অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৮

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৮
ইফা আমহৃদ

“আমি জোনাকি। আমি যদি কখনো মিথ্যা বলি, তাহলে আমার নাম পড়ে যাবে। সবাই আমাকে নাক পড়া জোনাকি বলবে।
কাঁদো কাঁদো মুখ করে টেনে টেনে বললাম আমি। রৌধিক ভ্রু কুঁচকে হাসলেন অধর চেপে। কফির কাপটা মৃদু শব্দে সেন্টার টেবিলের উপর রাখেন। হাতটা বেডের উপর ইশারা করে বসতে বললেন। আমি বসলাম। বাহু টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। থমথমে গলায় বলল,

“কেন বারণ করার সত্বেও এখানে এলে। এখন শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ। বাড়ি চলে যাও।”
আমি মাথা তুললাম। চলে যাওয়ার হলে তার দেওয়া শর্ত কেন মানলাম। শর্ত সাপেক্ষ তিনি কিছুতেই এখন এই বাড়ি থেকে আমাকে বের করতে পারেন না। কিছুতেই না। আমি কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলাম।
“কালকে আপনি কোন মেয়ের সাথে ছিলেন। আমাকে পাত্তাই দিলেন না। মেয়েটা কে?”
রৌধিক গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলেন। ভাবনা আয়ত্তে করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেন কোন মেয়ে।
” ভার্সিটির রাস্তায় যেই মেয়েটা ছিল।”
রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমার ক্ষোভ লহমায় অন্তরিক্ষ স্পর্শ করল। রুদ্ধ হলাম আমি। আমাকে এভাবে দেখে রৌধিক মজার ছলে বলে,
“ঐটা তো গার্লফ্রেন্ড। তবে বেশিদিন থাকবে না। ভাবছি আরেকটা বিয়ে করব। বর্তমান বউ-তো মনের দুঃখটাই বুঝে না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথা যেন মোটেও অন্তঃকরণে ঠাঁই পেল না। কয়টা লাগে তার। ইয়ানাত আপুর ছোট বোন। তাকে না-কি ভালোবাসে। তাহলে শেফা কে? শেফা গেছে, এখন আমি আছি। আবার আরেকটা মেয়েকে খুঁজছে। আমাকে আরেকটু খ্যাপাতে গম্ভীর গলায় বলে,
“বেশি বউ সমান বেশি ভালোবাসা।”
আমি চোখ মুখ ছোট করে ফেললাম। অজান্তেই অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে। লোকটা এমন কেন? আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে তার উদ্ভর কথায়, তবুও কেন এরুপ কথা বলেন?
পরক্ষণেই হু হা করে হেসে ফেললেন। আমাকে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। কাবার্ড থেকে স্বযত্নে একটা প্যাকেট বের করে হাতে দিলেন। আমি নিলাম না। একবার তাকালামও না। আমাকে রাগিয়ে এখন আদিক্ষ্যেতা দেখানো হচ্ছে। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে তিনি নিজেই প্যাকেট খুলেন। একটা স্মার্টফোন ভেতরে। আমার ভাড় করে রাখা মুখের পরপর কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দি করলেন। ফোড়ন কেটে বললেন,

