উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১২

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১২
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

অফিস যাওয়ার পূর্বে ভারি অবাক হলো শামীম। সাথে মিষ্টি ভালোলাগার পরিমাণ ছিল প্রকট। দীর্ঘ সময় গোসলে ব্যয় করে বের হলো। তার ড্রেসের সাথে নতুন একটি শুভ্র রঙা শার্ট। রংটা তার বরাবরই পছন্দের তালিকায় প্রথম। শার্টে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো উষার দিকে।
প্রত্যুত্তরে উষার মিষ্টি হাসি। তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“ভালোলেগেছে?”
তার চোখেমুখে প্রবল আগ্রহ, উৎফুল্ল মেজাজ। তা লক্ষ করেই অমায়িক হাসলো শামীম। প্রিয়দের কাছ থেকে গিফট পেতে কার না ভালোলাগে? কবে কিনলো, কোথা থেকে কিনলো, এসব কিছুই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলোনা।
নিঃশব্দে গায়ে জড়িয়ে নিলো। উষা ফের জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“বললেন না যে, কেমন লেগেছে? পছন্দ হয়েছে আপনার?”
-“ভীষণ।”
শামীমের এই ছোট্ট জবাবে চোখেমুখে খুশি ঝিলিমিলি করে উঠলো। বোতাম থেকে শামীমের হাত সরিয়ে তার চিকন দুটো হাত জায়গা করে নিলো। একটি একটি করে সবগুলো বোতাম বেশ যত্নসহকারে মিলিয়ে দিলো। সম্পুর্ন একবার পরখ করে বলল,

-“আজ ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।”
শামীম দুষ্টুমিষ্টি হেসে জবাব দিলো,
-“আমি জানি, অনেকের দৃষ্টিতে আমি দেখতে ভীষণ নজরকাড়া।”
সঙ্গে সঙ্গেই উষা ঠোঁট বাঁকালো।
-“ইশ! নিজেই নিজের কত প্রশংসা করেছে। নির্ঘাত আমার পছন্দে কেনা শার্ট পরেছেন বিধায় একটু ভালো দেখাচ্ছে। নতুবা আমি ছাড়া কোন মেয়ে আসতো আপনার কাছে? তাছাড়া খুব আনরোমান্টিক পারসন আপনি। গতকাল কী মেসেজ পাঠালেন?”

শামীম হাসছে। শব্দহীন হাসি। উষাকে অপ্রতিভ করে তোলার কঠিন উদ্দেশ্যে নেমে পড়লো। দূরত্ব কমিয়ে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করলো। উষার সান্নিধ্যে এসে কানের পাশের একগাছি চুল সরিয়ে গভীর, ঘোরলাগা গলায় বলল,
-“আমি কতটা রোমান্টিক, সেটা তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ বলতে পারবেনা।”
মৃদু লজ্জায় আড়ষ্ট উষা সরতে গিয়েও বাঁধা পড়লো। আলতো চুম্বন পড়লো কানের একটুখানি নিচে। নিচুস্বরে ফের জবাব,

-“আমি ছাড়া এই জে*দ কেউ সহ্য করবেনা।”
উষা ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
-“দেখা যাবে, আজ থেকে শামীম নামের সফটওয়্যার ডিলিট।”
ঠোঁট বাঁকিয়ে শব্দহীন হেসে শামীম বলল,

-“সমস্যা নেই, একটু পরই শামীম নামক সফটওয়্যার লোডিং হবে। ইন্সটল ও দেবেন মিসেস উষা।”
-“আমার আর খেয়ে-পরে কাজ নেই।”
-“আমি ছাড়া সব কাজ বাদ।”
-“যান তো, লেইট হলে আমার দো*ষ পড়বে।”

উষাকে ছেড়ে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো শামীম।
ক্লাস না থাকায় বাসায় থাকতে হলো উষাকে। রিয়া ক্লাসের তাড়া দিয়েই বাসা থেকে বেরিয়েছিল। আপাতত বাসায় লিলি, নাসিমা বেগম আর উষা ছাড়া কেউ নেই।

