প্রেয়সী পর্ব ৭৪
নন্দিনী নীলা
মধুর ডেলিভারি ডেইট আরো পনেরো দিন পর কিন্তু মধু গতকাল থেকে বেবির রেসপন্স পাচ্ছে না। সবাই চিন্তিত হয়ে আছে মধু বাম কাত হয়ে শুয়ে আছে কিন্তু তবুও কাজ হচ্ছে না। ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। নাফিসা বেগম অনেক দিন পর মধুর সাথে কথা বললেন আজ।
তিনি এসে মধুর কাছে থেকে সব শুনছে। আনিতা বেগম ও পাশে বসে আছে এটা ওটা বলছে। মধু রেসপন্স তাও পাচ্ছে না। ফুয়াদ বাসায় নাই ও ভয়ে কান্না করে দিছে।
নাফিসা বেগম ওকে কান্না করতে দেখে বলল,,” একি কাঁদছো কেন? একেক সময় এমন হয় বাবুর কিছু হয়নি কেঁদো না।”
মধু ফুয়াদের নাম্বারে কল করে কান্না গলায় বলল,,” আপনি কোথায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কি হয়েছে কাঁদছো কেন?”
” আপনি এখনি বাসায় আসেন। আমাদের হসপিটালে যাওয়া লাগবে। বাবু নড়াচড়া করছে না আমার ভয় করছে।”
” আম্মু কোথায়?”
” এখানেই বসে আছে আমার সাথে।”
” আম্মুর কাছে দাও।”
মধু ফোন নাফিসা বেগমের হাতে দিল। নাফিসা বেগম ফোন কানে ধরলে ফুয়াদ বলল,,” আম্মু তুমি মধু কে নিয়ে হসপিটালে যাও। আমার আসতে একটু লেট লাগবে।”
” আচ্ছা।” বলেই নাফিসা বেগম ফোন রেখে মধু কে বলল,,” তুমি রেডি হও আমরা হসপিটালে যাব।”
নাফিসা বেগম নিজের রুমে গেল রেডি হতে। আনিতা বেগম ধরে মধুকে সিঁড়ি বেয়ে নামালো। নাফিসা বেগম একাই মধু কে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আনিতা বেগম বাসায় রইল। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। মধু গাড়ি বসে ফ্যাচফ্যাচ করে শুধু কান্না করেছে আর নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে,” বাবু ঠিক আছে তো?’
নাফিসা বেগম ওকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বলেছে। কিন্তু মধু শান্ত হতে পারছে না। কাঁদছে আর পানি খেয়ে বোতল খালি করছে। হসপিটালে এসে মধুকে ডক্টরের চেম্বারে নেওয়া হলো তিনি নার্সের সাহায্যে মধুকে বেডে শুইয়ে দিল তারপর ওকে অক্সিজেন মাস্ক পরে বাম কাত হয়ে শুয়ে বেবি রেসপন্স করে নাকি দেখতে বলল।
মধু কে কাঁদতে মানা করে ডক্টর শান্ত হয়ে বেবি নড়াচড়া করে নাকি চেক করতে বলল। মধু দশ মিনিট শান্ত হয়ে শুয়ে থেকে উঠে বসে বলল,,”আমি ওর রেসপন্স পাচ্ছি না।”
ডক্টর মহিলা টা অনেক ভালো মধুর ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,,” দেখেছেন আপনার ছেলের বউ ভয়ে মুখটা শুকিয়ে ফেলেছে। এইটুকু মেয়ে অথচ সন্তানের জন্য কত টেনশন।”
নার্স কে ডেকে ডক্টর বললেন মধুকে আলট্রা রুমে নিয়ে যেতে। আলট্রা করে এসে মধু আর নাফিসা বেগম কডিটরে বসে আছে। রিপোর্ট আসার মধ্যে মধু অনেকবার ফুয়াদ কে কল দিল কিন্তু সুইচ অফ বলছে।
ডক্টর রিপোর্ট দেখে বলল,, ” আমাদের এখনি সিজার করতে হবে। আপনারা কি প্রস্তুত? উনার হাজব্যান্ড কই?”
