডুঁকরে কেঁদে ওঠে শ্রুতি। অনেকক্ষণ ধরেই তো নিজেকে শক্ত রেখেছিলো। কিন্তু এখন সেই মুহূর্তটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেটা যে তার জীবনের কালো অধ্যায়! এর জন্যই তার জীবনটা আজ অন্ধকার। জানে না সে আদৌ সেখানে এক চিলতে ফুটবে কিনা! নাকি বর্তমানের মতোই আঁধারে ঘনীভূত থাকবে তার ভবিষ্যৎ।
শ্রুতির কথা শেষ হতেই আভাস দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে ফেলে। একদিকে শ্রুতি কাঁদছে, আরেক দিকে আভাস কাঁদছে।

—আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই আমার সামনে বসা ছেলেটা জোরে চিৎকার করে কয়েকজনকে ডাক দেয়। তারা ভেতরে আসতেই বলে, ‘আমার কাজ শেষ, এখন একে যা করতে বলা হয়েছিল, সেটা কর।’ তারা আবার আমাকে অজ্ঞান করে ফেলে। তারপর একটা কালো কাপড় দিয়ে পেচিয়ে নিয়ে একটা জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর একজন একটা ছোট কাচের বোতল আর ছুরি বের করলো। সেই বোতল থেকে তরল জাতীয় কিছু আমার মুখের একপাশে ফেলতেই আমি তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠি। আমার মুখ জ্বলে যাচ্ছিলো, সারা শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো। আমি গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিলাম, ওরা আমায় বাঁধা দিচ্ছিলো। কিন্তু তাও আমি একহাত দিয়ে গালে স্পর্শ করতেই আমার হাতও জ্বালা করছিলো। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন সময় একজন হাত এসিডের বোতল, আরেকজন হাতে ছুরি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। হঠাৎ পেছন থেকে এক বৃদ্ধা ‘কে ওখানে?’ বলে চিৎকার করতেই তারা সবাই ভয় পেয়ে যায়। লোকগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্য সেখান থেকে পালিয়ে চলে যায়। সেই বৃদ্ধা আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায়। রাতের অন্ধকার হলেও আমি চাঁদের ক্ষীণ আলোয় আবছা আবছা দেখেছি যে, তার পেছনে আরো কয়েকজন ছিলো। কিন্তু মুখের প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই।
শ্রুতি একটু থেমে আবার বললো,

—আমার জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি হাসপাতালের বেডে, মুখের একপাশে ব্যান্ডেজ। আমার পাশেই আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে মা যদিও মাকে কে কীভাবে খবর দিয়েছে আমি জানতাম না। ওসব ভাবার কথা আমার মাথায়ই ছিল। মুখের ব্যথাটা তখনও যায় নি। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। মায়ের পাশে সেই বৃদ্ধাটাও ছিলো, তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি তাদের সব খুলে বলি। বৃদ্ধার নাম মিনহা, আমি মিনহা জি বলে ডাকি। পরে মেডিকেল রিপোর্টে আমার ওভারীতে সিস্ট ধরা পড়ে যেটা অনেক আগে থেকেই ছিলো, যার কারণে আমি মা হতে পারবো ঠিকই কিন্তু অনেক সময় লাগবে আবার নাও হতে পারি। আী একবার রেপ করায় ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
আভাস চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

—আর এজন্যই তুমি নিজেকে মৃত সাজিয়ে তোমার মাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছো?
শ্রুতি মাথা নিচু করে বললো,
—আমি তখন এতো কিছু ভাবার মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম না। যা করার মিনহা জি করেছিলো। তিনি মাকে বলেছিল, যারা আমাকে মারতে চেয়েছিল, তারা যদি জানতে পারে যে আমি এখনো বেঁচে আছি, তাহলে আবার আমার ওপর অ্যাটেক করতে পারে। রাজশাহীতে আমার বাবা মৃত্যুর আগে একটা বাড়ি কিনেছিলো, তাই আমরা এখানেই চলে আসি ঢাকা ছেড়ে।
—তারমানে যারা এসব করেছে, তাদের তোমরা কিছুই করতে পারোনি।
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। আভাস সবটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—অনেক রাত হয়ে গেছে, চলো তোমায় বাসায় পৌঁছে দেই। মুখটা ঢেকে নাও।

বলেই ধীর পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে যেতে লাগলো।
শ্রুতি আভাসের কথা শুনে থম মেরে গেল। সে ভেবেছিলো, এমনটাই হবে। আভাস সত্যি সত্যিই তাকে মানতে পারছে না হয়তো! যতই হোক, কেউ চাইবে না, কোনো রেপড ও এসিড ভিক্টিম মেয়ের সাথে জীবন বাঁধতে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আভাসও শেষমেশ তাকে দূরে ঠেলে দিবে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে শ্রুতির। কেন তার জীবনটাই এমন হলো? তবে এটা ভেবে শ্রুতির ভালো লাগছে যে, আভাস হয়তো তাকে ভুলে মুভ অন করবে! যদিও শ্রুতির কষ্ট হবে এটা সহ্য করতে। তবে সে তো আর কম কিছু সহ্য করেনি! এটাও হজম করে নিবে। তবুও মনে মনে জানবে, দিনশেষে ভালো আছে তার ভালোবাসা।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৬

গাড়িতে বসে আভাস একদম চুপচাপ হয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে। একবারও শ্রুতির দিকে তাকাচ্ছে না। শ্রুতিও বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।
গাড়ি শ্রুতির বাড়ির সামনে থামার পর শ্রুতি গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলেই আভাস থমথমে গলায় বললো,
—আমি কি বলেছি তোমায় গাড়ি থেকে নামতে?
আভাসের প্রশ্ন শুনে শ্রুতি গাড়ির দরজা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সত্যিই আভাসকে কিছু না বলেই চলেই যাওয়াটা অভদ্রতা। শ্রুতি আভাসকে কিছু বলতে যাবে এমনসময় আভাস বলে উঠলো,
—কালকে থেকে রেগুলার ক্লাস এটেন্ড করবে। এতে যেন আমি কোনো গাফিলতি না দেখি!
শ্রুতি কিছু বললো না। কারণ সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সে আর ঐ ভার্সিটিতে যাবে না। কিন্তু সেটা তো আর আভাসকে বলা যাবে না। তাই মাথা নিচু করেই গাড়ির দরজা খুলতে লাগলো। সাথে সাথেই আভাস লক বাটন চেপে দেয়।

—আমার কথায় সম্মতি জানানোর আগ পর্যন্ত তুমি এখান থেকে বের হতে পারবে না। আগে কথা দাও যে, তুমি রেগুলার ভার্সিটিতে যাবে।
শ্রুতি বুঝে গেছে যে, তার হাতে এর বাইরে আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু ভার্সিটিতে গেলে যে তার আরো কষ্ট হবে! তবুও রাজি হতেই হবে।
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে বললো,
—যাবো।
আভাস কার-ডোর আনলক করে দিলো। শ্রুতি দরজা খুলে বের হতেই আভাস ওর হাত ধরে আটকে দিলো। শ্রুতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাথার দু’পাশে হাত রেখে দুই চোখের পাতায় আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। সাথে সাথে শ্রুতিকে ছেড়ে দিয়ে স্টেয়ারিং-এ হাত রেখে বললো,
—যাও এবার।
ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে, ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রুতি আভাসের দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৮