অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৬

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৬
ইফা আমহৃদ

মাঝরাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে বুকের উপর ভারী কি অনুভব করলাম। ঘুম নামক জড়তা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। গলা ব্যাথায় শরীর যেন বড্ড ক্লান্ত। উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে মুখমণ্ডলের উপর। নিভু নিভু চোখের পাতা মেলে চাইলাম। অপ্রত্যাশিত মানুষের ন্যায় দেখে চমকে উঠলাম আমি। চিৎকার করার প্রয়াস করতেই ওষ্ঠদ্বয় গ্ৰথণ হলো পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের আড়ালে। নেত্র জোড়া বড় বড় করে চাইলাম। খুব চেনা। অতিশয় প্রিয় এই সুবাস। হৃৎপিণ্ডে ছড়িয়ে গেল মাতাল করা স্পর্শ। আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের উপর তর্জনী ঠেকিয়ে হুস করলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক বোঝালেন। বোধগম্য হলো মানুষটি রৌধিক।

আমি দ্রুত বেডের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলাম। পাশেই মিতা আন্টি ঘুমিয়ে আছে। রৌধিকের কানের কাছে মুখ এনে বিরবির করে বলি,
” আপনি, আপনি এখন এখানে কী করছেন?”
তিনি আমার কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন, “আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি। কেন, কী হয়েছে?”
কম্পন ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। বেডশিট আঁকড়ে ধরলাম দ্রুত। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম। সেকেন্ড খানিক ঝিম ধরে বসে রইলাম। ধাক্কা দিলেন তিনি। ধ্যান ভাঙল আমার। ফট করেই শুয়ে পড়লেন গা ছড়িয়ে। রৌধিককে টেনে তোলার প্রয়াস করতে করতে বললাম, “প্লীজ, উঠুন। আন্টি জেগে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“জেগে গেলে তো ভালোই হবে‌। ফাঁকা একটু স্পেশ পাওয়া যাবে। কতদিন মন খুলে একটু তোমাকে দেখা হয় না।”
“তাহলে আর কী করার, আমি যাই। তোরা মন, প্রাণ খুলে কথা বল।”
তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটল। রৌধিককে আর বলতে না দিয়ে মিতা আন্টি বললেন। আমি লজ্জানত হলাম। তিনি ফিরলেন না। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে চলে গেল। রৌধিক দাঁড়িয়ে চুমু ছুঁড়ে দিলেন।
সরে বসলাম আমি। রৌধিক আরেকটু এগিয়ে বসলেন। তার ডান হাতটা ললাটে ঠেকালেন। এপিঠ ওপিঠ করে বললেন, ” জ্বর নেই। গলা ব্যাথা করছে কী?”
“আপনি জানেন?”
“হম। আদ্রিতা বলেছে। কী দরকার ছিল, এখানের আসার। তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম দূরে থাকতে। ঝামেলা মিটে গেল নিয়ে আসতাম।”
বলেই কাঁধে মুখ গুঁজে দিলেন। নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন। চোখজোড়া গ্ৰথণ করে আরেকটু দৃঢ়ভাবে মুখ গুজলেন। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে,

“জানো, এতদিন শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। কীভাবে বাড়িটা ফিরে পাবো, বুঝতে পারছি না। এখনো কতোগুলো টাকা।”
চোখ ভিজে উঠল আমার। আমার জন্য সবাইকে বিপদে পড়তে হচ্ছে, কীভাবে বাড়ি ফিরে পাবে। আদৌও কি সম্ভব। রৌধিক ভ্রু কুঁচকালো। চোখের অশ্রুটুকু মুছিয়ে দিলেন স্বযত্নে। আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। বিনিময়ে কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। রৌধিক আমাকে শান্তনা দিচ্ছেন। আমার থামার নামই নেই। না পেরে অবশেষে ধমক দিলেন। সাথে সাথে কান্না থেমে গেল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমাকে নিয়ে বেডের উপর শুয়ে পড়লেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমিও বাচ্চাদের ন্যায় নিদ্রাচ্ছন্ন হলাম।

সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। বেলকেনিতে বসেছি আমি। অন্তরিক্ষে কালো মেঘের ভেলা। আমার সাথে মিলিয়ে তারাও মুখ ভার করে আছে। সামনেই একজোড়া চড়ুইপাখি। গাছের মগডালে বাসা বেঁধেছে। ডিমও পেরেছে। পাখিজোড়ার কতো আনন্দ অথচ আমার আনন্দ নেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। এই যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছি না। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। কারও সঙ্গে কোনো কথা হয় না। আমার সাথে কথা বলতে বারণ করেছে মৌমিতা। খাবারও ঘরে দিয়ে যায়। একা একা থাকতে আর ভালো লাগছে না। পায়ের দিকে তাকালাম। এখন হাঁটতেও কষ্ট হয়। রৌধিকের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দেহটা।

আজও সহ্য করতে হয়েছে তীব্র যন্ত্রণা। ইয়ানাত নামক মেয়েটা একদম আমাকে সহ্য করতে পারে না। যদি সম্ভব হতো আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিত। এইতো দুপুরের কথা। সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছি আমি। দরজা খুলে পার্পসে পা রাখতেই সূচালো কিছু পায়ে আঘাত করল। একটা দুটো নয়, সংখ্য অধিক। ডান পা রক্তে ভেসে গেছিল। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। ভারসাম্যহীন হয়ে বসে পড়েছিলাম মেঝেতে। অঢেল রক্ত ঝড়েছে পা থেকে। বেশ কয়েকটা পিন পায়ের সাথে গেঁথে ছিল। আমি একপায়ে ভর করে বেডের উপর গিয়ে বসলাম। পায়ে হাত স্পর্শ করতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করল কেউ। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলাম ইয়ানাতকে। পার্পোস থেকে পিন খুলে তুলে নিচ্ছে। তোলা শেষ করে আমার নিকট এসে হাঁটু মুড়ে বসল। আমাকে তোয়াক্কা না করে পা থেকে পিন খুলতে লাগল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মুখ চেপে ধরলেন। টেনে টেনে বলল,

“একদম চুপ। একটাও কথা যাতে মুখ থেকে বের না-হয়।”
পলকহীন নেত্রযুগল দ্বারা দেখল তার কাণ্ড। বাকরুদ্ধ আমি। প্রবল যাতনায় পা অবশ হয়ে গেছে। ইয়ানাত তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করল। লহমায় ফিরে চাইলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“এই ঘটনা যদি কেউ জানতে পারে, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আমি কী করতে পারি, আশাকরি তোমার জানা হয়ে গেছে।
রৌধিকের বউ হয়েছ না। এবার ভোগ কর।”
“কী করেছি আমি। কেন করছেন এমন। [অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠস্বর আমার]
“কারণ আমার বোন ছাড়া কাউকে আমি রৌধিকের পাশে দেখতে পারব না। তারজন্যই আমি শেফাকে টাকা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সরিয়ে ফেলেছি।”
“আমি তো আপনার বোনের মতোই।” আকুলতা মেশানো কণ্ঠ।
“বোন তো নয়।”

বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেলেন। আমি পায়ের হাত রেখে বসে ছিলাম।
কেন এমনটা করে ইয়ানাত। কে এই মেয়েটা। যদি তার বোন থেকেই থাকে তাহলে দেখতে কেন পাচ্ছি না। কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার গভীর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে প্রবেশ করল মিতা। আঁচল গুঁজে এসে বসলেন পাশে। মৃদু হেসে বললেন,
“কী হয়েছে জোনাকি, এত চুপচাপ কেন?”
“এমনিই আন্টি। ভালো লাগছে না। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম।”
“হ্যাঁ। বলো, কী জানতে চাও।”
অস্বস্তি দানা বাঁধল চতুর্দিক। নিশ্চয়ই মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি কষ্ট পাবেন। অধর চেপে থেমে থেমে বললাম, “আপনার কোনো মেয়ে আছে‌?”
“মেয়ে না থাকলে ইয়ানাত কে? পাগল একটা।”

