ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১২ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১২
Mahfuza Akter

ক্যালেন্ডার থেকে কাটা পড়ে গেল একটা মাসেরও কিছু বেশি সময়। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে পরিস্থিতিও। জীবনের অগ্রযাত্রা নিয়ে শ্রুতি এখন অনেক সিরিয়াস। কঠিন কঠিন ধাক্কায় ভেঙে যাওয়া জীবনটা নতুনভাবে গড়ে তুলতে আজ সে বদ্ধপরিকর। নিজের ক্লাস, তিনটা টিউশনি করতে করতে দিনটা যে কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যায়, শ্রুতি বুঝতেও পারে না। আবার রাতে নিজের পড়াশোনা নিয়ে বসতে হয়। ব্যস্ততায় মগ্ন থেকে নিজেকে একদমই নীরস গাম্ভীর্যের অধিকারী করে ফেলেছে সে। আজ তার মাঝে কোনো অনুভূতি কাজ করে না; না আনন্দের, না দুঃখের। তবুও দিনশেষে বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে ভাবে, এমনটা না হলেও পারতো। অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করলেও সেগুলোকে চেপে পিষে ফেলতে শিখে গেছে শ্রুতি। মাঝে মাঝে সেই প্রেমিকপুরুষের মতো বলা কথাগুলো, সেই চোখে চোখ রেখে প্রকাশিত অনুভূতিগুলো, হাতে হাত রেখে বলা প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি গুলো।

—আচ্ছা, সবই কি মিথ্যে ছিল? সে তো বলেছিলো কোনো দিনও আমায় ছেড়ে যাবে না। যদি মিথ্যে না-ই হতো, তাহলে কারো কথা শুনেই আমার হাত ছেড়ে দিলো! বলে দিলো ‘ভুলে যাও’! হয়তো সবকিছুই অভিনয় ছিল। আমিও নিজের অবস্থাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে আবার পড়ায় মনযোগ দিলো শ্রুতি। আজ বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সে; যার একদিকে থাকবে অদ্রিতা রুবাইয়াত, আর আরেক দিকে পুরো বিশ্ব।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—স্নেহা, তাড়াতাড়ি খেতে আয়। আজ তোর ক্লাস আছে না?
স্নেহা রেডি হয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এসে বললো,
—আপনি খেয়ে নিন, মিস্টার আরহাম। আমার খিদে নেই।
আভাস আহত দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো,
—স্নেহা, আমি তোর ভাইয়া!
—কিসের ভাই? আমার কাছ থেকে ভাইয়া ডাক শোনার অধিকার আপনি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছেন।
—খেয়ে তো যা, প্লিজ।
—যেসব মানুষ অসহায় মেয়েদের মন নিয়ে খেলে, সেসব মানুষের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেতে আমার রুচিতে বাঁধে।

বলেই গটগট করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল স্নেহা। আভাসের গলাটা যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে, হয়তো কান্নাগুলো গলায় আঁটকে আছে! সেগুলো উগলে বের হয় দিতে পারলে হয়তো একটু শান্তি হতো!
আভাসও না খেয়ে বেরিয়ে গেল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু স্নেহার কথা ভেবে আর যাওয়া হয়ে উঠে না।
রুটিনমাফিক ক্লাসে আভাসও ক্লাস নেয় শ্রুতিদের। কিন্তু শ্রুতি ক্লাস টাইমে শুধু ইম্পর্ট্যান্ট লেকচারগুলো নোট করে নেয় মাথা নিচু করে, একবারের জন্যও সামনে তাকায় না। ব্যাপারটা আভাস লক্ষ করলেও মনে মনে খুশি হয় এটা ভেবে যে, শ্রুতি অন্তত ক্লাস তো করছে! তাতেই চলবে। সে তার প্রিয় মানুষটার আশেপাশে তো থাকতে পারছে! দেখতে তো পারছে তাকে! এটাই অনেক।

