রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৩

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৩
নবনী নীলা

হাসপাতালে স্নিগ্ধা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বিষয়গুলোকে খুব সহজ ভাবে নেওয়া। সে কল্পনাও করতে পারেনি সবকিছু কতটা জটিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে ফাহাদ।কিছুক্ষণ আগে তার অস্ত্রোপচারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ডান পায়ের বুলেটটি অপারেশনের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে বললেন যে চিন্তার কোনো কারণ নেই। অস্ত্রোপচারের কাজ সফল হয়েছে কোনো ঝুঁকি নেই।

এবার কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে। ঘটনার আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে?
নিতান্ত প্রয়োজনেই স্নিগ্ধা ব্যাকুল হয়ে ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ফাহাদের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলেও কোনো ভাবেই সে ফোন তুলছে না। বার বার চেষ্টা করেছে কিন্তু সম্ভব হয় নি।
স্নিগ্ধা খবর খুব কম দেখে বললেই চলে। কিন্তু সেদিন কিচেনে যাওয়ার সময়ে খবরের কিছু কথা তার কানে আসে। পুরোটা সে বুঝতে পারে না তবে পুরোটা জানার কৌতূহল বাড়লো তার। এই বাড়িতে অভ্র ছাড়া আর কাউকে কখনো সে টিভি দেখতে দেখে নি। তাই হটাৎ আজ টিভিতে নিউজ চলছে শুনতে পেয়ে আগ্রহ নিয়ে সে ড্রইংরুমে আসলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ড্রইং রুমটা বিশাল। আদিল সোফায় আরাম করে বসেছে। একটা হাত সোফার হ্যান্ডেলে ছড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে কফির মগ ধরে আছে। আর ঠোঁটের কোনে সূক্ষ্ম হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। স্নিগ্ধা কোনো শব্দ করলো না। কৌতূহলী হয়ে টিলিভিশনের হেডলাইন পড়তে গিয়ে তার বিষ্ময়ের সীমা রইল না।
হেডলাইন পরে নিশ্চিত না হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে খবরটাও সে শুনলো। সম্পূর্ন ঘটনা না জানলেও সে যতটুকু বুঝেছে সেখানে এইটাই স্পষ্ট যে ফাহাদকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেশ বড়ো কোনো কারণ বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু কারণটা কি সেটা স্নিগ্ধা বুঝতে পারছে না।
আদিলের দৃষ্টি এতক্ষণ টিভির দিকে আটকে থাকলেও কি ভেবে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। স্নিগ্ধাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দাড়ালো। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি বন্ধ করতেই স্নিগ্ধা মুখ খুললো তারপর শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,” ফাহাদ রেজওয়ানকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে কেনো?”

আদিল ভ্রু কুঁচকে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। ফাহাদকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে এই খবরে স্নিগ্ধা এতো চিন্তিত কেনো? আদিলের সরু কণ্ঠে বললো,” যত কৌশলেই কেউ চুরি করুক না কেনো? তাকে তো একটা না একটা সময় ঠিক কি ধরা পড়তে হয়। ফাহাদের ও সেই সময় হয়ে এসেছে।”
স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”
আদিলের কপালে একটা ভাজ পড়েছে।চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হতেই সে থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,” আমি বুঝতে পারছি না। যবে থেকে ওই ফাহাদ তোমাকে কিডন্যাপ করেছে তারপর থেকেই ফাহাদকে নিয়ে তোমার একটু বেশি কৌতূহল। তোমার এই অবস্থা যে করেছে তাকে নিয়ে তোমার কিসের এত কনসার্ন?”

বেশ জোর গলায় কথা শেষ করলো আদিল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ। চোয়াল শক্ত করে সে রাগ সামলাচ্ছে।
স্নিগ্ধা যেনো আদিলের এই আচরণে কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো। কঠিন গলায় বললো,” আমার কনসার্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আর আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে লোকটা বিপদে পড়ায় আপনি বেশ খুশিই হয়েছেন।”
আদিল হটাৎ রেগে গিয়ে বললো,” অবশ্যই খুশী হয়েছি। এটা ওর সাথে আরো আগে হওয়া উচিত ছিলো। আমি তো এটাই ভেবে পাই না তুমি কেনো ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? কি বলেছে তোমাকে ও? নিশ্চই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেছে। সেইসব বর্ণনা শুনে তুমি ওকে বিশ্বাস করেছো?” বলতে বলতে হাত দিয়ে কপালের সামনের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাড়ালো আদিল।
স্নিগ্ধার অবাক লাগছে আদিলকে দেখে, অকারনেই লোকটা কিভাবে রেগে যাচ্ছে। স্নিগ্ধা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কেনো বিশ্বাস করবো না? এতদিনে আপনি তো আমাকে কিছুই বলেননি। তাই আমি যা জেনেছি সেসব কি বিশ্বাস করবো না?”

