ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৩ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৩
Mahfuza Akter
✨রহস্যভেদ✨
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। থেমে থেমে মেঘের হিংস্র গর্জন ভেসে আসছে। জানালার গ্রিল ধরে আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসা আলোকচ্ছটার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রুতি।
—পুরো পৃথিবীর মতো তুমিও আমার সাথে স্বার্থপরতা করলে, মা! যেখানে তোমাকে ছাড়া আমি একদিনও থাকতে পারতাম না, সেখানে আজ একসপ্তাহ হয়ে গেল। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে, মা। কিন্তু সবার মতো হাসি আর কান্নাও আমায় সঙ্গ দিতে চায় না। আজ আমি সম্পূর্ণ একা, আমার নামের পাশে ‘এতিম’ নামক তকমা লেগে গেছে। আমি অনাথ, অসহায়, নিঃস্ব।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনায় মগ্ন শ্রুতি। সে এখন আরাফ আহসানের বাসায় থাকে।সেদিন আভাস চলে যাওয়ার পর তিনি শ্রুতিকে নিজের সাথে নিয়ে চলে আসেন। মিনহাও বাঁধা দেয়নি।
—অদ্রিতা মা, এই পেপারস গুলোতে সাইন করে দাও।
হঠাৎ আরাফ আহসানের কথা শুনে চকিত হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, তিনি হাতে কয়েকটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে তানিয়া আহসান। শ্রুতি কাগজ গুলো নিয়ে ফটাফট কলম চালিয়ে স্বাক্ষর করে দিলো। তানিয়া আহসান অতিরিক্ত আবেগান্বিত হয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—আজ আমার মেয়ের অভাব পূরণ হয়েছে। তন্ময় পৃথিবীতে আসার পর আমি ডাক্তার বলেছিলেন, আমি নাকি আর মা হতে পারবো না। আমার খুব শখ ছিল একটা মেয়ের। ভেবেছিলাম সেটা কখনো পূরণ হবে না। কিন্তু আজ আমি একটা মেয়ে পেয়েছি। একবার মা বলে ডাক না আমায়, মা!
শ্রুতি শুকনো হাসি দিয়ে বললো
—আর কেঁদো না, মা!
তানিয়া আহসানকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরাফ আহসানকে জিজ্ঞেস করল,
—আর কোনো ফর্মালিটি বাকি আছে, স্যার।
আরাফ আহসান থমথমে গলায় বললেন,
—তার মানে, আমায় তুমি সারাজীবন স্যারই বলে যাবে?
শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—বাবা!
—হুম, এতোদিন অনেক হেলাফেলা করেছো সবকিছু নিয়ে। এখন থেকে খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা, ভার্সিটি সবকিছু সুন্দরমতো মেইনটেইন করে চলবে।
—আমি ভার্সিটিতে যাবো না, বাবা। প্লিজ, আমায় জোর করো না। আমি বাসায়ই পড়বো। পরীক্ষার সময়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবো।
—আচ্ছা, যেটা তোমার ইচ্ছা। তন্ময় তোমাকে সন্ধ্যার পর থেকে সময় দেবে আর আমি তো আছিই।
বলে শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন যে, শ্রুতি আভাসের জন্যই ভার্সিটিতে যেতে চাইছে না।
দিনগুলো এখন বেশ ভালোই কাটছে শ্রুতির। সারাদিনে আহসান ফ্যামিলির সবার কাছে থাকায় এখন আর পরিবারের অভাব অনুভব হয় না। শ্রুতি যেন তার অতীত নিয়ে মন খারাপ না করে, সেজন্য সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করে। দুপুরের দিকে আরাফ আহসানের কাছে আর সন্ধ্যায় পর তন্ময়ের কাছে পড়া বুঝে নেয় শ্রুতি। তবুও দিনশেষে মাকে অনেক মনে পড়ে। কষ্ট গুলো বুকের ভেতর দাপাদাপি করে। একটা শান্তির ঘুম দিতে চাইলে সেটাও ধরা দেয় না। ডাক্তার ও সাইকিয়াট্রিস্ট দের পরামর্শ মতো এখন ঘুমের ওষুধ তার শান্তির ঘুমের উৎস। তবে দুই-তিন দিন পরপর গ্যাপ দিতে বলেছে ডক্টর, নয়তো এটা অভ্যাস হয়ে যাব। সেই রাতগুলো বই পড়েই কাটিয়ে দেয় শ্রুতি।
—-স্যার, ব্যস্ত আছেন নাকি পরে আসবো?
তন্ময় শ্রুতির দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো,
—আবার!
শ্রুতি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,
—স্যরি, স্যরি! ভাইয়া! বিজি আছো?
