কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১৪

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১৪
লাবণ্য ইয়াসমিন

আলো ঝলমলে সোনালী সকাল।সূর্য পূর্ব আকাশে কিরণ দিচ্ছে। গ্রীষ্মকালের সকাল গরম আবহাওয়ার দরুন জুবায়ের এসি অন করে খুব মনোযোগ দিয়ে ফাইল চেক করছে। অধরা অফিসটা ঘুরেঘুরে দেখছে। এগারোটার পরে মিটিং আছে জুবায়ের তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অধরা এদিক ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে স্টোর রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ফিসফিস আওয়াজ শুনে থমকে গেলো। কান পেতে শুনলো কেউ বলছে,

স্যার একটা দিন সময় দিন আমি ফাইলগুলো আপনার কাছে পৌঁছে দিব। একটা দিন প্লিজ স্যার। এতদিন ধরে জুবায়ের স্যারের কোম্পানির সব খবরাখবর আপনাকে দিয়েছি কোনো অসুবিধা হয়েছে কি? তবে আজ কেনো বিশ্বাস রাখতে পারছেন না? প্লিজ স্যার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অধরা এইটুকু শুনেই চোখ বড়বড় করে ফেলল। জুবায়েরের মতো মানুষের নজর এড়িয়ে এই অফিসে এমন লোক কিভাবে আসলো ওর মাথায় আসছে না।তাই লোকটাকে দেখার জন্য চুপিচুপি গিয়ে দরজা হালকা আলগা করতেই ওকে ধাক্কা দিয়ে সেই অগন্তুক বেরিয়ে গেলো। সবুজ রঙের ফুল হাতা শার্ট আর মুখে মাস্কের জন্য অবয়বটা দেখা গেলোনা। অধরা হিতাহিত জ্ঞান ভুলে লোকটার পিছু ছুটতে শুরু করলো। করিডোর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটার পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে অনেকের নজরে পড়ে গেলো।

অধরা চিকন পাতলা মানুষ দৌড়াতে অসুবিধা হচ্ছেনা কিন্তু শাড়ির জন্য পা পেচিয়ে যাচ্ছে। অগন্তুক চালাকি করে চতুর্থ ফ্লোর থেকে লিফটে না উঠে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। অধরা কিছু একটা ভেবে দৌড়ে গিয়ে লিফটে উঠে নিচে নেমে পড়লো। লিফট থামতেই আবারও দৌড় দিলো। কিন্তু গেট পযর্ন্ত দৌড়ে গিয়েও কাউকে পেলোনা। অগন্তুক নিচে নামেনি মানে উপরেই আছে। অধরা এবার সিঁড়ি দিয়ে নিচ থেকে দৌড়ে দৌড়ে উঠতে গিয়ে একজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো। লোকটা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। অধরা ঝাড়ি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো তার আগেই জুবায়েরের তীক্ষ্ম দৃষ্টি ওর নজরে পড়লো। এতোক্ষন অচেনা লোকটাকে ধরতে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়েছিল। জুবায়ের যে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে সেটাও চোখে পড়েনি। সিঁড়ির মাঝামাঝিতে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। অধরা কিছু বলতে চাইলো তার আগেই জুবায়ের ভ্রু নাচিয়ে বলল,

বউ বাচ্চাদের মতো আমার অফিসে এসে হাডুডু খেলছো কেনো? মান সম্মান নিয়ে টানাটানি না করলে চলছিলো না? বাড়িতে সারাদিন কিচেনে পড়ে থাকো আর এখানে এসে তোমার খেলতে মন চাইছে?আমি দুঃখ পাচ্ছি।
অধরা চরম বিরক্ত জুবায়েরের উপরে। মানুষ এমন নাটক কিভাবে করতে পারে ও ভেবে পাচ্ছে না। চোখ রাঙিয়ে উত্তর দিলো,

ফালতু কথাবার্তা ছেড়ে সিসি ক্যামেরা চেক করুন খুব দ্রুত। অফিসের কেউ একজন কোম্পানির তথ্য পাচার করছে। আর একটুর জন্য ধরতে পারিনি। তাড়াতাড়ি চলুন প্লিজ।
অধরা হাপাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কোনোরকমে জুবায়েরের বাহু ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অধরার কথা ওর কর্ণকুণ্ডলে পৌঁছনোর পূর্বে জুবায়ের ওকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে উপরে উঠতে উঠতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

