অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৯

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৯
ইফা আমহৃদ

সন্ধ্যার অন্তরিক্ষ আজ অধিক আঁধারে আবৃত। সচরাচর অপেক্ষায় বড্ড পৃথক। অনুপস্থিত পূর্ণিমার থালার ন্যায় মস্ত চাঁদ। অনুপস্থিত মিটিমিটি তারকা। উপস্থিত আকাশে ভাসমান পুঞ্জীভূত জলীয় বাষ্প। যা মেঘ নামেই পরিচিত। যখন তখন পতিত হতে পারে পৃথিবীর বক্ষে। আমি কফি বানাচ্ছি মনের সুখে। রৌধিক প্রত্যাহিক দিনের ন্যায় শাওয়ার নিচ্ছে। আজ নিজ থেকে কফি চায়নি। আমারই বানাতে ইচ্ছে করল। হুট করে বাড়িতে উপস্থিত বাকিদের কথা মস্তিষ্কে হানা দিল। তাই আরেকটা পাতিলে পানি দিলাম। চা বানিয়ে ট্রে সমেত ছুটলাম চা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এঁকে এঁকে সবার ঘরে দিয়ে যখনই বাবা-মায়ের ঘরে দিতে যাবো তখনই শ্রবণ হলো অপ্রত্যাশিত কিছু কথন। থেমে গেল চরণ। আদ্রিক আহম্মেদ মৌমিতাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,

“রৌধিক কালকে বিকেলের ফ্রাইটে চলে যাবে। ওর প্রিয় খাবারগুলো রান্না করো। আসতে আসতে মাস ফুড়িয়ে যাবে। সেখানে গেলে খেতে পারবে কি-না।”
“হ্যাঁ। সবে বিয়ে হয়েছে মাস পেরুতে পারল না। জোনাকি কিভাবে নিবে ব্যাপারটা।
জোনাকিকে রৌধিক বলেছে তো?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অবলোকন করল মৌমিতা। আদ্রিক আহম্মেদ জবাব দিতে ব্যর্থ। এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর নেই। আমি নিঃপলক, স্থির, উদাসীন। রৌধিক লন্ডনে চলে যাচ্ছে আর আমি কিছু জানি না। এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যর কি আদৌও প্রাপ্য আমি। হাত ফসকে গেল। ট্রেটা ব্যালেন্স করতে সক্ষম হলাম। কাপে কাপে মৃদু ঘর্ষণের সৃষ্টির ফলে তারা অবলোকন করল। আমি ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কাঁপা কাঁপা হাত দ্বারা দু’কাপ চা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে এলাম। শরীরটা অবস হয়ে আসছে। দীর্ঘ অবকাশ প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে চলে এলাম। কফির কাপটা কিঞ্চিৎ শব্দে টেবিলের উপর রাখি, যাতে রৌধিক বুঝতে পারেন আমার অবস্থান।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বাহ্। বউ বউ লাগছে আজ।”
প্রত্যুক্তি নেই হৃদমাঝারে। তিনি কফির কাপ নিয়ে চুমুক দিলেন। মুখ কুচকালেন। আজ কফিতে চিনি দিয়েছি, হয়তো তাই। আমি শক্তপোক্ত কণ্ঠে বললাম,
“আপনি কাল কোথাও যাচ্ছেন?”
বিষম খেলেন। কাশতে কাশতে কিছু বলার প্রয়াস করতেই পুনরায় বলি, “হ্যাঁ অথবা না। সোজাসাপ্টা বললেন।”
“হ্যাঁ। আসলে তোমাকে বলতে..
“থাক। বলার দরকার নেই। আপনি ঘুমান। আমি আপনার লাকেজ গুছিয়ে দিচ্ছি।”
রৌধিক আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। পাত্তা দিলাম না। কাবার্ডের উপর থেকে লাকেজ নামিয়ে চেইন খুলে রাখলাম। অতঃপর জামা কাপড় বের করে ভাঁজে ভাঁজে রাখলাম। খুঁটি নাটি সব কিছু গুছিয়ে দিলাম। পুরোটা সময় রৌধিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি কম্পিলিট করে সোফায় বসলাম। রৌধিক উঠে এলে। পাশে বসে সরল ভাষায় বলে,

