অবিনাশী পর্ব ১৬

অবিনাশী পর্ব ১৬
রেজওয়ানা আসিফা

রাত বাজে ১১ টা। কেউ কেউ ঘুমাচ্ছে। তানিয়া আর তিশা নূহার দুই হাতে মেহেদী দিচ্ছে।
বাড়ি ভরা মেহমান।
আসলে নূর বারন করেছিলো এতো অনুষ্ঠান এখন না করতে কিছু জামাল সিকদারের কথা, তার বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আর পরে উঠিয়ে নেওয়া মানে তার কাছে বাসী। এইজন্য এখনই সে অনুষ্ঠান করবে। অনেক আয়োজন করেছে। সব মেহমান চলে এসেছে। শুধু তমা আর আমান চৌধুরী বাদে। তাকাই কালকে আসবে। ওহ্! আরো একজনও আছে। আয়ান!

বিয়ে বাড়ির সুন্দর সুন্দর মেয়ের লোভে আয়ান আগেই আসতে চেয়েছিলো কিন্তু তমা আসতে দেয় নি। কারণ এখানে এসে উল্টা পাল্টা কিছু করলে নূরের মাইর একটাও নিচে পরবে না। সব ওর পিঠেই পরবে।
নূহা ঘুমে ঢলে পরছে তানিয়া জোর করে ধরে রেখেছে। ফাতেমা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পরেছে। তিশা যেই হাতে দিয়েছে সেই হাতে দেওয়া শেষ তাই সে ঘুমাতে চলে গেলো। সারাদিন প্রচুর কাজ করেছে সে।
বের হওয়ার সাথে সাথেই দেখা হলো নূরের সাথে। নূরের হাতে এক বাটি চানাচুর মাখা।
নূর হেসে জিগ্যেস করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

-কীরে কোথায় জাচ্ছিস?
তিশা বললো,
-ঘুমাতে জাচ্ছিলাম
হঠাৎ তিশা বাটিটার দিকে খেয়াল করলো,
বাটি থেকে চানাচুর খেতে খেতে বললো, কোথায় জাচ্ছো? এই গুলো নিয়ে? তুমি চানাচুর মেখেছো আর আমকে বলোনি?

-তোদের ঘরেই জাচ্ছিলাম। তানিয়া ভাবির নাকি খিদে পেয়েছে।
তিশা ভ্রু কুচকে বললো,
-তা তার খিদে পেয়েছে তুমি কীভাবে যানো? খুব নজর রাখছো নাকি ভাবির প্রতি?
-গাধি! ওই সময়ই খেয়ে উঠেই তো বললো ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই বানালাম।
-কই আমাকে নূহাকে বা অন্য কাউকে তো করে খাওয়াও না। আরো আমাদের দিয়ে সব কাজ করাও। আজ হঠাৎ কী এমন হলো যে ভাবির ভাজা খেতে ইচ্ছে করলো আর নিজে হাতে বানালে?
নূর মুচকি হেসে বললো,

-কেনোরে! তোর হিংসে হচ্ছে নাকি?
-ইশশশ! আসছে! আমার হিংসে হবে কেন! যাও খাওয়াও। আমার কী?
-ওহ্! ভালো। তাহলে তুই তো ঘুমাতে জাচ্ছিলি। যা ঘুমা। আমি গিয়ে ভাবির সাথে আড্ডা দিয়ে আসি।
– কে বলেছে আমি ঘুমাবো! আমি তো এখন মেহেদী দিবো। চলো একসাথেই জাচ্ছি।
-তুই তো একটু আগেই বললি ঘুমাবি!

-কীহ্ আমি বলেছি ঘুমাবো? কখন? কখন বললাম? মনে পরছে না তো। তুমি দেখছি কানেও কম শোনো।
নূর আর কিছু বললো না। মুচকি হেসে নূহার ঘরের দিকে গেলো। তিশাও পিছু পিছু গেলো।
নূর ঘরে ঢুকেই বিছানায় বসে খাওয়া শুরু করলো।
তিশা কে নূরের পিছে পিছে আসতে দেখে নূহা বললো,
-তিশু আপু ! তুমি না ঘুমাতে গিয়েছিলে? তাহলে আবার এলে কেনো।
তানিয়া মেহেদী দিতে দিতে বললো,

