কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৪

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৪
নুজাইফা নূন

-” দেখতে দেখতে কে’টে যায় কয়েক মাস। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে স্রোতের আবদ্ধের প্রতি শুধু ঘৃণায় তৈরি হয়েছে। আবদ্ধের প্রতি স্রোতের ঘৃণা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সৈকত। সেদিন স্রোত কে হসপিটাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর বিকালে সৈকত একটা ফুলের তোড়া,স্রোতের পছন্দের আইসক্রিম, ফুচকা, ঝালমুড়ি, রসমাইল নিয়ে স্রোতের বাড়িতে আসে।

সৈকত কে দেখে খুশি হয় সাইফুল ভূঁইয়া আর শারমিন ভূঁইয়া।তারা সৈকত কে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। স্রোত তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছিলো।হুট করে তার রুমে সৈকত কে দেখে কিছুটা ভড়কে যায়।স্রোত তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে গেলে সৈকত বাঁধা দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” রিলাক্স স্রোত রিলাক্স।এতো হাইপার হ‌ওয়ার কিছু নেই।আমি একজন টিচার হিসেবে তোমাকে দেখতে আসি নি।এসেছি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে। টিচার হলেও সবার আগে আমি একজন মানুষ।আমি মুনফাসিল আবদ্ধের মতো হিংস্র নয় স্রোত।আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।আমাকে তোমার নিজের কাছের কেউ ভাবতে পারো। একান্তই কাছের কেউ।যে সবসময় তোমার ভালো চাইবে। নিজের দাম্ভিকতা বজায় রাখার জন্য কখনো তোমাকে কষ্ট দিবে না। তোমার চোখে পানি আসতে দিবে না।”

-“সৈকত লক্ষ্য করলো আবদ্ধের কথা শুনে স্রোতের চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।যা দেখে সৈকত বললো, জানো স্রোত আমি আবদ্ধ কে কতো করে বলেছিলাম বাচ্চা মেয়ে ভুল করেছে।তাকে এতো কঠিন শাস্তি দিস না। কিন্তু সে আমার কথা শোনে নি।আমি শুধু মাত্র তোমার কথা ভেবে আবদ্ধের হাতে পায়ে ধরে তোমাদের শাস্তি কমিয়ে দিয়েছিলাম।আবদ্ধ কি বলেছে জানো?”
-” কি?”

-“প্রিন্সিপাল স্যার কে বলে তোমাকে নাকি ভার্সিটি থেকে বের করে দিবে।তোমার জন্য নাকি সব ছাত্র-ছাত্রী খারাপ পথে চলে যাবে। আর আমি স্পষ্ট শুনেছি আবদ্ধ তোমাকে আরফার সাথেও মিশতে বারণ করেছে।মুনফাসিল আবদ্ধ অনেক খারাপ একটা লোক স্রোত।”

-” আবদ্ধের নামে এমন কটুক্তি শুনে স্রোতের মন আরো বিষিয়ে উঠে। পরেরে দিন স্রোত ভার্সিটি এসে আরফা কে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু পারে না।আরফা এসে স্রোত কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।আরফার চোখের পানি দেখে স্রোত ও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।বুকে টেনে নেয় আরফা কে।সব ভুলে আবারো হাসি খুশি দুষ্টুমি তে মেতে উঠে স্রোত। কিন্তু আবদ্ধের দিকে ভুলেও তাকিয়ে দেখে না স্রোত। সবসময় দুষ্টুমি তে মেতে থাকলে ও আবদ্ধের ক্লাস টাইমে স্রোত আরফা আলাদা আলাদা সিটে বসে।

একদম ভদ্র বাচ্চা হয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রম করে। এভাবেই কেটে যায় কয়েক মাস।স্রোত যথারীতি ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি নতুন এক সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে।সেই সাথে স্রোতের নানা নানু, ফুপি , ফুপা , মামা, মামী , স্রোতের কাজিন সবাই এসেছে। সবাইকে এক সাথে দেখে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় স্রোত। কিন্তু সে বুঝতে পারে না হুট করে সবাই একসাথে তাদের বাড়িতে কেন এসেছে?স্রোত অনেক দিন পর সবাইকে একসাথে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে।

তাই আর এই বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের রুমে ফ্রেশ হতে চলে যায়।প্রায় ত্রিশ মিনিট পরে স্রোত শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখে তার বিছানার উপর বিয়ের লেহেঙ্গা, গহনা কসমেটিক্স আরো প্রয়োজনীয় সব কিছু রয়েছে।স্রোত একে একে সবকিছু তে হাত বুলিয়ে বললো,

