অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩০

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩০
ইফা আমহৃদ

বালিশে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি আমি। রৌধিককে কোথাও দেখতে পারছি না। তার পছন্দসই আজ স্পেশাল খাবার রান্না করেছি। সেই ফাঁকে তিনি আমাকে না জানিয়ে চলে গেলেন? হৃদয়টা কেঁপে উঠল। আমাকে বলে গেলে, কী হতো? আমি বুঝি তাকে যেতে দিলাম না। আমার ভাবনার মাঝপথেই দ্বার খোলার মৃদু শব্দ কর্ণপথে আঘাত হানল। টনক নড়ল আমার। বিন্দু পরিমাণ স্থান অপসারণ করলাম না। নিম্নস্বরবিশিষ্ট কণ্ঠে বললেন,
“জোনাকি, কী হয়েছে তোমার? লজ্জাবতী লতার মতো এত লজ্জা কেন পাচ্ছ?”
কান্নার গতি হ্রাস পেল। আমি দ্রুত চোখ মুছে পশ্চাৎ ফিরলাম। রৌধিকের পড়নে ছাই রাঙা ট্রাউজার। টাওয়াল দ্বারা আর্দ্র কেশসমূহ মুছতে ব্যস্ত। তবে বর্তমানে তার আর্দ্র হাত স্থির। অনিমেষ দৃষ্টি আমার নিকট। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। আমাকে অচঞ্চল দেখে পুনরায় বলেন,

“ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? তুমি..
কথন ‌অবসান করার পূর্বেই তাকে জাপ্টে ধরলাম। আকস্মিক ঘটা পরিস্থিতিতে রৌধিক ভরকে গেল। ভারসাম্যহীন হয়ে পিছিয়ে গেল। সর্বাপরি দেয়ালের সহিত গিয়ে ঠেকেছে। অবিচল আস্থাসহিত বলে,
“জোনাকি কুলডাইন। কী হয়েছে, বলো আমাকে।”
“কোথায় ছিলেন আপনি? কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।”
রৌধিকের আর্দ্রহাতের সাহায্যে পেঁচিয়ে নিয়ে বলে, “আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। গাঁ ছিপছিপে লাগছিল। ফ্রাইটে তো শাওয়ার নিতে পারব না। তাই।”
“কিন্তু আমি যে দেখতে পেলাম না।”
“তখন মেভি মায়ের কাছে ছিলাম। এবার ওঠ।”
আমি নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলাম। তিনি পূর্বেই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিধায় চোখাচোখি হল দু’জনার। আমি সরে আসার প্রয়াস করলাম। রৌধিক ছাড়লেন না। তার বলিষ্ঠ হাতে সাহায্যে আমাকে মিলিয়ে নিলেন। অকপটে কণ্ঠে বলেন,
“শাড়ি পড়তে যা যা লাগে পড়ে এসো। শাড়ি পড়বে না। আমি পড়িয়ে দিবো। নাও গো..
“মানে..
“কিছু না। জামা খুলো আমিই পড়িয়ে দিচ্ছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি এক লাফে রৌধিকের থেকে পিছিয়ে এলাম। রৌধিক কাবার্ড হাতরে একটা কালচে প্যাকেট দিয়ে পড়তে বললেন। আমি মাথা নিচু করে প্যাকেট নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। দ্বার গ্ৰথণ করে প্যাকেট খুলতেই নজর কাটল পেটিকোট আর ব্লাউজ। আমি পড়ে উপর থেকে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।
রৌধিকের ঘোরলাগা নেত্রযুগল। পা টেনে টেনে এগিয়ে এলেন। কোমর টেনে ড্রেসিং টেবিলের উপরে বসালেন। অতঃপর শাড়ি বের করে সামনে রাখলেন। নাক ছিঁচকালাম আমি। বৈশাখী শাড়ি। হাড়ি পাতিলের ছবি। আমি নাক ফুলিয়ে বলি,
“এই হাড়ি পাতিল কে পড়বে?”
“হাড়ি পাতিল কোথায়?”
“এটা হাড়ি পাতিল না তো কী? একটা কাজ করি আমি ব্লাউজ আর পেটিকোট খুলে আপনাকে দেই। আপনি পড়ে আসুন আপনাকে এই হাড়ি পাতিল পড়িয়ে দেই। এই ধরনের শাড়িমার বি’শ্রী লাগে।”
রৌধিক একগাল হাসলেন বিনিময়ে। কাবার্ড থেকে আরও একটা শাড়ি বের করলেন। শুভ্র রঙের ভেতরে লাল রঙের মোটা পাড়। এক দেখাতেই নিমিষেই মন কাড়ল। আমি দ্রুত শাড়িটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর।

