আমি ফাইসা গেছি পর্ব ২৩

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ২৩
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সন্ধ্যাবেলা চামেলি বেগম এঁচোড়ের ডালনা, নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি রাঁধছেন।কারণ চামেলি বেগমের হাতের এসব খাবার তোড়া অনেক বেশি পছন্দ করে।যেহেতু তোড়া এখন তার বাবার বাড়িতে আছে সেজন্য চামেলি বেগম এখন মেয়ের পছন্দের খাবারদাবারই রান্না করেন।

অন্যদিকে তোড়া কুশানের সাথে কথা বলা শেষ করে মাত্র ফোন টা চার্জে লাগিয়ে দিয়ে স্বর্ণার সাথে গল্পে মেতে থাকলো।
কিন্তু হঠাৎ করে কারেন্ট চলে যাওয়ায় চামেলি বেগম তোড়া তোড়া বলে চিল্লাতে লাগলো।আর তাকে ঘর থেকে লাইট টা আনতে বললো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তোড়া তখন তার ফোনের লাইট জালিয়ে চামেলি বেগমের লাইট খুজে দিয়ে আসলো।এদিকে কারেন্ট না থাকায় ভ্যাপসা গরমে থাকা যাচ্ছিলো না বাড়ির মধ্যে।স্বর্ণা তখন বললো আপু চল না একটু বাহিরে যাই?এই গরমের মধ্যে কারেন্ট না থাকলে বাড়ির মধ্যে থাকা খুব কষ্টদায়ক হয়ে যায়।

তোড়া স্বর্ণার কথা শুনে বললো,এই সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বাহিরে গেলে আম্মু রাগ করবে।আমি যেতে পারবো না এখন।
–দূর চল। কিছুই বলবে না।এখন তোর বিয়ে হইছে না?এখন কেউ কিছুই বলবে না।ফোন টা হাতে নে,আর চাচীকে বল আম্মু তোমার জামাই কল দিয়েছে সেজন্য বাড়ির মধ্যে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না একটু বাহিরে যাবো।

তোড়া স্বর্ণার মুখে এই কথা শুনে বললো তুই তো দেখি অনেক ব্রিলিয়ান্ট হয়ে গেছিস রে?এতো বুদ্ধি পাস কই তুই?
স্বর্ণা তখন মুচকি হেসে বললো,এসব বুদ্ধি আবার শিখতে হয় নাকি?মাথাতে অটোমেটিক ভাবে চলে আসে।এই বলে স্বর্ণা তোড়াকে টেনে নিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেলো।

বাড়ির বাহিরে যেতেই দেখে শুধু তারায় নয় গরমের ঠেলায় সবাই রুম থেকে বের হয়ে এসেছে।বিশেষ করে বাড়ির বাহিরে যে টঙ টা আছে সেখানে বসার মতো একটুও জায়গা নাই।বাড়ির বাহিরে গাছগাছালি থাকায় খুব সুন্দর মিটিমিটি বাতাস বইছে।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেই শরীর টা একদম শীতল হয়ে যায়।

তোড়া আর স্বর্ণা যে আশায় বের হয়ে আসলো সেই আশা আর তাদের পূরণ হলো না।তারা ভেবেছিলো টঙে বসে থেকে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মনের সুখে গল্প করবে।
এদিকে সায়ক ও সেই টঙ এ বসে ছিলো।স্বর্ণাকে দেখামাত্র এগিয়ে এসে বললো,এই সন্ধ্যাবেলায় বাসা থেকে বের হইছিস কেনো?

স্বর্ণা তখন আমতা আমতা করে বললো তোড়া আপু ডেকে নিয়ে এসেছে।
সায়ক স্বর্ণার কথা শুনে তোড়ার দিকে এক নজর তাকিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।সে আর কিছু বললো না।

আসলে সায়ক মনে মনে তোড়াকে একটু একটু পছন্দ করতো।তার মনের কথা প্রকাশ করার আগেই তোড়ার বিয়ে হয়ে গেলো।সায়ক বাড়িতে থাকলে হয় তো কিছু একটা করতো সে।কিন্তু যেদিন কুশানরা তোড়াকে দেখতে আসে সেদিন সায়ক বাড়িতে ছিলো না।বন্ধুদের সাথে বনভোজনে গিয়েছিলো সে।