-ওর ঘুম চলে গেছে। বাদ দাও ওর কথা।
নূর অন্য বাটিয়ে খানিকটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলো। নূর কে চলে যেতে দেখে তিশাও কথা খুজে পেলো। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-কে বলেছে আমার ঘুম চলে গেছে। তোমাদের একবার দেখতে আসছিলাম। জাচ্ছি।
বাড়িটা তিন তলা।তিন তলার এক পাশে দুই টা রুম আর বাকি জায়গা পুরোটাই ফাকা ছাদ।তিশার রুম সবার উপরে।ছোট থেকেই তার ডর ভয় কম আর এই জায়গা টা তার খুব পছন্দ এইজন্য এখানেই খাটি গেরেছে সে। উপরে আসতেই দেখলো নূর দারিয়ে আছে। পরনে একটা কালো পাঞ্জাবী। তার আতরের ঘ্রাণ চারপাশে ছড়িয়ে গেছে।

আকাশে বিশাল বড়ো একটা চাদ উঠেছে। নূর সেই চাদ টার দিকে তাকিয়ে দারিয়ে আছে চার পাশে হালকা আবছা আলো। ছাদের গাছে যেইসব সাদা ফুল ফুটেছে সব গুলোতে মনে হচ্ছে আলো জ্বলছে। চারপাশ সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে। তিশা নূরের একপাশের মুখটার দিকে আপন মনে তাকিয়ে ভাবছে,
– হঠাৎ চারপাশ এতো সুন্দর কেনো লাগছে? এই মানুষ টা এই সৌন্দর্যের সাথে তাল মিলিয়েছে বলে? নাকি আমিই ব্যস্ততার কারণে এই সুন্দর জায়গা টার দিকে তাকিয়ে দেখিনি?
তিশাহঠাৎ খেয়াল করলো,

পাশের দোলনা টায় একটা লাল ব্যাগ রাখা। এই ব্যাগ টা সে আরো আগেও একবার দেখেছে। নূরের ঘরে। নূরের আলমারি থেকে তার পরিক্ষার ভালো রেজাল্টের গিফট লুকিয়ে দেখতে গিয়ে। সেইদিন খুলতে পারেনি। নূর চলে এসেছিলো। এর পর অনেক বার চেষ্টা করেছে ওটা চুরি করার কিন্তু নূরের জন্য পারে নি। আর পরে এটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো।
নূর অনেক ক্ষন পর খেয়াল করলো তিশাকে। তিশাকে ডাক দিয়েই সে ঘাবরে গেলো কিছু টা। অন্য ঘোরে হয়তো ছিলো সে।
তিশা এগিয়ে গেলো নূরের কাছে।

-তুমি এখানে কী করছো এতো রাতে?
-অনেক রাত? মাত্র ১১:৩০ বাজে। আর তুই না বললি মেহেদী দিবি হঠাৎ চলে এলি কেন?দিবি না মেহেদী?
-নাহ্। ঘুম পাচ্ছে ! ভালো লাগছে না তাই চলে এলাম।
-কিন্তু মেহেদী দিলে তোর হাত গুলো অনেক সুন্দর লাগে।
তিশা অবাক হয়ে তাকালো নূরের দিকে। তার কাল মিচমিচে দাড়ি গুলো উরছে বাতাসে। আর সে এক পলকে তাকিয়ে আছে তিশার দিকে।
তিশা অন্য দিকে ঘুরে গেলো। নূর দিকে ডেকে দোলনায় বসালো। তিশা বসে আছে নূর কাঠের একটা গুড়ির উপর বসে বললো,

-প্রেম যে কী জিনিস আগে জানতাম না।
তিশা নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নূরের এমন কথা শুনে তার জ্বল জ্বল করা চোখ দুটি দিয়ে নূরের দিকে তাকালো।
নূর আবারো বললো,
-তিন মাস আগে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। মেয়েটা অনেক সুন্দর দেখতে। প্রথমে আমি তেমন পাত্তা দেইনি। পরে মেয়েটার পাগলামো দেখে মনে হলো, মেয়েটা ভালোই হবে। ভাবছি নূহার বিয়ের পর ওর কথা বাড়িতে বলবো।
নূর তিশার পাশের ব্যাগ টা দেখিয়ে বললো,

– গিফট টা ওর জন্য কিনেছি। এখনো দেখা হয় নি। পরশু দেখা হবে। তোকে দেখানোর জন্যই উপরে এসেছি।
তিশা কথা গুলো এক মনে শুনছে। তার চোখ থেকে পানি পরছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তার চোখ তার সাথে বেইমানি করছে। কেনো কাদছে সে! সে কাদবে না। কাদবে না সে!

