ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৯ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৯
Mahfuza Akter

—আপনি, আপনি আমার দিকে এভাবে এগুচ্ছেন কেন? কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন? আমার বাসায় যেতে হবে।
আভাস শ্রুতির কথা শুনলো নাকি শুনলো না, সেটা শ্রুতি বুঝতে পারছে না। সে শ্রুতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকিয়ে থাকার জন্য ডেকেছে নাকি? আর তাকিয়ে দেখছেটা কী? তার মুখ তো দেখা যাচ্ছে না! শ্রুতি এসব আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই দেখলো আভাসের কাঁপা কাঁপা হাত তার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে।
আভাস একহাত দিয়ে শ্রুতির মুখের ওপর থেকে নিকাব তুলে দিলো। হলুদ ফর্সা চেহারার বাঁ পাশের পোড়া অংশটা দেখে আভাসের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, চোখ ছলছল করছে। পাঁচ বছরে পোড়া দাগটা অনেকটাই কালচে হয়ে গেছে। আভাস নিজের ডান হাতের আঙুল দিয়ে সেখানে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শ্রুতি কেঁপে উঠে অবাক চোখে আভাসের দিকে তাকায়। এই পাঁচ বছরে এখন পর্যন্ত কেউ তার মুখের বাঁ পাশে হাত ছুঁইয়ে দেখেনি, এমনকি তার মা-ও না। তাহলে আভাস কেন স্পর্শ করছে? আভাসের চোখে তার জন্য একধরনের বেদনা দেখতে পাচ্ছে, যা আজ পর্যন্ত কারো চোখে দেখেনি। শ্রুতি এসব ভাবনায় মশগুল থেকেই আনমনে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—আভাস, আপনি কী করছেন?
শ্রুতির কথা শুনে আভাসের ভ্রু ঈষৎ কুঁচকে এলো। মুহূর্তেই সেই কুঁচকানো কপালে গভীর ভাঁজ দেখতে পেল শ্রুতি। এতোক্ষণ তার ডান হাতের আঙুলগুলো অনবরত শ্রুতির বাঁ গালের ওপর চললেও এখন সেগুলো থমকে গেছে। আভাস ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—কী বললে? আবার বলো!
শ্রুতি কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সে আবার কী বললো? কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—কী বললাম আবার?
আভাস উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—আমার নাম।
শ্রুতি চোখ বড়বড় করে আভাসের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, একটু আগে সে আনমনে আভাসের নাম বলে ফেলেছে! ভাবতেই নিজেকে গালাগাল করতে লাগলো।
—কী হলো? বলো।
—পারবো না।
—একটু আগে যে বললে?
—ভুলে, ভুলে বলে ফেলেছিলাম। মুখ ফঁসকে বেরিয়ে গেছে।
আভাস বিরক্ত হয়ে বললো,
—তাহলে নেক্সট টাইম থেকে যেন মুখ ফঁসকেই বের হয় সবসময়।
—মানে।
—এতো মানে বুঝতে হবে না। তোমার এখনো বয়স হয়নি!

শ্রুতি কতক্ষণ আভাসের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। কী বললো এটা? তার বয়স হয়নি? আজব তো! নিজে যেন সবজান্তা একজন মানুষ, বয়সের ঢেঁকি! এসব ভাবলেও আর মুখে বললো না।
আভাস শ্রুতির এমন চুপ করে দাড়িয়ে থাকা দেখে অনেকটা অবাক হলো। আগে তো বয়স তুলে কিছু বললে তেড়ে এসে বলতো, “কী বলতে চাও, হ্যা? আমি ছোট বাচ্চা, কিছু বুঝিনা? এহহহ, নিজে যেন সবজান্তা, বয়সের ঢেঁকি।” কিন্তু এবার বললো না কেন? তার তো সেই আগের চঞ্চল শ্রুতিকে চাই! এই শান্তশিষ্ট, গম্ভীর শ্রুতিকে তার একদম ভালো লাগে না।
আভাস নিজের দুহাত পকেটে গুঁজে বললো,
—আই থিংক, এখনি তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু করে দেওয়া উচিত। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর দেরি করাটা ঠিক হবে না।
শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে বললো,
—কিসের ট্রিটমেন্ট?
—তোমার মুখের সার্জারির কথা বলছি, যেটাকে প্লাস্টিক সার্জারি বলে। আমি যতো দ্রুত পারি, সব ব্যবস্থা করে ফেলবো।
শ্রুতি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—লাগবে না আমার কোনো সার্জারি! আমি যেমন আছি, আমাকে তেমনই থাকতে দিন।
আভাস অবাক হয়ে বললো,