এইভাবে অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলো সারাজীবন আড়ালেই রয়ে যায়।কিন্তু এই ভালোবাসা গুলো ভীষণ কষ্টদায়ক।ভালোবাসা প্রকাশ করলে কিছুটা কষ্ট কমে যায় কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ না করে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখলে সেই ভালোবাসা ভীষণভাবে কাঁদায় প্রতিটা মানুষ কে।সায়ক তার জ্বলন্ত উদাহরণ। না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সহ্য করতে।

তোড়া নিজেও বুঝতে পারে এখন।কারণ সায়ক তার দিকে যেভাবে তাকায় বোঝায় যায় সে তোড়াকে কত টা ভালোবাসে?সায়কের অনুভূতি বোঝার আগেই তোড়া কুশানের প্রেম কাহিনি শুরু হয়ে যায়,সেজন্য সায়কের ভালোবাসা তোড়ার চোখে পড়ে নি।

তোড়া আর স্বর্ণা টঙে বসতে না পেরে গেটের সামলেই দাঁড়িয়ে রইলো।তোড়াদের পাশের বাসার এক চাচী তোড়ার কন্ঠ শুনে বললো,কি রে তোড়া?কবে এসেছিস?
তোড়া তার চাচীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো তার কাছে আর বললো,এই তো চাচী কালকে।

–তা জামাই কই?জামাইকে দেখছি না যে?
তোড়া তখন শান্ত কন্ঠে নিচ মুখ হয়ে বললো,ও আসে নি।ওর সামনে এক্সাম তো তাই ভার্সিটিতে ক্লাস করতে হয়,আবার প্রাইভেট আছে।
চাচী তখন তোড়ার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,তোদের গন্ডগোল কি ভালো হইছে?কি এক ঝামেলার কথা শুনলাম।

তোড়া তখন বললো, না তো চাচী।কোনো ঝামেলা তো হয় নি।সব তো ঠিকই আছে।
চাচী তখন বললো, স্বর্নার মায়ে বললো, তোর বিয়ে দেওয়া নাকি ভালো হয় নি।তোর জামাই নাকি কিছুই করে না,স্টুডেন্ট মানুষ। আবার তোর নাকি ওটা শশুড় বাড়িও নয়।তোর নানা শশুড়ের বাড়ি ওটা?

তোড়া সেই কথা শুনে বললো হ্যাঁ।সে আর বেশি কিছু না বলে বাড়ির ভিতর চলে গেলো।স্বর্ণা তখন চিল্লায়ে চিল্লায়ে বললো, এই তোড়া কই যাচ্ছিস?দাঁড়া।

তোড়া আর দাঁড়ালো না।তার ভীষণ রাগ উঠলো চাচীর কথা শুনে।আর ওনারই বা কি দোষ?ঘরের লোক যদি কুটনামি করে তাহলে তার সাথে আর পাওয়া যায় না।এসব কথা যে স্বর্ণার মা ই বলে বেড়াচ্ছে তা তোড়া ভালো করেই জানে।
এদিকে স্বর্না সেই চাচীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, চাচী এসব কথা তুমি কই পাইলে?
চাচী তখন বললো, কথা কি আর এক জায়গায় থাকে মা?এমনিতেই শোনা যায়।

স্বর্ণা তখন বললো যা শুনেছো ভুল শুনেছো।তোড়া আপুর যে বাড়িতে বিয়ে হয়েছে ওরা তো বিশাল বড়লোক।আমাদের গ্রামের অর্ধেক এর মতো জায়গা জুড়ে বিশাল বাড়ি আছে।আর তাদের নিজস্ব ব্যবসা বানিজ্য, ফ্যাক্টরি সব আছে বুঝেছেন?
চাচী তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো,তোর মা ই তো বললো,বেশি একটা নাকি ভালো হয় নি বিয়ে দেওয়া।আমরা এসব কথা কই পামু?তোর মা সেদিন গল্প করলো তাই জিজ্ঞেস করনু তোড়ারে।

স্বর্ণা তার চাচীর সাথে গল্প করতেই হঠাৎ সেখানে সে কুশানের মতো কাউকে দেখলো।পিছনে একটা ভ্যান ও আসছে।
স্বর্ণা তখন এগিয়ে গিয়ে বললো, দুলাভাই,আপনি?স্বর্না বেশ আশ্চর্য হলো কুশানকে দেখে।
কুশান বললো হ্যাঁ আমি,চিনতে পেরেছো তাহলে?

