অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৬

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৬
অরনিশা সাথী

নিজের কেবিনে ফোন রেখে একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে গেছে নুহাশ। এ সময়ে কোনো ফোন কলস আসবে না বলেই ফোন কেবিনে রাখা। নুহাশের ফোন বাজছে। পর পর দুবার বেজে কেটে গেছে। লিয়া আজ অফিসে এসেছে শুধুমাত্র নুহাশের সাথে দেখা করার জন্য। ইচ্ছে আছে নুহাশকে নিয়ে কোনো নামি-দামি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করতে যাবে।

নুহাশের কেবিনে প্রবেশ করে নুহাশ’কে না দেখতে পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। সেই মূহুর্তে আবারো ফোন বেজে উঠে। লিয়া ধরবে কি ধরবে না ভাবতে থাকে। ফোনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই ফোন কেটে যায়। ম্যাসেজ টোন বেজে উঠে এবার। লিয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখে কিয়ান ম্যাসেজ করেছে হোয়াটসঅ্যাপে। লিয়া ম্যাসেজ সিন করে। কিয়ান লিখেছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“রুজবার বিষয়ে কথা আছে নুহাশ, ফোন তুলছিস না কেন?”
ম্যাসেজ সিন হওয়ার পর ওপাশ থেকে আবারো ম্যাসেজ আসলো,
–“রুজবার ব্রেক-আপ হয়েছে। জারাফ ঠকিয়েছে রুজবাকে, অনেক ভেঙে পড়েছে ও।”
লিয়া’র রাগ হলো ম্যাসেজ দেখে। নুহাশ যদি এখন এই ম্যাসেজ দেখে তাহলে নিশ্চিত যত দ্রুত সম্ভব বিডিতে ব্যাক করবে। যা লিয়া কোনো ভাবেই চায় না। লিয়া ম্যাসেজ করলো,

–“রুজবার নাম শুনতে চাই না আমি। ওর ব্রেক-আপ হয়েছে এখন আমি কি করবো? ওকে তো ওর মতো করে ভালো থাকতে দেওয়ার জন্যই ছেড়ে এসেছিলাম আমি। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়েছি আমি। এখন আমি আর রুজবার বিষয়ে কিছু ভাবতে চাই না। ওর ব্যাপারে জানাতে হলে আমাকে আর ফোন/ম্যাসেজ দিস না।”
সাথে সাথেই কিয়ান রিপ্লাই করলো,

–“এসব কি বলছিস? রুজবাকে তুই এত সহজে ভুলতে পারিস না। এটা আমি খুব ভালো করে জানি। তাছাড়া গত দুদিন আগেও তুই রুজবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিস আমায়।”
–“মানুষ পরিবর্তনশীল, তেমনি আমিও পরিবর্তন হয়েছি৷ আমি চাই না এ বিষয়ে আর কোনো কথা হোক আমাদের।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে কনভারসেশন ডিলিট করে দিলো। নুহাশের ম্যাসেজ দেখে কিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেলো। নুহাশ যে এসব বলেছে বা বলতে পারে কিয়ান সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।

লিয়া ফোনটা জায়গা মতো রেখে পৈশাচিক হাসি দিলো। ওর এখন শান্তি শান্তি লাগছে। কিয়ানটা আর কিছু না বললেই হলো। লিয়া কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় নুহাশ কেবিনে প্রবেশ করে। লিয়াকে নিজের কেবিনে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। লিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো,

–“তোমাকে খুঁজতেই এসেছিলাম।”
নুহাশ কেবিনে গিয়ে চেয়ারে নিজের কোর্ট’টা রেখে চেয়ারে বসে বললো,
–“কেন? কি দরকার?”
–“একসাথে লাঞ্চ করতাম।”
লিয়ার কথায় নুহাশ ঘড়িতে সময় দেখলো। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। নুহাশ উঠে কোর্ট হাতে নিয়ে বললো,

–“চলো যাওয়া যাক।”
লিয়া খুশি হয়ে গেলো নুহাশ রাজি হওয়াতে। নুহাশ টেবিল থেকে ফোনটা তুলে লিয়ার সাথে হাঁটা লাগালো৷ মেয়েটা আজ কয়েকদিন ধরেই পাগল বানিয়ে ছাড়ছে ওর সাথে বাইরে লাঞ্চ করার জন্য। তাই আজ আর কোনো উপায় না পেয়ে রাজি হলো নুহাশ।

একটা রেস্টুরেন্টের কোনার এক টেবিলে বসে আছে নুহাশ আর লিয়া। খাবার অর্ডার দিয়েছে এখানে এসেই। নুহাশ ফোন নিয়ে এফবিতে স্ক্রল করছে। হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ আসায় নুহাশ এফবি থেকে বেরিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে গেলো। পরিচিত এক ফ্রেন্ডের ম্যাসেজ। টুকটাক ম্যাসেজ হলো দুজনের৷ নুহাশ হঠাৎ খেয়াল করলো কিয়ানের আইডি’টা নেই। ভ্রু কুঁচকে ফেললো ও।

