অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৫

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৫
ইফা আমহৃদ

“সত্যিটা না জেনে একটা ছেলের সাথে মিশিয়ে কী বলেছিলে, মনে আছে? এক্সিডেন্টলি সেই ছেলেটি আমার হাসব্যান্ড। তোমরা জানো, তবুও আমি কেঁদে ছিলাম। একজন ছেলে যদি ঐকথাগুলো বলত বিশ্বাস কর, আমি তেমন কিছু মনে করতাম না। কিন্তু যখন তোমরা মেয়ে হয়ে বলেছ, আমার মরে যেত ইচ্ছে করছিল।” ওদেরকে বলতে না দিয়ে নিজেই বললাম।

মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো একটু বেশিই বলে ফেললাম। ঠোঁট হেলিয়ে হাসলাম মৃদু। তাদের কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, তবে এইধরনের ভুল আর করো না।”
“তুমি কী ভালো গো। এতো সহজে সবকিছু ভুলে গেলে।”
অহি এগিয়ে এসে সরল ভাষায় বলে, ” ও তো এমনই, তাইতো আমার বেস্টফ্রেন্ড।”
একে একে সবার সাথে বন্ধুত্ব হলো। ওরা দুজন মেয়ে দুজন ছেলে। আগে সিনিয়র সিনিয়র ভাব নিত। ভার্সিটিতে ঘুরা হলো। আড্ডা দেওয়া হলো। ল্যাকের পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। হাওয়া বইছে। রাস্তার দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখলাম রৌধিকের মতো। একটা মেয়ের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। চিন্তিত তার মুখ। কেমন শুকিয়ে গেছে। পড়নে ঢিলেঢালা শার্ট। উসকোখুসকো চুল। ব্যাগ নিয়ে ছুটলাম। রৌধিকের সামনে গিয়ে পথ আঁটকে দাঁড়ালাম। রৌধিক খেয়াল করল না। না তাকিয়েই সরে গেলেন। আমি আবার পথ আটকালাম। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সমস্যা কী?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পরক্ষণেই বললেন, “তুমি?”
“হম। আমি। কোথায় যাচ্ছেন?”
“কাজ আছে, সরো।”
“না, সরব না। আগে বলুন কোথায় যাচ্ছেন?”
রৌধিক পাশের মেয়েটিকে হাঁটতে বললেন। মেয়েটি মুচকি হাসল। চোখ আড়াল হতেও বললেন, “বিরক্ত করছ কেন? আর চোখ মুখের এই হাল হয়েছে কী করে? খাওয়া-দাওয়া করো না না-কি! যাও বাড়িতে যাও। আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। বাড়ির কারো সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করলেন। আমি আহামকের ন্যায় চেয়ে করল। আমাকে পাত্তা না দিয়েই চলে গেলেন। শূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।

হাঁটছি। মাঝরাস্তায় এসে চোখ পড়ল ঝুলন্ত পত্রিকার উপরে। আগুনে পুড়ে যাওয়ার ছবি। বড় বড় অক্ষরে লেখা, “আহম্মেদ ইন্ডাস্ট্রিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। হাত পা জমে যাচ্ছে আমার। আমি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা হাতে নিলাম। আমাদের অফিসের ছবি। কি সব লিখেছে তারা। উপরে দৃষ্টি যেতেই দেখতে পেলাম কিছুদিন আগের তারিখ। যেদিন রৌধিক আমাকে মাঝরাস্তায় ফেলে এসেছিল। এতবড় একটা দুর্ঘটনা আমাকে কেন জানায়নি। বাড়ির সবার কী অবস্থা। ঘটনাটা কি আদৌ সত্য।

ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রৌধিকের নাম্বারে ফোন করলাম। ব্যালেন্স নেই। ব্যাগের ভেতরে রেখে এদিক ওদিকে ফ্লাক্সলোডের দোকান খুঁজলাম। ব্যালেন্স লোড করলাম। রৌধিকের নাম্বারে ফোন করলাম। তিনি রিসিভ করলেন। হ্যালো বলতেই ফোন রেখে দিলেন। তাকে আর পাওয়া গেল না। বাড়িতে ফোন করলাম সেখানেও কাউকে পাওয়া গেল না। কী করব কিছুই বুঝতে পারলাম না। রিক্সা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়িতে বড় একটা তালা ঝুলছে। দাড়োয়ান চাচাকে দেখতে পাচ্ছি না। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা, এখানে প্রবেশ নিষেধ।
একই রিক্সায় করে অফিসের সামনে গেলাম। পুলিশ পাহারায় রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এখনো কাজ করছে।
আদ্রিতা, বাবা মা কোথায় গেছে? হঠাৎ করেই আহির সারার কথা মনে পড়ল। আমরা তো একই অফিসে চাকরি করতাম। সারাকে ফোন দিতেই রিসিভ করল। যেন আমার ফোনের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল।
“হ্যালো। সারা বলছিস। অফিসে কী হয়েছে বল তো?”
অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে, “কী হয়েছে মানে তুই কিছু জানিস না?”

“আশ্চর্য তো! আমি জানি না বলেই তো তোর কাছে জানতে চাইছি। বলার হলে বল, নাহলে ফোন রাখ।”
“সেদিন মাঝরাতে খবর পেলাম আগুন লেগেছে। হন্তদন্ত হয়ে অফিসে যাই। শর্ট সার্কিটের ত্রুটির কারণে। এটা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছে। তবে আমাদের ধারণা, সবকিছু আরু করেছে। সেদিন তাকে অফিসের আশেপাশে ঘুরতে দেখা গেছে। শুনেছি, ব্যাংক থেকে অনেক টাকা লোন নেওয়া আছে। বাড়িটা বন্ধক রাখা ছিল। বাড়িটা ব্যাংকের দখলে। একমাস সময় দেওয়া হয়েছে। টাকা পরিশোধ করতে পারলে, বাড়িটা ফেরত পাবে।”
আমি স্তব্ধ। সারা ওপাশ থেকে বলেই চলেছে। কিন্তু কোনো কিছুই আমার কানে আসছে না। সবকিছু অস্পষ্ট। বসে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে। সবকিছু আমার জন্য হয়েছে। আরু আমার উপর ক্ষোভের বশে আগুন লাগিয়েছে। আমার জন্য তাদের মস্তবড় একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। চোখজোড়া ছলছলিয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই বড় একটা ক্ষতি করে ফেললাম।‌ কিভাবে বাড়ি ফিরে যাবো।
তৎক্ষণাৎ কাঁধে হাত রাখল কেউ। চোখজোড়া মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ইভুকে নজরে এলো। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কী অবস্থা করেছ চোখ মুখের? আয়নায় দেখেছ নিজেকে। চলো। কেঁদো না, বাড়িতে চলো।”
“আদ্রিতা, বাবা মা ওরা কোথায়?”
“আমাদের বাড়ি আছে। চলো। তুমিও সেখানে থাকবে।”
ইভু আমাকে ধরে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। বোতল এগিয়ে দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে বলল। আমিও মুখে পানি ছিটিয়ে নিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ি এসে থামল আমহৃদ বাড়ির সামনে। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। মনে হলো এই বাড়িতে আমি আরও এসেছি। কিন্তু কখনো চোখের দেখাও দেখি নি।
সোফায় বসে আদ্রিক আহম্মেদ এবং তার পাশে বসে আছে ইমতিয়াজ আমহৃদ। প্রাণের বন্ধু। রৌধিকের বউ করার জন্য তিনিই আদ্রিক আহম্মেদকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে বিয়েতে দেখা যায়নি। কিছুটা দূরে বসে আছে মৌমিতা এবং আদ্রিতা। মৌমিতাকে শান্তনা দিচ্ছে মিসেস মিতালী। তাদের মাঝেও বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। কিছুটা দূরে বসে ফোন টিপছে ইয়ানাত।