—কেন? তোমার কি ইচ্ছে করে না সবার মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে? কতদিন এভাবে মুখ লুকিয়ে থাকবে?
—সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার কখন কী করা দরকার সেটা আমি বেশ ভালো করেই জানি ও বুঝি। আর আপনি হঠাৎ এতো আমার মুখ নিয়ে পড়লেন কেন? আপনার অনেক সমস্যা আমার মুখ নিয়ে, তাই না? আপনি হয়তো ভাবছেন, আমার মতো একটা এসিড ভিক্টিম মেয়েকে কীভাবে লোকসমাজে প্রেজেন্ট করবেন? কীভাবে নিজের বউ বলে স্বীকৃতি দিবেন? কিন্তু আমি তো আপনাকে আমায় বিয়ে করতে বলিনি! আপনি কেন আমায় নিয়ে এতো ওভার ভাবছেন?
শ্রুতির কথা শুনে আভাসের মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তার রাগের সরলরেখা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কিন্তু নিজেকে ওপর থেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো,

—লিসেন, তুমি যেমনটা ভাবছো, আমি কখনো এসব মাথায়ও আনিনি। তোমার রূপ, সৌন্দর্য, যোগ্যতা এসব কিছুই দেখে তোমায় ভালোবাসিনি। আর তোমায় কীভাবে নিজের ওয়াইফ বলে প্রেজেন্ট করবো, সেটা নিয়েও আমার কোনো চিন্তা নেই। তোমার মুখ পোড়া হোক আর যাই হোক, ইভেন তোমার যদি দুটো চোখ, দুটো হাত, দুটো পা না-ও থাকে, তবুও আমি তোমাকেই ভালোবাসি। জাস্ট তোমার নিজের জন্য বলেছি ট্রিটমেন্টের কথা। বুঝেছো?
শ্রুতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

—ওহ, রিয়েলি! এজন্যই সেদিন আমার ফেস দেখার সাথে সাথে জোরে চিৎকার দিয়েছিলেন, তাই না? আমার জানা মতে তো মানুষ ভয়ে জোরে চিৎকার দেয়।
আভাস চোখ বন্ধ করে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—তুমি কখনো সেটা বুঝবে না। নিজের প্রিয় মানুষটাকে পাঁচ বছর পর হঠাৎ খুঁজে পেয়ে তাকে যদি কেউ এই অবস্থায় দেখে, তাহলে তার মনের অবস্থাটা তার থেকে ভালো আর কেউ বুঝবে না। একবার আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখো। সহ্য করতে পারো কিনা!
শ্রুতি আভাসের কথা শুনে একদম নির্বাক হয়ে গেল। সে এখন বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু তবুও তাকে শক্ত হতে হবে। আভাসের কথায় একদম রাজি হওয়া যাবে না। তার তো আভাসের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো যোগ্যতাই নেই!
আভাস শ্রুতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। এই মেয়েটা কেন এতো ত্যাড়ামি করছে, সেটা আভাস ঠিকই বুঝতে পারছে। সে নিজেকে আভাসের সামনে ইনফেরিয়র ভাবে। আভাস চোয়াল শক্ত করে বললো,

—জানি এখন তুমি বলার মতো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছো না। তোমায় কিছু বলতেও হবে না। জাস্ট আমি যেটা বলি, সেটা শুনলেই চলবে। তোমার চেহারা নিয়ে আমার কিছু যায়-আসে না, গট ইট? আমি যেমন তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে পারিনা, তোমাকেও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে দেব না। আই মিন, ভাবার চান্সই পাবে না তুমি। খুব তাড়াতাড়ি মিস অদ্রিতা রুবাইয়াত থেকে মিসেস আরহাম খান আভাস হচ্ছো তুমি। সো, গেট রেডি।
শেষোক্ত বাক্য দুটি শুনে শ্রুতি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—আমি কোনোদিন আপনাকে বিয়ে করবো না। আপনি মুখে না বললেও আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি যে, আপনি আমায় দয়া করে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। এতোটুকু বোঝার মতো এবিলিটি আমার আছে। আপনার আমার অবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে, তাই না? আর এজন্যই……………..

