আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ গল্পের লিংক

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ১
Raiha Zubair Ripte

ভরা বিয়ের আসর হতে সদ্য বিয়ে করা বউয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে তন্ময় শাহরিয়ার। মেয়েটার ছোট্ট দেহটা সুঠাম দেহের অধিকারী তন্ময়ের পায়ের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে পারলো না যার ফলে বারবার শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সবাই আড়চোখে দেখছে সেটা কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলার সাহস পাচ্ছে না। পাবে কি করে? একটু আগেই এই ছেলে মেয়েটাকে সকলের লাঞ্ছনা থেকে বাঁচিয়েছে যে।
তন্ময় মেয়েটাকে গাড়ির কাছে এনে হাত ছেড়ে দেয়। চোখ মুখ জুড়ে রয়েছে আগ্নেয়গিরি লাভা। শক্ত মুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল-

-“ গাড়িতে উঠো।
মেয়েটি যেনো বুঝলো না তন্ময়ের কথা। অবুঝ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। হাত টেনে আনায় হাত টা ভীষণ জ্বলছে। খুব শক্ত করে ধরেছিল কি না। তন্ময় মেয়েটাকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলে-
-“ কথা কানে যায় নি গাড়িতে যে উঠতে বললাম?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েটা ঈর্ষৎ কেঁপে উঠলো। আশেপাশে তাকালো কাউকে খুঁজলো কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। তন্ময়ের ইতিমধ্যে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। মেয়েটার হাত শক্ত করে চেপে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে ঢুকালো।
আকস্মিক ব্যাথাযুক্ত হাতে আবার ও তন্ময়ের চেপে ধরায় এবার ব্যাথায় মৃদু আহ শব্দ করে উঠলো মেয়েটা। সেদিকে তন্ময়ের হুঁশ নেই। সে মেয়েটাকে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

মুহূর্তে বুকটা ধক করে উঠে মেয়েটার। গাড়ির জানালা দিয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা বের করে পেছনে তাকায়। আর তখনই দেখতে পায় চারটি পরিচিত মুখ হন্তদন্ত হয়ে আসছে। মুহূর্তে মুখে হাসি ফুটলেও পরিচিত মুখ গুলো যখন দৃষ্টি সীমারেখার বাহিরে চলে গেলো তখনই মুখ জুড়ে হানা দিলো আতঙ্ক আর ভয়।

চিত্রা হন্তদন্ত হয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখতে পায় তার ছেলের গাড়ি ততক্ষণে তার ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। চিন্তায় তার প্রেসার হাই হয়ে যাচ্ছে। এই রাত করে মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। মেয়েটার সাথে বাজে কিছু করবে না তো তন্ময়? কথাটা ভাবতেই ভয়ে শিউরে উঠে চিত্রা। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতে চিত্রা পাশ ফিরে তাকায়। কাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে চিত্রা ধরা গলায় বলল-

-“ আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি? আমার ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল কি ঐ মেয়েটাকে দিতে হবে?
-“ মোটেও ভুল সিদ্ধান্ত নিস নি তুই। একটা মেয়েকে অপমান হওয়ার থেকে বাঁচিয়েছিস ।
তৃষ্ণার কথায় চিত্রা পরপর কয়েকবার পলক ফেলে।
-“ মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে আবার মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিলাম তৃষ্ণা। তন্ময় সব রাগ মেয়েটার উপর ফেলবে। কি করবো এখন? মেয়েটা কে নিয়ে কোথায় গেলো ওভাবে? আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে তৃষ্ণা। আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি।

পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে চিত্রা। তৃষ্ণা চিত্রা কে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল- এতো চিন্তা করিস না রাহাত কে পাঠিয়েছি সাথে লিখন আর সাব্বির ও আছে। ওরা ঠিক সামলে নিবে।
একটু শান্ত হলো চিত্রা। ওরা তিনজন পারবে তন্ময় কে শান্ত করতে কিন্তু মনে এখনও অশান্তির ঝড় বইছে।
আজ এসেছিল চিত্রা তৃষ্ণা ডক্টর মরিয়ম মান্নানের ভাস্তির বিয়েতে। মেয়েটাকে এর আগেও চিত্রা বেশ কয়েকবার দেখেছে। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে।