” নাউ পারফেক্ট। একাই আমার এবং তোমার ওয়াল পেপার থাকবে।
উনি উকিল। আমার মামলাটা দেখছেন। বাড়ির ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কথা বলছি।”
আমার টানা টানা চোখ জোড়া ডাগর ডাগর চোখে রুপান্তরিত হলো। তিনি উকিলের সাথে ছিলেন আর আমি কি-না কি ভেবে বসে আছি। নিজের ভিত্তিহীন কাজে অন্তরে অন্তরে তীব্রতর হাসলাম। অতঃপর বললাম,
“বাড়ির ফিরে পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়েছে?”
“আশা রাখছি, হয়ে যাবে। তবে কিছুটা সময় লাগবে। বিদেশি কোম্পানির যাবতীয় টাকার কিছু পরিমাণ দান করার হয় এবং কিছুটা ব্যাংকে জমা করা হয়। আমার কিংবা বাবার সাইন্স ছাড়া উত্তোলন করা সম্ভব নয়। তাই লন্ডনে যেতে হবে একবার। ভাবছি, বিদেশি কোম্পানিটা এখানে প্রতিষ্ঠা করব।”
“দরকার নেই। ওটা ওখানেই থাক না! আপনি বাড়িটা ফিরিয়ে আনার আর একটা চাকরির চেষ্টা করেন। যদি আরু আবার কোনো ক্ষতি করে ফেলে, আমি কক্ষনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লীজ!”
রৌধিক ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দিলেন তার অগোছালো এলোমেলো কেশগুচ্ছ। আমার কথা রাখার প্রয়াস করবেন তিনি। আমি এতেই অসন্তুষ্ট।

পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে আয়।
ও সে চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলনায়–
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
অন্তরিক্ষে কৃষ্ণ বর্ণ মেঘের ছড়াছড়ি। শৈত্য হাওয়া বইছে। আমি মাথায় চিরুনি চালাচ্ছি। আর মন খুলে গান গাইছি। গানটা ছোটবেলা থেকেই খুব পছন্দের আমার। হুট করেই মেঘলা আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে সুর তুলছে ইচ্ছে হলো। মাথার দুই পাশে দুই বেণুনী করে ব্যালকেনি থেকে ঘরে এসে বসলাম। তৎক্ষণাৎ দেখা মেলল মিতা আন্টির। সে বেডের উপর বসে আছে। স্থির দৃষ্টি মাটির দিকে। আমি চিরুনিটা ব্রাশদানীর মাঝে রেখে হাঁসি হাঁসি মুখে বলি,

“আন্টি, তুমি এখানে বসে আছো? কখন এলে। আমাকে কেন ডাকলে না।”
ভাবনার ছেদ ঘটল তার। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“গানটা অনেক পছন্দের। শুধু আমার একার নয়, ওর বাবা, ইভু ইনায়াত আর ..
অনেক বছর পর গানটা‌ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল।”
“ওহ্!”
আন্টি একটা থ্রী পিছ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পড়ে নিতে বললেন। কোথাও একটা ঘুরতে নিয়ে‌ যাবে। মুখের উপর না করতে পারলাম না, তাই পড়ে নিলাম। খুলতেই শুভ্র রঙটা নজরে এলো।
আমি চটজলদি পড়ে বেরিয়ে এলাম। চোখে কাজল আর গোলাপী রঙের লিপস্টিক দিলাম। অতঃপর আন্টির সাথে বেরিয়ে এলাম।

দোলনায় দুলছি। আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছেন মিতা আন্টি। তার স্থির দৃষ্টি আমার নিকট নিবদ্ধ। মিশুক স্বভাবের মানুষ তিনি। তার ন্যায় মানুষ পাওয়া যায় না। আজ মনটা ভালো নেই। বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নেই। ইয়ানাত আপু একটা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা। ইভু ভাইয়া হসপিটালে গেছেন। বাকিরা যে যার নিজ নিজ কাছে গেছেন। সেই সুবাধে বাড়ি ফাঁকা। আমহৃদ বাড়ির পাশেই ছোট একটা পার্ক। বাচ্চারা পার্কে খেলাধুলা করছে।
বাচ্চাদের সাথে থাকলে আমার মন ভালো হবে, এই আকাঙ্ক্ষায় মিতা আন্টি এখানে নিয়ে এসেছে। এসে থেকেই এভাবে বসে আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পর তিনি এগিয়ে এলেন। আমার দোলনায় ধাক্কা দিতে চাইলেন। আমি সম্মতি দিলাম। তৎক্ষণাৎ একটা ছোট বাচ্চা ছুটে এলো। আন্টিকে জড়িয়ে ধরলেন। আধো আধো কণ্ঠে বলে,
“আমিও দোলনায় উঠব, নানিমা। তুমি আন্টিকে বলো, আমাকে একটু তুলতে। দেখো বাকি দোলনা‌গুলো ফাঁকা নেই।

