আসক্তি পর্ব ৯

আসক্তি পর্ব ৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকাল সকাল বাড়ির সব কাজ মোটামুটি ভাবে শেষ করে শ্বাশুরি মায়ের ডাকে সারা দিয়ে তার ঘরে যায় পাখি।বসতে বলে আলমারি থেকে কয়েকটা প্যাকেট বের করেন তিনি।বিয়ের পর থেকে এ ঘরে আসার আজ প্রথম দিন।বেশ রাজকীয় ব্যপার সেপার আছে ঘরটায়।পুরোনো দিনের অনেক কিছুই সেখানে।ঘরের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা কোণার সৌন্দর্য উপভোগ করছে সে।

“বৌমা!”
“হহহ্যা মা “শ্বাশুরি মায়ের হঠাত ডাকে সম্বিৎ ফেরে পাখির।
“এখানে বসো।দেখোতো কোন টা পছন্দ হয়”-বিভিন্ন ডিজাইনের কয়েকটা গয়না দেখায় পাখিকে।
“মা আমি এসব গয়না পরি না।দেখতেই তো পারছেন।এসব আমার লাগবে না মা। আপনি রেখে দিন পরে কাজে লাগবে”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিছু একটা ভেবে শর্মিলা আহমেদ ঠোঁটে হাসি এলিয়ে পাখির কপালে চুমু খেয়ে বলেন, “জীবনে অনেক অনেক সুখী হও গো মা।সাথে আমার ছেলেকেও সুখী রেখো।”
পাখি নিঃশব্দ হেসে ওঠে।
“আমার ছেলেটা মনের দিক থেকে অনেক ভালো।সেদিন রাতে হয়ত বাজে ব্যবহার করেছিলো তোমার সাথে তবে ও খুবই ভালো।”-বলতে বলতেই মনের মতো একটা হার নিয়ে পাখির গলায় পরিয়ে দেয়।
“ওর মাঝে অনেক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করছি ক’দিন ধরে।আমি জানি সবই তোমার অবদান,দেখবে একদিন তোমরা অনেক সুখী থাকবে”
পাখি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে।

আজ বিকেল বিকেলই বাড়ি ফেরে শান।এসে ফ্রেশ হয় কিন্তু পাখিকে ঘরে খুঁজে পায় না।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।
“পাখি,পাখি! ”
“ওওওহো,পা খি!কি আদুরে স্বরে ডাকিস রে ভাইয়া!”-মজার ছলে কথাটা বলে টিনা রান্না ঘর থেকে এক বাটি আচার নিয়ে বের হয়।
“মারব টেনে এক চড়।যা আচারের বাটি দিয়ে পড়তে বস গিয়ে”
“বড় মা ভাইয়াকে বলে দাও আমি বড় হয়ে গেছি যখন তখন এক চড়,এক চড় কি? “-কথা শেষ হবার সাথে সাথেই কানটা টেনে ধরে শান।
“খুব লায়েক হয়েছো না? ”
“ইসসস ভাইয়া লাগছে আমার।ভাবিইইই!”

পাখি দাদির রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে ভাই বোনের খুনসুটি দেখে আড়চোখে তাকায় সেদিকে।শানের চোখে চোখ পড়ে যায়।সাথে সাথেই লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়।
“লোকটা দিন দিন সুন্দর হচ্ছে মনে হয়।কি কি যে করে নিজেকে ফিট রাখতে কে জানে!”-ভাবতে ভাবতেই সামনে কারো বুকের সাথে ধাক্কা লেগে পরে যায়।বিকট শব্দে পাখি পা চেপে মেঝেতে বসে পরে।রান্নাঘর থেকে সবাই ছুটে আসে। শান থ হয়ে যায় ঘটনার আকষ্মিকতায়।
“আমি তো ইচ্ছে করেই দাড়ালাম ওর সামনে।কি থেকে কি হলো এটা”

“ভাইয়া কি ভাবছিস ভাবির পায়ের গোড়ার জয়েন ভেঙ্গে গেছে।তারাতারি কিছু একটা কর।”-রনির ডাকে হুশ ফিরে দেখে সত্যিই পায়ের জয়েনের হাড়টা সরে গেছে অনেকটাই।পা চেপে ধরে অসহনীয় ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে পাখি।দ্রুত মেডিকেলে ফোন করে কেবিন বুক করতে বলে শান।তারপর পাখিকে কোলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়।