নাফিসা বেগম তেমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। ফোন দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিল। ফুয়াদ কে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। মধু চিন্তিত মুখে বসে আছে ফুয়াদ গেল কোথায়? সে সব জানার পর ও কেন আসছে না।
রাগে অভিমানে ওর কান্না পাচ্ছে শুধু।
রাজিব খান হসপিটালে এসে সিদ্ধান্ত নিল। ফুয়াদ কে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না তাই তাকে ছাড়াই ডিসিশন নিল। মধু অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করার আগে শুধু পাগলের মতো ফুয়াদের আশায় চেয়ে রইল। ভয় পাচ্ছিল খুব ফুয়াদ কে আর দেখতে পারব তো? এমন একটা সময় এ ও ফুয়াদ কে পেলাম না পাশে। ওর বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। তিন্নি, রাহী আপু এসেছে। সবাই অনেক সাহস দিয়েছে ওকে নাফিসা বেগম ও ওকে অনেক সাহস দিয়েছে। ভয় পেতে মানা করেছে। শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে বলেছে। মধু ফুয়াদের অনুপস্থিতিতে সিজারের জন্য রাজি হতে চাইছিল না কিন্তু বাবুর কথা চিন্তা করেই রাজি হতে বাধ্য হতে হলো ওকে।
তিন্নি পায়চারি করছে আর ফুয়াদের নাম্বারে কল করছে। ভয়ে ওর হাত ও কাঁপছে সব যেন ঠিক ঠাক থাকে আল্লাহর কাছে এই একটা দোয়াই করছে। মধু আর বেবি দুজনেই যেন সুস্থ থাকে।
ভেতরে থেকে বেবির কান্নার আওয়াজ পেতেই সবার মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। তিন্নি লাফ দিয়ে রাহীর হাত ধরে বলল,,” আপু বেবি কাঁদছে।ইশ এই সুন্দর মুহূর্তে ফুয়াদ ভাইয়া নাই।”
সাদা তোয়ালে করে যখন বেবিকে পেঁচিয়ে বের করে আনল সবার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। কে কোলে নেবে আগে সেই নিয়ে কাড়াকাড়ি পরে গেল। কিন্তু কেউ নিতে পারল না ফুয়াদ কোথা থেকে ছুটে এসে সবাইকে থামিয়ে নিজে কোলে তুলে নিল।
নার্স বলল,,” অভিনন্দন আপনি একটা পুতুল মেয়ের বাবা হয়েছেন।
ফুয়াদের হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। ছোটো পুতুলের মতো বাচ্চা টা ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে অশ্রু তে ভরে উঠেছে। এই টুকু বাচ্চা কে কোলে রাখতে ওর হাত কাঁপছে। ফুয়াদ পাগলের মতো চুমু খেল মেয়েকে।
ফুয়াদ নার্সের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,,”মধু কেমন আছে?”
” দুজনেই সুস্থ আছে। তখন তো ডক্টর ভয় পেয়ে গেছিল কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেবি একদম সুস্থ আছে। কিন্তু ওজন কম।”
ফুয়াদ বেবিকে নিয়ে মায়ের কাছে গেল তারপর মায়ের কোলে দিয়ে বলল,,” আম্মু দেখো আমার মেয়ে, আমার রাজকন্যা। আমার মা।”
নাফিসা বেগম ও বুকে জড়িয়ে নিল নাতনিকে।
তারপর তিন্নি ও রাহী কোলে নিল। ফুয়াদ নাফিসা বেগমের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নাফিসা বেগম ধমকের স্বরে বললেন,,”কোন আক্কেল জ্ঞান নেই তোমার? মেয়েটা অটির রুমে ঢোকার আগে পাগলের মতো তোমাকে খোঁজেছে। ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছিলে।”
“সরি মা আসলে তখন ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছিল। রাস্তায় জ্যামে পড়েছিলাম তাই আসতে লেট হয়েছে।”
নাফিসা বেগম কিছুই বললেন না। শুধু রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
ফুয়াদ মধুর বের হবার অপেক্ষায় রইল। মধু কে কেবিনে রেখে আসলো মধুর জ্ঞান নাই। ফুয়াদ মধুর পাশেই বসে আছে। রক্তের পরিমাণ কম থাকলেও সিজারে নতুন করে রক্তের প্রয়োজন পরে নি মধুর। আল্লাহর রহমতে সব কিছু নির্ভেজাল ভাবেই কেটে গেছে। মধুর সেলাইন চলছে। বেবিকে কোলে নিয়ে বসে আছে নাফিসা বেগম। ফুয়াদের বাবা রাজিব খান নাতনির প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনতে গেছে। রাহীর হাজব্যান্ড এলো এক গাদা বাবুর পোশাক নিয়ে। তিন্নি ফুপি হবার আনন্দে ফেসবুকে পোস্ট করে দিল ছবি। মধুর বাবা মাকে খবর জানিয়ে দিল ফুয়াদ তারা আনন্দে তখনি রওনা হয়ে গেছে।
মধুর যখন জ্ঞান ফিরল দেখল ফুয়াদ ওর পাশেই বসে আছে। মধু জ্ঞান ফিরতেই বলল,,” আমার মেয়ে কই?”
ফুয়াদ বলল,,” মায়ের কাছে। তুমি কেমন আছো?”