তন্ময় ল্যাপটপটা ঠিক করতে করতে বললো,
—না, তোমার জন্যই ওয়েট করছিলাম। এতো দেরি হলো যে! এসে আমার পাশের চেয়ারটাতে বসো।
শ্রুতি বসতেই তন্ময় ল্যাপটপটা ওপেন অবস্থায়ই সামনে রেখে ওকে পড়াতে লাগলো। টানা দুই ঘন্টা পরে শ্রুতি বোর হয়ে বললো,
—আর লেকচার শুনবো না। ঘুম পাচ্ছে খুব। তুমি আমার ঘুমের সময় কানের কাছে এসে লেকচার দিও, ভাইয়া। তাহলে আর আমায় ওষুধ খেতে হবে না।
তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বললো,
—তার মানে কী বুঝাতে চান আপনি? আমার লেকচার বোরিং?
হুট করে কোথা থেকে তানিয়া আহসান এসে বললো,
—তুই মেয়েটাকে বকছিস নাকি? এরপর থেকে আর তোর কারণ ওকে পড়তে পাঠাবো না!
—যাব্বাবাহ্! আমি আবার কখন বকলাম। এই অদ্রিতা, তোমায় আমি বকেছি?
—ও কী বলবে? আমি কি চোখে দেখি না? তুই ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলি!
একথা শুনে শ্রুতি ফিক করে হেসে দিলো। তানিয়া আহসান বললেন,
—আমি আজ চকোলেট কেক বানিয়েছি অদ্রিতার জন্য। চল তো, এখন আর পড়া লাগবে না।
তন্ময় অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
—আমাকে দিবে না, মা?
—না, তোর জন্য অন্য একদিন বানাবো!
বলেই শ্রুতিকে নিয়ে চলে গেল। শ্রুতি ঘাড় ঘুরিয়ে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো।
শ্রুতি চলে যেতেই তন্ময় ল্যাপটপ নিয়ে কনফারেন্সে ঢুকতেই দেখলো, আভাস তার ঘরের দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
—আপনার দেখা শেষ হলে অডিও অন করবেন নাকি আমি কলটা কেটে দিবো?
আভাস হকচকিয়ে গিয়ে অডিও অন করে বললো, —ও ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে যাচ্ছে!  আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এতো তাড়াতাড়ি ইম্প্রুভ করছে শ্রুতি!
—হ্যাঁ, সবই সম্ভব হয়েছে বাবা আর মায়ের জন্য। কয়েকদিনের মধ্যেই ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
—কবে যে ওকে সামনাসামনি একটু দেখবো! ভার্সিটিতে যায় না, বাইরেও বের হয় না। তবে আমি চাই ও সুখে থাকুক, ভালো থাকুক। ওর মুখের হাসিটা যেন সবসময় লেগে থাকে।
তন্ময় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—আর তুই? তুই কি ভালো আছিস? এতো কিছু কীভাবে সহ্য করছিস আমি ভাবতেই পারছি না।
আভাস মলিন হেসে বললো,
—আমার সহ্য করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই! শ্রুতির জন্য এটুকু সহ্য করাই যায়।
—তুই ওকে সবকিছু খুলে বলে দে। তাহলে অন্তত ওর মনে তোর জন্য ঘৃণা তৈরি হবে না।মনে মনে জানবে যে, তুই ওকে সত্যিই ভালোবাসি।
আভাস ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
—কিন্তু আমি চাই ও আমাকে ঘৃণা করুক। এতে ওর মনে আমার অবস্থা ভেবে কোনো কষ্ট থাকবে না।
—তাহলে স্নেহাকে তো বলতে পারিস! শুধু শুধু ও তোকে দোষারোপ করছে!