“থামো মেয়ে, তোমার কান্না আমার কলিজা ভেদ করছে।সহ্য হচ্ছে না, কিছুতেই না।না জানি কতো কষ্ট হচ্ছে তোমার।প্লিজ থামো পাখি।এতো ব্যথা কেন হচ্ছে বুকে”-ভাবতে ভাবতেই গাড়ির কাছে চলে আসে শান।শানের চোখের কোণ ভরাট হওয়া অশ্রু পাখির নজর এড়ায় নি।
মেডিকেলে এসে অর্থোপেডিক ডক্টর মাহমুদের কাছে নেয়া হয় পাখিকে।

“শান ভয় পাবার কিছু নেই।আমি পেইন কিলার দিয়েছি।এটা ক্লোজ ফ্রাকচার অর্থাৎ চামড়া ভেদ করে হাড় বাহিরে আসে নি।ফলে ব্লাডও নেই।আশা করা যায় তারাতারি সেরে যাবে।আমি এক্সরে টেষ্ট দিচ্ছি করিয়ে নাও আর দূঃচিন্তার কারণ নেই ইয়াং ম্যান”-মেডিকেলের সিনিওর ডক্টর মাহমুদ শানকে আশ্বস্ত করেন।সিনিওর হলেও স্বভাবসূলভ আচরন তার সবার সাথেই থেকে যায়।

“একজন কাউকে সবসময় ওর কাছাকাছি থাকতে হবে।ক্লোজ ফ্রাকচারে আমরা ডক্টররা RICEN থেরাপি দিয়ে থাকি।অর্থাৎ R=Rest – ভাঙ্গা স্থানটিকে টোট্যাল বিশ্রামে রাখতে হবে,I=Ice therapy – বরফ লাগাতে হবে, C=Crape bandage দিয়ে নাড়াচাড়া বন্ধ করানো, E=Elevation-ভাঙ্গা স্থানটি উুঁচুতে রাখতে হবে আর N=NSAID অর্থাৎ বেদনানাশক ঔষধ দিতে হবে।তুমি চিন্তা করো না আমি পেইন কিলার দিয়েছি ওকে আরো দিচ্ছি।আর আজই নিয়ে যেতে পারবা ওকে তবে মাইন্ড ইট, প্রোপার রেস্ট,হুমমম?”-প্রেসক্রিপশন লিখে হাতে দেন শানের।

এক্সরে টেষ্টের পর ডক্টর পা টা প্লাস্টার করে দেন।পেইন কিলার দেয়ার পরও ব্যথায় দাঁতে দাঁত চাপছে পাখি।ওর এই অবস্থা দেখে নিজেকেই বার বার দোষ দিচ্ছে শান।
ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে পরিবারের সবাইকে আশ্বস্ত করে শান।এরপর কেবিনে ঢুকে পাখিকে আবারও সাবধানে কোলে তুলে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন।পাখি শুধু অবাক চোখে দেখে চলেছে শানকে।গাড়িতে খুব সতর্কতার সাথে পাখিকে বসিয়ে দিয়ে রনিকে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন,”ঔষধ গুলো নিয়ে তারাতারি বাড়ি আসবি”

“আই’ম সরি পাখি।আমি জানতাম না এমন কিছু হবে।”
“আপনি সরি কেন বলছেন আমারই আরেকটু দেখে হাঁটা উচিত ছিলো।”
ঘরে ঢুকেও শান ওকে কোল থেকে নামাচ্ছে না দেখে পাখি উসখুস করছে।শান বুঝতে পেরে আস্তে ধীরে পাখিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।শান এতোটাই কাছে এসেছে পাখির যেন দম আটকে আসছিলো।শ্বাস যেন ভারি হয়ে আসতে চায়। শানের মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি পাখির বাম গাল বেয়ে নিচে নামতেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে সে।শান দুটো শুকনো ঢোক গিলে গভীর চাহনীতে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।

“শান কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ,ইট ইজ নট দ্যা রাইট টাইম।ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড”-নিজের মনকে বুঝিয়ে শান দ্রুত উঠে চলে আসে।পাখি হতভম্ব হয়ে শানের দিকে চেয়ে থাকে।লজ্জা লাগছে নিজের কাজে নিজেরই।শান এক পলক সেদিকে চেয়ে মনে মনে ভাবে,”এই ছোট ছোট দূরত্ব গুলোই তোমাকে আমার কাছে আনবে পাখি”