“কী হয়েছে, এমন গোমরামুখ করে বসে আছো কেন?”
“কিছু হয়নি। আমি বলেছি, কিছু হয়েছে? যান সরেন এখান থেকে।”
“ধ্যাত। না বললে না।”
আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটতে লাগলাম আমি। কলার টেনে ধরলাম। রক্তচক্ষু করে চেয়ে রইলাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
“ধ্যাত। না বললে না। মানে কী হ্যাঁ? তুই যে লন্ডনে যাবি। আমাকে বলেছিলিস? আমি বাবার মুখে শুনছি! তাও আবার প্রায় একমাস।”
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক হাত ছাড়ালেন কলার থেকে। গহীন নয়নে চেয়ে রইলেন। পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। মুখ ভার করে রাখলাম। পানি খাবো না মানে খাবো না। কিছুতেই না। রৌধিক আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মানলেন না। গাল চেপে দুই অধরের মাঝে কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে পানির গ্লাস এলিয়ে দিলেন। আমি ঢোক গেলার জন্য কিয়ৎক্ষণ থামলাম। পুনরায় কান্নার সূচনা করার পূর্বেই রৌধিক বলতে শুরু করলেন,

” আগে আমার কথা শেষ হবে, পরে তুমি কথা বলবে।আজকে তোমাকে আমি ব্রীজে নিয়ে গেছিলাম। গেছিলাম তো?”
কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলি, “হম!”
“কিছু বলতে চেয়েছিলাম?”
“হম।”
“বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তো?”
“হ্যাঁ। কিন্তু মাঝপথে আপনি থেমে গেছিলেন। বলেছিলেন, আমাকে যেতে। তারপরে আর কিছু বলেন নি।”
“তাহলে? আমি তোমাকে সবটা বলতে চেয়েছিলাম। তখন তুমি বাচ্চা বাচ্চা মুডে ছিলে। আমি সত্যিটা বললে, তুমি কষ্ট পেতে। আমি চাইনি তোমার খুশিটা নষ্ট করতে। তাই বলেনি। বুঝেছ?”
আমার নাক টেনে শব্দের সমাপ্তি ঘটালেন রৌধিক। আমাকে তিনি এই কথাটা বলতেই সেখানে নিয়ে গেছিলেন। আর আমি তাকে ভুল বুঝলাম। আচ্ছা তিনি চলে গেলে, আমি একা কীভাবে থাকব? কথাটি ভাবতেই হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকের তুলনায় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। অজান্তেই নেত্রযুগল পূর্ণ হল অশ্রুধারায়। ঝাঁপসা হল দৃষ্টি। নেত্রযুগলের পলক ফেলতেই গাল গড়িয়ে পড়ল। হুট করেই অজান্তা আয়াসে বক্ষটা ছ্যাত করে উঠল। রৌধিকের বেষ্টিত করে নিলাম নিজের পৃথক বাহুবন্ধনে। অস্ফুট স্বরে শুধালাম,

“আপনি সত্যিই চলে যাবেন রৌধিক। আমি কীভাবে থাকব আপনাকে ছাড়া।”
“আমি তো চলে যাচ্ছি না। ফিরে আসছি।”
বলেই পরপর কয়েকবার নিজের অধর জোড়া ছুঁয়ে দিলের আমার পৃথক অধরে। তীক্ষ্ণ আঘাতপ্রাপ্ত হলো আমার তুলতুলে গাল। আহ্ করে উঠলাম। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই রৌধিক বেপরোয়া কাজ করে বসলেন। আমার ভাঁজ বিশিষ্ট ললাটে তার ভাঁজ বিহীন ললাটে রেখে নেশাক্ত কণ্ঠে বললেন,
“আই নিউ ইউ জোনাকি। ডিপলী নিড। এই রাতের মাধুর্যের বিনিময়ে আগামী এক মাস প্রাণভরে বাঁচতে চাই। এক মুহুর্তের জন্যও যাতে মনে না-হয় তুমি আমার পাশে নেই।”