মধু মুখ ঘুরিয়ে নিল। তিন্নি আসলো বাবুকে নিয়ে মধু মেয়েকে চুমু খেয়ে নিল।
হসপিটালে একে একে সবাই এসে ভীড় জমালো মধু সবার সাথেই কথা বলছে কিন্তু ফুয়াদের সাথে কথা বলছে না। ফুয়াদ সবার সামনে অভিমানী মধুর অভিমান ও ভাঙাতে পারছে না। মধু ওকে পাত্তাই দিচ্ছে। বারো ঘন্টা পর মধুকে স্যুপ এনে খাওয়ালো ফুয়াদ মধু যন্ত্রের মতো খেয়ে নিল কিন্তু কথা বলেনি।
তিনদিন পর মধু কে নিয়ে বাসায় আসলো।এই তিনদিন ফুয়াদ হসপিটালে ছিল।
মধু আর ফুয়াদের মান অভিমানের পাল্লা চলল আরো দুইদিন তারপর মধুর মন গলল। আর নরম হওয়ার পেছনে আসল কারণ হলো ফুয়াদের পিঠে একটা কাঁটা দাগ।
মধু সেটা দেখেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,,”আপনার পিঠে আঘাত পেলেন কি করে?”
ফুয়াদ এটা লুকাতেই ড্রেস মধুর সামনে চেঞ্জ করত না সেই ভয় টাই সঠিক হলো। মধুর চোখে পড়েই গেল।
ফুয়াদ সেদিন সে মিশনে গিয়েছিল সেখানেই আঘাত পেয়েছে। মধু কান্না করে দিবে ঠোঁট উল্টে তখনি ফুয়াদ বলল,,” এজন্যেই বলতে চাইনি। তোমার কান্না করা বারণ জানো না?”
মধু ফুয়াদের গালে হাত দিয়ে বলল,,” কতটা লেগেছে আপনি এসব কাজ বাদ দিন তো। এখন আপনার মেয়ে আছে ওর কথা ভেবে ছেড়ে দিন। আপনার কিছু হলে আমাদের কি হবে ভাবেন তো?”
” এটা কেউ ইচ্ছা করে করিয়েছে। আমাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চায় নি।”
” এটা সমুদ্র ভাইয়া ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।”
মেয়ের কান্না শুনে ফুয়াদ মেয়েকে দোলনা থেকে কোলে তুলে নিল। দেখল মেয়ে প্রস্রাব করে সব ভিজিয়ে কাঁদছে। মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে ও একটা কথাই ভাবছে একবার যদি সমুদ্র কে সামনে পেতাম ওকে মেরে ফেলতাম আমি।
মধু আস্তে করে বিছানায় বসে রইল। ফুয়াদ মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।
এদিকে,
একটা মেয়ে প্লেনে নিজের সিটে দেখল একটা ছেলে বসে আছে।
মেয়েটা অবাক কন্ঠে বলল,,” হে ইউ, এটা আমার সিট।”
ছেলেটা চোখ বন্ধ করে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনছে এজন্য মেয়েটার কোন কথাই শুনছে না। মেয়েটি রাগে গজগজ করে ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে বসল। ছেলেটি চোখ মেলে তাকাল। দেখল একটা মেয়ে রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
” কোন সমস্যা?” ছেলেটি বলল।
মেয়েটি বলল,,” এতোক্ষণ ধরে ডাকছি শুনেছেন না যে। আর আপনি আমার সিটে বসে আছেন কেন উঠুন।”
” উপস সরি আসলে একসাথে তো সিট তাই অদলবদল করে ছিলাম।”
ছেলেটি ইচ্ছে করেই করেছিল কিন্তু মিথ্যা বলল। উঠে ছেলেটি নিজের সিটে বসল। মেয়েটি ও বসল।
ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,,” সরি কিছু মনে করবেন না।”
” তখন অনেক কিছুই রাগ হয়েছিল কিন্তু এখন আপনার মতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলের মুখ থেকে সরি শুনে রাগ চলে গেছে।”
ছেলেটি হেসে উঠল।
” আপনার নাম কি?”
” জি অরুণ চৌধুরী। আপনার?”
” আমি সোহা।”
তারপর আর দুজনের মধ্যে কথা হলো না। প্লেন চলতে শুরু করল। সোহা একটু পর পর অরুণের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু অরুণ একবার ও ওর দিকে তাকায় নি। সোহা ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল হঠাৎ অরুণের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সোহা। সোহা ঝুঁকে পড়ে অরুণের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,,” এই বেবিটা কে?”
অরুণ মিষ্টি করে হেসে তাকাল সোহার দিকে তারপর বলল,,” আমার মেয়ে।”
সোহা মুখ কালো করে বলল,,” আমি ভেবেছিলাম আপনি আন ম্যারিড। কি কিউট! একদম পিচ্চি কত দিন বেবির? নাম কি?”
অরুণ বলল,,” নাম এখনো ঠিক করিনি। ওর বয়স ছয় দিন।”
” ওহ গড তারমানে এখনো সামনাসামনি দেখেন নি।”
” নাহ দেখতেই যাচ্ছি।”
” আপনার নাম অরুণ। আপনার মেয়ের নাম অরিন রাখতে পারেন। মিলবে সুন্দর বাবা মেয়ের নাম। আপনার ওয়াইফের নাম কি?”
প্রেয়সী পর্ব ৭৩
” মেহেরিমা মধু।”
” দেখানো যাবে প্লিজ?”
অরুণ সাজের সমুদ্র মধুর একটা ছবি বের করে দেখালো। তারপর সোহা মন খারাপ করে বসে রইল।