চার পাশের সৌন্দর্য মূহুর্ত্তের মধ্যেই তার কাছে ধূসর হয়ে গেলো। মাথা ঘুরছে তার। সব কিছু এলোমেলো লাগছে। সে এটা আশা করেনি। তার সপ্ন তার ইচ্ছে সব শেষ। সে ভাবতে পারছেনা।
সে একবার নূরের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সেই লাল রঙা ব্যাগ টার দিকে।

তিশা বসা থেকে উঠে দারালো, ওকে উঠতে দেখে নূরও উঠে দারালো। তিশা নূরের খুব কাছাকাছি দারালো, নূরের বুক বরাবর তিশা মুখ। তিশার চুল গুলো উড়ে নূরের বুকে গিয়ে লাগছে। কিছু কিছু চুল আটকে গেলো তার পাঞ্জাবির বোতামে। চার পাশে বাতাস। হালকা শীত আর এতোক্ষনে নূরের বলা গুলো শুনে তিশা শরীরের লোম দারিয়ে আছে। নূরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে বললো,

-আমি এতো ভালো মেয়ে নই যে তোমাকে অনেক কারো সাথে ভালো থাকার দোয়া দেবো। তুমি জানতে আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসি। তুমি এটাও জানতে আমি আসক্ত ছিলাম তোমার উপর। তোমাকে আমি কী বলবো ! আমি কথা খুজে পাচ্ছি না। আমার গলা কাপছে। দোয়া করি, একদিন তুমিও আমার জায়গায় থেকো। তারপর সেইদিন আমাকে মনে করো। আর কিচ্ছু না। এইটুকুই চাই।

আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ আজকের পর আর আমার সাথে কথা বলো না। প্লিজ!
কথা গুলো বলে তিশা নূরের পাঞ্জাবীর বোতাম থেকে চুল গুলো ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো।
নূর এখনো সেখানেই দারিয়ে আছে। এক ধ্যানে চাদের দিকে তাকিয়ে দারিয়ে আছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার।

সকাল ৬:৩০ মিনিট। জামাল সিকদার বাজারের লিস্ট করছে। নূর পাশেই দারিয়ে আছে। তিশা রাতে কান্না করায় চোখ ফুলে গেছে তাই উঠেই ফ্রিজ থেকে একটা বরফ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নূর আর তানিয়া দুই জনেই আড় চোখে দেখলো ব্যপার টা। তানিয়া আজকে সকাল পাচ টা বাজে উঠেছে। উঠে নূরের মার সাথে রান্না করেছে। সবাই আজকে এখন সকালের নাস্তা করে সব কাজে লেগে যাবে।
সবাই খেতে বসেছে। নূর ফাতেমা নূহা জামাল সিকদার সবাই একসাথে খাচ্ছে। তানিয়া বেরে দিচ্ছে।
হঠাৎ তিশা বলে উঠলো,

-মামা আমি নূহার বিয়ের পর বাড়ি চলে যাবো। ওখানেই কলেজে তর্ভি হবো।
তিশার এমন কথায় সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জামাল সিকদার খাবার রেখে বেকুল হয়ে জিগ্যেস করলো,
-কী হয়েছে মা! কেউ কিছু বলেছে তোকে? কী হয়েছে হঠাৎ?
তিশা নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,

অবিনাশী পর্ব ১৪+১৫

– কিছু না মামা! পরের বাড়ি আর কয়দিন থাকবো!
কথাটা বলেই উঠে গেলো তিশা। জামাল সিকদার তাকিয়ে থাকলো তিশার যাওয়ার পানে।
নূর চলে গেলো সেখান থেকে। তানিয়া সব খেয়াল করেছে। সে এটা বুঝতে পারছে ওদের দুই জনের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে।

অবিনাশী পর্ব ১৭+১৮