আদিল অবাক হয়ে বললো,” তাই বলে তুমি যার তার কথায় বিশ্বাস করবে?”
স্নিগ্ধা উপহাস করে ঠোটটা একটু প্রসারিত করলো তারপর বললো,” আমি তো জানি আপনি নিজেও দেশে ছিলেন না যখন এই সবটা হয়েছে। আপনি নিজেও কি অন্যের কথা বিশ্বাস করে বসেন আছেন না?”
আদিল স্নিগ্ধার কাছে এগিয়ে এসে বলল,” দিদির ডায়রি পড়ার পরও তুমি ফাহাদকে কি করে বিশ্বাস করছো? কি করে পারছো?”
স্নিগ্ধা আদিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” শুধু একজনের ডায়রি পরে বিচার করে নিলেন লোকটা কেমন? আপনার বোন মানুষ চিনতে সত্যি এতটা ভুল করতে পারে বলে আপনার বিশ্বাস হয়? বরং আপনি এটা বলছেন না কেনো আপনি আপনার বাবার কথাটা কেই সত্যিই ভেবে বসে আছেন।”

আদিল স্নিগ্ধার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে চেনা এই চোখ হটাৎ অচেনা হয়ে উঠেছে। আদিল নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি বলতে চাচ্ছো তুমি? আমি আমার বাবাকে বিশ্বাস করবো না?”
” বিশ্বাস করতে কে বারণ করেছে? তবে অন্ধ বিশ্বাস করারই বা কি প্রয়োজন? ফাহাদকে তো ওনার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। বিয়ের পর নাকি জেল হাজতে পাঠানোর সকল ব্যাবস্থাও তিনি করেছিলেন ফাহাদের জন্যে। পদে পদে হেনস্তাও করেছিলেন প্রচুর।” বলেই স্নিগ্ধার আদিলের চোখ মুখ দেখলো। কপাল কুঁচকে সে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা আদিলের চেহারা দেখে বললো,” কি ব্যাপার কি ভাবছেন আপনি? এইটাই কি ভাবছেন যে আপনার বোন ডায়রীতে কিছু লেখেনি কেনো? তাই না? আপনি কি খেয়াল করেছেন ডায়রির পাতায় একটা বছর মিসিং। প্রতি সপ্তাহে যে মেয়ে এক পৃষ্ঠা হলেও লিখেছে সে হটাৎ এক বছর কিছুই লিখেনি কেনো?”
আদিল স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে ধরে একদম নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”

স্নিগ্ধা এবার আর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো না।আদিলের চোখে চোখ রেখে বললো,” সে লিখেছে ঠিকই কিন্তু সেই লেখা কেউ না কেউ তো সরিয়ে দিয়েছে। লেখাগুলো হয়তো আপনার মনে সন্দেহের সুযোগ করে দিতো, সেই কারণেই সরিয়ে দিয়েছে। নয়তো এমন অন্ধ বিশ্বাস পাওয়া যাবে না।”
আদিল স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে স্নিগ্ধার এই কথাগুলোর পিছনে যথেষ্ট প্রমাণ স্নিগ্ধা পেয়েছে। আদিল চোয়াল শক্ত করে স্নিগ্ধার হাত ছেড়ে দাড়ালো । তপ্ত নিশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,” যে আমার বোনকে ছেড়ে দিয়েছে শুধু ক্ষমতা পাবার আশায়, যার কাছে মানুষ মারাটা একটা পশু মারার সমান তার কথায় এতো বিশ্বাস তোমার?”

” কই আমাকে তো মারেনি! আমাকে মেরে ফেলাটা তো তার কাছে কোনো ব্যাপার ছিলো না। তবে ছেড়ে দিলো কেনো বলুন তো? আর মানুষ রূপের পশুদের যদি মেরেই থাকে তবে তো বেশ করেছে। আর ক্ষমতার কথা বলছেন? ক্ষমতা তো আপনাদেরও কম নেই। তাহলে তো আপনাদের ক্ষমতার দিকেই প্রথম হাত বাড়ানোর কথা তাই না?”, বলেই স্নিগ্ধা ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকালো তারপর বললো,” বাকিটা আপনার বিষয়। আপনি অন্যের কথায় বিশ্বাস করবেন নাকি নিজে যাচাই করে দেখবেন।” বলেই স্নিগ্ধা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আদিল মূর্তির মতন দাড়িয়ে রইলো। এমনটা সে সত্যি ভাবে নি। তার বাবা তাকে মিথ্যে বলবে? আর এত কনফিডেন্স নিয়ে স্নিগ্ধা কথাগুলো বলছে কি করে?

