ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১০ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১০
Mahfuza Akter

সময় তার নিজের গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আভাসের মনের অতৃপ্ত বাসনাগুলো পূরণ একদমই হচ্ছে না। রোজ রোজ শ্রুতিকে দেখা, কথা বলা সবই চলছে ঠিক ঠাক মতো। কিন্তু সবটাই লোকচক্ষুর আড়ালে করতে হচ্ছে। স্নেহা, তন্ময়, আরাফ আহসান এবং শায়লা রুবাইয়াত ছাড়া এব্যাপারে আর কেউ কিছুই জানে না। আভাস তো এসব লুকোচুরির মাধ্যমে নিজের প্রেয়সীকে পেতে চায়নি! সবক্ষেত্রেই কোনো না কোনো বাঁধা বেশ দারুণভাবে অনুভূত হয় আভাসের। কিন্তু শতসহস্র বার শ্রুতিকে বুঝিয়েও ফলাফল শুন্য। শ্রুতির কাটকাট জবাব, এখন সে কোনো মতেই বিয়ে করছে না। অন্তত সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনালটা সে মনযোগ সহকারে দিতে চায়। যেহেতু আর একমাস পরেই এক্স্যাম, তাই রেজাল্টের ওপর ইফেক্ট পড়তে পারে। আভাসও শ্রুতির পড়াশোনার ব্যাপারে সেন্সেটিভ মানুষ, তাই বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে।

এদিকে আরিহা খানের ‘বিয়ে করতে হবে’ নামক অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলেছে। আরো দুই মাস সবকিছু সহ্য করে হজম করা ছাড়া আভাসের আর কোনো উপায় নেই। ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। ভাবতে ভাবতেই ফোনের ওপর আঙুল চালিয়ে কল লাগালো সে। রিসিভ হতেই বললো
—কোনো খেয়াল আছে আপনার, নাকি দুনিয়াদারি ভুলে বইয়ের ভেতর ঢুকে গেছেন।
শ্রুতি বইয়ের ভেতর কলম ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বললো,
—বইয়ের ভেতর ঢুকিনি, বাইরেই আছি। লজিক নামক সাবজেক্টটার সাথে যুদ্ধ করছিলাম। আশায়ও ছিলাম যে, কেউ একজন কখন স্মরণ করবে আমায়?
—কখন থেকো স্মরণ করছিলাম, সেটা না হয় না-ই বলি! এখন বলো, আমার কি আসতে হবে তোমায় হেল্প করার জন্য?
—আসতে হবে না, আমি পারবো।
আভাস অপ্রসন্ন গলায় বললো,
—জানি, আমায় দেখার ইচ্ছে নেই তোমার! কতো স্বপ্ন দেখছি আমি দিন-রাত এক করে! যদি তুমি একটু বুঝতে আমায়!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

আভাসের হতাশ গলা শুনে শ্রুতি টেবিলে কনুই বসিয়ে গালে হাত রেখে বললো,
—আচ্ছা, বলুন। আমিও একটু বুঝতে চাই আপনাকে।
আভাস এবার একটু নড়েচড়ে বসে বললো,
—আজকের আকাশ দেখেছো? কতো বড় থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে! আই সোয়ার, ভবিষ্যতে যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, একটা পূর্ণিমা রাতও তোমার সাথে জ্যোৎস্না বিলাস না করে কাটাবো না। আমাদের একটা ছোট্ট ভূবণ থাকবে, যেখানে সবটা তোমার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেবো। কেন জানো? আমার বিশ্বাস আসে তোমার ওপর। তোমার সুখ, আনন্দ, খুশি গুলো তোমার কাছেই রেখো; কিন্তু দুঃখ গুলো আমার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। সবার সামনে প্রকাশ্যে কখনো আমার কাছ থেকে কেয়ারিং পাবে না, কারণ আমি আমার অনুভূতিটা কারো সামনে প্রকাশ করবো না। শুধু তুমি জানবে, দেখবে আর সহ্য করবে আমার পাগলামি গুলো। তবে দিনশেষে সকল ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আমিই তোমায় বলবো, ‘ভালোবাসি’। আমার ইচ্ছার সাথে তুমি তাল না-ই বা মেলালে, আমার রঙে রঙ্গিন না-ই বা হলে, তবুও মনে মনে তো জানবো যে, মানুষটা একান্তই আমার, শুধু মাত্র আমার অধিকার আছে তাকে ভালোবাসার।
শ্রুতি হেসে দিয়ে বললো,

—আমি এতোটাও প্রেমিক পুরুষ! আমি ভাবতেই পারছি না! এতো কিছু ভেবে রেখেছেন বুঝলাম। কিন্তু আপনার আর আমার মাঝে যদি কোনো বাঁধা আসে, তখন কী করবেন?
আভাসের উৎফুল্ল চেহারাটা মুহূর্তেই বিমর্ষ হয়ে গেল। গলায় কাঠিন্য বজায় রেখে বললো,
—একবার না পেয়ে হারিয়েছি,তাই সহ্য করতে পেরেছিলাম। কিন্তু এবার পেয়েও হারালে কতোটুকু সহ্য হবে জানি না। তবে এটা বলতে পারি যে, একবার যদি তোমার হাতটা নিজের মুঠোয় ধরতে পারি, আল্লাহ ছাড়া কোন শক্তি আমাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমিও দেখবো।
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো। এদিকে শ্রুতি হতভম্ব হয়ে বসে আছে। এভাবে রেগে যাওয়ার কী আছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। বিরবির করে বললো,
—এ তো দেখি সামান্য কথাতেই আগুনের মতো হয়ে গেছে! ভাবতেও পারিনি এতোটাও কনজার্ভেটিভ চিন্তা ধারা এই ধলা বিড়ালের!

