অনেক সাধনার পরে গল্পের লিংক || অরনিশা সাথী

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১
অরনিশা সাথী

নূরপুর গ্রাম। গ্রামটা খুব বেশি বড় না হলেও একেবারে ছোটও না। গ্রামটির মাঠজুড়ে আছে ধানক্ষেত এবং সবুজ ফসলের মাঠ। দখিনা বাতাস দোলা দেয় সেই ফসলকে। আঁকাবাঁকা নদীর দু তীরে অবারিত সবুজ মাঠ। সবুজে বৃস্তিত পুরো গ্রাম৷ যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারহ। প্রকৃতি যেন আজ সবুজে সবুজে নতুন করে সেজে উঠেছে।

কাল সারারাত ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় পর ভোরের দিকেই বৃষ্টি থেমেছে। বৃষ্টির পর প্রকৃতি আরো সুন্দর সতেজ হয়ে উঠেছে। স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে চারপাশ। গ্রামের সারি সারি গাছপালা, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, ফসলের ক্ষেত, বসতবাড়িতে শান বাঁধানো পুকুরের ঘাট। প্রকৃতির এরকম অপরুপ সৌন্দর্যের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে চায় সকল প্রকৃতি-প্রেমীর মন। সবকিছু দেখলে মনে হবে এ যেন শিল্পীর রংতুলি দিয়ে আঁকা কোনো ছবি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে দুরন্তপনার সাথে হেঁটে যাচ্ছে দুই কিশোরী। পরনে কলেজ ড্রেস, চুলগুলো দুই বিনুনি করা আর কাঁধে কলেজ ব্যাগ৷ কাল সারা রাত ধরে বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাঠঘাট গাছপালা সবকিছুই ভেজা ভেজা। কাঁদা মাটির উপর দিয়েও কি সুন্দর দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছে দুই কিশোরী। একজন রুজবা এবং অন্যজন ফারিন। দুজনেই প্রানের বান্ধবী। পাশাপাশি বাড়ি। ক্লাস ওয়ান থেকে দুজনে একইসাথে পড়াশোনা করছে৷

দুজনের এত্ত মিল দেখে মনে হবে বান্ধবী না দুই বোন। এইবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে দুজনেই। রুজবার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের। আর ফারিনের হলদে ফর্সা৷ দুজনেরই কোমড় সমান চুল, পার্থক্য শুধু রুজবার চুল সিল্কি আর ফারিনের চুল একটু আঁকাবাঁকা। রুজবা ওদের বাড়ি থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই বড় রাস্তা। সেখান থেকেই রিকশা ধরে দুই বান্ধবী রোজ কলেজে যাওয়া আসা করে।

কলেজে আসতেই কিয়ানের সাথে দেখা হলো দুই বান্ধবীর। কিয়ান হচ্ছে ফারিনের বয়ফ্রেন্ড, এবার মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে৷ ফারিনদের পাশের বাড়ির মেয়ে জান্নাত ওর দেবর হয় কিয়ান। ফারিন রুজবা জান্নাত তিনজনের বাসা পাশাপাশি। জান্নাত ওদের থেকে অনেকটা বড়। রুজবার দূরসম্পর্কের ফুপাতো বোন হয় জান্নাত। বছর দুয়েক আগেই বিয়ে হয়। সেখান থেকেই ফারিনকে ভালো লেগে যায় কিয়ানের। বেশ কয়েকমাস পেছনে ঘুরিয়ে তারপর কিয়ানের সাথে সম্পর্কে যায় ফারিন। কিয়ান এবং ফারিন দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসে। তবে ব্যাপারটা জান্নাত জানে না। জানলে হয়তো এই সম্পর্ক কখনো হতো না। কিয়ান হাসিমুখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো দুই বান্ধবীর সামনে। রুজবা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

–“ভালো আছেন ভাইয়া?”
–“আলহামদুলিল্লাহ, তোমাদের কি খবর ভালো তো?”
–“জ্বি ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ।”
রুজবা দুজনকে বাই বলে ক্লাসের দিকে চলে গেল। ও এইটা রোজ করে। প্রতিদিন কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিয়ান, রুজবা আর ফারিনের জন্য অপেক্ষা করে। ওরা আসলেই রুজবা টুকটাক কথা বলে আগে আগেই ক্লাসের দিকে চলে যায়। এইটুকু সময় কিয়ান আর ফারিন দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। কিয়ান গেট থেকে ক্লাস অব্দি ফারিনকে দিয়ে নিজের ক্লাসে চলে যায়। রুজবা যেতেই কিয়ান ফারিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“কি ব্যাপার? ম্যাডাম আজ কথা বলছে না যে?”
–“সবসময় তো আমিই বকবক করি, আজ না হয় তুমি করলে।”
–“যথা আজ্ঞা ম্যাডাম।”
কিয়ানের কথায় ফারিন মৃদু হাসলো। ফারিনের হাসি দেখে কিয়ানের মুখেও হাসি ফুটলো। কিয়ান হেসেই বললো,
–“রুজবা রোজ এভাবে আগে আগে চলে যায় কি আমাদের স্পেস দেওয়ার জন্য? নাকি ওর জন্যও কেউ অপেক্ষায় আছে?”