কথা শেষ করার আগেই শ্রুতির ডান গালে একটা চড় পড়লো। শ্রুতি হঠাৎ চড় খেয়ে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেছে। গালটাও চরমভাবে জ্বলছে যেন কেউ লাল মরিচ ঘষে দিয়েছে। গালে হাত রেখে মাথা ফিরিয়ে আভাসের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো সে। আভাস তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আভাসের ঠোঁটটা অনবরত কাঁপতে থাকায় বোঝা যাচ্ছে যে, সে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে তার। দু পা পিছিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। ধরা গলায় বলে উঠলো,

—আমি তোমাকে দয়া দেখাচ্ছি, আমার তোমার প্রতি করুণা হচ্ছে, রাইট? আসলে কী বলো তো? ভুলটা আমারই। সেই কখন থেকে কতো কী বলে তোমাকে বোঝালাম, আর তুমি বুঝছোই না। আরে এর থেকে তো একটা কলাগাছকে বোঝালেও কাজে দিতো। আসলে আমিই বারবার তোমার দ্বারে ফিরে যাই, আর তুমি বারবারই আমায় ফিরিয়ে দিচ্ছো। তোমার প্রতি আমার ফিলিংসটাকে কী অবলীলায়-ই না করুণা নাম দিয়ে দিলে! সাত সাতটা বছর ধরে তোমায় ভালোবেসেছি। একদম নিঃস্বার্থভাবে, তোমার কাছে কোনো কিছু পাবো সেই আশা কখনো আমার মনে জাগেনি। জাগবেই বা কীভাবে? তুমিই তো ছিলে না! তবুও ভালোবেসেছি। কিন্তু কী পেয়েছি বিনিময়ে শুধু কষ্ট ছাড়া? প্রথম দু বছর তো তোমায় কিছু বলতেও পারিনি! এরপর তুমি ছেড়ে চলে গেলে। কী অবস্থা হয়েছিল আমার তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার সাথে দেখা হওয়ার একবছর আগে আমার বাবা মারা যায়। বাবাকে হারানোর পর তোমাকে পেয়ে ভেবেছিলাম হয়তো একজন এসেছে আমার জীবনে যাকে ঘিরে আমি বাচতে পারবো। তোমার মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছিল আমার সবকিছু। কিন্তু তুমি আমায় একা করে দিয়ে চলে গেলে।

এখন তোমায় আবার যখন ফিরে পেলাম, তখন ভেবেছি আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবো। কিন্তু তুমি? তুমি আবারও একই ভাবে আমার সাথে খেলছো। তারপরও কীভাবে আমার মন এতো বেহায়া হয়ে উঠছে, বুঝি না? সে শুধু বারবার তোমাকেই চায়। কেন এমনটা হচ্ছে আমার সাথে? এজন্যই কাউকে এভাবে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে নেই। নয়তো সে এমনভাবে পোড়াবে যে, দিনশেষে সবটা ভস্ম করে, নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যায়। সেই আগুনে তো সাতটা বছর ধরেই পুড়ছি! কিন্তু আমার কষ্ট কেন শুধু বাড়ছে? তুমি নিজেকে সর্বহারা, নিঃস্ব মনে করো, তাই না? একবার আমার দিকটা ভেবে দেখো তো! আমার কষ্টের সাথে নিজের কষ্টগুলো তুলনা করে দেখো তো কারটা বেশি? তোমায় তো কেউ একজন এতো এতো ভালোবাসে, কিন্তু আমাকে তো কেউ-ই বাসে না! তাহলে কী আমি নিঃস্ব নই? আমার কষ্টটা কি বেশি নয়? আর এই কষ্টের একমাত্র কারণ হলে তুমি। শুধু তোমায় ভালোবাসি বলেই আমি এতো কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু আফসোস! তুমি বুঝলে না।

শ্রুতি আভাসের কথা শুনে নির্বাক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করছে তার। বারবার শুধু একটা কথাই কানে বাজছে, ‘কিন্তু আফসোস! তুমি বুঝলে না’। কী ভয়াবহ ছিল শব্দ গুলো! সত্যিই তো আভাস তার জন্যই কষ্ট পেয়েছে। আবার সে-ই বা কীভাবে এই ব্যক্তিটাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে?