কাজটা তুমি ঠিক করোনি বউ। এভাবে কেউ দৌড়াদৌড়ি করে? পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙে গেলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার হাড্ডি আরও খানিকটা ভেঙে দিতাম। তথ্য পাচার করে আমার কি এমন ক্ষতি করছে শুনি? তোমার কিছু হলে আমি এসব টাকা পয়সা দিয়ে কি করবো বলোতো? বয়স হচ্ছে বিষয়টা ভুলে গেলে চলবে না। আমারই ভুল তোমাকে অফিসে এনেছি। ভুলে গিয়েছিলাম আমার বউতো সাধারণ রমণীদের মতো না।

সে হচ্ছে মহা গোয়েন্দা। রহস্য তাকে টানে।
জুবায়ের বকবক করতে করতে উপরে উঠে গেলো। অধরা আপাতত ওর কথা পাত্তা দিচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিভাবে হালকা করতে হয় জুবায়ের খুব ভালো করে জানে। টেনশন বলে কিছু নেই আছে শুধু বউ বাচ্চার পেছনে কিভাবে ঘুরতে হবে সেই বুদ্ধি। জুবায়ের কক্ষে গিয়ে নিজের চেয়ারে অধরাকে বসিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো। সিসি ক্যামেরা চেক করে ম্যানেজারকে ফোন করলো। অধরা চেয়ারে হেলান দিয়ে জুবায়েরের দিকে তাঁকিয়ে আছে। মুগ্ধতা ওকে পেয়ে বসেছে। আশেপাশের কোনো কিছুতে ওর খেয়াল নেই।খানিকটা পরে হুড়মুড় করে ম্যানেজার ভেতরে প্রবেশ করে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে বলল,

স্যার ম্যাম ঠিক আছেন? আমি পঞ্চম ফ্লরে ছিলাম। খবর পেলাম ম্যাম কাউকে ধাওয়া করছে। বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
জুবায়ের কিছুক্ষণ ম্যানেজারের দিকে চেয়ে থেকে হুঙ্কার দিয়ে টেবিলে চাপড়ে উত্তর দিলো,

আপনার রেফারেন্সে যে লোকটাকে গত মাসে আমার কোম্পানিতে নিয়োগ দিয়েছিলাম তার খবরাখবর তুমি কি রাখো? আমার কোম্পানির বারোটা বাজানোর তালে আছে সে সবটা তোমার জানা আছে? আমি তোমাকেসহ ওকে পুলিশে দিব।
জুবায়েরের মেজাজ চরম খারাপ ম্যানেজারের উপরে। হুটহাট যখন তখন কোম্পানিতে লোক নিয়োগ হয়না তবুও জুবায়ের প্রায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে লাভী নামের ছেলেটাকে রেখেছিল। অসহায় মানুষের পাশে থাকতে জুবায়ের সব সময় চেষ্টা করে কিন্তু তাইবলে এভাবে ধোকা দিবে বিষয়টা ও মানতে পারছে না। যত রাগ আছে ম্যানেজারের উপরে ঝেড়ে দিয়ে শান্তিতে বউকে নিয়ে ছেলের ইউনিভার্সিটিতে যাবে বলে ঠিক করলো। আজকের মিটিং বাতিল হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তাই কোনোরকমের প্যারা নিতে চাইছে না। ম্যানেজার ওর হুমকি শুনে এক প্রকার কেঁদে ফেললো। জুবায়ের দিকে এগিয়ে এসে ছলছল চোখে বলল,

সরি স্যার ক্ষমা করে দিন আমি কখনও এমন ভুলভাল কাউকে নিযুক্ত করতে অনুরোধ করবোনা। আমাকে একটা সুযোগ দিন আমি আপনার লস হওয়া সব টাকা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবো। ছেলেটার নামে এখুনি অভিযোগ করবো। ও টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।
জুবায়ের ওষ্ঠে কুঠিল হাসি বিরাজ করছে। ল্যাপটপের দিকে চেয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

এটাই কিন্তু শেষ সুযোগ। আমাকে তুমি ভালো করে চিনো। নিজের ক্ষতি আমি কিছুতেই মানবো না। আমার সঙ্গে যে ভালো আমিও তার সঙ্গে ভালো। আর আমার সঙ্গে যে খারাপ আমি তার জন্য জঘন্য খারাপ। বিষয়টা আরও মগজে ঢুকিয়ে নিয়ে বের হয়ে যাও। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমি কোম্পানির লস হওয়া সব অর্থ ফেরত চাই। বুঝতে পেরেছো?
জুবায়েরের শীতল কণ্ঠের হুমকি শুনে ম্যানেজার খানিকটা কেঁপে উঠলো। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে ঝট করে অধরার দিকে ফিরে তাঁকালো। মেয়েটা এখনো ওকে দেখছে। জুবায়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো তাই ডান হাত বাড়িয়ে ওর চোখের পাপড়ি ধরে টান দিতেই অধরা ধড়ফড় করে পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলো। অধরা জুবায়েরের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,