আমার থেকে শাড়িটা না নিয়েই নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। কাজল দ্বারা টানা টানা করে পড়ালেন। লিপস্টিক লাগালেন। অতঃপর গাঁ থেকে ওড়না সরিয়ে ফেললেন। খিঁচে নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে নিলাম। হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরলাম ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ। চোখ মেলার প্রয়াস করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ওড়নার শক্তপোক্ত কাপড় দিয়ে চোখজোড়া বেঁধে দিলেন। আর দেখা হলো না তাকে। রৌধিক নিজের অন্তঃকরণের ন্যায় শাড়ি পড়িয়ে দিতে লাগলেন। তার দুষ্টু মিষ্টি স্পর্শের সাথে শাড়ি পড়ান শেষ করলেন। চোখের বাঁধন খুলে দাঁড় করালেন। হাঁটু মুড়ে পায়ের কাছে বসলেন। স্বযত্নে শাড়ির কুচি ঠিক করলেন। স্বচ্ছ দর্পণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে গহীন নেত্রে দেখলেন সবকিছু। টেনে টেনে বললেন,
“বাহ্। অসাধারণ লাগছে তোমায়? তোমার ভালো লাগছে কী?”

আমার ধ্যানের ছেদ ঘটল। চটজলদি তাকাতেই মায়ায় হারালাম। শাড়িতে আমাকে ভালো লাগছে কি-না জানা নেই, তবে রৌধিকের পাশে দাঁড়ানোর ফলে আমাকে হাজার গুণ সুন্দর লাগছে। মেইড ফর ইচ আদার। লজ্জানত হলাম। রৌধিক চিবুক উঁচু করলেন। নেশাল মানুষের ন্যায় বললেন,
“কাল রাতের পরেও এত লজ্জা। আচ্ছা মেয়েদের এত লজ্জা আসে কোথা থেকে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, বাসর ঘরে বসে আছ। আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন তুমি এত লজ্জা পাও নি।”
বা’হাতটা রৌধিকের অধরের উপর রেখে থামিয়ে দিলাম তাকে। তার বলা প্রতিটা কথা কাঁধে স্পর্শ করছে। বিধায় সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। খাবারের নিমিত্তে ডাক পড়ল। তাই নিচে নামলাম।

“রৌধিক, শেষবারের মত একটু জড়িয়ে ধরবেন আমায়। প্লীজ।
এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? দেরি হচ্ছে যাচ্ছে তো। সবাই নিচে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
রৌধিকের ভাবাবেগ নেই। সে স্থির। বাধ্যহয়ে আমিই তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। দৃঢ় করে কিয়ৎক্ষণ নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে রইলাম। অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর আমি ছেড়ে দাঁড়ালাম। হাতের সাহায্যে রৌধিকের মাথাটা এনে অধর ছুয়ে দিলাম। হাসির আধো আধো স্বর টেনে বললাম,
“নিজের যত্ন নিবেন। আমার সাথে কথা বলতে ভুলবেন না। তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।”
বিনিময়ে তিনিও তার অধর জোড়া ললাটে ছুঁয়ে দিলেন। বাঁধ ভাঙাল আমার। নিভৃতে লুকিয়ে রাখা অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল নিচে। রৌধিকের বুকে মাথা রেখে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক নিশ্চুপ। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কেঁদো না, আমি যাবো না।”
“যাবেন না, মানে কী?”