যেহেতু এখন সন্ধ্যার সময়,আবছা আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে সবাইকে।
স্বর্ণার মুখে দুলাভাই ডাক শুনে টঙে থাকা মহিলা আর মেয়ে গুলো নেমে আসলো।কারণ অনেকেই এখনো তোড়ার হাজব্যান্ড কে দেখে নি।হঠাৎ করে বিয়ে হওয়াই আর বিয়ের পর থেকে নানা ঝামেলায় কুশানেরও শশুড় বাড়িতে সেভাবে আসা হয় নি।

–কি রে? এই ছেলেই কি তোড়ার জামাই?
–হ্যাঁ,এটাই আমাদের তোড়া আপুর জামাই।আমাদের একমাত্র দুলাভাই।
কুশান স্বর্ণার মুখে এই দুলাভাই ডাকটা শুনলেই কেমন যেনো লজ্জায় লাল হয়ে যায়।সে কিছুক্ষন নিচ মুখ হয়ে থাকলেও মহিলাগুলোকে দেখে সালাম দিলো।

মহিলা গুলো সালামের উত্তর দিলো ঠিকই কিন্তু তাদের চোখ তো এখন ভ্যানের দিকে।
মহিলা গুলো মনে মনে ভাবতে লাগলো,এই রকম জামাই ই তো দরকার।ভ্যানভর্তি খরচপাতি করে এনেছে।
এক মহিলা তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললো,তা বাবা শুধু কি নিজের শাশুড়ীকে মিষ্টি খাওয়ালেই হবে?আমাদের খাওয়াতে হবে না?

কুশান সেই কথা শুনে এক প্যাকেট মিষ্টি মহিলাটির হাতে দিয়ে বললো,এটা আপনাদের জন্য।
মহিলাগুলো মিষ্টির প্যাকেট পেয়ে তো সেই খুশি।
এদিকে স্বর্ণা চিল্লাতে লাগলো,বড় আম্মু? তোড়া আপু বাহিরে এসে দেখে যাও কে এসেছে?

এদিকে তোড়া তো মন খারাপ করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।আর চামেলি বেগমের রান্নাবান্না এখনো শেষ হয় নি।সেজন্য তিনি বাড়ির ভিতর থেকেই উত্তর দিলেন কে এসেছে রে?
স্বর্ণা তখন বললো বাহিরে এসে দেখে যাও।

এদিকে মহিলাগুলো কুশানের সাথে গল্প করতে লাগলো।একের পর এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো যার কারণে কুশান বাড়ির ভিতর যেতে পারলো না।
স্বর্ণার এমন চিল্লাচিল্লি শুনে স্বর্ণার আম্মু বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে বললো,তুই এভাবে ষাঁড়ের মতো চিল্লা চিল্লি করছিস কেনো?তোর যে এখনো বিয়ে হয় নি সে খেয়াল আছে তোর?যা বাড়ির মধ্যে যা।

স্বর্ণা তার মায়ের ধমকানি শুনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।সে আর থাকতে পারলো না।আসলে স্বর্নার আম্মু টা এমনই।
স্বর্নাদের বাড়ি তোড়াদের বাড়ির সাথেই।মানে পাশাপাশি দুই টা পরিবার থাকে।শুধু মাঝখানে একটা প্রাচীর দিয়ে দুই পরিবার আলাদা হয়ে গেছে।আগে তারা যৌথই ছিলো। কিন্তু স্বর্নার আম্মু প্রায়ই চামেলি বেগমের সাথে কাজ কাম নিয়ে ঝগড়া করায় তারা আলাদা খায়।তবে হেনা বেগম চামেলি বেগমের সাথেই থাকে।