হটাৎ এমন করে স্পৃহাকে দেখতে ছেলে পক্ষের লোক আসবে আয়েশা খাতুন বুঝতে পারেন নি। স্পৃহার বাবার বন্ধু আসিফ সাহেবের বড় ছেলে জন্যে স্পৃহাকে তারা চায়। কয়েকমাস ধরেই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। কোনো জবাব না পেয়ে যে আজ হুট করে চলে আসবেন সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি। হুট করে এসে বেশ বিপাকে ফেলেছে তাদের। এতো ঝামেলা একা সামলাতে না পেরে স্নিগ্ধাকে ফোন করে ডাকতেই হলো তার।
সে কারণেই স্নিগ্ধা মায়ের ফোন পেয়ে তৈরি হয়েছে। অভ্রকেও তৈরি করেছে। অভ্র এমনেই এতো কিউট দেখতে তার উপর আবার শার্ট প্যান্ট আর জুতোয় কি যে মিষ্টি লাগছে দেখতে। জুতো পড়ার পর থেকেই বিছানায় উঠে লাফ দিচ্ছে সে। লাফ দিতে দিতে বিছানায় পরে যাচ্ছে আর তখন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
স্নিগ্ধা শাড়ির আঁচলে সেফটিপিন লাগিয়ে নিজের পার্স হাতে নিলো তারপর অভ্রকে কোলে করে বিছানায় থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো,” অনেক লাফালাফি করেছো। এবার চলো আমরা যাই।”

অভ্র চোখ পিট পিট করে বললো,” কোথায় যাবো?”
স্নিগ্ধা মজার ছলে বললো,” তোমার খালামনির বরকে দেখতে।”
কথাটা শুনেই অভ্র একটা লাফ দিলো। তার খুশি আর রাখে কে? স্নিগ্ধা উঠে দাঁড়াতেই জিমকে দেখতে পেয়ে ডাকলো তারপর বললো,” আজ আমাকে একবার বাড়িতে যেতে হবে।”
জিমের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে আছে। স্নিগ্ধার কথা শুনে সে শান্ত স্বরে বলল,” আজ যাওয়াটা কি খুব জরুরী?”
” হ্যা আজই যেতে হবে।”,বলেই স্নিগ্ধা জিমের দিকে তাকালো। কাল রাত থেকে আদিল বাড়ি ফেরেনি। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই জন্যেই জিমের চোখমুখের এই দশা। স্নিগ্ধার যে চিন্তা কম হচ্ছে সেটা না। তবে সে প্রকাশ করছে না। কাল রাতে আদিল অনেক্ষন রূমে নিজের বাবার সাথে কথা বলেছে। হয়তো সেই কারণেই ……. আর ভাবতে পারছে না সে। তবে স্নিগ্ধার ধারণা আদিল ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। তার মন বলছে।

জিমের অবস্থা দেখে স্নিগ্ধা বললো,” ফাহাদকে তো পুলিশ ধরেই ফেলেছে তাহলে এখনো কিসের ভয়? নাকি আপনার বসের পারমিশন লাগবে?”
অভ্র ঠোঁট উল্টে বললো,” চলো না যাই, আমাদের যেতে দাও তাহলে তোমাকেও আমি খালামনির বরটা দেখাবো।”
অভ্রর কথায় স্নিগ্ধা হাসলো। কিন্তু জিম ভ্রু কুঁচকে বললো,” কার বর?”
স্নিগ্ধা জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” স্পৃহার কথা বলছে। স্পৃহাকে আজ দেখতে এসেছে। সেইজন্যেই আমরা যাচ্ছি।”
জিম কিছুটা অবাক হলো কিন্তু চেহারায় সেটা বেশি প্রকাশ করলো না। ” ওহ্ ” বলে থেমে গিয়ে বললো,” ঠিক আছে চলুন আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।”

তারপর বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মুদি দোকান থেকে খবর তার কানে ভেসে আসে। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ফাহাদ রেজওয়ানকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। এইটুকু শুনেই থমকে দাড়িয়েছিলো স্নিগ্ধা। আর বাড়ির ভিতরে পা ফেলে নি সে। জিম অভ্রকে কোলে করে বাড়ির ভিতরে চলে যাওয়ায় পালানোর সুযোগ পেয়েছিল স্নিগ্ধা।কোনো কিছু না ভেবেই রিক্সায় উঠে পড়ল সে। তারপর এখন ঢাকা মেডিকেলে বসে আছে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩২

গল্পটা এতো অনিয়মিত দেওয়ার জন্যে আমি দুঃখিত। গল্পটা একদম শেষের দিকে চলে এসেছে। আর অল্প কিছু পর্ব দিয়ে ইতি টানবো।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৪