ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১১ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১১
Mahfuza Akter

রাতটা প্রচন্ড নিরব। চারদিকে থমথমে নিস্তব্ধ পরিবেশ। সময়টা মধ্যরাত হওয়ায় নিস্তব্ধতা আরও ব্যাপকভাবে ঘনীভূত হচ্ছে। হঠাৎ নিরবতার প্রাচীর ভেদ করে বিকট চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসলো শ্রুতি। জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো চারপাশে অন্ধকার ছেয়ে আছে। আবছা আলোয় সবকিছু একটু-আধটু দেখা গেলেও এখন সেসবে স্পষ্ট দৃষ্টিনিক্ষেপের পরিস্থিতিতে নেই শ্রুতি। ভয়ে শ্বাস আটকে আসছে তার। সারা শরীর কাঁপছে ও ঘামছে।

আকস্মিক তীব্র চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ব্যাকুল ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে শায়লা রুবাইয়াত। বারবার মেয়েকে দরজা খুলে দিতে বলছেন। কিন্তু শ্রুতির কোনো সারা-শব্দ পাচ্ছেন না। তিনি দ্রুত ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেন। আলো জ্বালিয়ে শ্রুতির কাছে গিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললেন,
—কী হয়েছে, মা? এভাবে চিৎকার করলি কেন? এমন করছিস কেন? বল আমাকে। কী হলো?
শ্রুতি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো,
—আমাকে বাঁচাও, মা। আমাকে বাঁচাও। ঐ লোকটা আমার কাছে এভাবে আসছে কেন? আমার সব শেষ করে দিবে, মা!

শায়লা রুবাইয়াত মেয়ের কথা শুনে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে এসেছে বলেই কি তার মেয়েটা এতো অসহায়? যারা ওর এতোবড় ক্ষতি করে দিলো, তারা তো কোনো শাস্তি পেল না! তাদরকে তো সমাজ কোনো প্রকার তিরস্কারও করলো না! তাহলে তার মেয়েকে কেন এভাবে কষ্ট পেতে হচ্ছে? কেন তার জীবনের বেদনাবিধুর দূর্ঘটনাটা বারবার কল্পনায় হানা দেয়?

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

তিনি শ্রুতিকে অনেকক্ষণ ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শ্রুতি বারবার শুধু একই কথা বলে চলেছে। তার ব্রেনে এখন তার বর্তমান অবস্থান নয়, বরং পাঁচ বছর আগের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘুরপাক খাচ্ছে। শায়লা রুবাইয়াত বুঝে গেছেন যে, এখন আর কথায় কাজ হবে না। তিনি বেডবক্স থেকে একটা ইনজেকশন বের করে শ্রুতির হাতে পুশ করে দিলেন। কিছুক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচি করে হুট করেই বন্ধ চোখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। শায়লা রুবাইয়াত কিছুক্ষণ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

পাঁচ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে শ্রুতি। ঘুমের মধ্যে অকস্মাৎ সেই দূর্ঘটনাটা স্বপ্ন আকারে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার। সেজন্য চিৎকার, কান্না, প্রলাপ একসাথে শেখ করে সে। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে তিনি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিতে বলেন। এর বাইরে কোনো উপায় আপাতত নেই।
দুপুরের দিকে আভাস শ্রুতির নাম্বারে একের পর এক কল দিয়েই চলেছে। কিন্তু শ্রুতির কোনো রেসপন্স পাচ্ছে না। এদিকে শ্রুতি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। তার হাতের কাছে থাকে ফোনটা কয়েক সেকেলে পরপরই ভাইব্রেট হচ্ছে, কিন্তু সে কিছুই টের পাচ্ছে না।

আভাস এবার বেশ ভালোই বিরক্ত বোধ করছে। আভাস আজই শায়লা রুবাইয়াতের সাথে বিয়ে নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো। যেহেতু শ্রুতির পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে এক সপ্তাহ আগেই, তাই এখন আর দেরি করতে চাইছে না সে। আরো কিছুক্ষণ যোগাযোগের চেষ্টা করার পর আভাসের বিরক্তি এখন চিন্তায় রূপ নিয়েছে। শ্রতি তো সব সময় এক কলেই ফোন রিসিভ করে! আজ কোনো বিপদ ঘটলো না তো? এসব ভেবেই আভাস শ্রুতির বাড়ির দিকে রওনা দিলো। তার মাথায় এটাই ঘুরছে যে, শ্রুতির কোনো বিপদ হতে পারে না। এখন ওদের বাসায় গিয়ে ওকে ফোন না ধরার জন্য আচ্ছা মতো বকে দিবে, পাশাপাশি শ্রুতির মায়ের সাথেও কথা বলে এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলবে। গাড়ির স্টেয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে এসব কথাই ভেবে চলেছে আভাস।