আপনি মহা বেয়াদব। আমার লেগেছে। আমি রাগ করেছি।
জুবায়ের হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিলো,
তুমি যেভাবে তাকিয়ে ছিলে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম ম্যানেজারকে আরও খানিকটা হুমকি ধামকী দিব কিন্তু তোমার বেহায়া দৃষ্টির জন্য আমি এলোমেলো হয়ে সবটা অগোছালো করে ফেলেছি। রাগ ভুলে গিয়ে লজ্জা আর প্রেম ভর করেছিল মস্তিষ্কে। তোমার শাস্তি কিন্তু শেষ হয়নি। এই অপরাধে জন্য তোমার শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ আসলো,

একদম না। আমি জানতাম আপনি ম্যানেজারের উপরে উল্টোপাল্টা রাগ দেখাবেন তাইতো এমন বুদ্ধিটা করেছি। শুনুন আমার না সখ নেই বেহায়া নজরে আপনাকে দেখার। বয়স হচ্ছে ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে দুদিন পরে বউমা আসবে সবটা আমার মাথায় থাকে। অধরা বারির মস্তিষ্ক ধারা/লো খ/ঞ্জরের ন্যায় বুঝলেন?

অধরা বেশ দাম্ভিকতার সহিত কথাগুলো বলল কিন্তু জুবায়ের ওকে পাত্তা না দিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে একে নিজের আরও খানিকটা কাছে জড়িয়ে নিয়ে মৃদু হাসলো। বউয়ের মাথায় সত্যিই বুদ্ধি আছে মানতে ওর অসুবিধা নেই। উপরে উপরে যতই শান্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেনো গত এক সপ্তাহ মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়েছিল। কেউ একজন তথ্য পাচার করছে বুঝতে পেরেছিলো কিন্তু ধরতে পারেনি। সন্দেহ হয় এমন কেউ নজরে আসেনি। জুবায়ের ঠোঁট কামড়ে হাসলো। জীবনে সুখী হতে হলে যোগ্য জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন যেটা সুলতান জুবায়ের ফারুকীর আছে।

কহিনুর মাথা নিচু করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিছানায়। ওর সম্মুখে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মাহিম রিজুয়ান। নির্জনতা কাটিয়ে গমগমে আওয়াজে ছেলেটা বলে উঠলো,
তোমার সৌন্দর্যে যেকোনো পুরুষের মাথা ঘুরতেই পারে কিন্তু একটা বিষয় কি জানো তুমি? সব সময় সৌন্দর্য আমাদের সুখ দেয়না। সুখে থাকতে হলে সুস্থ পরিবেশ আর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। জানি তোমার বাবার অনেকখানি অর্থ সম্পত্তি আছে কিন্তু অতটাও নেই যতটা আমার প্রয়োজন।

সুলতান পরিবারের নাম শুনেছো নিশ্চয়ই? সুলতান জামসেদ ফারুকীর একমাত্র কন্যা সুলতানা দৃষ্টি ফারুকীকে চিনো? মেয়েটাকে আমার বেশ মনে ধরেছে। সুলতানদের কাছে যা অর্থ আছে আমার চৌদ্দ পুরুষ অনায়াসে পায়ের উপরে পা তুলে খেতে পারবে। তাছাড়া দৃষ্টি দেখতে তোমার মতো সুন্দরী না হলেও কম না। কিছুদিন আগে এক পার্টিতে দেখা হলো। মোটামুটি পরিচয় হয়েছে। মেয়েটাকে আমি প্রপোজ করেছি ও সময় নিয়েছে। আমার ধারণা মেয়েটা আমাকে ফিরিয়ে দিবেনা।

তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো। তুমি পালিয়ে যাবে এখান থেকে। আমার বাবাকে চিনোনা প্রতিশোধের নেশায় যা ইচ্ছা করতে পারে। আমি নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে ইচ্ছুক না। আশাকরি বুঝতে পেরেছো?
মাহিম বেশ গুছিয়ে নিজের কথাগুলো বলে উত্তরের আশায় কহিনুরের দিকে চাইলো। সাঈদ গভীর মনোযোগ দিয়ে মাহিমের কথাগুলো শুনছে। যদিও ওকে দেখা যাচ্ছে না। কহিনুর খানিকটা মাথা উচু করে বক্র হেসে সোজাসুজি তাঁকালো। মাহিম ভড়কে গেলো মেয়ের এমন চাহুনি দেখে। নির্জন কক্ষে পিনপতন নিরবতাকে দুহাতে ঠেলে রিনরিনে আওয়াজে মুখোরিত হয়ে উঠলো,