রান্নাবান্না, সংসারের কোন কাজেই নাসিমা বেগমের ধ্যান নেই। সর্বদা গম্ভীর হয়ে থাকছেন। মুখে সেই পূর্বের হাসির ছটা আর দেখা যায়না। অথচ আগে এই বাসায় উষা আসলেই নাসিমা বেগম একগাল হেসে তাকে জড়িয়ে ধরতেন। মামনী, মামনী বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলতেন। উষা কি ভেবেছিল সেই মায়াময়ী নারীর পেছনের রূপ এমন কুৎ*সিত হতে পারে? যে যতটা করবে, ততটা ফল উপরওয়ালার কাছ থেকে ভো*গ করতে হবে। রাহাত মায়ের সাথে কথা বলেনা। আর নাসিমা বেগম নিজেই শামীমকে এড়িয়ে চলেন। তিনি মনে করেন শামীমের প্রতি*বাদের পেছনে উষা কলকাঠি নাড়ছে।

নাসিমা বেগম যেহেতু রান্নাঘরে আসেননা,উষা নিজ থেকেই রান্না করে। প্রতিদিন খাবারের স্বাদ একইরকম ভালো হয়না সে বুঝতে পারে। তবে কারো কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই শুনতে হয়নি। দুদিন আগেই একটা তরকারিতে লবণ বেশি হয়েছিলো। রিয়া খেয়েই বলেছিল,

-“একটুখানি লবণ বেশি হয়েছে।”
খাবার প্লেটে হাত চালাতে চালাতেই শামীম গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,
-“সমস্যা নেই, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
ব্যস, আর কোন কথা হয়নি। রিয়ার কথায় যতটা অপরাধবোধ কাজ করছিল, শামীমের কথায় তারচেয়ে বেশি ভালোলাগলো উষার। কি সুন্দর তাকে সাপোর্ট দিলো। অথচ আমরা কারো কাজ ভালো না লাগলে তাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা না দিয়েই বলি ‘তোমাকে দিয়ে হবেনা’।

রান্নাঘরে কা*টা*কু*টি করার মাঝেই লিলির আগমন। দুজনের মধ্যে কোনরূপ বাক্য ব্যয় হলোনা। উষাকে কা*টা*কু*টি করতে দেখে ভাতের পানি সে নিজেই বসিয়ে দিলো। নিরবে কাজ চললো। রান্না প্রায় শেষের দিকে। চুলা থেকে ভাতের পাতিল নামাতে গিয়ে অসাবধানতায় লিলির হাত থেকে পাতিল পড়ে গেল। ভাত আর মাড় ছিটকে পড়লো চারদিকে। এর অনেকটা অংশ উষার পায়ের উপর পড়তেই লাফিয়ে উঠলো সে। পায়ের পাতা ভীষণ জ্বা*লা করতেই দ্রুত পায়ে পানি ডাললো। উত্তপ্ত ভাতের তাপে বেশ ভালোভাবেই লাল হয়ে উঠলো পায়ের পাতা।

বিষয়টি লিলির অনিচ্ছাকৃত ঘটলেও এমন অপ্রত্যাশিত অ*প*রা*ধে তার কোন অনুশোচনা নেই। যেন এমন কিছুতে তার মনটা বিশাল বড় তৃপ্তি পেলো। ঊর্মিকে কিছু করতে না পেরে উষাকে দিয়েই ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালো’।
সবকিছু ওভাবে রেখেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো উষা। ঘর থেকে টুথপেষ্ট খুঁজে পায়ে প্রলেপ লাগিয়ে নিলো। তবুও যেন জ্বা*লা কমছে না। তাই তীব্র ঝাঁকুনি দেওয়া ঠান্ডার মধ্যেই ফ্যান চালু করে দিলো। শরীরে ঠান্ডা অনুভূত হতেই ফ্যান বন্ধ করে চোখ বুজে রইলো।

ঘন্টাখানেক সময় ওভাবেই স্থির পড়ে রইলো। অতঃপর গোসল শেষে নামায শেষ দিয়েই খাবার টেবিলে আসলো। সবকিছু গোছানো। বাকি রান্না লিলি নিজেই করে নিয়েছে। চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠলেও পায়ের ব্যাপারে লিলিকে কোনরূপ প্রশ্ন করলোনা উষা।