শান খাটের পাশে স্ট্যান্ড রেখে সেখানে পা টা ঝুলিয়ে রেখে এটা ওটা কথা বলছে পাখির সাথে।পাখি শুধু শানের কাজ কারবার দেখছে আর ক্ষনে ক্ষনে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
“এতো বড় মাপের একজন মানুষ তার মাঝে কোন অহঙ্কার নেই, না আছে আলাদা কোন ইগো।কোনদিক থেকেই আমি তার যোগ্য নই,অথচ কতো কেয়ার করছেন তিনি আমার”-ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে আসে পাখির।

কথার ফাঁকে শান চোখ ফেলে দেখে পাখির চোখে গভীর ঘুম।
“এই পাখি এএই, একদম না। ঘুমাবা না একদম।তোমার রাত্রের ঔষধ আছে”
“হুমমমমম,আমার খুউব ঘুম লাগছে”গভীর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে পাখি।
“লিসেন, বেশী সময় লাগবে না। জাস্ট রাতে খাবার টা খেয়ে ঔষধ খাবা”
বার বার শ্বাশুরি মা এসে দেখে যাচ্ছেন।বয়স্ক দাদি সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে দেখে গেছেন দুইবার।নিজেকে খুব বিশেষ মানুষ মনে হচ্ছে পাখির।

একটু পর শ্বাশুরি মা প্লেট ভর্তি খাবার এনে জোড় করে খাইয়েছেন পাখিকে।খাওয়া শেষে তিনি শানকে ঔষধ গুলো খাওয়াতে বলেন
“আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।আজ ফ্রাকচার টা না হলে নীরার দেয়া ঔষধগুলো এই মেয়েকে কখনো খাওয়ানো যেতো না।
“আপনি হাসছেন যে!”
“কই না তো!”
“ঐ যে মুখে হাসির রেশ”
“অতো ভাবতে হবে না তোমায় ঔষধ খাও।হুমম নাও?”

“প্রেসক্রিপশনে পাঁচটা ঔষধ দেখলাম এখানে সাত টা কেন?”
পাখির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শান জবাব দেয়, “ডাক্তার পরে ফোন কককরে ও দুটা ঔষধ দিয়েছেন”
“কি ব্যপার এমন করে কি দেখো,ডাক্তার তুমি না আমি?”
“আমি তো কিছুই বললাম না আপনাকে জাস্ট বললাম…..”
“এনাফ, অনেক বকবক করেছো এবার ঘুমাও”
“আমি বকবক করি!!!!”
“এই যে!”
পাখি মুখ ফিরিয়ে ঔষধগুলো খেয়ে সাবধানে শুয়ে পড়ে।
“তোমার মধ্যকার জড়তা একটু হলেও কমেছে”-মুচকি হেসে মনে মনেই বলে ওঠে।
শানের ফোনে কারো কল আসায় বেলকোনিতে চলে যায়।কাউকে ইমিডিয়েট আগামিকালই জয়েন করার কথা বলে।

সকাল হতেই পাখির পরিবারের সবাই উপস্থিত।শান নিচে নেমে তাদের দেখে পুরোই অবাক।
“ভাইয়া আপনারা?”
“আমি ওনাদেরকে বলেছি শান এখানে আসতে”-রান্নাঘর থেকে শানের মা গলা উচিয়ে বললেন।
“কিন্তু মা, কেন?”

“কি বলিস এসব? কেন মানে?মেয়ের বাড়ি আসবে না তারা।আর পাখির অসুস্থ্যতার কথাটা আমি চেপে রাখতে পারি নি।তা বাদেও মেয়েটা বিয়ের পর একদিনও ও বাড়ি যায় নি”
“এনারা তো পাখিকে দেখলে সাথে নিয়ে যাবে”- শানের মনে অজানা শঙ্কা কাজ করছে এই মূহূর্তে।
পাখির সাথে দেখা সাক্ষাত করেন সবাই।পাখির মায়ের মন বড্ডো খারাপ।মা তো!
তিনি এই অবস্থায় মেয়েকে রেখে কিছুতেই যাবেন না।তার কথা তার মেয়ে ওখান থেকে সুস্থ্য হয়ে এ বাড়ি ফিরবে।

