রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৪

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৪
নবনী নীলা

স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষন বসে থেকে অপেক্ষা করলো। ফাহাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইলো। পুলিশ অফিসার রাজি হলেন না। আজকে কারোর সঙ্গেই দেখা করতে দেওয়া হবে না। ফাহাদের কেবিন মানে নয় নাম্বার বেডকে ঘিরেই সবার সব কৌতূহল। দেখা করতে দেওয়া হবে না জেনেও কেনো জানি স্নিগ্ধা বসে আছে।
এই সবের ঝামেলার মাঝে স্নিগ্ধা একা একজন মেয়ে। তার কথা বা তার এই দেখা করবার ইচ্ছেটুকু কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। খুব জোড় খাটিয়ে সে কিছু বলতেও পারছে না। একপাশে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষন।
স্নিগ্ধা দেখতে পেলো দূর থেকে কে যেনো হেঁটে আসছে এইদিকে। মুখটা স্পষ্ট নয় তবে অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। খুব স্মার্ট কোনো মেয়ে এই দিকে এগিয়ে আসছে সেটা তার পোশাক দেখে ধারণা করে নিয়েছে স্নিগ্ধা।

মেয়েটি কেবিনে ঢুকার চেষ্টা করতেই নার্স তাকে থামিয়ে দিলো। পরক্ষনেই মেয়েটি অগ্নী কণ্ঠে নার্সের উপর চেঁচিয়ে উঠলো। এতে পরিবেশ আরো হযবরল হয়ে গেলো। ডাক্তার আর পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। তর্কাতরকি শুরু হলো। এমন গরমেলে পরিস্থিতির মুখোমুখি এর কখনো হয়নি স্নিগ্ধা। তাও সে চুপ করে এক পাশে দাড়িয়ে রইলো। কিছু কিছু অস্পষ্ট কথা বার্তা ভেসে আসছিলো। এর মাঝেই একটি নাম শুনে বেশ চমকালো স্নিগ্ধা।
সুনেয়রা রেজওয়ান। নামটা শুনা মাত্রই স্নিগ্ধা কৌতূহলী হয়ে তাকালো। এই মেয়েটি কি তাহলে সুনেয়রা! সুনেয়রা রেজওয়ান মানে তো ফাহাদের স্ত্রী! তাহলে কি এই সেই যার সাথে আদিল দেখা করতে গিয়েছিলো। মনে মনে কিছুক্ষণ ভাবলো স্নিগ্ধা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এইদিকে গন্ডগোল আরো বাড়লো। বোঝাই যাচ্ছে আজ আর কাউকে ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে দিবে না তারা। তাই স্নিগ্ধার এইখানে অপেক্ষা করার সম্পূর্ন বৃথা। সে আর রইলো না। মেডিকেল থেকে বেরিয়ে গেলো। একবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি একটি টেক্সীতে উঠে পড়ল সে।
গাড়ীতে বসে ফোনটা একবার হাতে নিয়েও আবার রেখে দিলো সে। আদিলকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছিলো তার। কিন্তু কেনো জানি সে ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিলো না। স্নিগ্ধা জানে তার এই রাগটা সম্পূর্ন অযুক্তিত তবুও তার রাগ লাগছে। একটা মানুষ কেনোই বা এতো নির্বোধ হবে? একটিবার বুঝি ফোন করে জানানো যাচ্ছে না? তার জন্যেও যে কেউ চিন্তা করবে এই কথা তার মনে হলো না? বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে স্নিগ্ধা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। গাড়ি চলছে তার গতিতে।

জিম দূর থেকে ড্রইং রুমে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই ছেলেটিকে তার ভীষন অসহ্যকর লাগছে। অকারণে কারোর প্রতি তার এতো মেজাজ খারাপ তার এর আগে হয় নি। ছেলেটা দেখতে ভালো। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সকলের সঙ্গে সুন্দর ব্যাবহার করছে কিন্তু তবুও জিমের তাকে পছন্দ হচ্ছে না। বিরক্তি বশত সে বারান্দায় বসে আছে। তাকে ফরিদা ড্রইং রূমে বসতে বলেছিলো সে ইচ্ছে করেই ভিতরে যায় নি। থমথমে মুখ নিয়ে অনেক্ষন হলো বসে আছে।
এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ বেশ ব্যাস্ত। বাতাসে খাবারের সুভাস ভাসছে। রান্না ঘর থেকে মহিলাদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।
জিম বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। সেই বিরক্তি ভরা মেজাজ নিয়ে সে ভিতরে এলো। তাকে দেখে ছেলেটি কথা বলার জন্যে সোজন্য দেখলেও জিম সেই সব অগ্রাহ্য করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কাজটি সে সম্পূর্ন নিজ ইচ্ছেতেই করেছে।

