প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৩

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৩
Writer Mahfuza Akter

প্রহর গাড়ির গতি ক্রমেই কমিয়ে আনল। নীরবে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। এই মুহূর্তে মাথায় অনেক কিছু ঘুরঘুর করছে ওর। অর্থীর এই সময়ে কল করাটা অস্বাভাবিক ঠেকছে। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-কে কল করেছে? অমন মুখ করে তাকিয়ে আছিস যে!
সৌহার্দ্যের প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো প্রহর। ইতোমধ্যে ফোনের রিংটোন বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে কলটা কেটে গেছে।

প্রহর ঠোঁট গোল করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আঙুল চালিয়ে দ্রুত ফোনটা সাইলেন্ট করে পকেটে পুরে নিলো যেন ফোনটা পুনরায় বেজে না ওঠে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে এক পলক তাকালো প্রহর। সৌহার্দ্য এখনো একইভাবে তাকিয়ে আছে। প্রহর কপট হাসার চেষ্টা করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তেমন দরকারি কোনো ফোনকল ছিলো না। বাসায় পৌঁছে কথা বলে নেবো আমি।
সৌহার্দ্য নির্বিকার ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
-সামনের স্টল থেকে প্রণয়ীর জন্য চকোলেট কিনতে হবে। গাড়ি দাঁড় করাস।

বাকিটা সময় নীরবতায় কাটলো। প্রহর নীরবে ড্রাইভিং-এ মনোনিবেশ করলো আর সৌহার্দ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে দৃষ্টি মেলে দিলো। যেই দু’টি হৃদয় বন্ধুত্ব নামক গভীর বন্ধনে বাঁধা ছিল, তারা আজ দুই প্রান্তে নিজ নিজ শোকতপ্ত মনের সান্ত্বনা খোঁজায় ব্যস্ত। সেই পুরনো হাসাহাসি, মারামারি ও গালাগালি আজ তাদের টানে না। পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে মন সায় দেয় না। দুজনেই সুনশান নীরবতায় প্রিয় ব্যক্তির অনুপস্থিতি অনুভব করে।
বাড়ি পৌঁছাতেই প্রণয়-প্রণয়ী ছুটে এলো প্রহরের দিকে। প্রণয়ী এক ছুটে প্রহরের কোলে ওঠে গেল। প্রহর ওর গালে চুমু দিয়ে বললো,

-আজকে এতো এক্সাইটেড কেন লাগছে আপনাকে?
প্রণয়ী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
-আজকে আমার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি পুরো ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি।
সৌহার্দ্য প্রসন্নের হাসি দিয়ে প্রণয়ীর মাথায় চুমু দিলো। প্রণয় কোমরে দুই হাত রেখে চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখ ফুলিয়ে বললো,

-এখন সব আদর শুধু প্রণয়ীর জন্য? আমাকে সত্যিই কেউ ভালোবাসে না।
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে প্রণয়ের কান চেপে ধরে বললো,
-আগে আপনার রেজাল্ট বলুন! তারপর আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসার কথা ভাবা যাবে।
প্রণয় ঠোঁট উল্টে বললো,
-আমিও ভালোই করেছি। কিন্তু প্রণয়ীর মতো এতো ভালো না।
প্রণয়ী খিলখিল করে হেসে বললো,

-সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ালে রেজাল্ট ভালো হবে কীভাবে? আবার আমাকে আসে গাধী বলতে! হুহ্!!
প্রণয় রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-তুই তো গাধীই! ফার্স্ট হলেই গাধী থেকে মানুষ হয়ে যায় নাকি কেউ? এ্যাহহহ!
প্রণয়ী তেড়ে এসে কিছু বলতে যাবে ওমনি প্রহর ওকে আবার কোলে তুলে নিয়ে বললো,

-এখন দুজনের ঝগড়াঝাটি আর চুল ছেঁড়া-ছেঁড়ি বন্ধ! চলো, দু’জনের জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছি আমরা।
প্রণয়-প্রণয়ীর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে প্রহর নিজের ঘরে চলে এলো। মন যতই ভারাক্রান্ত থাকুক না কেন? বুকের ভেতর হাজারো বেদনারা সমস্বরে কোলাহল তুলুক না কেন? এখানে এই দু’টো বাচ্চার নিষ্পাপ মুখ দু’টো দেখলেই ভেতরে অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে প্রহর। হয়তো এই শীতল শান্তির মাধ্যমেই সৌহার্দ্য এদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। নয়তো এভাবে একা বাঁচতে পারে নাকি কেউ? প্রতিটা মুহুর্তেই তো দম বন্ধ হয়ে আসার কথা!

ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে নিজের ভেতরে থাকা দীর্ঘশ্বাস গুলো বের করলো প্রহর। বারান্দায় রাখা দোলনায় বসতেই মধুর কথা মনে পড়লো। এই ঘরটাও মধুর ছিল। কিন্তু প্রহর এখন এই ঘরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও কোনোকিছুতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। এখানে এলে নিজের প্রতিটা নিঃশ্বাসে মধুর অস্তিত্ব অনুভব করে সে। ভালোবাসার অনুভূতি আসলেই অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর।

পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা জ্বালাতেই ফোনের কথা মাথায় এলো প্রহরের। দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, অর্থী নয়বার কল করেছে। এই মেয়েটা বরাবরই এমন। কল রিসিভ না করলে বারবার কল দিতেই থাকে। প্রহর শান্ত হয়ে বসে কল ব্যাক করলো। একবার রিং হতেই অর্থীর গলা শোনা গেল,
-কাজের সময় কোথায় থাকো তুমি? এতোবার কেন কল দেওয়া লাগে?
প্রহর গলা ঝেড়ে বললো,