—না, আমি চাই না স্নেহা কষ্ট পাক। সব সত্য জানার পর ও সহ্যই করতে পারবে না।
হঠাৎ বাহির থেকে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে তন্ময় দ্রুত ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। পেছনে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি ওর জন্য কেক নিয়ে আসছে।
শ্রুতি কিছু দেখেনি ভেবে তন্ময় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।
আজ শায়লা রুবাইয়াতের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পূরণ হলো। শ্রুতি ঘরের ভেতর তার মা আর বাবার একটা বাঁধাই করা ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে। ছবিটার ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে হচ্ছে যেন তাদেরকে সত্যি সত্যিই ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। বাড়ির সবাইকে শ্রুতি বলে দিয়েছে, আজ যেন তাকে সবাই একটু একা ছেড়ে দেয়। তাই কেউ আর বিরক্ত করেনি তাকে।
হঠাৎ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেই শ্রুতির কিছু একটা মনে পড়লো। সে মুখটা ভালোভাবে ঢেকে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। পেছন থেকে তানিয়া আহসান ডাকলে বললো,
—আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো, মা। চিন্তা করো না।
শ্রুতি নিজের বাড়িতে তালা খুলে ঢুকে দৌড়ে তার মায়ের ঘরে চলে গেল। সেখানে একটা কাঠের আলমারি থেকে একটা বেশ বড়সড় ছবির এলবাম বের করলো সে। তার ওপর লেখা ‘রুবাইয়াত ফ্যামিলি ‘। শ্রুতির বাবা রুবাইয়াত আহমেদ বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত সব ছবি এটাতে সংরক্ষণ করে রেখেছেন শায়লা রুবাইয়াত। এটা অনেক প্রিয় একটা বস্তু ছিল তার কাছে। শ্রুতি দেখেছিল, তার মা প্রায়ই এলবামটা বসে বসে দেখতো। কিন্তু শ্রুতি কখনো এটা খুলে দেখেনি। তাই আজ সে দেখবে।
শ্রুতি এলবামটা নিয়ে কভার পেজটা খুলতেই দেখলো একটা কাগজ তিনভাজ করে রাখা, যার ওপর লেখা ‘আমার শ্রুতি মায়ের জন্য’। শ্রুতি একটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা খুললো। কাগজের পুরো পৃষ্ঠা জুড়েই লেখা, তবে শেষের লেখা গুলো কেমন যেন ত্যাড়াব্যাকা! লেখা দেখে শ্রুতি চিনে ফেললো যে, এটা ওর মায়ের হাতে লেখা। শ্রুতি চিঠিটা পড়তে শুরু করলো,
“শ্রুতি মা,
তোকে এই পরিবর্তিত রূপে দেখতে আমার অনেক কষ্ট হয়।আমি জানি তুই ভেতরে ভেতরে কতোটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছিস। কিন্তু তোর এই কষ্ট বাড়ানোর জন্য আমিও দায়ী।
আমায় মাফ করে দিস। অনেক বড় একটা সত্য তোর কাছ থেকে লুকিয়েছি আমি। কিন্তু আজ সেটা আমায় বলতেই হবে। তোর সাথে হয়তো আর কথা বলা হবে না আমার। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে রে, মা। কিন্তু আজকে আমি লিখবো। মিনহার বারণ সত্ত্বেও তোকে আমি আসল কথাটা জানিয়ে দিয়ে যাবো। যদি আমি বেঁচে না ফিরি, তাহলে আর সুযোগ পাবো না।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১২

সত্যি কথা হলো, আভাস তোকে অনেক ভালোবাসে। আমি ওর চোখে তোর জন্য একটা অন্যরকমের মায়া দেখেছি সেই সাত বছর আগেই। এখনো দেখি। আভাস তোকে ছেড়ে গিয়েছিল কেন জানিস? সেদিন মিনহা ওকে একটা ভয়ংকর সত্যি বলেছিল। আর সেটা হলোঃ আভাসের মা, আরিহা খানই পাঁচ বছর আগে তোকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো ঐ লোকগুলোকে দিয়ে। আর এখন যদি আভাস তোকে বিয়ে করে, তাহলে এবার তোকে আর বাঁচতে দিবে না। এজন্যই আভাস সেদিন তোর হাত ছেড়ে দিয়েছিলো। দুদিন আগেও আমি আভাসের সাথে ফোনে কথা বলেছি। আমি আগেই তোকে সবকিছু বলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছেলেটা আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, তোকে কিছু না বলতে।
আমি এসব কিছুই জানতাম না, সেদিন মিনহাকে জোর করার পর ও আমায় বলেছে। মিনহা ভেবেছিলো, আভাস যদি তোকে বিয়ে করে তাহলে তোর নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করবে। তোর ভালোর জন্যই আভাসকে সত্যিটা জানিয়েছিলো। আভাসের সাথে তুই কথা বলবি, কোনো সুরাহা খুঁজে বের করবি। আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে। জানি না তুই এই চিঠিটা কবে পাবি। কিন্তু একদিন না একদিন এটা তোর হাতে পৌঁছাবে। কারণ এটা আমি আমার প্রিয় জিনিসটার ভেতর রাখবো। এখন আমার এটা ভেবে শান্তি লাগছে যে, তোকে আমি সবটা জানিয়ে দিতে পেরেছি।
 ভালো থাকিস।”
চিঠি টার ওপর টপটপ করে পানি পড়ছে। শ্রুতির চোখের পানি আজ বাঁধ মানছে না। আভাসের মা কেন তার সাথে এমন করলো? কী ক্ষতি করেছিলো শ্রুতি তার? আভাসকে সে এতোদিন অকারণেই ভুল বুঝে এসেছে! আর আভাস নিজেই সব কষ্ট হজম করে নিয়েছে। মানুষটার যেমন ধৈর্য্যশক্তি, তেমনই তার নিখুঁত অভিনয়!
(রহস্য খোলার জন্য উপযুক্ত সময় প্রয়োজন। হুট করেই সবকিছু ক্লিয়ার করে দিলে আপনারাই খাপছাড়া বলবেন। আর একটা জটলা আছে, সময়মতো খুলে দিবো।
আমি কখনো রি-চেক দেই না। তাই ভুল ত্রুটিগুলো
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৪