তোড়াদের বাড়িটা মোটামুটি বড়।গোলাপ আর চামেলি বেগমের একটা শোবার ঘর,তোড়ার একটা শোবার আর একটা পড়ার ঘর।আর একটা হেনা বেগমের ঘর,বড়গোছের একটা বসার ঘর—রান্নাঘরের পাশে আলাদা খাওয়ার ঘর আছে।পুরো বাড়ি জুড়ে দুই টা বাথরুম।একটা বাথরুম আঙিনা থেকে কিছুটা দূরে আর আরেকটা তোড়ার রুমে আছে।

কুশান এবার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।
কুশানকে দেখামাত্র চামেলি বেগম এতো বেশি আশ্চর্য হলো যে তার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিলো না।কুশান তার শাশুড়ী কে সালাম দেওয়ার পর মনে হয় হুশ ফিরে এলো চামেলি বেগমের।
চামেলি বেগম তখন বললো,

এই তোড়া না মস্ত এক বজ্জাত মাইয়া। তুমি যে আসবে সেটা কি একবার আমাকে বলা উচিত ছিলো না?
কুশান তখন বললো আম্মু ওকে বকে লাভ নাই।যা বকুনি দেওয়ার আমাকে দিন।কারণ আমি আসার সময় বলি নি তোড়াকে।ভাবলাম সারপ্রাইজ দিবো।কই ও?

–ঘরেই আছে।যাও বাবা ঘরে যাও।
এদিকে এখন পর্যন্ত কারেন্ট আসে নি।কুশান তখন তার মোবাইল টা বের করে আলো জ্বালিয়ে তোড়ার রুমে প্রবেশ করলো।কুশান আলো জালিয়ে দেখে তোড়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।সেজন্য সে আলো টা নিভিয়ে দিলো।
অন্যদিকে তোড়া ভেবেছে হয় তো স্বর্ণা এসেছে সেজন্য সে ঠিক আগের মতোই শুয়ে থাকলো।

কুশান ধীরে ধীরে তোড়ার পাশে যেতেই তোড়া একদম চমকে উঠলো।তার বুক টা একদম ধক করে উঠলো।কারণ এ যে কুশানের পারফিউম এর ঘ্রাণ।তোড়া তখন সাথে সাথে এক লাফে উঠে বসতেই কুশান তোড়াকে জড়িয়ে ধরলো।
তোড়া ভয়ে কথা বলতে পারছিলো না।সে তো বুঝতে পারছে এটা কুশান।

তারপরেও ভয় লাগছে।কারণ কুশান এই সন্ধ্যাবেলা কই থেকে আসবে?এই কিছুক্ষন আগেই তো সে তার সাথে কথা বলেছে।কই কুশান তো আসার কথা কিছু বলে নি।আবার এটা তো স্বর্ণাও নয়।তোড়া যেই চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই কুশান তোড়ার মুখ টিপে ধরে বললো অযথা চিৎকার করে আমার মানসম্মান নষ্ট করিও না।আমি কুশান।তোমার স্বামী।

তোড়া সেই কথা শোনামাত্র কুশানকে এক ঝাটকায় সরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বালিশের নিচ থেকে
তার মোবাইল টা হাতে নিয়ে লাইট অন করলো।লাইট অন করা মাত্র কুশানকে দেখে সে আর তার খুশিকে ধরে রাখতে পারছিলো না।সে সাথে সাথে কুশানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
তুমি?তা আমাকে বলবে না?আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কুশান তখন নিজেও দুই হাত দিয়ে তোড়াকে জড়িয়ে ধরে বললো, আগে থেকে যদি জানতে তাহলে তোমার এই আনন্দভরা মুখ খানা দেখার সৌভাগ্য হতো কি?
তোড়া সেই কথা শুনে বললো,

আমি মোটেও আনন্দিত হয় নি।কাল তোমার ভার্সিটি আছে না?তুমি কেনো এসেছো সেটা আগে বলো।
কুশান তখন বললো একা একা ভালো লাগছিলো না।সেজন্য নিতে আসলাম।
তোড়া তখন বললো মাত্র কাল আসলাম কুশান।আর আজকেই নিতে এসেছো তুমি?বলেছি না তিন চার দিন থাকবো আমি?