—স্যার, আপনি এতো রেগে আছেন কেন আমার ওপর?
স্নেহার কথা শুনে তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—তুমি কাল সারা রাত আমায় ঘুমাতে দাও নি। তোমার ওপর রেগে থাকাটা কি স্বাভাবিক নয়? তোমায় আজ আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিবো ভেবেছো?
স্নেহা ভীত দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো। ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
—এবারের মতো ছেড়ে দিন, প্লিজ। আর কখনো রাতে আপনাকে কল দিয়ে বিরক্ত করবো না।
—বিরক্ত, তাই না? এটাকে বিরক্ত করা বলে? তুমি ইন্টেনশনালি আমাকে ঘুমাতে দাও নি। এজন্য বারবার কল দিয়েছো। আবার ফোন বন্ধ করার পর মা-কে ফোন দিয়ে নালিশ দিয়েছো। জানো, তোমার জন্য আমায় কতো কথা শুনতে হয়েছে?

—-এক রাত না ঘুমালে কী হয়, স্যার?
—তাহলে তুমিও একদিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। বুঝে যাবে কী হয়?
—আমার জন্য ভাইয়া বাইরে ওয়েট করছে।
—তুমি মিথ্যা বলো জানতাম। কিন্তু এমন ডাহা মিথ্যা বলো, জানতাম না।
স্নেহা আমতা আমতা করে বললো,
—সত্যি বলছি, স্যার।
—জাস্ট শাট আপ। আভাস আমায় নিজে ফোন দিয়ে তোমায় বাসায় পৌঁছে দিতে বলেছে।
তন্ময়ের কথা শুনে স্নেহা মনে মনে বললো,
—স্নেহা রে, আজ তো তু গায়া! এই ব্যাটার মতো খাটাশ আমি দ্বিতীয়টা দেখিনি। বিয়ের পরেও না জানি আমার বাচ্চা-কাচ্চার সামনে আমায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে!

আভাস শ্রুতির কোনো উত্তর না পেয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
—কী হলো? এভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার তো বাসায় যেতে হবে! যাও।
শ্রুতি আভাসের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর চোখ, মুখ, নাক, কান লাল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে ভয়ংকর জিনিস গড়িয়ে পড়ছে। চোখের পানিতে দলাপাকিয়ে যাওয়া ঘন পল্লবে ঘেরা চোখের সাদা অংশটা অস্বাভাবিক লাল, যেন ছুঁলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে। শ্রুতি সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে আভাসের কান্না দেখে। তার একটা কথায় কতোটা কষ্ট পেয়েছে এই মানুষটা!
আভাস শার্টের হাতা দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে বললো,

—তোমার হাতে এতো সময় থাকলে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চলে যাই।
আভাস চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শ্রুতি বলে উঠলো,
—আমার কথা আছে আপনার সাথে।
—কিন্তু আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই।
—কাঁদছেন কেন আপনি?
—আমি কাঁদলে তোমার কী?
—আমার কষ্ট হয়।
—কেন?
—আপনাকে ভালোবাসি, তাই।
আভাস অবাক হয়ে শ্রুতির দিকে তাকালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—কী বললে? আরেকবার বলো!
শ্রুতি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,