আমি মাথা তুলে অবলোকন করার প্রয়াস করলাম। বরাবরের ন্যায় এবারেও ব্যর্থ। তার বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের দ্বারা আমি বাঁধা। সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। আমি চাই, যাতে আগামী একমাস তিনিহীনা কাটাতে পারি। মাথা নতজানু। তার জামাবিহীন উদাম দেহ নজর কাটল আমার। শীতলতা কয়েকশ’গুন বাড়িয়ে দিল। তিনি কতক্ষণ ধরে এমন অবস্থার আছেন। অথচ আমার অভিমানী নজর একবারও তার দিকে পড়ল না। হাত জোড়া চেপে ধরলেন। আমি মিনমিনে গলায় বলি,
“আপনার শার্ট কোথায়?”
রৌধিক মাথা সরালেন না। পূর্বের ন্যায় রেখেই জড়ানো গলায় বলেন, “আমি তো শার্ট পড়ি নি। তাহলে আবার কোথায় যাবে? টাওয়ার কাঁধে পেঁচানো ছিল। তোমার অভিমান ভাঙাতে গিয়ে খসে পড়েছে।
এখন কি আফসোস হচ্ছে, দেখতে পারো নি বলে?”
“আপনি তো পুরোটাই আমার। আমি দেখতেই পারি! আপনি আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন। এবার আমিও চুমু খাবো। তো শোধবোধ।”
“কিন্তু আমি এখন আর দেখতে দিবো না, না চুমু খেতে দিবো।”
“এই তো..
নেত্রযুগল বড়ো বড়ো করে পরপর কয়েকবার রৌধিকের উন্মুক্ত বুকে অধর ছুঁয়েছিলাম। পরক্ষণেই ওষ্ঠদ্বয় শীতল স্পর্শে ভরে উঠল। নেত্রযুগল ছোট হলো না। নিভে গেল আলো। অতিবাহিত হতে লাগল প্রহর।

ভোরের মিষ্টি সোনালি আভা গাছগাছালি ভেদ করে উঁকি দিয়ে পূর্ব আকাশে। নিভু নিভু আলো পেরিয়ে প্রজ্বলিত হয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত। আমি গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছি রৌধিকের বাহুডোরে। ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরিয়েছে। ঘুম ভেঙ্গেছে বহু সময় পূর্বে। উঠার স্পৃহা নেই। এই মুহূর্তটা উপভোগ করছি। উঠলেই মনে হবে, আবার কবে এই বুকে মাথা রাখব। কিছু ঘণ্টা পরই হয়তো রৌধিককে চোখের দেখাও দেখতে পাবো না। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারব না। ভাবলেই চোখের পাতা ঝাঁপসা হয়ে আসে। এইসব ভাবতে ভাবতেই চোখের ভরে এলো। গড়িয়ে পড়ল রৌধিকের উন্মুক্ত বুকের উপর। রৌধিক নড়েচড়ে উঠল। চোখ মেলতেই চোখাচোখি হলো দুজনার। আমি দৃষ্টি সরালাম। রৌধিক কিছু বললেন না। হয়তো অনুভব করতে পারলেন আমার অবস্থাটা। এভাবে পেরিয়ে গেল কিছু মহেন্দ্রক্ষণ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে,

“উঠবে না। না-কি আমার মতো সুদর্শন সুপুরুষের প্রেমে ভাসছ?”
“একটু ভাসতে ইচ্ছে করছে। আবার কবে ভাসতে পারব?
হয়তো কাজের মাঝে সারাদিনে একবারও আপনার কণ্ঠ শুনতে পেলাম না।”
“বাহ্, বাহ্। কালরাতে তুইও বলেছিলে আমাকে আর আজ আবার আপনি?”
“স্যরি!” [সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে]
“ঠিক আছে, এবার উঠ। সবাই কী ভাববে।”
আমি বসলাম। কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া অগোছালো চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে বলি, “ব্রেকফাস্ট সেরে এসে কিন্তু আবার এভাবে শুয়ে থাকব।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৮

রৌধিক হাসলেন। বাঁকা হাঁসি তার ওষ্ঠদ্বয়ে। বোধগম্য হলো তার হাসির মানে। কী ভাবতে কী ভেবে ফেলেছে? ছিঃ! ছিঃ! কী লজ্জা। লজ্জানত হলাম আমি। চটজলদি উঠে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। পেছনে না ফিরে বুঝতে পারছি, তিনি এখন হাসছে। পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি হাসতে গিয়েও হাসলাম না। হয়তো কখনও এই হাসিটাকে বড্ড বেশি মিস্ করব, মানুষটাকে মিস্ করব কিংবা এই লজ্জাদায়ক মুহুর্তটাকে মিস্ করব।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩০

1 COMMENT

Comments are closed.