দুদিন আগেও কিয়ানের সাথে কথা হয়েছে এরপর আর হোয়াটসঅ্যাপে অন্যকারো সাথে কথা হয়নি নুহাশের। সেই হিসেবে কিয়ানের আইডিটা উপরেই থাকার কথা। কিন্তু কিয়ানের আইডি নেই। নুহাশ ভাবলো ও নিজেই হয়তো কোনো ভাবে ডিলিট করে দিয়েছে। তাই এ বিষয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে বেরিয়ে গেলো হোয়াটসঅ্যাপ থেকে।

অথচ নুহাশ জানতেও পারলো না কিয়ান আজই রুজবার বিষয়ে বলার জন্য ম্যাসেজ করেছিলো ওকে। এদিক থেকেও লিয়া উল্টাপাল্টা ম্যাসেজ করে জানিয়েছে রুজবার বিষয়ে কোনো কথা না বলতে৷ কথাগুলো কি নুহাশের অজানা’ই থেকে যাবে? নুহাশ কি কখনো জানতে পারবে রুজবা জারাফের থেকে বাজে ভাবে ঠকেছে? এমন কি রুজবা সুইসাইড অব্দি করতে গিয়েছিলো এটাও কি কখনো জানবে নুহাশ?

বিকেলে নিজের ঘরে বসে ফেসবুকিং করছে রুজবা। এর মাঝে দুটো মাস কেটেছে। রুজবা এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। এখন আর কষ্ট হয় না আগের মতো। কষ্ট হলেও সেটা সহ্য করার ক্ষমতা জন্মে গেছে রুজবার। তবুও প্রতি রাতেই কাঁদে ও। জারাফের কথা মনে হলে ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছে।

রুজবার শরীরে হালকা জ্বর জ্বর ভাব৷ তাই আর আজ ভার্সিটি যায়নি ও। শারমিন যেতে দেয়নি৷ বিরিয়ানির একটা ভিডিও সামনে আসতেই রুজবার ইচ্ছে হলো বিরিয়ানি রান্না করতে। যদিওবা টুকটাক সব রান্না জানে রুজবা। শুধু বিরিয়ানিটা কখনো ট্রাই করেনি। ভাবলো আজ একবার দেখা যাক বিরিয়ানি রান্না করতে পারে কিনা। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোনটা বিছানায় রেখে শারমিন বেগমের ঘরে চলে গেলো। শারমিন বেগম বিছানায় বসে নকশি কাঁথা সেলাই করছিলেন। রুজবা বললো,

–“মা, বিরিয়ানি রান্না করি আজ? তুমি আমাকে একটু দেখিয়ে দিবে?”
শারমিন বেগম মুচকি হেসে বললো,
–“আচ্ছা। ফ্রিজ থেকে মাংস’টা বের কর তাহলে। বিরিয়ানিতে যা যা লাগবে আমি সব রেডি করে রাখছি।”
রুজবা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো কিচেনে। মুরগি বের করে একটা পাত্রে ভিজিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ বাদেই শারমিন বেগম এসে সবকিছু জোগাড় করতে শুরু করেন। পেয়াজ মরিচ কাটা শেষ করে গরম মশলা বাটতে বসেন শিলনোড়ায়। রুজবা বললো,

–“মাগরিবের পর রান্না করি?”
শারমিন মাথা নাড়াতেই রুজবা আবার নিজের ঘরে চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে শারমিন তপ্ত শ্বাস ফেলে। জারাফের সাথে ব্রেক-আপের পর মেয়েটা কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো। আগের মতো আর হাসিখুশি প্রাণবন্ত নেই। মেয়েটা কেমন ছিলো আর কেমন হয়ে গেলো। জারাফের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত উনি রুজবাকে এভাবে ঠকানোর জন্য। রুজবার এরকম মলিন মুখটা যে সহ্য হয় না কারো। মাঝে মধ্যে আবার জারাফের জন্য আফসোস হয় এইটা ভেবে রুজবার খাঁটি ভালোবাসা এভাবে অবহেলায় হারালো জারাফ।

ঘরে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখলো সাহিল ফোন করেছিলো। রুজবা মুচকি হাসলো। বড় ভাইয়ের মতো ছেলেটা ওকে আগলে রাখে। ওর ভালো-মন্দের খেয়াল রাখে। জারাফের সাথে ব্রেক-আপের পর প্রতিদিন ফোন দিয়ে রুজবার খোঁজ নেয় ও। রুজবাকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করে। রুজবা সাহিলকে ফোন লাগালো। দু বার রিং হতেই সাহিল রিসিভ করে বললো,

