অবিনাশী পর্ব ৯

অবিনাশী পর্ব ৯
রেজওয়ানা আসিফা

সকালে সবাই বসে নাস্তা করছে। দরজা খোলাই আছে। হঠাৎ কারো আগমনে সবাই দরজার দিকে তাকালো।
তানিয়া অবাক হয়ে গেছে। তার চোখ থেকে পানি পরছে। সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তানিয়া বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাদছে আর ওর বাবা শান্তনা দিচ্ছে।

মিসেস তমা আর আমান চৌধুরীর পায়ে ধরা বাকি এছাড়া বাকি সব করেছে আর বলেছে, একবার তানিয়াকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিছুতেই রাজি হচ্ছে না তারা। তানিয়া মিসেস তমাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,
-মা আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। একটা কথাও আমার মুখ থেকে কেউ বের করতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি । প্লিজ আমাকে একটা বার যেতে দেন। খুব তারাতাড়ি চলে আসবো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

তমা অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
-দরকার নেই। তোমাকে এতো বিশ্বাস আমি করিনা।
– একবার যেতে দিন না। আর কখনো যেতে চাইবো না।
তমা অনেক ক্ষন ভেবে বললো,

-যদি আমি শুনেছি তুমি কিছু বলেছো তাহলে খুব খারাপ হবে।
-আমি কিচ্ছু বলবো না। কথা দিলাম আপনাকে। কিন্তু মা ঈশানকে না নিয়ে গেলে তো গ্রামের লোক খারাপ বলবে। এখনো বিয়ের পর একবারও সে ওখানে জায়নি।
-বলে দিবে ঈশান ওইসব বাড়িতে থাকতে পারে না। আর নাহলে বলবে সে কাজের জন্য বাইরে গেছে।
তানিয়া মাথা নিচু করে মাথা নাড়ালো।

তানিয়ার বাবাও অনেক বার বললো আমান চৌধুরীকে। কিন্তু ঈশান কে নিতে তারা বারন করে দিলো।
তানিয়া যখন রেডী হচ্ছে ঈশান ঘরে বসে দেখছে।
তানিয়া তিশার দেওয়া একটা শাড়ি পরেছে। উপরে বোরকা পরবে। তারপরও বাবার বাড়ি যাবে এই খুশিতে শাড়ি পরেছে।
ঈশান হঠাৎ করে বললো,

-তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। কোথাও কী যাবে তুমি?
তানিয়া আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে ঈশানের দিকে তাকালো।
-হ্যা আমার বাড়ি যাবো।
-তোমাকে ছাড়া তো আমার ভালো লাগে না। আমাকেও নিয়ে যাও। আমি তোমাকে কোনো বিরক্ত করবো না। আমার একা একা ভালো লাগবে না।
তানিয়া ঈশানের দিকে এগিয়ে ঈশানের গালে হাত দিয়ে বললো,

-আমি খুব তারাতাড়ি চলে আসবো। তুমি মন খারাপ করো না। আমি ফোন করে তোমার সাথে কথা বলবো।
– তা মানলাম। কিন্তু আমি খাবো কী? তোমার মজার মজার খাবার ছাড়া অন্য কেউ খাবার দিলে খেতে ইচ্ছে করেনা।
-আমি তোমার পছন্দের সব খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছি। মা গরম করে দিবে।
তানিয়ার কথা শুনে ঈশানের চোখ ছল ছল করে উঠলো।
তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি কত্তো ভালো। আমি মার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। তুমি অনেক ভালো।
ভালোবাসি কথাটা শোনার পরেই তানিয়ার মুখ টা কালো হয়ে গেলো। মলিন চোখে তাকালো ঈশানের দিকে।
তানিয়া তিশার দেওয়া মোবাইল টা একবার ব্যাগে রেখে আবার নিজের কাছে রাখলো। যখন ঘর থেকে বের হবে তখন দেখলো ঈশানের প্রচণ্ড মন খারাপ। তানিয়া ঈশানের কাছে গিয়ে বললো,