আভাসের মেজাজটা বেশ ভালো ভাবেই বিগড়ে গেছে। এসব অলক্ষুণে কথা-বার্তার কোনোই মানে হয় না। হঠাৎ আবার ফোন বেজে ওঠায় আভাস নাম না দেখেই শ্রুতি ভেবে রিসিভ করে বললো,
—আবার কল দিলে কেন? ওসব আজেবাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। তোমার কি এসব উল্টাপাল্টা থট ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না?
—এসব কি বলছিস তুই, আভাস? তোর মাথা কি ঠিক আছে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে?
গুরুগম্ভীর তেজদীপ্ত নারীকন্ঠ শুনে আভাস বুঝে গেছে এটা কে। হালকা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
—না, তেমন কিছু না। কেন ফোন দিলে সেটা বলো।
আরিহা খান হুকুমের স্বরে বললেন,
—এই সপ্তাহের মধ্যে তুই ঢাকা ব্যাক কর। আমি নাতাশার পরিবারকে পাকা কথা দিয়ে ফেলেছি। এসব নিয়ে গড়িমসি করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।

আভাসের রাগের ওপর ঘি ঢালার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়াট্র মতো ক্যাপেবলও। সো, আই ওয়ার্ন ইউ, মা। আই ওয়ার্ন ইউ। ডোন্ট ডেয়ার টু কল মি এগেইন। দুই মাস পর ঢাকা ফিরছি আমি। এর মধ্যে তোমার একটা কলও যেন আমার ফোনে না আসে।
আভাসে তিরিক্ষি মেজাজের কথা শুনে আরিহা খান বেশ অবাক হলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। কারণ আভাস তার উত্তরের আশা না করেই ফোন কেটে দিয়েছে।

—স্যার, একটা কোয়েশ্চন বুঝতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। যদি একটু হেল্প করতেন!
তন্ময় ফোন কানে গুঁজে বুকশেলফ থেকে বই খুঁজতে খুঁজতে বললো,
—কী কোয়শ্চন?
—স্যার, একটা ছেলে একটা মেয়েকে দ্বিতীয় বার দেখার পর একটু এগিয়ে গিয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর মানে কী?
তন্ময় দু’সেকেণ্ড ভেবে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—এসব ননসেন্স টাইপের ফালতু প্রশ্ন করার জন্য আমায় ফোন দিয়েছো?
স্নেহা মুখ চেপে হেসে বললো,
—আচ্ছা, আমার না একটা গভীর প্রশ্ন আছে?
—আরেকটা আজেবাজে কথা বললে আমি যে কী করবো তুমি ভাবতেও পারবে না!
স্নেহা একটু দমে গিয়ে বললো,
—আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখছি।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৯

স্নেহার হঠাৎ এরকম আচরণে তন্ময় খানিকটা অবাক হলো। স্নেহা তো কখনো এভাবে বলেনি? আচ্ছা, স্নেহা কি রাগ করলো? আবার কষ্ট পেলো না তো!
অন্যদিকে স্নেহা ফোনের দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে বেশ ভালো করেই জানে যে, স্নেহার আকস্মিক শান্ত আচরণ তন্ময়কে ভাবাচ্ছে। তাই সে কল করবেই।
তন্ময় সব ভাবনা চিন্তাকে সাইডে রেখে নিজের ঘরের বেলকনিতে গিয়ে স্নেহাকে ফোন দিলো।
—কী হয়েছে, স্নেহময়ী? তুমি আজ হঠাৎ এতো শান্ত ভাবে কথা বলে ফোন কেটে দিলে যে?
স্নেহা তন্ময়ের সম্বোধন শুনে কতক্ষণ হা হয়ে রইলো। অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো
—স্নেহময়ী? হু ইজ দিস স্নেহময়ী, স্যার?
তন্ময় হালকা হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

—আছে কেউ একজন! আমিও তাকে প্রথম বার দেখার পর এগিয়ে গিয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো এখনো বাচ্চা! তার সাথে রোমান্টিক কোনো কথাই বলতে পারিনা আমি।
স্নেহার এই কথাটা অনেক গায়ে লাগলো। তাকে বাচ্চা বললো? কতো বড় অপমান? কপাল কুঁচকে বললো,
—আপনি তো অনেক লুচু দেখছি! বাচ্চা মেয়েদের সাথে রোমান্টিক কথা বলতে চান!
তন্ময় এমন প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলেও সেটা চেপে গেল। আপাততঃ মুড নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

—আজকের চাঁদটা কতো সুন্দর, দেখেছো?
স্নেহা মুখ বাকিয়ে বললো,
—না। আমি সিঙ্গেল মানুষ, ভাই!
তন্ময় সিঙ্গেল আর ভাই ডাক শুনে কতক্ষণ দাঁত দাঁতে চিবিয়ে রাগটা হজম করতে চাইলো। কিন্তু সে পারছে না।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১১