লাঠিতে ঠকঠক আওয়াজ তুলে কেউ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করছে। শায়লা রুবাইয়াত রান্নাঘরে মেয়ের জন্য খাবার সাজাচ্ছেন। অনেক বেলা হয়ে গেছে, এখন শ্রুতিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাওয়াবেন তিনি। খাবারের ট্রে সাজিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হতেই উঠানে দাড়ানো ব্যক্তিটাকে দেখে পুলকিত হয়ে বললেন,
—মিনহা, তুমি কখন এলে? বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো যে! তুমি কি পর নাকি যে আমাদের আশায় দাঁড়িয়ে আছো?
মিনহা লাঠির ওপর থেকে নিজের ভর সরিয়ে মাথার ঘোমটাটা আরো সামনে টানতে টানতে বললো,
—তোরাও পারিস বটে! আমি তো সবে মাত্র এলাম! তা মেয়েটা কোথায়? দেখছি না যে!

শায়লা রুবাইয়াত মিনহাকে নিয়ে গিয়ে শ্রুতির ঘরে বসালেন। চোখ-মুখ কালো করে গতরাতের ঘটনা সব খুলে বললেন। সব শোনার পর শ্রুতির দিকে কিছুক্ষণ মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিনহা। ভাবগাম্ভীর্যের সাথে বললেন,
—চাইলে সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে ঠিক করে দেওয়া কোনো ব্যাপার না আমার কাছে। কিন্তু সেটা তোর মেয়েটার জন্য একদমই ভালো হবে না। আমি চাই শ্রুতি নিজেকে শক্ত করুক। আর শক্ত হওয়ার জন্য সহ্য করতে হয়। ও যতো সহ্য করবে, ততই ওর সহ্যশক্তি বাড়বে। তখন কোনো কষ্টই আর ওর কাছে কষ্ট মনে হবে না।
শায়লা রুবাইয়াত ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,

—আমার যে সহ্য হয় না ওর কষ্ট! আমার মেয়েটা জীবনে একটুও সুখ পেল না। এই ক্ষুদ্র জীবনে কতো বড় বড় ধাক্কা খেয়েছে সে!
মিনহা কিছু বলতে যাবে, তখনই মেইনগেটে কারো কড়া নাড়ার শব্দ এলো। শায়লা রুবাইয়াত বললো,
—তুমি একটু ওকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাইয়ে দাও। আমি দেখি কে এলো?
শায়লা রুবাইয়াতের প্রস্থানের সাথে সাথে মিনহা শ্রুতিকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। শ্রুতি চোখ পিটপিট করে খুলে সামনে মিনহাকে দেখে এক ঝটকায় উঠে বসলো। মিনহাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—তুমি? তুমি কখন এলে? আমি তোমাকে কতো মিস করছিলাম জানো? এতোদিন পর মনে পড়েছে আমার কথা?
মিনহা শ্রুতির কথা শুনে বললেন,

—আমি কি আর যখন ইচ্ছা, তখন আসতে পারি রে পাগলি? তবে আমারো যে তোকে ছাড়া একটুও ভালো লাগে না!
শ্রুতি অভিমানী সুরে বললো,
—এজন্যই এতো দিন পর এলে? এর মাঝে একটুও সময় হয়নি তোমার আমার জন্য?
মিনহা শ্রুতির মুখের সামনে খাবার ধরে বললো,
—হয়েছে আর অভিনয় করতে হবে না। এখন খেয়ে নে। কতো বেলা হয়ে গেছে দেখেছিস?
এদেশে শায়লা রুবাইয়াত উঠান পেরিয়ে মেইন গেটের সামনে গিয়ে দেখলেন আভাস দাঁড়িয়ে আছে।
—আন্টি কেমন আছেন? অনেক বছর পর দেখা হলো!
শায়লা রুবাইয়াত মলিন হেসে বললো,
—হ্যাঁ, এসো ভেতরে।
—আন্টি, শ্রুতি ঠিক আছে তো!
—ঠিক আছে। কিন্তু একটু অসুস্থ আর কি! তুমি চলো আমার সাথে।

আভাস শ্রুতির অসুস্থতার কথা শুনে দ্রুত পা চালিয়ে শায়লা রুবাইয়াতের পিছু পিছু গেল। শ্রুতির ঘরে গিয়ে দেখলো, সে তার পাশে বসা একজনের সাথে হাসতে হাসতে কথা বলছে আর খাচ্ছে। আভাস সব খেয়াল ও হুশ-জ্ঞান ছেড়ে শ্রুতির গালে, কপালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
—তুমি নাকি অসুস্থ? কী হয়েছে তোমার? এতো বার ফোন দিলাম ধরলে না কেন?
শ্রুতি আভাসের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। এভাবে হুট করে বাড়িতে চলে আসবে, এটা সে ভাবতেও পারেনি। এদিকে মিনহা আভাসের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
—শ্রুতির কিছু হয়নি। ও একদম ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কে?
আভাস মিনহার দিকে একবার তাকিয়ে আবার শ্রুতির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। শ্রুতি বুঝতে পেরে বললো,
—আসলে ওনি-ই মিনহা জি। আপনাকে একবার বলেছিলাম না। আর মিনহা জি, উনি হচ্ছে আরহাম খান আভাস। তোমার কাছে আমি বলতাম অনেক ওনার কথা।

