কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৩

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৩
নুজাইফা নূন

-” হেই ইউ ! ওপেন ইউর আইস বলে আবদ্ধ স্রোতের চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো। কিন্তু স্রোতের কোনো রেসপন্স নেই দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো আবদ্ধ। তখন আবদ্ধ রাগের বশে স্রোত কে কান ধরে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেও সবাইকে রোদের মধ্যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবদ্ধের গিল্টি ফিল হচ্ছিলো।যার কারণে আবদ্ধ সৈকত স্যার কে ডেকে সবাই কে ক্লাস রুমে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

আবদ্ধ ভেবেছিলো স্রোত‌ হয়তো ক্লাসরুমে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে দৌড়ে ক্লাস রুমে চলে যাবে। কিন্তু আবদ্ধের ধারণা পাল্টে দিয়ে তার অনুমতি পাওয়ার পর সব ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস রুমে চলে গেলেও স্রোত কে ঠাঁই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবদ্ধের।তার কথা অমান্য করার সাধ্য কারো নেই। সেখানে চার আঙ্গুলে মেয়েটা তার কথার অবাধ্য হয়েছে দেখে আবদ্ধ স্রোতের দিকে এগিয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মনে মনে ভাবে টু পাশ মহিলা কে আরো কিছু কঠিন কথা শোনাবে। কিন্তু আবদ্ধ স্রোতের কাছাকাছি এসে বুঝতে পারে স্রোত রোদের তাপ সহ্য করতে পারে না।রোদের মধ্যে থাকার জন্য স্রোতের চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটা ঝরে যাওয়ার পাতার মতো নুইয়ে পড়েছে।আবদ্ধ বড়ো বড়ো কদমে স্রোতের দিকে এগিয়ে যেতেই স্রোত ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়ে যেতে যায়।

আর তখনি আবদ্ধ তার বক্ষ পিঞ্জরে স্রোত কে আটকে নেয়।আবদ্ধ স্রোতের চোখে মুখে কয়েকবার পানি ছিটা দিয়ে মুখে চাপড় দিতেই স্রোত টিপটিপ করে চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে আবদ্ধের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে দেখে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় তার। সেই সাথে মানুষ টার প্রতি ঘৃণার পরিমাণ ও বেড়ে যায়।স্রোত তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারে না।বড্ড দূর্বল লাগছে তার। দ্বিতীয় বার আবারো সে আবদ্ধের বুকে ঢলে পড়ে।আবদ্ধ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্রোত কে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসে। ডক্টর স্রোতের চেকাপ করে বললো,

-“চিন্তার কোন কারণ নেই মিস্টার আবদ্ধ।স্রোত মামনির তেমন কোন কিছু হয় নি ।তবে প্রেশার লো । খাওয়া দাওয়ার প্রচুর অনিয়ম করে।এতো বড়ো মেয়েকে বাচ্চাদের মতো জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়। মেয়েটা কে নিয়ে আমার দোস্ত সাইফুলের চিন্তার কোন শেষ নেই। সাইফুলের কথা বলতে বলতেই সাইফুল ভূঁইয়া আর তার স্ত্রী শারমিন ভূঁইয়া হসপিটালে উপস্থিত হয়।স্রোত হসপিটালে রয়েছে শুনে তাদের পাগলপ্রায় অবস্থা হয়ে গিয়েছে। সাইফুল ভূঁইয়া স্রোতের মাথার চুমু দিয়ে ভেজা গলায় বললো,

-” আপনি ঠিক আছেন আম্মা? আমাদের কষ্ট দিয়ে আপনি কি সুখ পান বলুন তো?”
-“স্রোত উঠে তার পাপা মমকে দু হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো, তোমরা শুধু শুধু টেনশন করছো পাপা ,মম। আমার কিছু হয় নি।আমি একদম ফিট আছি।”

-” কেমন ফিট আছেন দেখতেই তো পারছি। আচ্ছা আম্মা! একটা কথা বলুন তো আপনি কবে বড়ো হবেন? আপনার বয়সি মেয়েরা বিয়ে করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করছে।আর আপনি এখনো বাচ্ছাটাই থেকে গেলেন। সারাক্ষণ বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছেন।এখনো মায়ের হাতে ছাড়া ভাত খেতে পারেন না,তাকে ছাড়া গোসল করতে পারেন না।আর কবে বড় হবেন আপনি?”