-ঠিক আছে যাবো না।
ঈশান নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো হঠাৎ তানিয়ার এই কথা শুনে মাথা উচু করে তাকিয়ে বললো,
-কেনো যাবে না?
-তোমাকে এভাবে মন মরা রেখে কীভাবে যাই? ভেবেছিলাম তুমি বলবে আমি যেনো তারাতাড়ি চলে আসি। আর আমাকে হাসি মুখে বিদায় দিবে। কিন্তু তা না। তুমি মুখ কালো করে বসে আছো। তোমার মন খারাপ।
-আচ্ছা আমি মন খারাপ করবো না। তুমি যাও। আর তারাতাড়ি এসো।
– সত্যি তো! মন খারাপ করবে না তো?
-হ্যা সত্যি।

-ঠিক আছে। আসো নিচে চলো। আমি তোমার হাসি মুখ দেখে তারপর যাবো।
ঈশান ও নিচে যেতে রাজি হলো। ঈশান কে নিয়ে বের হওয়ার সময় তমা ঘরে এলো। এসেই তানিয়ার ব্যাগটা এলোমেলো করতে লাগলো। মনে হচ্ছে সে কিছু খুজছে। সব কিছু দেখার পর তানিয়াকে বললো,
-এই গুলো আবার গোছাও। আর তুমি ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? ওকে একদম নিচে নিবে না। ঈশান তুমি গিয়ে এখানে বসো। মা খাবার নিয়ে আসছি। তানিয়া বসে বসে আবার সব গোছালো। মনে মনে বললো,

– নিশ্চয়ই মোবাইল বা অন্য জাতীয় কিছু আছে নাকি সেটা খুজেছে। ভাগ্যিস মোবাইল টা ব্যাগে রাখিনি।
তানিয়া আবার ব্যাগ গুছিয়ে ঈশানকে বিদায় জানিয়ে নিচে গেলো।নিচেই তানিয়ার বাবা দাড়িয়ে ছিলো। তানিয়া কে নিয়ে এখন বের হবে।

বের হওয়ায় সময়ও পই পই করে বলেছে মিসেস তমা। তার কথার বাইরে কোনো ভুল যেনো না হয়।
বিয়ের চার মাস হয়ে গেছে। তানিয়া আজ প্রথম এই বাড়ি থেকে বের হলো।
বাড়ি টা থেকে বের হয়ে নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে। বাসে উঠে জানালার পাশের সিটে বসে বাইরের সব কিছুতে চোখ বুলাচ্ছে।

হঠাৎ মনে পরলো তিশার কথা। ওকে জানানো দরকার সব এই ভেবে ফোন টা বের করলো। মেয়ের হাতে দামি ফোন দেখে তানিয়ার বাবা বলে উঠলো,
-কে দিয়েছে রে মা! ঈশান দিয়েছে এতো সুন্দর মোবাইল?
তানিয়া বাবার হাতে ফোনটা দিয়ে বললো,

-না বাবা। আমার ননদ তিশা দিয়েছে। মেয়েটা এতো ভালো জানো। ওর ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আমার জন্য কি না করেছে মেয়েটা। বড্ড ভালো মেয়ে। এ যুগে প্রতিটা ঘরে ঘরে এমন কী প্রতিটা জায়গায় ওর মতো মেয়ে দরকার।
তানিয়ার বাবা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করলো,

-ঋণ মানে? কেনোরে মা, কিছু হয়েছিলো ওই বাড়ি? তোকে কেউ কিছু বলেছে?
তানিয়া জিভ কেটে মনে মনে বললো,
-ইসসস কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেললাম।
-কীরে মা, কী হয়েছে বল আমাকে। ওরা কিছু বলেছে? বকেছে? এমন কিছু করলে এই বাড়ি তোর আর আসতে হবে না।