শানের মনের শঙ্কাটা বাস্তবে পরিনত হতে সময় লাগলো না।কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না শানের।
“আন্টি এই অবস্থায় কি করে নেবেন ওকে?ডাক্তার প্রোপার বেড রেস্ট নিতে বলেছে”
“আন্টি মানে, এসব কি ব্যবহার শান? উনি তোমার শ্বাশুরি মা। মা ডাকবে তাকে”-মায়ের কথায় কান দিয়ে চুপসে যায় শান
ওনাদের কথার মাঝেই একটি মেয়ে ব্যাগ পত্র সহ বাড়িতে ঢোকে।
“আসো ইকরা।”-
“ও কে রে শান?”

“মা ও ইকরা।আমি পাখির জন্যে চব্বিশ ঘন্টা নার্স রেখেছি।আজ থেকে জয়েন ওর।আমি তো আর ওর পাশে সারাক্ষন থাকতে পারবো না।তাই ইকরা ওকে দেখাশোনা করবে”
শানের কথায় সেখানকার সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে।নিজের মেয়ের এমন যত্ন দেখে রাশিদা বেগমের চোখে খুশির অশ্রু টলমল করে।
“ডাক্তার কয়েকটা দিন নড়াচড়া করতে বারোন করেছেন একদমই তাই ওর যাওয়া হচ্ছে না ভাইয়া।ও একটু সুস্থ্য হয়ে যাক আমি নিজেই গিয়ে রেখে আসব”-শানের কথার সাথে পাখির ভাই সহমত প্রদান করে।

ইকরাকে পাখির রুম দেখিয়ে দেয় শান।এরপর রেডি হয় মেডিকেলের জন্যে।
মাথায় জেল টা লাগিয়ে চুল গুলো সেট করে নেয় শান।হাতের ব্র্যান্ডেড ঘরি টা বাঁধে।গায়ে ব্রাউন কালার শার্টের হাতা ফোল্ড করছে আর আয়না দিয়ে বিছানায় পাখির দিক দেখছে ।পাখি বার বার আড়চোখে দেখছে তাকে সেটা কোনভাবেই চোখ এড়ায় নি শানের।
পারমিউমের কড়া সুগন্ধ পুরো রুম জুড়ে ছেয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ পাখির নাকে আসায় হেঁচে ফেলে।এতে পায়ে সামান্য ব্যথা অনূভব করে উফফ শব্দে ওঠে।

আসক্তি পর্ব ৮

“কি হয়েছে, ব্যথা পেলে?ঠিকাছো তুমি?
“কোথায় যাচ্ছেন এতো সেজেগুজে?”-বলতে বলতেই আধশোয়া হয়ে বসতে চায় পাখি।
শান ওর পিঠের নিচে বালিশ দুটো ঠেকিয়ে জবাব দেয়,”মেডিকেল ছাড়া কোথায় যাবো আর!”
“মনে তো হচ্ছে মেয়ে পাগল করতে যাচ্ছেন”
“কেন তুমি পাগল হলে নাকি? ”
পাখির চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে ভাব।
“আমি তো মাত্র ঠোঁট নেড়েই বললাম তাতেই বুঝলো,কি কান রে বাবা!”
“বেশি না ভেবে চুপচাপ শুয়ে থাকো।কোন প্রকার কোন প্রয়োজন পরলে ইকরাকে ডাকবে।মনে থাকবে?”-শান পাখির মাথায় হাত রেখে বলে।

নিজের মাথায় কারো ভরসার হাত অনূভব হচ্ছে পাখির।প্রশান্তিতে যেন বুক ভরে উঠছে তার!
“সব পুরুষ মানুষ এক না”-আনমনে ভেবেই মুখে হাসির রেশ ফুটিয়ে তোলে পাখি।
“টেইক কেয়ার।তারাতারি আসার চেষ্টা করব”-বলেই ফট করে পাখির বাম গালে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু খেয়ে দ্রুত ঘর ছাড়ে শান।
এদিকে কি থেকে কি হলো পাখির ভাবতে কিছু সময় লাগল।গালে হাত দিয়ে হা করে অবাক চোখে দরজার দিকে চেয়ে আছে।

আসক্তি পর্ব ১০