মেয়েটার বাবা গ্রামে থাকে মা নেই। মেয়েটাও গ্রামে থাকতো কিন্তু ভালো পড়াশোনা করার জন্য মেয়েটাকে এই শহরে এনেছেন মরিয়ম মান্নান। এরমধ্যে ভালো ঘর থেকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসায় মরিয়ম মান্নান তার ভাই মিনাল কে খবর পাঠায়। মিনাল প্রথমে রাজি হতে চায় নি,তার মেয়েটা এখনও ছোট,বিয়ের বয়স হয় নি কিন্তু বোনের জোড়াজুড়ি তে নাও করতে পারে নি মুখের উপর। বোন তার যথাযথ কারন তুলে ধরেছিল। মিনালের মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই,মেয়ের ও বাবা ছাড়া কেউ নেই।

বাবা অন্ত প্রাণ মেয়েটা। সেখানে হুট করে মিনাল হোসেনের খারাপ কিছু হয়ে গেলে তখন কে দেখবে মেয়েকে? আজকাল শরীরে অসুখ বেড়েছে। বুকে প্রায়সময়ই ব্যাথা হয়। তখন মনে হয় নিশ্বাস বুঝি থেমে গেলো। এই নিশ্বাস থামার আগে মেয়েটার একটা গোছ করে দিতে পারলে ম’রে গিয়েও তখন শান্তি পাবেন। তারপর মিনাল বোনের বাসায় এসে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।

ছেলে কলেজে শিক্ষকতা করেন। দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। পাত্র পক্ষ রা আর্জি জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে। মিনাল হোসেন বোনের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন বোনের বাসা থেকে মেয়ে বিয়ে দিবেন। সেই অনুযায়ী দিনক্ষণ ও ঠিক করা হলো। বিয়ের দিন ও ঘনিয়ে এলো কিন্তু পাত্র এসে পৌঁছাল না। শোনা গেলো পাত্র পালিয়েছে তার প্রেমিকা কে নিয়ে।

কথাটা মিনালের কানে আসতেই মিনালের বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। মা হারা মেয়ে তার। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ই করলো না যে তার হবু স্বামী পালিয়ে গেছে লোকজন তাকে এখন কথা শুনাবে। সে বাবার জন্য কেঁদেকুটে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। বারবার ফুফুর দিকে তাকিয়ে বলে- ও ফুফু বাবার বুকে ব্যাথা করতেছে একটু ঔষধ দিয়ে ঠিক করে দাও না।

মরিয়ম মান্নান ঔষধ দিয়ে মিনাল কে সুস্থ করে তুলেন। কিন্তু মিনাল বিলাপ পেরে চলছে মেয়েটার এখন কি হবে সেটা ভেবে।লোকজন ও কানাঘুঁষা করছে। কেউ কেউ হাহুতাশ করছে মেয়েটার হয়ে। আবার কেউ অলক্ষ্মী বলে আখ্যায়িত করছে। অতচ ছোট্ট মেয়েটির সেদিকে খেয়াল নেই।
চিত্রা তৃষ্ণা দেখছিল পরিস্থিতি টা। চিত্রার ভীষণ মায়া হলো মেয়েটার মুখশ্রী দেখে। সাথে রাগ ও হলো লোকজনের কথা শুনে। তাইতো প্রতিবাদ করে লোক গুলোর উদ্দেশ্যে বলল-