-কী বলবি তাড়াতাড়ি বল! কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? এই সময়ে তো কখনো কল দিতে দেখি না আমি!
-আসলে কালকের ফ্লাইটে আমি বিডিতে ব্যাক করছি।
প্রহর অবাক হলো। বললো,
-হঠাৎ! কেন? দুই মাস আগেই তো ঘুরে গেলি! আবার কী হলো?
অর্থী হাসার চেষ্টা করে বললো,
-পার্সোনাল কাজে না, প্রফেশনালি আসছি এবার। হসপিটাল থেকে ডক্টরদের টিম আসছে। তাদের সাথে আমিও আসছি। তোমাদের বাড়িতেও উঠবো না, সবার সাথে হোটেলে উঠবো।
প্রহর বিরস কন্ঠে বললো,

-অহ্ আচ্ছা! এসে জানাস আমাকে। এয়ারপোর্টে দেখা করতে যাবো না-হয়!
অর্থী কিছু একটা চিন্তা করতে করতে বললো,
-আচ্ছা, রাখি তাহলে!
-ঠিক আছে।

অরিত্রী বেশ প্রফুল্ল মনে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে। অর্থী সবটা বেশ মনযোগ দিয়ে খেয়াল করছে। দরকারী জিনিস পত্র গোছানোর পর অর্থী বললো,
-এতো কম কাপড় নিয়েছিস কেন?
অরিত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
-এগুলো কম? এক মাসের জন্য এর থেকে বেশি কাপড়চোপড় লাগবে বলে মনে হয় না।
অর্থী বিরক্ত হয়ে বললো,

-আরেহ্, গাধা! যা যা দরকার সবই নিয়ে নে। এখানে আর আসা হবে না তোর।
অরিত্রী ভ্রু কুঁচকালো। অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-আসা হবে না মানে?
অর্থী হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,
-মানে বলতে চাচ্ছিলাম যে, বাংলাদেশ তো বারবার যাওয়া হবে না! এবারই হয়তো শেষ বার তোর জন্য। তাই ভালোমতো গোছগাছ করে নিলে ভালো।
অরিত্রী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। বললো,

-ঠিকই বলেছো তুমি। কিন্তু এবার যদি বাবা, মা আর অর্ণব ভাইয়ের চোখে ধুলো দিতে সাকসেসফুল হই, তাহলে আমি আবারও যাবো। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। বুঝলে?
অর্থী হেসে বললো,

-বুঝেছি, ম্যাডাম! এবার চলুন। হসপিটালে সবাই আমাদের জন্য ওয়েট করছে।
অরিত্রী লাগেজ গুছিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অর্ণব প্রায়ই অরিত্রীদের বাসায় এসে দেখা করে যায়। আজকেও এসেছে। যেহেতু মোহনা আর মিস্টার আফনাদ বাসায় নেই, তাই অরিত্রীর খোঁজখবর ওকেই রাখতে হবে। কয়েক মিনিটের মাথায় অর্ণবের গাড়িকে বেরিয়ে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তারা। এরপর অর্থী আর অরিত্রী একসাথে বেরিয়ে গেল।

প্রণয়-প্রণয়ীকে স্কুলে দিয়ে আসায় সৌহার্দ্যের হসপিটালে পৌছাতে বেশ দেরী হয়ে গেল। প্রতিদিনের মতো আজ আর ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে গেল না সে। এপয়েন্টমেন্ট লিস্টটা চেক করতে গিয়ে দেখলো, সেটা ফাঁকা। সৌহার্দ্যের ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল। তার মানে আজকের শিডিউলে কারো কোনো এপয়েন্টমেন্ট নেই? এমনটা তো কখনো হয় না!
সৌহার্দ্য পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,

-স্যার, আজকে আপনার হসপিটালে কোনো ডিউটি নেই। কানাডা থেকে ডক্টরদের টিম আসছে আজ। বেশ বড়মাপের ডাক্তার তারা। আপনাকে আর ডক্টর শাহেদকে ওনাদের রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যেতে বলা হয়েছে।
সৌহার্দ্যের কাছে বেশ অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা। ডক্টর আসবে ভালো কথা! তাই বলে সে কেন যাবে ওদের রিসিভ করতে? সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে সিনিয়র ডক্টরকে কল করলো। অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল,

-ইয়েস! সৌহার্দ্য, মাই বয়! এনি প্রব্লেম?
-স্যার, আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার আগে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত ছিল। আমি তো….
-সৌহার্দ্য, লিসেন! আমি যা করেছি, ভেবেচিন্তে করেছি। তুমি একবার এয়ারপোর্টে গিয়ে সেখান থেকে ডিরেক্ট তোমার বাসায় চলে যেতে পারবে। এতে তোমার ছেলেমেয়েদের আজ সারাদিন সময় দিতে পারবে। ডক্টররা তো ছুটি পায় না বললেই চলে! বাট ইয়র চিলড্রেন নিড ইউ, এটা তো মাথায় রাখতে হবে, তাই না? সব দিক কনসিডার করে ভাবলাম, তোমাকে এই ছোট টাস্ক-টা দিয়ে আজকের মতো ডিউটি শেষ করিয়ে দেই।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫২

সৌহার্দ্যের মাথায় এই ব্যাপারটা আসেনি। তবে আইডিয়া বেশ ভালো লেগেছে ওর। তাই আর কালক্ষেপ না করে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। ডক্টর শাহেদকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। রাস্তায় তেমন জ্যামজট না থাকায় তারা বেশ তাড়াতাড়ি-ই পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকাতেই সৌহার্দ্য চমকে গেল। এমন কিছুর জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না হয়তো!…

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৫৪