–তিন চার দিন?একদিনই থাকতে পারছি না।আর যদি তুমি তিন চার দিন থাকো তাহলে আমিও থাকবো এখানে।
–পাগল হইছো তুমি?
কুশান তখন তোড়াকে কিস করতে করতে বললো,হ্যাঁ পাগলই হইছি।আমাকে পাগল বলো আর কিছু বলো তোমাকে রেখে একা একা আর যাচ্ছি না।
তোড়া তখন বললো, বাসায় বলে এসেছো?

–হ্যাঁ।
–সত্যি বলছো তো?
–বললাম তো হ্যাঁ।মিথ্যা কেনো বলবো?
এদিকে হেনা বেগম চিল্লাতে চিল্লাতে বললো কই কুশান?কুশান নাকি আসছে?
কুশান দাদীর ডাক শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে তোড়াকে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলো।আর হেনা বেগমকে সালাম দিয়ে বললো, দাদী কেমন আছো?

হেনা বেগম তা শুনে বললো, আমি তো ভালোই আছি।কিন্তু তুই হঠাৎ করে এই সন্ধ্যাবেলায়।বুঝলাম না ব্যাপার টা।
–ও তোমাকে বুঝতে হবে না দাদী।তোমাদের সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো বলে না বলেই এসেছি।
হেনা বেগম তখন বললো হ ভাই,সবই বুঝি।এরকম সময় আমরাও কিন্তু পার করে এসেছি।আমি তো ভাবছিলাম তোর দাদুই মনে হয় এরকম সারপ্রাইজ দিতো,এখন তো দেখি এই জেনারেশনের ছেলেরাও সারপ্রাইজ দিতে জানে।
কুশান তখন ফিসফিসিয়ে বললো,দাদী বলেছিলে না?মনে আছে?ওই জন্য আর কি আসা।এই বলে কুশান মুচকি একটা হাসি দিলো।

দাদী কুশানের এমন দুষ্ট কথা শুনে বললো তুই বেশ বজ্জাত আছিস ভাই।
তোড়া পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো।সে ভাবতেই পারছে না কুশান এতো টা নির্লজ্জ হয়েছে।সে তখন কুশানকে ডাকতে লাগলো।
কুশান তোড়ার কাছে এগিয়ে যেতেই সে রাগ দেখিয়ে বললো, এসব কি হচ্ছে কুশান?দাদী তোমার মুরব্বি হয় না।কি যা তা বলছো?

— মুরুব্বি?হ্যাঁ তোমাদের দিক দিয়ে মুরুব্বিই বটে।কিন্তু দাদী আমাকে বলেছে আমি তার কাছে নিজের নাতির মতো।আমার নিজের দাদীকে তো দেখি নি এজন্য এই দাদীর সাথে মজা করি।এতে কি তোমার কোনো প্রবলেম আছে?
তোড়া কুশানের কথা শুনে বললো তোমার দাদীকে তুমি দেখো নি?
কুশান তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,শুধু দাদী না,আমি তো এখন পর্যন্ত জানি না আমার দাদুর বাড়ি টা কই?আব্বু এ সম্পর্কে কিছুই বলে নি।আর আম্মু তো জীবনেও বলবে না।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কুশান তোড়ার শোবার ঘরে চলে গেলো।শাশুড়ীর হাতের রান্নার অপূর্ব স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে তার—এঁচোড়ের ডালনা, নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি, এ যেনো এক স্বর্গীয় স্বাদের খাবার।কুশান অনেক বেশি উপভোগ করেছে খাবারগুলো।কুশান আসায় তার শাশুড়ী আরো অনেক পদ রান্না করেছে কিন্তু এই খাবারগুলো যেনো তার কাছে অমৃতের মতো মনে হলো।

এদিকে অনেক রাত হয়েছে—চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর ঝোপ ঝাড়, গাছপালাতে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে।
তোড়া এখনো তার রুমে আসে নি।কুশান বুঝতে পারছে না কিছু।এত লেট করছে কেনো তোড়া?তারা সবাই একসাথেই খাবার খেয়েছে।খাবার খাওয়া শেষ হলে তোড়া কুশান কে তার রুমে যেতে বললো আর বললো আমি একটু পরে আসছি এই বলে সে দাদীর রুমে প্রবেশ করলো।সেই যে ঢুকলো ওই রুমে আর বের হলো না।