বহুদিন পর অভিলষণীয় মানুষটির সঙ্গে দেখা হলো রিয়ার। নিত্যদিনের ফোনালাপ, টুকটাক বার্তা আদান-প্রদান করেই কাটিয়ে দিতো প্রেমময় মুহূর্ত। দু’বছরের সম্পর্ক তাদের। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে বেশ কয়েকবার। তানভীরের সাথে দেখা করে বাড়ির পথে রওনা হতেই কারো অবয়ব দেখে থেমে গেলো। আরেকটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করতেই স্পষ্ট হলো বলিষ্ঠ শরীর আর মুখের গঠন। রাহাতকেই দেখা যাচ্ছে কোর্টের বাহিরে। বারবার হাত ঘড়ি চেইক করাটাই জানান দিচ্ছে সে কারো অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এখানে তার কাজ কী থাকতে পারে? কোনভাবে ভাবির সাথে সম্পৃক্ত নয়তো?
পাশে তানভীর থাকায় আর এগিয়ে যেতে পারলোনা। দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।

বিকেলেই বাড়ি ফিরলো রাহাত। চৌকাঠ মাড়িয়ে ঘরের পথে পা রাখতেই পেছন থেকে ডাক পড়লো। থামতে হলো তাকে। এভাবে উষা তাকে ডেকেছে ভেবে ভারি আশ্চর্য হলো রাহাত। পুড়ে যাওয়া পা নিয়ে রাহাতের মুখোমুখি হয়ে উষা বলল,

-“আজ না*লি*শ করতে এসেছি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে।”
রাহাত উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো। পুড়ে যাওয়া পায়ের দিকে ইশারা করলো উষা। ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাহাত।
-“পা পুড়লো কিভাবে?”
উষার নির্লিপ্ত জবাব,

-“আপনার স্ত্রীর হাত থেকে পাতিল পড়েই আমার পায়ের এই অবস্থা। তবে উনাকে দেখে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছেন তিনি। তাই আপনাকে একটা ব্যাপারে সাব*ধান করতে এসেছি। পরেরবার আমিও এমন পু*ড়ি*য়ে দিতে পারি। তখন যেন প্রতি*বাদী হতে না দেখি আপনাকে।”
তপ্ত শ্বাস ছা*ড়*লো রাহাত। উষাকে আশ্বস্ত করে বলল,

-“ঠিক আছে, তুমি সাবধানে চলাফেরা কর। আমি দেখছি লিলির ব্যাপারটা।”
ঘরে ঢুকে বেশ শব্দ করেই ফোন, ওয়ালেট ছুঁ*ড়ে মা*র*লো রাহাত। নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন চালাচ্ছিলো লিলি। ওয়ালেট এসে তার হাতের উপর পড়লো। মুহূর্তেই তেতে উঠলো সে।
-“সমস্যা কী আপনার?”

এমনিতেই মেজাজ গরম ছিলো রাহাতের। লিলিকে প্রশ্নবিদ্ধ হতেই হতো। তার উপর সে উচ্চস্বরে কথা বলছে। দ্বিগুণ রা*গ নিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলো রাহাত। হিং*স্রতা ঢেলে বলল,
-“এই মেয়ে সমস্যা কী তোমার? বিনা অনুমতিতে আমার লাইফে ঢুকে পড়েছো। এখন আবার উষার সাথে, উষার সাথে কী শ*ত্রু*তা তোমার?”