—ভালোবাসি আপনাকে, কিন্তু বলতে চাইনি। কারণ আমার সাথে আপনি কখনো সুখী হবেন না। অনেকে অনেক কথা শোনাবে আপনাকে। শান্তি পাবেন না আপনি কখনো। কেন বুঝতে পারছেন না? আপনি অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন, আমার মতো কাউকে না। প্লিজ, আপনি আমায় নিয়ে ভাবা বাদ দিন, ভুলে যান আমার কথা।
আভাস শ্রুতির মুখ উঠিয়ে দু গালে হাত রেখে বললো,
—ভুলে যাবো? এটা এতো সহজে কীভাবে বললে তুমি? আমার তো এটা ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে! তোমার সাথে কী ঘটেছে না ঘটেছে, আই ডোন্ট কেয়ার। ঐটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আজ আমি যদি তোমার মতো অসহায় অবস্থায় পড়তাম, তাহলে? তখন কি আমার হাত ছেড়ে দিতে? স্বার্থপরের মতো দূরে চলে যেতে?
শ্রুতি ডানে বামে মাথা নাড়ালো। বললো,
—আমি ভাবতে পারিনি আপনি এতোটাও ভালোবাসেন আমায়! বাস্তবতা তো এটাই যে, আমার মতো মেয়েকে কেউ কখনো জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবে না, ভালোবাসুক আর নাই বাসুক। সবটা জানার পর কেউ মেনে নেবে না আমায়। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আপনি সবকিছু জেনেও আমায় মেনে নিতে চাইছেন দেখে আমি ভেবেছিলাম, হয়তোবা আপনার দয়া হচ্ছে আমাকে দেখে।

আভাস শ্রুতির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
—আর কখনো এসব করা মাথায়ও আনবে না। ভালোবাসার মানুষের প্রতি কখনো দয়া-করুণা কাজ করে না, বরং মায়া কাজ করে। তোমার এই অবস্থা দেখে কি তোমার মা তোমাকে ফেলে দিয়েছে? দেয়নি। কারণ তিনি তোমায় নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, তাই তোমার প্রতি তার একটা মায়া কাজ করে। আমার ভালোবাসাটাও তেমন, যেখানে একটুও খাঁদ নেই। তাই দয়া, করুণা এসব বলে তার অপমান করবে না।
—সরি।
আভাস শ্রুতিকে ছেড়ে একটু দূরে সরে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—কেন?
শ্রুতি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—কষ্ট দিয়েছি আমায় ধলা বিড়ালটাকে।
আভাস ডানহাত বুকের বাঁ পাশে রেখে বললো,

—কষ্ট তো এইখানটায় দিয়েছো! জানো, এই জায়গাটা মরুভূমির মতো কতো খাঁ খাঁ করে? এখানের আগুন নেভানোর জন্য পানি প্রয়োজন, আবার বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার অক্সিজেনের। কিন্তু দুটো জিনিসের অভাব পূরণকারী ব্যক্তিটা আমার থেকে এখনো একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কেমন বিচার?
আভাসের শেষের কথাটা শুনে শ্রুতি হেসে দিলো। কাছে গিয়ে আভাসের বুকে মাথা রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। আভাসও ওকে দুহাতে আগলে নিলো।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৮

—Mujhe ab koyi gham rula na sakegaa,
Ke tu hain bahana meri haasi ka.
Main jis din bhula duu tera pyar dil see,
Woo din Aakhri hoo meri jindegi ka.
Na thehrega koyi Aakho mein meri,
Hoo na sakunga main aur kisi ka.

আভাসের গান শুনে শ্রুতির চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। মুখ উঁচিয়ে আভাসের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সে।
—এমন করে তাকিয়ে আছো কেন, হুম?
—কী গাইলেন এটা? এই গানটা কেন গাইলেন?
—মনের কথাটা গান দিয়ে প্রকাশ করলাম আর কি! কেন পছন্দ হয়নি?
—আপনার তো প্রফেসর না হয়ে সিঙ্গার হওয়া উচিত ছিল!
—সমস্যা নেই। তুমি বললে হয়ে যাবো।
শ্রুতি হেসে দিয়ে বললো,
—আপনার ভালোবাসাটা পাগলামির মতো! লোকে দেখলে পাগল বলবে আপনাকে।
—কাউকে দেখালে তো দেখবে! শুধু সেই দেখবে, যাকে ভালোবাসি। তার কাছে পাগলামি মনে হলে পাগলামি-ই। যাই ঘটে যাক না কেন আমার যে সব অবস্থাতে শুধু তাকেই চাই! #ভুলতে_পারিনি_তাকে আর কখনো পারবোও না।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১০