“যাবো না মানে তোমাকে ছেড়ে আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। ফ্রাইট ক্যান্সেল।”
আমি চটজলদি নেত্রযুগল মুছে নিয়ে অকপটে কণ্ঠে বলি, “শুনেন। একদম না। দেখুন আমি কাঁদছি না। আমি কেন কাঁদব? আমি তো এখন হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাব।”
বলেই মুখ ভেংচি কাটলাম। রৌধিক ভ্রু কুঁচকালেন। অধর কামড়ালাম আমি। একটু বেশিই বলে ফেলেছি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে, “এবার একটু বেশিই হয়ে গেল না?”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। রৌধিক গতিহীন পা দুটো গতিশীল করে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন। লহমায় অদৃশ্য হল আমার মুখের প্রাণবন্ত হাসিটা। আমি ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক পেছনে না চেয়েই গাড়িতে উঠে বসলেন। নিচে নামলাম না। সকলে এগিয়ে দিতে বিমানবন্দর অবধি যাবে। কেন তাকালেন না? আমি শেষবারের নিমিত্তে তার ন্যায় সুদর্শন সুপুরুষের প্রেমে তীব্রতর ভাসতে স্পৃহা প্রকাশ করলাম।‌ কিন্তু ব্যর্থ হলাম। তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে দেওয়া জায়গাটায় ডানহাত স্পর্শ করলাম। গলা ধরে আসছে। ধরে ধরে ঘর অবধি গেলাম। বেডের উপর বসতেই নিজেকে সংযত করতে ব্যর্থ হলাম। বালিশে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক নেই। আমার অগোচরে বিরাজমান।

ভাবী ডাকে হুস ফিরে আমার।‌ দ্রুত নেত্র মুছে উঠে বসলাম। মাত্রারিক্ত কান্নার ফলে এখনও ক্রমাগত হেঁচকি তুলছি। আদ্রিতা আপু এসে বসলেন। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। আমি পানি পান‌ করলাম। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” যখন এতো ভালোবাসিস, তাহলে ভাইয়ের সাথে লন্ডনে গেলেই পারতি। শুধু শুধু কেঁদে চোখ মুখের এত খারাপ হয়েছে।”
আমি নতজানু হয়ে বসলাম। আদ্রিতা আপু আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে এসেছেন।‌ আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিন। ইয়ানাত আপু যেই স্কুলে পড়ান সেখানে ছোট করে উৎসব অনুষ্ঠিত করা হয়েছে। রৌধিক যাওয়ার পূর্বে কড়া গলায় তাকে শাসিয়ে গেছেন, তিনি যাওয়ার পর যাতে আমাকে নিয়ে বৈশাখী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। আমি অসম্মত। অথচ আদ্রিতা আপু কিছুতেই আমাকে রেখে যাবেন না। রৌধিক জানতে পারলে তার অবশ্যই শোচনীয় করবেন।
মুখে পানির ছিটা দিতে ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৯

আদ্রিতা আপুর সাথে যাওয়া হল না। ভার্সিটিতে গেলাম। অহি ফোন করে আসতে বলেছে। বড় করে আয়োজন করা হয়েছে। আদ্রিতা আপুকে বলতেই তিনি সম্মতি দিলেন। যেহুতু ফ্রেন্ডদের সাথে থাকব সেহুতু মন খারাপ হওয়ার কোনো উপায় নেই। আমি বেরিয়ে এলাম ভার্সিটির অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে।
“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।”
গান বাজছে। এখনও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়নি প্রধান অতিথি। তাই মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। আমি ভিড় ঠেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অহি হাত টেনে এক পাশে নিয়ে এলো। সেখানে সিনিয়ররাও ছিলাম। আমাকে দেখে বেজায় খুশি হয়েছেন, বুঝতে পারলাম। জড়িয়ে ধরে বলেন, কেমন আছি, এতদিন কেন আসিনি। আজ আমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৩১