আভাস মিনহার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে সালাম দিলেও মিনহা চোখ মুখ কালো করে উত্তর নিল। এরকম আচরণের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না আভাস। তাও ততোটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
—আমি আজ সব কিছু ফাইনাল করতে এসেছি, শ্রুতি। আমাকে আর অপেক্ষা করিও না, প্লিজ।
শ্রুতি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
—আজই বলবেন। কিন্তু……..
—কোনো কিন্তু না। আন্টি, আপনি তো সবটাই জানেন! এতো ঘুরিয়ে -পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলছি যে, এবার কি আমার হাতে শ্রুতিকে তুলে দিবেন?
শায়লা রুবাইয়াত আভাসের কথাতে অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলেন না। হালকা হেসে বললেন,
—আমি তোমাকে বাঁধা দিবো না। কিন্তু তোমার পরিবার এটা যদি মেনে না নেয়?
—আপনি আমার হাতে শ্রুতিকে তুলে দিচ্ছেন, আমার পরিবারের হাতে নয়। পরিবার বলতে আমার মা আর বোনই শুধু আছে। মা রাজি হবে না আমি জানি, তবে শ্রুতিকে মা কিছু বলতে পারবে না এটা নিশ্চিত থাকুন।
—আমার মেয়েটার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে, আভাস। তুমি তো সব জানোই!
আভাস কিছু বলার আগেই মিনহা বললো,
—শায়লা, তুই শুধু রাজি হলেই চলবে না! আমার ওকে কিছু বলার আছে।
শায়লা রুবাইয়াত বললেন,

—তুমি যা বলার বলো, মিনহা। আমি জানি, তুমি শ্রুতির খারাপ চাইবে না কখনোই।
মিনহা শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বললো,
—তুই কি বলিস?
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে বললো,
—বিশ্বাস আছে তোমার ওপর, মিনহা জি।
মিনহা প্রসন্নের হাসি দিয়ে আভাসকে বললেন,
—তুই চল আমার সাথে।
আভাস শ্রুতির দিকে একবার তাকিয়ে মিনহার সাথে বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পর মিনহা আভাসের হাত ধরে ঘরে এনে শ্রুতির সামনে দাঁড় করালেন। বললেন,
—তোর সিদ্ধান্ত তোর হাতেই। তোর যেটুকু জানার, সেটুকু তোকে জানিয়ে দিলাম। এখন শ্রুতির সামনে দাঁড়িয়ে তোর সিদ্ধান্ত বল।
শ্রুতি কিছু না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পারছে, আভাসকে অপ্রীতিকর কিছু বলা হয়েছে। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আভাসের দিকে তাকাতেই দেখলো, আভাস অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে পানি, কিন্তু সেটা গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না সে।
আভাস কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১০

—আমায় ক্ষমা করে দিও। ভুলে যাও আমায়।
শ্রুতি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার গলা থেকে কোনো কথাও বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দেখলো, আভাস দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রুতি ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—আভাস, আমায় ছেড়ে যেও না। আমি তোমায় ভুলতে পারবো না, আভাস। মরে যাবো আমি, মরে যাবো তোমায় ছাড়া এবার। আমায় ছেড়ে যেও না, প্লিজ। তোমার দুটো পায়ে পড়ি, আভাস। রহম করো আমার ওপর।
আভাস নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত থেকে শ্রুতির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। একবারও শ্রুতির দিকে তাকালো না। শ্রুতি আভাসের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ পাথরের মতো তাকিয়ে থেকে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

—কোনো আমায় ঐদিন মেরে ফেললে না, আল্লাহ? কেন এই ধোঁকার দুনিয়ায় আমায় বাঁচিয়ে রেখেছো? সব মিথ্যে, সব! এ পৃথিবীতে সবাই ধোঁকা দেয়! সবাই মন ভাঙে। কেউ সত্যিকারের ভালোবাসে না। কেন এসেছিলে চলেই যখন যাবে? দুই দিনে স্বপ্ন দেখিয়ে আবার সেটা ভেঙেও দিলে। ঠকিয়েছ তুমি আমায়। ক্ষমা নেই তোমার, কোনো ক্ষমা নেই।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১২