“ইয়ানাত নয়। অন্য কোনো মেয়ে। ইয়ানাতের ছোট। যার জন্য ইয়ানাত আমাকে সহ্য করতে পারে না।”
লহমায় চিকচিক করে উঠল নেত্রযুগল। পলকহীন, স্থির দৃষ্টি। ওষ্ঠদ্বয়ে ঝুলে থাকা মায়া মায়া হাসিটা গায়েব হলো। গম্ভীর হলেন তিনি। জবাব দিলেন না। কাজ আছে বলে উঠতে নিলেন। আমি হাত টেনে ধরলাম। বাঁধা দিলাম গমনপথে। ব্যাকুল কণ্ঠের বললাম, “প্লীজ।”

পূর্বের ন্যায় বসলেন তিনি। বাধ্যবাধকতা মিশ্রিত হাসি। আবেগপ্রবণ হলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “ছিল এক কালে। এখন নেই। হারিয়ে গেলে। ইভু ইয়ানাতের প্রিয় ছিল। দুই ভাই বোন কাড়াকাড়ি করত, তাকে নিয়ে। মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দিত না। কতবার পড়ে ব্যাথা পেয়েছে, হিসেব নেই। পুচকির জন্য ওদের দুই ভাই বোনকে কত মে’রে’ছি, হিসেব নেই। রৌধিকের বউ করবে ঠিক করে রেখেছিল। রৌধিকও বিয়ে করতে রাজি। হুট করেই হারিয়ে গেল মেয়েটা। খুব আদরের ছিল, তাই ওর হারিয়ে যাওয়াটা ইভু ইয়ানাত সহ্য করতে পারেনি। মনে করে, ওর বোন ফিরে আসবে। তাই তোমার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করে।”
“ওহ্। কিভাবে হারিয়ে গেছে।”

তৎক্ষণাৎ ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। মুষুলধারে বৃষ্টি। লহমায় বৃষ্টির ধারা ব্যালকেনিতে এলো। আর্দ্রতা ছড়িয়ে গেল জায়গায়টা। আন্টি প্রত্যুত্তর দেওয়া কুল পেলেন না। আমাকে রেখে ছাদের দিকে ছুটলেন। অনুমানসাপেক্ষ, বৃষ্টির নিমিত্তে পিচ্ছিল হয়েছে জায়গাটা। আন্টিকে যেতে না করে আমি ছুটলাম সেদিকে। পায়ে ব্যাথায় মাটিতে পা স্পর্শ করাই দায়। তবুও দেয়াল ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছাদে পৌঁছালাম। ততক্ষণে আংশিক আর্দ্র জামা কাপড়। আমি দ্রুত জামা কাপড়গুলো তুললাম। ধীরে ধীরে হাঁটার সমীপে বেশ খানিকটা ভিজে গেছি।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৫

তৎক্ষণাৎ অন্তঃকরণে হানা দিল, বৃষ্টির ফোঁটা আমার দেহের উপর পতিত হচ্ছে না। আমি ফট করে উর্ধ্বে চাইলাম। আমার মাথার দেড়হাত উর্ধ্বে মস্ত কালো রঙের ছাতা। পাশ দিয়ে পেছনে না ফিরেই উপর থেকে পেছনে ঘুরার প্রয়াস করলাম। পা পিছনে পড়ে যেতে নিলেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতে কোমর জড়িয়ে নিল। ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরিয়ে নিল। রৌধিককে দেখে এক চিলতে হাসলাম আমি। লোকটা অদ্ভুত ধরনের। পরক্ষণে ভীত হলাম। তার সামনে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটব কিভাবে? নিশ্চয় দেখে ফেলল। সেই মুহুর্তেই ধমকে উঠবেন, কীভাবে পায়ে ব্যাথা পেলাম?

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৭

1 COMMENT

Comments are closed.