-“ আপনারা কি মানুষ? একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে আর ওমনি সেটার সুযোগ নিয়ে কথা শুনাচ্ছেন। এই মেয়েটার জায়গায় আপনাদের মধ্যে কারো মেয়ে হলে এভাবে বলতে পারতেন?
কিছু মানুষ চুপ হয়ে গেলো আর কিছু মানুষ জ্বলে উঠলো। একজন বলে উঠল-
-“ আপনার গায়ে লাগছে কেনো? মেয়েটা অপয়া না হলে পাত্র কেনো পালিয়ে যাবে?
-“ সেটা পাত্র কে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন মেয়েটাকে দোষারোপ না করে।
-“ শুনেছি আপনার তো ছেলে আছে আপনার যখন মেয়েটার জন্য এতো মায়া লাগছে তো আপনার ছেলের বউ করে নিয়ে যান।

চিত্রা কটমট চাহনি নিয়ে তাকালো। কিছু বলতে নিলে তৃষ্ণা টেনে সরিয়ে নিলো।
-“ এদের সাথে কথা বাড়াস না তো।
এরমধ্যে মরিয়ম মান্নান বেশ কান্নাকাটি করলো চিত্রার কাছে। বারবার মেয়েটার কি হবে এসব বলে উঠছিল। হঠাৎ মনে পড়লো ঐ মহিলা টার কথা। ছেলের বউ করলে এতে মন্দ তো হয় না। তাইতো জরুরি তলব জানিয়ে ছেলেকে আসতে বলল তৃষ্ণা কে দিয়ে।

তন্ময় সবেমাত্র বাসায় ফিরেছে হঠাৎ ফুপির ফোন পেয়ে বেশ অবাক হয়। ফোন টা রিসিভ করে কানে নিতেই শুনতে পায় তৃষ্ণা তাকে তাড়াতাড়ি মরিয়ম মান্নানের বাসায় আসতে বলছে আর্জেন্ট।
প্রতিত্তোরে কোনো কথাই বলার সুযোগ দেয় নি তৃষ্ণা। তন্ময় ভয়ানক কিছু ভেবে ওভাবেই ছুটে চলে আসে মরিয়ম মান্নানের বাসায়।

তন্ময় জানে না এখানে আজ বিয়ে হচ্ছে। জানবেই বা কি করে? তন্ময় তো নিজ বাড়িতেই থাকে না।
এখানে এসে তৃষ্ণা কে খুঁজে পেতে সময় লাগে নি তন্ময়ের।
-“ কি হয়েছে ফুপি? সব ঠিকঠাক তো?
-“ কোনো কিছু ঠিকঠাক নেই তন্ময়।
-“ মানে?
-“ মানে টা হচ্ছে তুমি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
তন্ময় পেছন ফিরে তাকায়। চিত্রা কে দেখামাত্র ই তার মুখের ভঙিমা বদলে যায়। চিত্রা অধির হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলের পানে উত্তর শোনার।

-“ শেষ বারের মতো একটা অনুরোধ রাখ না তোর মায়ের তন্ময়।
তন্ময় চোখ মুখ শক্ত করে জবাব দিলো- আমি তার কোনো অনুরোধ রাখতে পারবো না ফুপি।
চিত্রার হৃদয় টা কয়েক টুকরোতে ক্ষত-বিক্ষত হলো।ছেলের কাছে নিজের জন্য এমন ক্রোধ রাগ দেখতে দেখতে জীবন বিষিয়ে গেছে তার। চোখ নোনা জলে টইটম্বুর করছে। পলক ফেলতেই তা গড়িয়ে পড়লো। তৃষ্ণা আহত হলো।
-“ এভাবে বলছিস কেনো তন্ময়? তোর মায়ের সম্মান জড়িয়ে আছে এখানে। তুই কি চাস তোর মায়ের অসম্মান হোক?