ক্লাস শেষ করে বের হতেই আভাসের সাথে মুখোমুখি দেখা হয় শ্রুতির। আভাস শ্রুতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিন্তু শ্রুতি বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আভাসের অনেক ইচ্ছে করছিলো ওকে হাত ধরে আটকাতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না, তাই ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হলো সে। দু পা এগুতেই আবার শ্রুতির সামনে এসে স্নেহা দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো,
—কেমন আছো, শ্রুতি?
শ্রুতি ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
—ভালোই চলছে, আলহামদুলিল্লাহ। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা টা বেশি, এই আর কি!
স্নেহা এখনো খেয়াল করেনি যে, আভাস তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, তবে কানটা ওদের কথার দিকে নিয়োজিত রেখেছে।
—আমি জানি, ভাইয়া যেটা করেছে, সেটা একদমই ঠিক না। তুমি…………….
শ্রুতি স্নেহাকে থামিয়ে বললো,

—বাদ দাও না, আপু। এরকম অনেকেই বলে যে, তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না, বাঁচবো না। কিন্তু দিনশেষে তারা সবকিছু ভুলে গিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে। তাদেরকে মন দেওয়াটাই ভুল, কারণ সবশেষে তারাই মন ভাঙে।
বলেই হাতে থাকা বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে চলে গেল শ্রুতি।
আভাস ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রুতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। হঠাৎ ফোন আসতেই অপর পাশ থেকে কথা শুনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
—আমি আসছি।

কয়েকদিন পরের কথা,
শ্রুতি তন্ময়ের রুমে ঢুকতেই দেখলো, স্নেহা সেখানে বসে তন্ময়ের সাথে কথা বলছে। তন্ময় শ্রুতিকে দেখে বললো,
—আরে অদ্রিতা, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।
—স্যার, আসলে আমার কয়েকটা প্রশ্ন বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। একটু হেল্প করতে পারবেন?
—ওকে দেখাও।
শ্রুতি প্রশ্নগুলো তন্ময়কে দিলে সে সবকিছু দেখে বললো,
—এগুলো তো আভাস ভালো করে বুঝাতে পারবে! আমি তো এই সাবজেক্টের ক্লাস নেই না, তাই আমার তেমন ধারণাও নেই।
স্নেহা মুখ কালো করে বললো,
—ও তো ঢাকায় গেছে কয়েকদিন আগে। মা অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, তাই!
শ্রুতি স্নেহাকে জিজ্ঞেস করল,
—তোমার মা অসুস্থ, অথচ তুমি যাওনি।
—গিয়েছিলাম, দুদিন আগে ফিরলাম। আভাস স্যার এলে তুমি প্রবলেম সলভ করে নিও।
—না, লাগবে না। আমি অন্য কারো কাছ থেকে হেল্প নিব। নয়তো আরাফ স্যারের কাছে যাবো কাল।
বলেই চলে যেতে লাগলো শ্রুতি।

বাড়িতে ফিরে গেইট ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো, উঠানো মানুষের ছোটো-খাটো একটা জটলা। শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে ভাবছে, এখন এতো মানুষ কেন এখানে? সবাইকে ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলো, একজন মানুষকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, তার মাথার কাছে বসে আছে মিনহা।
—কী হয়েছে, মিনহা জি? এখানে এতো মানুষ কেন? আর এটা কাকে শুইয়ে রেখেছো?
মিনহা মুখ তুলে তাকাতেই শ্রুতি দেখলো, মিনহা কাঁদছে। শ্রুতির ভেতরে ভয় ঢুকে গেল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যক্তিটার মুখ থেকে কাপড় সরালো। শায়লা রুবাইয়াতকে দেখেই জোরে চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস হয়ে গেল সে।