সুলতান পরিবারের মেয়েদের সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে মিস্টার মাহিম রেজুয়ান।তবে বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস দেখাতে চাইলে হাতদুটো পুড়বে তাই সাবধান। খুশী হলাম আপনি আমাকে পালানোর জন্য সাহায্য করতে চেয়েছেন কিন্তু কহিনুর নিজেই নিজেরটা বুঝে নিতে জানে। আপনি এখন আসতে পারেন।

কহিনুর শেষের কথাগুলো বেশ ঝাঝালো ভাবেই বলল। মাহিম কিছুটা অবাক হলো কহিনুরের কথা শুনে। মেয়েটা হঠাৎ রেগে গেলো কেনো ওর বোধগম্য হচ্ছে না। বিয়েতে না বলার জন্য নাকি দৃষ্টির কথা সামনে আনার জন্য কোনটা? মেয়েটাকি দৃষ্টিকে নিয়ে জেলাস? এরকম নানা এলোমেলো চিন্তা মাহিমের মস্তিষ্কে ঘুরছে। কহিনুরের ঝাড়ি শুনে এখানে বসে থাকার মতো মন মানুষিকতা ওর নেই। এমনিতেই রাগ হচ্ছে বাবার উপরে তারপর জুটেছে অচেনা এই মেয়েটা। মাহিম মুখ ভার করে উঠে আসলো কিন্তু বেশিদূরে যেতে পারলোনা। দরজার বাইরে পা রাখতেই পেছন থেকে কহিনুর বলে উঠলো,

দৃষ্টির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিন।আপনার জন্য মঙ্গল হবে। বাবার মতো ভুল করবেন না সারাজীবন ভুগতে হবে।
কহিনুরের কথাগুলো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতোই কাজ করলো। মাহিম তেড়ে এসে কহিনুরের গলাতে হাত রাখতে গিয়ে ছিটকে গিয়ে বিছানায় পড়লো। তাতে ও আরও খানিকটা তেতে উঠলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে ঘটে গেলো সবটা। মাহিম রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ফুলে উঠছে যার দরুন কথা বলতে পারছেনা। কহিনুর নির্বাকভাবে তাঁকিয়ে আছে ওর দিকে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আগেই মাহিম নিজেকে সামলে আবারও কহিনুরের দিকে এগিয়ে আসলো। তাতে কহিনুর বিরক্ত হলো। নিজেকে নিরাপদ দূরুত্বে রেখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বলল,

কাপুরুষ
আমি তোকে যথেষ্ট সম্মান করেছি কিন্তু সরি আর পারবোনা। আমারই ভুল তোকে ভালো ভেবে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরী করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন কিছুতেই না। আমি বিয়ে করতে পারবোনা তাতে কি? আমার ছোট ভাই আছে না? সেদিন রাতে তোকে দেখে ওর ফিউজ উড়ে গেছে। ও নিজে বাবাকে তোর ঠিকানা দিয়েছিলো। জানেনা তুই এখানে আছিস। দৃষ্টি বা আমাকে নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ কর প্রমিজ তোকে খু*ন করবো।ওকে সবটা জানিয়ে দিব।

মাহিমের হুমকি শুনে কহিনুর শব্দ করে হেসে ফেলল। চোখে কোনা দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো হাসির দাপটে। সাঈদ এখনো চুপচাপ আছে। এখানে কি হচ্ছে বা হবে সবটা ওর জানা আছে। পরিকল্পনার অংশ ভেবে সহ্য করছে নয়তো মাহিমের মুখ বন্ধ করতে ওর খুব একটা অসুবিধা হবে না। ছেলেটা অবুঝ নয়তো কি আর কহিনুরের সঙ্গে এহেন ব্যবহার করতে আসতো? কখনও না।

মাহিম রিজুয়ান আমার মনে হচ্ছে আপনার একটু একাকিত্বের প্রয়োজন। আমার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে আসবেন আপনার জন্য সুবিধা হবে। যাইহোক আমি ভীষণ দুঃখিত আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্য। আমি নিজেও কিছুটা অবাক নিজের ব্যবহারে। আমাকে একটু একা থাকতে দিন। আর নিশ্চিত থাকুন বিয়েটা হবে না।
মাহিম হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো কহিনুরের কথাগুলো শুনলো কি বোঝা গেলোনা। সাঈদ পাশ থেকে বলে উঠলো,

