ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৮ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৮
Mahfuza Akter

জনমানবশূন্য নির্জন রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে আভাস। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। ডান হাতের কনুইয়ের খানিকটা নিচের দিকে ফোল্ড করা হাতায় বারবার চোখ ঘষছে সে। কেন বাস্তবতাটা এতো নির্মম হয়? শ্রুতির সাথেই কেন এমনটা ঘটতে গেল? কীভাবে সহ্য করেছে মেয়েটা এতো কিছু? ভাবতেই আভাসের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে!

বাসায় পৌঁছে কলিং বেল চাপতেই স্নেহা দরজা খুলে দিলো। খুলে দেখে আভাস দরজার পাশের একটা দেয়ালে একহাত রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নেহা দরজা খুলতেই আভাস মুখ তুলে তাকায়। স্নেহা আভাসের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,

—ভাইয়া, কী হয়েছে তোমার? চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?
আভাস থমথমে গলায় বললো,
—ভেতরে ঢুকতে দে আগে। এখানে দাড় করিয়েই রাখবি নাকি?
—না,না, এসো ভেতরে।
আভাস হেঁটে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। স্নেহা কিছুই বুঝতে পারছে না, তাই সেও আভাসের পেছন পেছন গেল।
—ভাইয়া, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমার সাথে যে মেয়েটাকে নিয়ে গেলে, সেটা কে?
আভাস বিছানায় বসে স্নেহার দিকে তাকিয়ে দেখলো স্নেহা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
—ঐটা শ্রুতি ছিল।
আভাসের কথা শুনে স্নেহা হতভম্ব হয়ে বললো,
—শ্রুতি!! ও বেঁচে আছে? কিন্তু কীভাবে?

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

আভাস স্নেহাকে সবকিছু খুলে বললো, কারণ স্নেহা ওর ছোট বোন হলেও স্নেহার সাথে সব কথা শেয়ার করে।
—এতোকিছু ঘটে গেছে মেয়েটার সাথে আর আমরা কিছু জানতেই পারলাম না। ওর বয়স তখন কতটুকুই বা ছিল! বড়জোর ষোলো হবে। আর এ বয়সেই এসবের শিকার!
স্নেহার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আভাস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

—ওর সাথেই কেন এমন হলো, বলতো! মেয়েটা তো জীবনে কম কষ্ট পায়নি! ছোট থাকতেই পিতৃহীন। বাবা নামক বটবৃক্ষটির ছায়া ছাড়া জীবনের পথচলা কতটা কঠিন সেটা আমি ভালোই বুঝি। তার ওপর এতো বড় ঝড় ওর ওপর দিয়ে বয়ে না গেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?
স্নেহা আভাসকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তবে তার মনে একটা বিষয় বারবার উঁকি-ঝুকি দিচ্ছে। ওর মনে পড়ছে, সেদিন আনহা যেই এসিড ভিক্টিম মেয়েটার কথা বলেছিল, সেটাই শ্রুতি।

শ্রুতি বাসায় ঢুকতেই শায়লা রুবাইয়াত ব্যস্ত স্বরে বললেন,
—এতো রাত হলো কেন তোর? কোনো সমস্যা হয়নি তো! আমি তো এখানে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম! কতোবার বলি ফোনটা সাথে নিয়ে যেতে? শুনিস না আমার কথা। এরপর থেকে বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে ফোনটা সাথে নিয়ে যাবি বলে দিলাম।
শ্রুতির এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাই ভাবলো আজ আর কথা না বাড়িয়ে কালকে সব খুশি বলবে তার মাকে।
—আচ্ছা, নিয়ে যাবো। এবার খুশি?
—হুম।

কোনো মতে শায়লা রুবাইয়াতকে কাটিয়ে শ্রুতি ঘরে চলে এলো। কিন্তু এখন তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। না চাইতেও হাত বারবার চোখ দুটোর ওপর চলে যাচ্ছে। এই প্রথম আভাস তাকে জড়িয়ে ধরেছিল আর এভাবে স্পর্শ করেছিলো। সে এখনো বুঝতে পারছে না, সামনের দিনগুলোতে কী হবে? আভাসের গতিবিধি দেখে কিছুই স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। আভাস আসলে চাইছেটা কী? ও বুঝতে পারছে না, ভার্সিটিতে গেলে আভাস ঠিক কি করবে?