–“হ্যাঁ রুজবা কেমন আছিস?”
–“ভালো সাহিল ভাই, তুমি কেমন আছো?”
–“আলহামদুলিল্লাহ, কি করছিস? ফোন তুললি না যে।”
–“কিচেনে ছিলাম তখন।”
–“রান্না করছিলি নাকি?”
–“নাহ তবে করবো সন্ধ্যার পর, বিরিয়ানি।”

–“ওয়াহ! আমার ফেভারিট। বাই দ্যা ওয়ে আমাকে আসতে বললি না যে বিরিয়ানি খেতে।”
–“রাঁধতে জানি না তো, আজ ট্রাই করবো।”
–“ব্যাপার না, ওটাতেই চলবে আমার। বাসার সামনে যাবো বক্সে করে দিয়ে দিবি আমাকে।”
–“তার থেকে বরং বাসাতেই চলে আসো, খেয়ে যেও।”
–“আংকেল, আন্টি?”

–“কিছু বলবে না, উনারা জানে রাফাতের মতো তুমিও আমার আর একটা ভাই। আর তুমিই আমাকে জারাফের সত্যিটা সামনে এনে দিয়েছো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও।”
–“আমি কিন্তু তাহলে সত্যিই আসবো।”
–“আচ্ছা, বিরিয়ানি ভালো হলে আনিকা আপুর জন্য দিয়ে দিবো আমি। তারপর আপু আবার আমার ওই বক্সে করে আমার জন্য কিছু বানিয়ে পাঠাবে, জোশ হবে না?”
–“একদম। এখন যা রান্না কর দ্রুত। বিরিয়ানির নাম শুনে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।”

রুজবা মৃদু হেসে লাইন কেটে দিলো। সাহিলের সাথে কথা বললে ও মন খারাপ করে থাকতেই পারে না। ছেলেটা ওকে কোনো না কোনো কারণে হাসবেই হাসাবে। রুজবা ফোন করে ফারিনকে আসতে বললো। দুজনে মিলে রান্না করা যাবে। সাথে শারমিন বেগম’ও আছেন সবটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।

বিরিয়ানি রাঁধতে রাঁধতে রুজবার জারাফের কথা মনে হলো। একবার জারাফের জন্য পাস্তা বানিয়ে নিয়েছিলো রুজবা। জারাফ খেয়ে তেমন কিছুই বলেনি। কিয়ান তো ফারিনের রান্নার অনেক প্রশংসা করে। অথচ রুজবা আশায় ছিলো জারাফ রুজবার রান্নার প্রশংসা করবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি, হবে কি করে? জারাফ যে তখন নিদ্রা’র সাথে ম্যাসেজ টাইপিংয়ে ব্যস্ত ছিলো। রুজবা যে তখন জারাফের লাইফে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিলো। তখন না বুঝলেও এখন রুজবা বেশ বুঝতে পারে। ফারিনের কথায় ধ্যান ভাঙে রুজবার। ফারিন আচমকা বললো,

–“নুহাশ ভাইয়ের বিরিয়ানি খুব পছন্দ, জানিস রুজবা?”
আচমকা নুহাশের কথা শুনে হকচকিয়ে যায় রুজবা। আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আমি কিভাবে জানবো?”
ফারিন আর কিছু বললো না। একদিন কলেজে ফারিন বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলো কিয়ান আর নুহাশের জন্য। তখন নুহাশ ফারিনকে বলেছিলো,

–“তোমার রান্না তো বেশ কয়েকবার খেয়েছি ফারিন, তোমার বান্ধবীর রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য কি হবে আমাদের?”
আচমকা নুহাশের স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই চমকে যায় রুজবা। হঠাৎ করে নুহাশের কথা মনে হলো কেন? ভেবে পেলো না। গত দুই বছরে তো নুহাশের কথা মনে পড়েনি তাহলে আজ কেন? রুজবা মনে মনে ভাবলো,

–“আমি কি নুহাশ ভাই কে খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন? হয়তো উনার কষ্ট’টা উনি আমার সামনে প্রকাশ করে নি। কিন্তু কষ্ট তো হয়েছিলো। নুহাশ ভাইয়ের কষ্ট আমি আজ বুঝতে পারছি। দুই বছর আগে নুহাশ ভাই যে কষ্ট’টা পেয়েছিলো আজ আমি সে কষ্ট’টা পাচ্ছি। ভালোবাসার দহনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাওয়ার কষ্ট।”
শারমিন বেগমের ডাকে হুশ ফিরে রুজবার। আগের সেসব অতীতের চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে রান্নায় মনোযোগ দেয়।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৫

|এত দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত আমি। জ্বর-ঠান্ডা লেগেছে। কাল দেইনি বলে আজ অসুস্থ শরীর নিয়েই ১২৮৫ শব্দের মধ্যে লিখে দিলাম। ছোট হয়েছে বলবেন না প্লিজ। আজ এতটুকুই পড়েন। আর কেমন হয়েছে অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন, ধন্যবাদ|

অনেক সাধনার পরে পর্ব ১৭