বাচ্চার কথায় বাজ পড়ল মাথায়। আমার ন্যায় স্বল্পবয়সী তরুণীকে আন্টি ডাকছে। বাহ্।
কথা অনুসরণ করে পাশে ফিরতেই দেখলাম, দোলনাগুলো ফাঁকা নেই।‌ আমি ফট করে কোলে তুলে নিলাম। আন্টি পেছন থেকে ধাক্কা দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটি চ্যাঁচিয়ে বলল,
“থামো থামো। আমি যাবো!”
“কোথায় যাবে তুমি?”
“মা যাবো।”
দোলনা থামাতেই মেয়েটি যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে গেল। আমিও নামলাম দোলনা থেকে। মেয়েটি তার মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারল কি-না তাই পিছু নিলাম। কিছুদূর যেতেই দেখলাম, সে স্বল্পবয়সী একজন মহিলার কোলে। তাই আমরাও উল্টো পথ ধরলাম। গাছের নিচেই গিয়ে বসলাম। দুপুর হয়ে আসছে। উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাড়ির দিকে হাঁটা দিবো।
অবিলম্বে এসে উপস্থিত হলো ইভু ভাইয়া ও রৌধিক।চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। দুহাতে হাওয়াই মিঠাই। আমার দিকে এগিয়ে দিলেন একটা। লহমায় খুলে খেতে শুরু করলাম। বরাবরই এই জিনিসটা পছন্দ আমার।‌
অতঃপর আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মামুনি, জোনাকির সাথে আমার কিছু কথা আছে। নিয়ে যাবো?”
“যা!”
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। তা দেখে তিনি বললেন,
” চলেন দিপ্তিরানী।” একটু সামনে অগ্ৰসর হতেই রিক্সা পেলাম। হয়তো রৌধিকই ঠিক করে রেখেছিলেন।রিক্সায় উঠতেই ছেড়ে দিলেন। ছোট একটা ব্রীজের সামনে এনে দাঁড় করালেন। রৌধিক ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে লাগলেন। আমিও তার পিছুপিছু হাঁটছি। কম হাঁটছি তো খাচ্ছি বেশি। রৌধিক রেলিংয়ের উপর বসলেন। আমিও বসলাম। হাতের উপর হাত রাখলেন। আমি হাত ছাড়িয়ে একটু সরে বসলাম। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“জোনাকি, আমার পাশে বসতে ভালো লাগছে না বুঝি।”
বুঝতে পারলাম, তার অভিমানী কথার ধরন। বিনিময়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম। হাঁসিমাখা কণ্ঠে বললাম,
“শুধু আপনার পাশে না, আপনার কাঁধে মাথা রেখে সর্বক্ষণ থাকবে আমার অনেক ভালো লাগে।”
এবারে নিরবচ্ছিন্নতায় কেটে গেল প্রিয় মুহুর্তগুলো। উষ্ণ দুপুরেও বেশ তৃপ্তিদায়ক এই মুহুর্তটা। হুট করেই তিনি বলেন,
“জোনাকি, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।‌”
“জি বলুন।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৭

“দিনকে দিন বয়স বাড়ছে আদ্রুর। আমাদের অসচ্ছলতা বাড়ছে। বাবা চাইছে আদ্রুর বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে। লন্ডনের কোম্পানিটার অবস্থা ভালো না। মাসখানেক সময় লাগবে সেদিকটা দেখতে। আমাকে যেতে..
রৌধিক থেমে গেলেন। বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমি পরবর্তী কথাটা শ্রবণ করার নিমিত্তে চেয়ে রইলাম চাতক পাখির ন্যায়। তার নীলাভ চোখজোড়া উদাসীন। অন্যরকম।
“থেমে গেলেন কেন বলুন?”
কিছু না, বাড়ি চলো। ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৯

2 COMMENTS

Comments are closed.