রা*গে থরথর করে শরীর কেঁপে উঠলো লিলির। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-“দরদ লাগছে প্রাক্তন শা*লীর জন্য, না? আর আমার লাইফটা যে ন*ষ্ট করছিস তোরা মা – ছেলে মিলে। তাতে কিছুই যায় আসেনা, তাইনা?”
তুই-তুকারি করায় মাথায় র*ক্ত চড়ে গেল। মাথার রগগুলো দপদপ করে উঠলো। লিলির হাতের মুঠো বেশ শক্ত করেই মু*চ*ড়ে ধরে ঘর থেকে বের করে দিলো। দরজা লাগানোর পূর্বে একবার শাসিয়ে বলল,

-“এই ঘর তোর জন্য নয়। আজ ঘর থেকে বের করেছি, কিছুদিন পর আমার লাইফ থেকে ছুঁ*ড়ে ফেলবো। সব বন্দোবস্ত করাই আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
মুখের উপর দরজা পড়লো বেশ শব্দ করেই। লিলি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। বুঝতে পারলো সুখের খোঁজে পা বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার পা*প করে ফে*ল*লো। খুব বড় পা*প।

শীতের রাতে কম্বলের নিচে ছাড়া কোথাও যেন একফোঁটা শান্তি নেই।
শামীম ফ্রেশ হয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো। পা লাগলো উষার পুড়ে যাওয়া পায়ে। সাথে সাথেই মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে উঠলো উষা।
-“আহ্!”
শামীম বোকার মতো চেয়ে থেকে বলল,
-“কী হলো?”
-“কিছুনা।”

পায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে দেখলো শামীম। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
-“পায়ের এই অবস্থা কেন?”
-“ভাতের পাতিল ছিটকে প*ড়ে*ছে।”
-“কিভাবে কাজ করো? তাছাড়া তোমাকে একাহাতে সব করতে কে বলে? স্টু*পি*ড কোথাকার। পায়ে কি দিয়েছো?”
-“টুথপেষ্ট।”

শামীম উঠে পড়লো। রিয়ার ঘর থেকে মলম হাতে প্রবেশ করলো। আলতো হাতে যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিতে দিতেই বেশ বকা*বকি করলো উষাকে।
উষা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

-“পা না পুড়লে কি আপনি এত যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিতেন?”
মলম লাগানো শেষ করেই শান্ত চোখে তাকালো শামীম। বলল,
-“এমনিতে আমি তোমার যত্ন নিই না?”
-“নাহ্, সেটা বলিনি। এখন তো এক্সট্রা যত্ন পাচ্ছি।”
উষাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে একহাত বাড়িয়ে দিলো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বলল,

-“এত কাজ করতে হবেনা তোমায়। যার যতটুকু কাজ, সে ততটুকু করবে। পূণরায় এমন ভুল*ভাল কাজ করলে ঘর থেকে বের করে দেবো। তখন রিয়ার সাথে থাকবে তুমি?”
প্রতিবাদ করে উঠলো উষা।
-“ইশ! শখ দেখে বাঁচিনা। কার ঘর থেকে বের করবেন? এই ঘরের মালিক এখন আমি। বাইরে গিয়ে ভাব দেখাবেন।”
চোখ ছোট করে ফে*ল*লো শামীম। পরক্ষণেই বলল,
-“ঘর কেন? ঘরের রাজাও আপনার। এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।”

রাহাত এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। এতদিন ঊর্মির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেও, আজ সাহস নিয়ে বাড়িতেই ঢুকে পড়লো। যেই-সেই দাবি নয়, একেবারে নিজের বউ নিয়ে যাওয়ার দাবি নিয়ে প্রবেশ করলো। মোস্তফা সাহেবের চেহারা রক্তিম হয়ে উঠলো। এটা কি কোন ছেলেখেলা নাকি? যে বউ নিয়ে যাবো বললেই হলো।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১১

(গত পর্বে রাহাতের জায়গা আমি শামীম ব্যবহার করেছি। শুধু গত পর্বে নয়, ২-৩ টি পর্বে এমন হয়েছে। গ্রুপ থেকে শুধরে নিলেও পেইজে চলে যাওয়া পর্ব ঠিক করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তার জন্য দুঃখিত।
অনেকেই বলেন পুরোদিন পার করে এইটুকু লিখি। আমি সারাদিনই ব্যস্ত থাকি। সন্ধ্যার পর আবার টিউশন। তারপরই লিখতে বসি। এরচেয়ে বেশি লিখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। হ্যাপি রিডিং।)

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৩