আজ দুদিন পর শ্রুতি ভার্সিটিতে যাবে। শায়লা রুবাইয়াতকে সবকিছু বলার পর তিনি তো কিছুতেই শ্রুতিকে ভার্সিটিতে যেতে দিবে না। শ্রুতি তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে তারপর রাজি করিয়েছে। তবুও তিনি মুখ ভার করে রেখেছেন আর বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।
—মা, আর কেঁদো না তো! আমি বললাম না আমার কিছুই হবে না। এবার একটু হাসো না! প্লিজ।
শ্রুতির কথা শুনে তিনি একটু হেসে ওকে বিদায় দিলেন।

শ্রুতি ক্লাসে বসে চরম বিরক্ত হচ্ছে, একটানা এতক্ষণ ক্লাস করতে তার একদমই ভালো লাগছে না। কিন্তু আগে কখনো তো এমন হতো না! এদিকে আভাস ক্লাসে ঢুকে সামনে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। পেছনের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো শ্রুতি এসেছে। একবার তার দিকে তাকিয়েই আভাস ক্লাস স্টার্ট করলো। এমনভাবে ক্লাস নিচ্ছে যেন এখানে তার পরিচিত কেউই নেই। শ্রুতিও নিজের বিরক্তি সাইডে রেখে মাথা নিচু করে শুধু লেকচার নোট করেছে। একবারও আভাসের দিকে তাকায়নি।

ক্লাস শেষ হতেই আভাস বেরিয়ে চলে গেল। শ্রুতি ভেবেছিলো, তাকে হয়তো বলবে ক্লাস শেষে দেখা করে যেতে। কিন্তু আভাস তো তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে চলে গেল! তাহলে কি সেদিনের ভাবনা গুলোই সঠিক। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে? শ্রুতির মাথায় ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

শ্রুতি বাইরে বের হতেই সামনে স্নেহাকে দেখতে পেল। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে কাউকে খুজছে। শ্রুতিকে স্নেহা চিনতে না পারলেও শ্রুতি স্নেহাকে ঠিকই চিনেছে। কিন্তু এখন স্নেহার সামনে যেতে চায় না সে। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই স্নেহা পেছন থেকে ‘শ্রুতি বলে ডাক দেয়। স্নেহা শ্রুতিকেই খুঁজছিলো, কিন্তু পাচ্ছিলো। আভাসের ভাষ্যমতে শ্রুতির গেটআপ দেখে তাকে চিনতে পেরেছে স্নেহা।

—তুমি আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছো কেন? সেই কখন থেকে খুঁজছি তোমায় জানো?
শ্রুতি আমতা আমতা করে বললো,
—আসলে আমি ভেবেছি, তুমি অন্য কাউকে খুঁজছো।
স্নেহা শ্রুতির কথা শুনে পুরো অবাক হয়ে গেছে। শ্রুতি তো আগে এতো শান্ত-শিষ্ট আর ঠান্ডা মেজাজের ছিল না। সব সময় খালি তিড়িং বিড়িং করে লাফাতো, আর কথা বলে কানের মাথা খেয়ে ফেলতো সে। আর এখন এতো চেঞ্জ? অবশ্য চেঞ্জ হওয়াটাই স্বাভাবিক! ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল স্নেহা।
—অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো তুমি। আমার ভাইয়ের মিষ্টিপাখিটা আর আগের মতো নেই।
বলেই হাসলো স্নেহা। হেসেই বললো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৭

—ভাইয়া তোমায় তার সাথে দেখা করতে বলেছে। আমায় কল দিয়ে বললো তোমায় জানাতে।
শ্রুতি মনে মনে ভাবলো, জানতাম ওনার সাথে দেখা না করিয়ে আমায় ছাড়বেন না। শ্রুতি স্নেহার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে আভাসের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো।
শ্রুতি হাঁটছে আর ভাবছে, আভাস যদি আগের মতোই তার অনুভূতি গুলো নিয়ে বসে থাকে, তাহলে সে আজই তার হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। সে কখনো আভাসকে নিজের জীবনের সাথে জড়াবে না। তার নষ্ট হয়ে যাওয়া জীবনের সাথে আর কাউকেই জড়াবে না সে। আভাস যদি তাকে নিয়ে কিছু ভেবে থাকে তাহলে সেটা কখনোই সম্ভব নয়।
শ্রুতি দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দেখলো আভাস তার চেয়ারে আরাম করে বসে চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। শ্রুতি কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আভাস বললো,

—মে আই কাম ইন, স্যার – না বলে ভেতরে এসো। তোমার জন্য বসে আছি এতোক্ষণ।
শ্রুতি ভেতরে ঢুকতেই আভাস বললো,
—দরজার লকটা চেপে দাও। যদিও এখন কেউ আসবে না, তাও আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
আভাসের কথা শুনে শ্রুতি হতভম্ব হয়ে গেছে। দরজা লক করতে বলছে কেন? রিস্ক মানে? কিসের রিস্ক? শ্রুতি এসব ভাবনায় মশগুল হতেই আভাস তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিয়ে বললো,

—সময় নষ্ট করছো কেন? আমি এলে কী করতে পারি তা কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো। সেদিন গাড়ির ব্যাপারটা মনে নেই। এখন কিংবা একসেস কিছু করে ফেলবো!
শ্রুতি একটা শুকনো ঢোক গিলে দরজা তাড়াতাড়ি লক করে দিলো। শ্রুতি আভাসের দিকে ঘুরতেই দেখে আভাস তার দিকেই এগিয়ে আসছে। শ্রুতি বুঝতে পারছে না, তার এখন কী করা উচিত?

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৯