ছেলেটাকে রাগিয়ে বিশেষ লাভ হলোনা। কি দরকার ছিল অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করার?
দরকার ছিল সাঈদ। ওকে না রাগালে এই বাড়িতে আজ আমার শেষ দিন হতো কিন্তু আমি যে এতো তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে চাইছিনা। তোমার মনে পড়ে এক তুষারপাতের সকালের কথা? সাদা শুভ্র পোশাকে আঠারো বা বিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে এই বাড়ির গেটের কাছে পড়ে ছিল তার রহস্য জানতে হবে না? গতকাল রাতে অদ্ভুত কিছু দৃশ্য আমি স্বপ্নে দেখেছি।

কহিনুরের কথা শেষ হলোনা বারান্দায় ঠকঠক আওয়াজ আসতে শুরু করলো। সাঈদ চমকে উঠলো। কহিনুরের কপালে চিন্তার রেখা। বেশ রাত হয়েছে। আকাশে মেঘ জমেছে। এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে মেঘের আওয়াজ ভেসে আসছে। হয়তো তুষারঝড় হবে। দরজা বন্ধ তবে বেলকনিতে কে এমন আওয়াজ করছে ওদের বোধগম্য হচ্ছে না। সাঈদ ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে চুপিচুপি বেরিয়ে আসলো।

কিছু একটা ভেবে দরজা খানিকটা খুলে উঁকিঝুঁকি দিতেই দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে ওকে সরিয়ে দিয়ে একজন দানবাকৃতির মানুষ ভেতরে ঢুকে পড়লো। কহিনুর দরজার দিকে তাঁকিয়ে ছিল। লোকটা এসেই কহিনুর সামনে হাটু ভাজ করে বসে পড়লো। তারপর সামনে তুলে ধরলো একটা পুরাতন নকশাকার ডাইরী। কহিনুরের ওষ্ঠে হাসি ফুটলো। চিন্তার রেখা মুছে গিয়ে একরাশ ঝিলিক খেলে গেলো সারা শরীর বেয়ে। সাঈদ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখে বিস্ময় খেলা করছে। লোকটা গমগমে কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,

জাদুলিপির মালকীন আপনাকে ছাড়া আমি অর্থহীন। বুঝে নিন আপনার সম্পত্তি।
কহিনুর হাত বাড়িয়ে ডাইরীটা তুলে নিলো। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
ধন্যবাদ তোমাকে।

নির্জন সমুদ্রের তীরে পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমরোজ। খানিকটা পরপর বজ্রপাত হচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের তীরে সাধারণ মানুষের পক্ষে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কঠিন। কিছু ভাসমান স্মৃতি মস্তিষ্কে এসে সবটা এলোমেলো করে দিচ্ছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতেই ওর এখানে আসা। দাদুর কথায় ঐশ্বর্যকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েও শান্তি মিলছেনা। মেয়েটাকে দেখলে মেজাজ চড়ে যায়। গলা টি*পে দিতে ইচ্ছা করে।

হুদাই রাগ আসে যেটা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। দুদিন আগে মেয়েটাকে আঘাত করে ফেলেছে যার দরুন মেয়েটার অবস্থা শোচনীয়। দাদু বলে দিয়েছে আগামীকাল রাতেই বিয়ে করতে হবে ঐশ্বর্যকে। বিয়ের জন্য দাদু উতলা হচ্ছেন যেটা ওকে ভাবিয়ে তুলছে। বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো নিয়মকানুন মেনে ওকে বড় করা হয়নি। কেউ ইচ্ছা করলে পছন্দসই মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন এক বাড়িতে থাকতে পারে।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১৩

কিন্তু ওর বেলায় নিয়ম ভিন্ন। যেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। কথাগুলো ভেবে ও সমুদ্রের তীরে বসে পড়লো। এক আজলা জল তুলে ছুড়ে দিলো কিছুটা দূরে। আবারও পূণরায় পানি তুলতে গিয়ে ও থমকে গেলো। ওর পায়ের কাছে পানিতে ভাসমান এক রমনীর ফেকাশে মুখ ওর দিকে চেয়ে আছে। কঠিন সেই দৃষ্টি। ইমরোজ আনমনেই প্রশ্ন করলো, কে তুমি?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১৫