-তুমি যে কী ভাবো। তোমার কি মনে হয় আমাকে দেখে, আমি কী অসুখী আছি? আমাকে ওরা কোনো কাজ করতে দেয় না রান্না বাদে আগে তো রান্নাও করতাম না কিন্তু হঠাৎ একদিন রান্না করলাম আর তোমার জামাইয়ের খুব পছন্দ হয়। এর পর থেকে শুধু রান্না টা আমি করি। আমার শাশুড়ি তো আমাকে অনেক ভালোবাসে।
-তোকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি আমি। জানিস, আমার ওদের খুব সন্দেহ হতো, বিয়ের কোনো নিয়ম পালন করলো না। জামাইকে একবার আমাদের বাড়ি আসতে দিলো না। এমনকি আমি গেলাম আমার সাথে একবার দেখাও করলো না।

-আরে বাবা ! বিয়ের পর যাইনি কেনো জানো? তোমার ভালোর জন্য ! ওরা গেলে তোমার কতো খরচ হতো এই জন্য আমার শশুর বলেছে তোমাকে এতো খরচ করানোর দরকার নেই। আর তুমি যখন গেলে ও তো বাড়ি ছিলো না। বাইরে ছিলো কীভাবে দেখা করবে বলো? আর ও আসলে তোমার ভালো বাজার করতে হবে এতে তোমার পরে চলতে কষ্ট হবে এইজন্য মা ওকে আনতে দেয়নাই।

-তারপরও গ্রামের লোকের মুখ কীভাবে চলে জানিস তো! কতো কথা বলবে আড়ালে।
-আমাকে দেখলেই ওরা বুঝবে আমি কতো সুখে আছি। কোনো কথা বলার সুযোগ-ই পাবে না।
এইরে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে তিশাকে ফোন করতেই ভুলে গেছি। দারাও ওকে একবার বলে নেই।
একবার কল করার পরেই তিশা ব্যাক করে,

-শোনো তিশা, আমি বাবার সাথে বাড়ি যাচ্ছি।
-সে কী! মা যেতে দিচ্ছে।
-হ্যা কেনো যেতে দিবে না। একটু বলতেই যেতে দিলো।
তিশার সন্দেহ হলো তানিয়াকে।
-তানিয়া তোমার পাশে কী তোমার বাবা? তোমার কথা কেমন যেনো মনে হচ্ছে।
-হ্যা। তোমাকে আমি বাড়ি গিয়ে ফোন করবো। আর তুমি বাড়ি ফোন করলে ভুলেও বলো না তুমি আমার বাড়ি আসার কথা জানো।

-ঠিক আছে সাবধানে যাও।
তানিয়ার পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে। কতোদিন গ্রামের আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বনের ফল খাওয়া হয় না তার। আবার সেই চিরচেনা বন বাদাড়ে সে ঘুরবে। তার প্রিয় মাঠঘাট মনে হচ্ছে সে কতো বছর হয়ে গেছে দেখে না।নিজের ভাই বোনেরা হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করছে।

নূরের ঘর পরিষ্কার করছে তিশা। নূরের ঘর তেমন পরিষ্কার করতে হয় না। ছেলেটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কখনো কিচ্ছু এলোমেলো করে রাখে না। নিজের জামা কাপড়ও নিজেই পরিষ্কার করে। মাঝে মাঝে খুব জোর করে তার মা পরিষ্কার করে দেয়।
তিশাকে ঘরে দেখে নূর এসে বললো,

– নাউজুবিল্লাহ, করোস কী এইগুলা!
তিশা মুখ বেকিয়ে বললো,
-এতো নাটক কেনো করো? দেখছোই তো ঘর পরিষ্কার করছি।

অবিনাশী পর্ব ৮

-আমার ঘর পর নারীর পরিষ্কার করতে হবে না। তুই বের হও। তোর ঘরের থেকে আমার ঘর পরিষ্কার।
কথাটা শুনে তিশা রেগে গেলেও মনে মনে বললো,
-কথা সত্য। ছেলে মানুষ হয়েও ঘরের কী সুন্দর ভিউ।

অবিনাশী পর্ব ১০