-“স্রোত তৎক্ষণাৎ বেড থেকে নেমে সাইফুল ভূঁইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তার হাইটের সাথে নিজের হাইট মেপে বললো,দেখছো আমি তোমার গলা পর্যন্ত। লম্বায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি একটা মেয়ে আর কতো বড় হবে বলো তো?”
-” স্রোতের কথা শুনে আবদ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে বললো শুধু লম্বায় বড় হলে হয় না।মাথার মধ্যে ঘিলু বলে কিছু থাকা লাগে। কিন্তু আপনার মাথায় ঘিলুর পরিবর্তে গোবর রয়েছে।স্রোত আবদ্ধের কথায় পাত্তা না দিয়ে সাইফুল ভূঁইয়া কে বললো,

-” তোমাকে কতো বার বললাম পড়াশোনা ভাল্লাগে আমার।আমাকে কোনো বেকার ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।তখন আমিও পড়াশোনা নামক প্যারা থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। বেকার ছেলেদের যেহেতু কোন কাজ কর্ম থাকে না।তাই তারা ব‌উকে অনেক বেশি ভালোবেসে। সারাক্ষণ ব‌উয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ায়। ব‌উকে সুখে শান্তিতে রাখে।”
-” আপনি সারাক্ষণ এমন দুষ্টুমি করলে বেকার ছেলে কেন আপনাকে কোনো ছেলেই বিয়ে করতে রাজি হবে না আম্মা। আগে আপনি বড়ো হোন। তারপর একটা রাজপুত্র দেখে‌ মহা ধুমধাম করে আমি আমার আম্মার বিয়ে দিবো।”

-” এতোক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের ভালোবাসা দেখছিলো আবদ্ধ।বাবারা এমনি হয়।বাবা মায়ের কাছে সন্তান হাজার বড়ো হলেও তাদের কাছে সেই ছোট্টটি রয়ে যায়।তারা চায় তাদের মেয়ে যেন সারাজীবন ছোট্ট থাকে। প্রকৃতির নিয়মে মেয়ে বড় হয়ে গেলেই যে পরের হাতে তাকে তুলে দিতে হবে।আবদ্ধ সাইফুল ভূঁইয়া কে বললো ,
-” তাহলে আমি এখন আসি আঙ্কেল।”

-” সাইফুল ভূঁইয়া আবদ্ধ কে কেবিনের বাইরে এসে আবদ্ধের হাত ধরে বললো, আমি সবটাই শুনেছি বাবা।আমি আমার মেয়ের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি বাবা।আমার মেয়ে যেটা করেছে অন্যায় করেছে। কিন্তু কি করবো বলো তো বাবা? মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিচ্ছুটি বলতে পারি না তাকে।মেয়েটা যে তার মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। আমাদের বেঁচে থাকার ‌কারণ। আমাদের বিয়ের পর পনেরো বছর আমরা নিঃসন্তান ছিলাম।একটা সন্তানের জন্য কতো কিছুই না করেছি।

ডক্টর, কবিরাজ‌ , ফকির কিছুই দাও দেই নি। আল্লাহর দরবারে অনেক কান্নাকাটি করার পর তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকান। আমার স্ত্রী কনসিভ করে। কিন্তু বাচ্চা টা তিন মাসে মিসক্যারেজ হয়ে যায়।এরপর শারমিন প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের আশার আলো নিভে যায়। কিন্তু কয়েকমাস যাওয়ার পর আল্লাহর রহমতে শারমিন আবারো কনসিভ করে। আমাদের পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে যায়।সব‌ই ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু হুট করে একদিন রাতে শারমিন আমাকে না ডেকে নিজেই ওয়াশরুমে যায়।

আর দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে যায়।যার জন্য তার অবস্থা খুব‌ই খারাপ হয়ে পড়ে। ডক্টর জানায় তাকে বাঁচানো গেলেও বাচ্চা টাকে বাঁচানো যাবে না। সেই মূহূর্তে আমি ও বাচ্চার মায়া ত্যাগ করে দিয়েছিলাম। তখন বাচ্চা টা চাই নি আমি। আমি যেকোনো মূল্যে আমার স্ত্রী কে চেয়েছিলাম। অবশেষে শারমিনের অপারেশন হলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাচ্চা টা জীবিত ছিলো। কিন্তু মৃতপ্রায় অবস্থা ছিলো।সবাই বলছিলো আমার মেয়েটা বাঁচবে না।

কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? সবার ধারণা পাল্টে দিয়ে আমার মেয়েটা আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠলো। অনেক সাধনা , অনেক কষ্ট করে আমার মেয়েটা পেয়েছি।তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতেও আমার বুক কেঁপে উঠে।তার চোখে পানি দেখলে সমুদ্রের স্রোতের মতো আমার বুকে উথাল পাতাল শুরু হয়।মেয়েটা কে পেয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছি আমরা।তার সুখের জন্য আমরা সব করতে পারবো।প্রয়োজনে আমি আমার মেয়েকে অন্য ভার্সিটি তে ট্রান্সফার করে নিয়ে যাবো বলে সাইফুল ভূঁইয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলেন।তার চোখে পানি দেখে কখন যে নিজের অজান্তেই নিজের চোখ ভিজে গেছে বুঝতে পারে নি আবদ্ধ।আবদ্ধ তৎক্ষণাৎ চোখের পানি মুছে বললো,

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ২

-” আপনার প্রতি এতোটা কঠোর হ‌ওয়া উচিত হয় নি টু পাশ মহিলা। সত্যিই অনেক আঘাত দিয়ে ফেলেছি আপনাকে।তবে আঘাত যেহেতু আমি দিয়েছি,মলম টাও আমিই লাগিয়ে দিবো।”

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৪