কুশানের এই মুহুর্তে ইচ্ছা করছিলো একটু সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দুই একটা টান দিতে।কিন্তু এটা তো আর তার নিজের বাড়ি নয়,যে লুকিয়ে দুই একটা টান দিতে পারবে।কখন কে দেখে ফেলে কে জানে এই ভয়ে আর সিগারেটের কথা মনেই আনলো না সে।কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ একা একা রুমে বসে থাকা যায়?ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার।অবশেষে কুশানের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।প্রায় তিরিশ মিনিট পার হয়ে যাবার পরে তোড়া রুমে প্রবেশ করলো।

তোড়া ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলো।তারপর পায়ে পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
কুশান তোড়াকে দেখে একদম হা হয়ে গেলো।সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তোড়ার দিকে দেখছিলো। অল্প একটু সেজেছে তোড়া—মাঝখানে সিথি করে একটা খোপা করেছে,চোখে কাজল দিয়েছে, হালকা গোলাপি লিপিস্টিক দিয়ে ঠোঁট ও রাঙিয়েছে। ফর্সা, সুন্দর মুখটা—এই সামান্য সাজটুকুর জন্যে আরও সুন্দর লাগছে।

কুশান এই প্রথমবার তোড়াকে নিজের ইচ্ছায় এমন করে পরিপাটি করে সাজতে দেখলো।তোড়াকে দেখামাত্র কুশান তীব্র ভালবাসা অনুভব হতে লাগলো।সোনালি কালারের পাড় আর নীল কালারের ব্লু শাড়ি পড়ে আছে তোড়া—সোনালি পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে সোনালি কালারের ব্লাউজ ও পড়েছে। আঁচলটা দু বার করে বুকের ওপর সাজানো।

কুশান তোড়ার এমন সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয় রুপ দু চোখ ভরে দেখছিলো।তোড়া যে ধীরে ধীরে কুশানের মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করছে তা সে বুঝতে পারছে।
এতোদিন তোড়া যেমন আচরণ ই করুক না কেনো তবুও কখনো কুশান তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি।সে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসার চেষ্টা করেছে।

আর কুশান এটা ভালো করেই জানে তোড়া কথায় কথায় রেগে গেলেও সে সবচেয়ে বেশি আবেগি মানুষ। কারন রাগি মানুষদের মন ভেতর থেকে ভীষণ নরম প্রকৃতির হয়। তোড়া হুটহাট রেগে গেলেও কিছুক্ষন পরে আবার সেই ঠান্ডা চুপচাপ হয়ে যায়।
তোড়া যখন রেগে যায় তখন মনের অজান্তেই অনেক কড়া কড়া কথা বলে ফেলে কিন্তু রাগ কমার পর কষ্টটা সেই বেশি পায়।

তবে কুশান আরেক টা জিনিস খেয়াল করেছে তোড়া যার তার উপর রেগে যায় না।শুধুমাত্র তার সাথেই এতো টা রাগ দেখায়।বাকি সবার সাথে কত নরমাল ভাবে কথা বলে মনেই হয় না এই মেয়েই তার সেই রাগী বউ।আসলে মেয়েরা সবচেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসে তার উপরই রাগটা দেখায়। হুটহাট রেগে যাওয়া মানুষ গুলো আসলেই মন থেকে ভালো হয়।

এখন তোড়াকে একজন পারফেক্ট বউ ই মনে হচ্ছে কুশানের।
কুশান আর এভাবে খাটে বসে থাকতে পারলো না।খাট থেকে নেমে পড়ে তোড়াকে তার কাছে টেনে নিলো।তোড়ার নরম এবং পরিপূর্ণ রূপ লাবণ্যের শরীরটাকে নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরে মৃদু এবং গভীর গলায় ডেকে বললো,তোড়া?ব্যাপার কি?আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি?

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ২২

তোড়া কুশানের মুখে এরকম আবেগঘন ডাক শুনে কুশানের দিকে মুখ তুলে তাকালো।তোড়ার এমন চাহনি দেখেই কুশানের সমস্ত ভালোবাসা যেনো আগ্নেয়গিরি থেকে ছুটে বেরোল লাভার মত—ও এখন আর একটুও অপেক্ষা করতে পারলো না।

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ২৪