দোতলায় উঠে সে স্পৃহার ঘরের সামনে এসে দাড়ালো। পর্দার কারণে ভিতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। জিম চুপ করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। সে এখানে কেনো এসেছে? আর স্পৃহার ঘরের সামনেই বা কেনো দাড়িয়ে আছে? সে জানে না। নিজেকে এই প্রশ্ন করে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে। জিম মিনিট দশেক রূমের সামনে পায়চারি করলো। হয়তো স্পৃহা বের হয়ে তাকে দেখবে। কিন্তু স্পৃহা বের হলো না। এতে মেজাজ আর মন দুটোই পৃথক আবেগে সোচ্চার হয়ে উঠলো। মনটা একটু খারাপ কিন্তু মেজাজ গরম। অগ্নি মেজাজে রূমের সামনে থেকে চলে যাওয়ার আগেই কে যেনো তার হাত ধরে টেনে রূমের ভিতরে নিয়ে গেলো।
ভিতরে এসে জিম হতবাক হয়ে তাকালো।স্পৃহা তাকে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করতেই বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো সে। চোখ বড় বড় করে বললো,” কি করছো কি? দরজা বন্ধ করলে কেনো?”
স্পৃহা দরজা বন্ধ করে তীক্ষ্ণ চোখে পিছনে তাকালো। তারপর রাগী গলায় বললো,” আমার আপনার সঙ্গে কথা আছে তাই দরজা বন্ধ করেছি।”

জিমের চোখে মুখে এখনো বিষ্ময় নিয়ে বললো,” কথা থাকতেই পারে কিন্তু তার জন্যে দরজা বন্ধ করতে হবে ?”
স্পৃহা এবার ভ্রু কুঁচকে ফেললো তারপর বললো,” আশ্চর্য! দড়জা বন্ধ করেছি তো কি হয়েছে? আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো আমি আপনার সতীত্ব হরণ করতে আপনাকে রুমে নিয়ে এসেছি।”
স্পৃহার এমন কথায় নিজেকে শান্ত করলো। হটাৎ স্পৃহার এমন কাজে সে বিচলিত হয়ে উঠেছিল। তারপর হালকা গলা সারিয়ে বললো,” শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে?”
স্পৃহা চোখ তীক্ষ্ণ করে আরো দুকদম এগিয়ে এসে বলল,” ও আচ্ছা। আপনি জানেন তাহলে? দিন দুনিয়ার খবর তাহলে আছে আপনার কাছে?”
স্পৃহার কথায় কেমন একটা রাগ ফুটে উঠেছে। জিম অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” হুম্, আছে। তা বর পছন্দ হয়েছে?”

স্পৃহা আরো এগিয়ে এসে বলল,” পছন্দ হবে না কেনো? খুব পছন্দ হয়েছে।”
জিমের কপালে একটা ভাজ পড়লো সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাথা নেড়ে বললো,” হুম্ ভালো।”
স্পৃহা এতোক্ষণ নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু জিমের এই উত্তরে তার রাগ আরো তুমুল হলো। স্পৃহা চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এসে জিমের কলার চেপে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। হটাৎ দুজনেই দুজনের মুখোমুখি। ব্যালেন্স করতে গিয়ে জিম একটু ঝুঁকে দাড়ালো। স্পৃহার চোখে চোখ পড়তেই কেনো জানি হৃদয়ে এক কম্পন শুরু হলো তার। স্পৃহার দৃষ্টি তখন তীক্ষ্ণ। দাতে দাঁত চিপে সে বললো,” হুম্, ভালো। এইসব বলতে এইখানে এসেছেন? কেনো এসেছেন আপনি? আমার বিয়ে যদি আপনি না ভেঙেছেন না? আপনাকে আমি বদনাম করে ছাড়বো বলে রাখলাম।”