মাথা নত করে বাড়িতে ঢুকলাম আমি। আমাকে দেখেও ক্ষিপ্ত হলেন মৌমিতা। হিংস্র বাঘের ন্যায় ছুটে এলেন। পরিস্থিতি বোধগম্য হওয়ার আগেই হামলে পড়লেন। একের পর এক চড় বসালেন গালে। গলা চেপে ধরলেন। খুক খুক করে কেশে উঠলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যথারীতি চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।‌ মৌমিতার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার হিংস্র শক্তির কাছে আমি তুচ্ছ।
“মা, কী করছ তুমি? ছাড়ো।”
আদ্রিতা কথায় ধ্যান ভাঙল সবার। আমার থেকে মৌমিতাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন।‌ অনেক চেষ্টার পর আদ্রিক আহম্মেদ মৌমিতাকে সরিয়ে নিলেন। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“পাগল হয়েছ তুমি মৌমি। এভাবে কেউ কাউকে ধরে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে।”
“আমি তো হওয়ার জন্যই ধরেছি। এই মেয়েটার জন্যই আমার সুখের সংসারে অসুখের ছাড়া নেমেছে। বিয়ে হয়েছে, মাস পেরুনোর আগেই আমাদের পথে নামতে হয়েছে।”
অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে। নিশ্চুপ আমি। রৌধিক বাড়ির পরিস্থিতি জানে বলেই আমাকে আনতে চায়নি। বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করতে বারণ করেছে। আগুন লাগার খবর পেতেই তিনি ছুটে গেছেন। হয়তো আমার কথা তখন মাথাই ছিল না। আর আমিই অন্যসব ভেবে বসে ছিলাম।
ফোড়ন কেটে বলে ইয়ানাত,

“সেদিনই বলেছিলাম, এই মেয়েটা এমনই। কিন্তু আমার কথা না শুনে উল্টো আমাকেই যা নয় তাই বলে রৌধিক বের করে দিতে বলেছে। তোমরাও ওর কথায় সায় দিয়েছিলে।”
ইভু ইনায়াতের কাঁধে হাত রেখে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। অতঃপর ইনায়াত রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেল। মৌমিতা থামল না। বলেই চলেছে, ” এই মেয়েটাকে টাকার বিনিময়ে আমার রৌদুর বউ করেছিলে না। টাকা তো পেয়েছে। এবার বিধেয় হও। আর কোনো দিন যাতে আমার চোখের সামনে তোমাকে দেখতে না পাই। তাহলে..
মিতালী মৌমিতাকে থামিয়ে দিলেন। আমাকে ধরে বললেন, “এই মেয়ে কী করেছে শুনি।”

“ওর‌ জন্যই রৌদু আরুকে অফিস থেকে বের করেছিল।”
“আরুকে বের করতে কী জোনাকি বলেছিল? রৌধিক ছোট বাচ্চা নয় যে, জোনাকি তাকে যা বলবে তাই করবে। জোনাকি তুমি আমার সাথে এসো।”
মিতালী আমাকে নিয়ে উপরে চলে এলো। ফাস্ট এইড বক্স বের করলেন। তুলোর সাহায্যের রক্তগুলো মুছিয়ে দিলেন। স্যাভলন লাগাতেই ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। স্বযত্নে ড্রেসিং করে দিলেন। নিজের কাবার্ড থেকে পছন্দ করে জামা কাপড় বের করে হাতে দিয়ে বসলেন শাওয়ার সেরে নিতে। নেমে গেলেন তিনি। তাকে ডাক দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কথা বলতে গেলে গলায় ব্যাথা পাচ্ছি।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৪

শাওয়ার সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম, হট ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বসিয়ে ধীরে ধীরে গলায় ছ্যাঁকা দিতে লাগলেন।‌ আমি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। মনে হলো, কোনো মা তার সন্তানকে ভালোবেসে সেবা করছে।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৬