-” তোদের কে গায়ে ধারণ করার সৌভাগ্য আমার নেই রে।সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার বিয়ে নিয়ে পাপা মমের কোনো হেলদোল নেই। কবে যে বিয়ের সাজে সজ্জিত হতে পারবো আল্লাহ জানে?”
-” আজকেই বিয়ের সাজে সজ্জিত হতে পারবেন আম্মা।আপনার মনের আশা পূরণ হতে চলেছে।”
-” পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শুনে স্রোত দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মম হাতে গহনার বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।স্রোত তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-” তুমি সত্যি বলছো? আজ আমার বিয়ে?”
-” হ্যাঁ আম্মা।আজ আপনার বিয়ে।”
-“সাধারণত মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে কান্নাকাটি করে‌।ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করে। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে রুমে দরজা বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে থাকে। কিন্তু মেয়েদের সেসব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে স্রোত বললো, ও মাই গড! আজ আমার বিয়ে।তার মানে আজ থেকে আমি পড়াশোনা থেকে মুক্তি পাবো। দাঁড়াও আমি এক্ষুনি আমার বিয়ের কথা সবাইকে জানিয়ে দেই।”

-” না না আম্মা।বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে। এক্ষুনি সবাইকে জানাচ্ছি না আমরা। পরবর্তীতে জানানো হবে।”
-” কেন মম?”
-” আগে এটা বলুন আপনি কোন ধাতুর তৈরি আম্মা?”
-” সবাই যে ধাতুর তৈরি আমি ও সেই ধাতুর তৈরি। কিন্তু কেন বলো তো মম?”
-” বিয়ের কথা শুনে একটু ও খারাপ লাগছে না আপনার?বিয়ে হলে যে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।”
-” কাম অন মম।এটা আধুনিক যুগ।এ যুগের মেয়েরা নিজের বিয়েতে নিজেরাই নাচ গান করে।হৈ হুল্লোড় করে।।তবে একটু খারাপ লাগছে হুট করে বিয়ে হবে এটা ভেবে।বিয়ে নিয়ে কতো প্ল্যান ছিলো আমার। হলুদ অনুষ্ঠান হবে, মেহেদীর অনুষ্ঠান হবে।বিয়েতে আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাইকে নিয়ে কতো মজা করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না।”

-” স্রোতের কথা শুনে শারমিন ভূঁইয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো, আমার আম্মা টা কতো বড়ো হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা টা যেন সারাজীবন সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। মানুষ টা যেন আমাদের থেকেও আমার আম্মাকে বেশি ভালো রাখতে পারে। আমার বিশ্বাস আপনি তার কাছে‌ ভালো থাকবেন।সুখে থাকবেন বলে শারমিন শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে স্রোতের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।শারমিন নিচে গিয়ে পার্লারের মেয়েদের স্রোতের রুমে পাঠিয়ে দিলো।

পার্লারের মেয়েরা এসে স্রোতের হাতে সুন্দর করে মেহেদি দিয়ে হাতের মাঝ খানে ইংরেজি অক্ষরে A লিখে দিলো। স্রোতের হাতের মাঝখানে A অক্ষরা জ্বলজ্বল করতে দেখে তৎক্ষণাৎ স্রোতের চোখের সামনে আবদ্ধের রাগী , গম্ভীর চেহারা টা ভেসে উঠে।কোথাও যেন একটা চাপা কষ্ট অনুভব হয়।স্রোত সেদিকে পাত্তা দেয় না।স্রোতের মেহেদী শুকিয়ে গেলে পার্লারের মেয়েরা তাকে সুন্দর করে বিয়ের সাজে সাজিয়ে দেয়।স্রোত আয়নায় নিজেকে দেখে বললো, মাশাআল্লাহ আমাকে একদম পরীর মতো লাগছে। নিজের রুপে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।আমার বর তো আমাকে দেখে ফিট হয়ে পড়ে থাকবে।

কিন্তু আমার বিয়েটা হচ্ছে কার সাথে? এটাই তো জানি না।যাই হোক আমার পাপা মম কখনো আমার খারাপ চাইবে না। তাদের সন্তুষ্টি তে আমার সন্তুষ্টি।তারা আমার জন্য যে পাত্র ঠিক করেছে আমি তাকেই বিয়ে করবো।বিয়ে করে মুনফাসিল আবদ্ধের মুখে একদম ঝামা ঘষে দিবো। হুঁ আমি ও‌ স্রোত ভূঁইয়া।”

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৩

-” বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।বর কনের জন্য পাশাপাশি আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বরপক্ষ চলে এসেছে। তাদের আপ্যায়ন পর্ব শেষ হলে স্রোত কে বিয়ের আসরে নিয়ে আসা হয়। বিয়ের আসরে পাত্রের জায়গায় অ্যাকাউন্টিং এর প্রফেসর মুনফাসিল আবদ্ধ কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় স্রোত।সে কখনোই পাত্র হিসেবে এই গম্ভীর রাগী বদমেজাজি অহংকারী মানুষ টাকে আশা করে নি।স্রোত সবার সামনে চিৎকার করে বললো, আমি এই খারাপ লোক, একটা এটিটিউড এর দোকানদার কে বিয়ে করতে পারবো না।কখনোই না।”

কলিজার ভেতর গেঁথে রাখবো তোমারে পর্ব ৫