প্রথম দুটি বাক্য শুনে মনে একটু বসন্তের বাতাস বসলেও শেষ বাক্যটি গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা রোদ্দুরের মতন তির্যক ভাবে তার মাথায় বিধলো। তাকে বদনাম করবে মানে? কি ধরনের কথা এইসব! জিম চোখ বড় বড় করে তাকালো তারপর বললো,” বদনাম করবে মানে কি?”
স্পৃহা একটা ভ্রু তুলে বললো,” বদনাম মানে বুঝতে পারছেন না? এইযে আমি আপনি এক ঘরে দরজা বন্ধ করে আছি। এটাই কি কম না আপনাকে বদনাম করার জন্যে?”
জিম নিজের কলার থেকে স্পৃহার হাত সরানোর চেষ্টা করে বললো,” পাগল হয়ে গেছো তুমি। আবোল তাবোল বকছো।”
” আচ্ছা। তাহলে কি করবো? এই বিয়েটা করে নিবো?”,জিমের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো স্পৃহা।
জিম ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা একটু তাচ্ছিলের সঙ্গে বললো,” করে নাও।”
স্পৃহা চোয়াল শক্ত করে দাতে দাঁত চিপে জিমের কলার আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,” আচ্ছা তাই! আর আপনি! আপনি কি করবেন? আমার বিয়েতে এসে খাসির রেজালা খাবেন? আর আমার বাচ্চা কাচ্চার মামা হবেন?”

জিম একটু হাসলো। মুচকি একটু হাসি, ক্ষুদ্র আয়তন হওয়া সত্বেও সেই হাসি যেনো স্পৃহার বুকে এক ঝড় তুললো। মুহূর্তের জন্যে থমকে তাকালো সে। জিম স্পৃহার কোমরের দুপাশে হাত দিয়ে আগলে ধরতেই। জিমের কলার থেকে স্পৃহার হাতের বাধন সহজ হলো। চেষ্টা করেও জিমের চোখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনতে পারছে না সে। স্পৃহা একটা ঢোক গিলে তাকাতেই জিম বললো,” উহু, মামা হওয়াতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুমি রাজি থাকলে বাবা হতেই পারি।”

স্পৃহা হতবাক হয়ে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে, চোখ দুটো খুলে আসার উপক্রম হয়েছে তার। স্পৃহা ফট করে জিমের কলার থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,” আ..আপনি এত নিলজ্জ সেটা তো জানা ছিলো না।”
জিম একটা ভ্রূ তুলে বললো,” হুম্, আমি নিলজ্জ্ আর তুমি খুব লজ্জাবতী।”
স্পৃহা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,” একদম বেশি কথা বলবেন …. না।” শেষের না টুকু বলার আগেই স্পৃহা, দরজায় টোকার শব্দে কেপে উঠলো। ছিটকে জিমের থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েও সরতে পারলো না সে। জিমের দুই হাতের বাঁধনে সে আবদ্ধ।
স্পৃহা চোখ বড় বড় জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” ছাড়ুন বলছি।” বলতে বলতেই ওপাশ থেকে স্নিগ্ধা ডেকে বললো,” এই দরজা খুল।”

স্পৃহা একটা ঢোক গিলতেই জিম বললো,” আমার নামে নাকি বদনাম ছড়াবে। এখন ভয় পাচ্ছো কেনো? তোমার সঙ্গে বদনাম হতে তো আমার কোনো ভয় নেই।” বলেই জিম ঠোঁট একটু প্রশস্ত করলো। স্পৃহা দাতে দাঁত চিপে বললো,” আপনাকে আমি পরে দেখে নিবো।আপনার এই হাসি আমি ঠিক বের করবো।”
জিম স্পৃহাকে জ্বালাতন করে ভালোই মজা পাচ্ছে।
দরজায় আরো কয়েকবার টোকা পড়লো। এইবার হাক দিলেন আয়েশা খাতুন। গলা উচিয়ে বললেন,” কিরে জলদি দরজা খুল।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৩

আয়েশা খাতুনের কণ্ঠ শুনে জিম ফট করে হাতের বাঁধন খুলে দূরে সরে এলো। আয়েশা খাতুনকে সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে। জিমের চোখ মুখের অবস্থা নাজেহাল। এমন কিছু সে আশা করেনি সেটা তাকে দেখেই আন্দাজ করা যায়। এমন পরিস্থিতিতেও স্পৃহা ঠোঁট চেপে হাসলো তারপর বললো,” কি ব্যাপার! আপনার না আমার সঙ্গে বদনাম হতে ভয় নেই। তাহলে ঘামছেন কেনো এতো?”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৫