শ্রুতি বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো আভাস। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মন বলছে, শ্রুতির কিছু হয়েছে, ও ভালো নেই। বিছানা ছেড়ে ট্রাউজার চেঞ্জ করে একটা ব্ল্যাক জিন্স আর গায়ে থাকা সাদা টি-শার্টের ওপর একটা কালো শার্ট জড়িয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল আভাস। হুট করে ছেলেকে কোথাও যেতে দেখে আরিহা খান অবাক হয়ে বললো,
—এই ভরদুপুরে কোথায় যাচ্ছিস, আভাস।
আভাস কোনো উত্তর না দিয়ে শার্টের হাতা গুঁজতে গুঁজতে চলে গেল। নাতাশা মেইনডোরের সামনে এসে দুই হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
—কোথাও যাবে না তুমি, আভাস! তুমি কেন বুঝতে…………

নাতাশার কথা শেষ হওয়ার আগেই আভাস ওর বাঁ গালে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলো। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো,
—তোর সাহস কী করে হয় আমার রাস্তা আগলে দাঁড়ানোর? আর আমায় নাম ধরে ডাকিস কোন অধিকারে? রিমেম্বার, আ’ম থ্রি ইয়ার্স ওল্ডার দ্যান ইউ।
বলে নাতাশাকে সামনে থেকে সরিয়ে চলে গেল আভাস।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দেয়ালের সাথে ঘেঁষে নিজের ঘরের ফ্লোরে বসে আছে শ্রুতি। দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ, যেন কোনো অনুভূতিহীন জড়পদার্থ। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। বাইরে বসে আছে মিনহা, আরাফ আহসান ও তন্ময়। মিনহার ভাষ্যমতে, ব্রেইন স্ট্রোক করেই মারা গেছেন শায়লা রুবাইয়াত। তাদের কথার মাঝে হঠাৎ আভাস বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। বাইরে মানুষের কথা শুনে সে ঠিকই আসল ঘটনা বুঝে ফেলেছে।
আভাসের হঠাৎ আগমনে সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আভাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে শ্রুতির ঘরে চলে যায়। শ্রুতির পাশে বসে তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে হাতের ওপর হাত রাখলো আভাস। কিন্তু শ্রুতির কোনো হেলদোল নেই, সে একই ভাবে বসে আছে।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১১

—শ্রুতি, কথা বলো। আমি এসেছি, তোমার পাশে বসেছি, তোমার হাত ধরেছি। আমায় বকবে না? মারবে না? অপমান করবে না?
শ্রুতির কোনো সাড়া না পেয়ে ওকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল আভাস। গেইট দিয়ে বেড়িয়ে যাবে এমন সময় হঠাৎ আরাফ আহসান পেছন থেকে বলে উঠলেন,
—দাড়াও।
আভাস পা থামিয়ে দিলো ঠিকই, কিন্তু হাত এখনো ছাড়েনি। আরাফ আহসান থমথমে গলায় বললেন,
—আমার কিছু প্রশ্ন আছে, আভাস।
আভাস আরাফ আহসানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে তিনি বলেন,
—তুমি অদ্রিতাকে নিয়ে যাও, আমি কিছু বলবো না। তবে তুমি কি ওকে বিয়ে করতে পারবে? সবার সামনে নিজের বউ বলে পরিচয় দিতে পারবে? সমাজের কাছে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে?
আভাস ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আরাফ আহসানের দিকে। মাথা নিচু করে বললো,
—পারবো না।

—তাহলে ওর হাত এখনো ধরে রেখেছো কেন তুমি? আজ থেকে অদ্রিতাই আমার মেয়ে, আমি ওর বাবা। আমি খুব দ্রুত সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে ওকে নিজের একমাত্র মেয়ে হিসেবে পরিচিতি দিবো। আর একজন বাবা হিসেবে তোমার ছায়াও পড়তে দেবো না আমার মেয়ের ওপর।
আরাফ আহসান শ্রুতির হাত আভাসের হাতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। তন্ময়ের দিকে তাকাতেই ও মাথা নিচু করে চলে গেল। মিনহা আভাসের কাঁধে হাত রেখে বললো,
—আমার কিছু করার নেই রে, আমার কিছু করার নেই। আমিও তোর মতো নিরুপায়।
আভাস শার্টের হাতায় চোখ ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৩