তন্ময় ভ্রু কুঁচকালো।- মানে?
-“ বুঝতেই পারছিস এখানে আজ বিয়ে। কিন্তু যার বিয়ে তার বিয়েটা ভেঙে গেছে৷ লোকজন বাজে বাজে কথা বলছে। মেয়েটা তো এসব বাজে কথা ডিজার্ভ করে না। মেয়েটাকে ভীষণ স্নেহ করে চিত্রা। মেয়েটাকে তোর বউ করবে বলে কথা দিয়ে ফেলছে। প্লিজ তুই মেয়েটাকে বিয়ে কর।

তৃষ্ণা পুরোপুরি সত্যি বলে নি। চিত্রা কথা দেয় নি বিয়ে নিয়ে। সে আগে চাইছে তন্ময় রাজি হোক তারপর বিয়ের কথা তুলবে। চিত্রা জানে খুব সহজে তন্ময় রাজি হবে না কিন্তু তৃষ্ণা ঠিক রাজি করিয়ে ছাড়বে।
তন্ময়ের দৃষ্টি কঠোর হলো। আশেপাশে তাকিয়ে হাসফাস করতে লাগলো। যথাসম্ভব রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে৷
-“ আমাকে কি তোমাদের মানুষ মনে হয় না ফুপি? আমি কি কোনো মেশিং? যে তোমরা যেভাবে চালাবে আমি সেভাবে চলবো। আমার মত অমত নেই নিজস্ব?

-“ অবশ্যই আছে থাকবে না কেনো। তুই তো তোর নিজের স্বাধীন মতোই চলিস৷ কেউ আমরা বাঁধা দেই? আর দিলেও কি শুনিস? তুই নিশ্চয়ই চাইবি না তোর মায়ের অসম্মান অন্য কেউ বা বাহিরের লোকের সামনে হোক। আজ হোক কাল হোক বিয়ে তো করবিই তুই সেখানে আজ করলে সমস্যা কোথায়? মেয়েটা বাজে কথা থেকে মুক্তি পাবে।
-“ সরি ফুপি আমার পক্ষে অচেনা অজানা এক মেয়েকে বিয়ে করা পসিবল না। আমি আসছি।
-“ তোর মায়ের কসম বিয়ে টা করে নে তন্ময়।

তন্ময় ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তৃষ্ণার কথা শুনে পা থেমে যায়। হাত তার মুঠোবন্দি হয়ে আসে। কপালের রগ ভাসমান হয়। পেছন ফিরে আশেপাশে তাকায়। কিছুটা দূরে বিয়ের বেনারসি পড়ে অগোছালো হয়ে এক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। তন্ময়ে মস্তিষ্ক বুঝে নিলো ওটাই সেই মেয়ে। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরে বলে- কাজিকে বিয়ে পড়াতে বলুন।

মরিয়ম মান্নান পাশেই ছিলো। তন্ময় কে দেখে সে বেশ অবাক হয়। তৃষ্ণা এগিয়ে এসে কাজিকে বিয়ে পড়াতে বলে। কাজি বিয়ে পড়ায়। তন্ময় কে কবুল বলতে বললে সে শক্ত মুখে কবুল বলে। এবার মেয়েটাকে বলতে বললে মেয়েটা তার বাবার দিকে তাকায়। তার বাবা ইশারায় কবুল বলতে বলে। মেয়েটা মিহি কন্ঠে কবুল বলে উঠে।
কবুল বলার সাথে সাথে তন্ময় আর এক সেকেন্ড ও দেরি না করে মেয়েটাকে টেনে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায়। তৃষ্ণা বাঁধা দিতে গেলে তন্ময় হুংকার দিয়ে বলে-

-“ বিয়ে করতে বলেছো বিয়ে করেছি। এখন তন্ময় শাহরিয়ার তার বউকে তার নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা ভুলেও করো না।
তারপর টানতে টানতে নিয়ে গেলো।
মরিয়ম মান্নান তৃষ্ণা চিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ তন্ময় কোথায় নিয়ে গেলো আমাদের দোলন কে?
চিত্রা তৃষ্ণা চমকায়। তৃষ্ণা আমতাআমতা করে বলে-

-“ খাঁন ভিলা তে নিয়ে গেছে। আমরা আসছি চিন্তা করো না কেমন?
তৃষ্ণা চিত্রা কে নিয়ে গাড়িতে উঠে। মরিয়ম মান্নান চিত্রা দের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রয়।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পরিচ্ছেদ ২ পর্ব ২