–“আজ্ঞে না, ও আমাদের স্পেস দেওয়ার জন্যই চলে যায়।”
–“তুমি রুজবাকে একটু বোঝাতে পারো না?”
কিয়ানের কথায় ফারিন হাঁটা বন্ধ করে থেমে যায়। তারপর কিয়ানের দিকে পূর্ন দৃষ্টি রেখে বললো,
–“কোন ব্যাপারে?”

–“নুহাশ সত্যিই রুজবাকে অনেক ভালোবাসে, এইটা রুজবা কেন বুঝতে পারছে না?”
ফারিন কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। কিয়ানের কথার জবাবে ও ঠিক কি বলবে খুঁজে পেলো না। জীবনটা রুজবার, ও নিজেই ঠিক করবে ও কাকে ভালোবাসবে আর কাকে ভালোবাসবে না। এতে তো ফারিনের কিছু বলা বা করার নেই। রুজবা যেহেতু বলেছে ও সম্পর্কে জড়াবে না তাহলে ফারিন তো আর এতে জোর করতে পারে না। কিয়ান ফারিনের হাত ধরে বললো,

–“কি ভাবছো?”
–“কিছু না__কিয়ান এইটা রুজবার জীবন ও তো বলেছে কোনোরুপ সম্পর্কে জড়াবে না ও। তাহলে এতে তোমার বা আমার কি করার থাকতে পারে বলো?”
–“তুমি তো একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে__”
–“আমরা এ বিষয়ে কথা না বলি কিয়ান?”
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কিয়ান। ফারিন ততক্ষণে হাঁটা শুরু করেছে। কিয়ান ফারিনের পাশে যেতে যেতে বলল,

–“আচ্ছা, এই বিষয় বাদ। আজ কি ইমপোর্টেন্স ক্লাস আছে তোমার?”
–“কেন বলো তো?”
–“বের হতাম তোমাকে নিয়ে।”
–“দুই ক্লাস করে বের হই?”
–“আচ্ছা, তাহলে রুজবাকে সাথে নিও।”
কথা বলতে বলতে ফারিনের ক্লাসের সামনে চলে এলো ওরা। ফারিন ছোট্ট করে ‘আসছি’ বলে ক্লাসে চলে গেল। কিয়ানও নিজের ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ ক্লাস থেকে বের হলো ফারিন আর রুজবা। ক্যাম্পাস থেকে বের হতেই দেখলো কিয়ান আর নুহাশ পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। নুহাশ ফারদিন, কিয়ানের বেস্টফ্রেন্ড প্লাস চাচাতো ভাই। ছেলেটা নাকি জান্নাতের বিয়ের সময় থেকেই রুজবাকে পছন্দ করে। পছন্দ বললে ভুল হবে, ভালোবাসে। আর এটা রুজবা কয়েক মাস আগেই কিয়ান আর ফারিনের মাধ্যমে জানতে পারছে নুহাশ ছেলেটা রুজবাকে ভালোবাসে, রীতিমতো পাগল ওর জন্য। কিন্তু রুজবা প্রতিবারই এসব থেকে দূরে থেকেছে। ছেলেটাকে অকারণেই রুজবার একদম পছন্দ না। কিয়ান দুটো রিকশা ডাকতে চাইলে রুজবা বললো,

–“আমি রিকশায় করে যাবো না। আর গেলেও ফারিন আর আমি এক রিকশায় যাবো।”
রুজবার কথায় কিয়ান অসহায় স্বরে বললো,
–“এমন করো কেন? কিছু সময়ই তো, আর নুহাশের সাথে এক রিকশায় গেলে তো ভালোবাসা হয়ে যাবে না তোমাদের।”

–“তাহলে আপনারা গিয়ে ঘুরে আসুন, আমি বাসায় যাচ্ছি।”
রুজবা চলে যেতে চাইলে ফারিন ওর হাত চেপে ধরে। ইশারায় থাকতে বলে রুজবাকে। নুহাশ দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে নিরবে। মেয়েটা এত পুড়ায় কেন ওকে? ওর ভালোবাসাটা কি বুঝবে না কখনো? ফারিন কিয়ানকে বলল,
–“অটোরিকশা নাও।”

ফারিনের কথামতো কিয়ান তাই করলো৷ ফারিন উঠে বসতেই কিয়ান চট করে ফারিনের পাশে বসে পড়লো। রুজবা চোখ কটমট করে কিয়ানের দিকে তাকাতেই কিয়ান কান ধরে বললো,
–“স্যরি শালীকা, এখন তো আর আলাদা আলাদা রিকশায় নেই। এইটুকু একটু ম্যানেজ করে নাও প্লিজ।”

রুজবা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নুহাশের থেকে বেশ দূরত্ব রেখে বসলো। অটোরিকশা চলতে শুরু করলো। বেশ অনেকটা সময় বাদে একটা নিরিবিলি পার্কের সামনে এসে অটোরিকশা থামতেই ওরা চারজনে নেমে পড়লো৷ ফারিন আর রুজবা আগে আগে হেঁটে পার্কের ভিতর ঢুকে পড়লো৷ ভাড়া মিটিয়ে ওরা দুজনেও পার্কের ভিতর গেলো৷ কিয়ানকে দেখে রুজবা অন্য পাশে চলে গেলো৷

পাশাপাশি একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ফারিন আর কিয়ান। কিয়ানের কাঁধে ফারিন মাথা রেখে বসে আছে৷ ফারিনের হাতদুটো কিয়ানের হাতের মুঠোয়৷ সামনের একটা পুকুরে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ফারিন। কিয়ান ফারিনের আঙুল গুলো উল্টেপাল্টে নাড়তে লাগলো। ফারিনের আঙুলের মাঝেই দৃষ্টি রেখে বললো,
–“এভাবে লুকিয়ে চুড়িয়ে আর কতদিন প্রেম করতে হবে আমাদের?”
ফারিন দৃষ্টি সরিয়ে কিয়ানের দিকে তাকালো। ধীর কন্ঠে বললো,

–“তুমি কি সবাইকে দেখিয়ে প্রেম করে বেড়াতে চাও নাকি?”
–“এত লুকোচুরি ভালো লাগে না আর। ভাবীকে অন্তত বলি? ভাবী ছাড়া আর কেউ তো হেল্প করবে না এ ব্যাপারে।”
–“একদম না। জান্নাত যাতে কিচ্ছু না জানে।”
–“আচ্ছা প্রেমের ব্যাপারে না বলি৷ বিয়ের কথা বলি?”
–“কোনো বাবা-মা তার মেয়েকে বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না কিয়ান। তুমি পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করো। আমার বাড়ি থেকে আপাতত বিয়ের কোনো চাপ নেই।”

–“তোমাকে হারাতে পারবো না ফারিন।”
–“তুমি হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিও না, তাহলেই হবে।”
এভাবেই নানান ধরনের কথোপকথন চলতে লাগলো দুজনের মাঝে৷ কিয়ানের মনে হুটহাট করেই ফারিনকে হারানোর ভয় জাগে৷ তাই তো জান্নাতকে জানাতে চায় ও ফারিনকে ভালোবাসে আর ফারিনকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু ফারিন এটা কিছুতেই জান্নাতকে জানতে দিতে চায় না। ওর ধারনা জান্নাতের মা এই সম্পর্ক কখনো হতে দিবে না। সেই ভয়েই ফারিন আপাতত কাউকেই জানাতে দিতে চায় না ওদের সম্পর্কের কথা।

দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে রুজবা৷ ওর থেকে কিছুটা দূরের একটা বেঞ্চিতে বসেই নুহাশ আড়চোখে রুজবাকে দেখছে। যা রুজবার চোখ এড়াচ্ছে না৷ চোখে চোখ পড়লেই নুহাশ দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় রুজবার থেকে। বিরক্তির মাঝেই এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে নুহাশের ভয়ার্ত চাহনী দেখে৷ রুজবা যেমন অকারণেই নুহাশকে পছন্দ করে না, নুহাশও তেমন অকারণেই রুজবাকে দেখলে কেমন যেন হয়ে যায়৷ রুজবার মুখে হাসি দেখে নুহাশ বুকে হাত দেয়। আর মনে মনে ভাবে,

–“ইশ্! মেয়েটা কেন যে এত পুড়ায় আমায়, ভেবে পাই না৷ ভালোবাসার এত দহন যে আমি আর নিতে পারছি না৷ এত অবহেলা কেউ কাউকে করে? ভালোই তো বেসেছি, ভালোবাসায় এত কষ্ট বুঝি? কই কিয়ান আর ফারিনের ভালোবাসা তো কত মধুর। তাহলে আমার ভালোবাসা আমাকে এত পুড়ায় কেন? তার প্রতি যে আমার এত প্রেম এত ভালোবাসা মেয়েটা কি বুঝে না? কবে বুঝবে আমাকে? আর কবে বুঝবে আমার ভালোবাসা?”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২