কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১০

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১০
লাবণ্য ইয়াসমিন

বিশাল ডাইনিং রুম জুড়ে নানারকম মানুষের আনাগোনা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিয়ে বেশ জটলা তৈরী হয়েছে। খান সাহেব দক্ষ হাতে সবটা সামলে নিয়ে মুখটা গম্ভীর করে ভাবছেন। ইমরোজ ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাঁকিয়ে আছে। দোষটা মেয়েটার মধ্যে নাকি নিজের মধ্যে সেটা নিয়ে দোটানায় আছে। ওর স্পর্শ পেয়ে মেয়েটা এভাবে ছিঁটকে পড়লো কিন্তু কেনো।তবে নিজের মধ্যে কোনো দোষ নেই এতে ও একশত ভাগ সিউর।

যদি সমস্যা হতো তবে গতকাল সেই অচেনা মেয়েটাকে যখন কোলে নিয়েছিলো তখনও হতো। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। ও কোলে করে মেয়েটাকে রাস্তা থেকে বাড়িতে অবধি নিয়ে এসেছে। তখন কিছু হয়নি। কিছু একটা ভেবে ইমরোজ দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো। সামনে মদের নেশায় বুদ হয়ে দুজন মেয়ে কোমর দুলিয়ে নেচে চলেছে। আশেপাশের কোনো কিছুতে খেয়াল নেই। ইমরোজ আলগোছে ব্লাক ড্রেস পরা মেয়েটার কব্জিটা নিজের হতের মুঠোয় নিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা সামনের মেয়েটার দিকে ছিটকে গেলো। আবারও সেই অনূভুতি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ও দ্রুত গিয়ে মেয়ে দুটোকে তুলতে চাইলো। তখনই খান সাহেব এসে ওকে আটকে দিলো। ইমরোজের চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে। কি হচ্ছে কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। একটা কথা সিউর হলো ওর ছোঁয়া কোনো মেয়ে সহ্য করতে পারেনা।তবে প্রশ্ন হচ্ছে সেদিন রাতে সেই মেয়টাকে কিভাবে স্পর্শ করতে পারলো? কি আছে ওই মেয়ের মধ্যে? ওর সঙ্গে মেয়েটার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? নানারকম প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। খান সাহেবের আওয়াজে ওর ধ্যান ভাঙলো,

কি করছো এসব? নিজের কক্ষে যাও।আপাতত কোনো ঝামেলা করোনা আমি সবটা সামলে নিবো। মেয়েটা অসুস্থ ওকে সুস্থ হতে সময় লাগবে। একবারে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আশাকরি সম্পর্কের বৈধতা পেলে আর কোনো বাঁধা আসবে না
ইমরোজ কথাটা মানতে পারলোনা। একবার ভাবলো অচেনা সেই মেয়েটা সম্পর্কে কিছু বলবে কিন্তু মন সাড়া দিলো না। কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলো,

আসলেই কি তাই? আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমার ছোঁয়া মেয়েটা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করতে পারবে না। কাছাকাছি যদি না আসতে পারে তবে নাম মাত্র বিয়ের কি দরকার দাদু? ছেড়ে দাও।
ছেড়ে দিব ভাবলে কিভাবে? তুমি আমার কথার বাইরে কথা বলছো? ভুলে যাচ্ছো আমি তোমাদের সবাইকে আগলে রেখেছি। যখন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে ছিলে যখন আমি ছিলাম যে তোমাদের কাউকে ছেড়ে যায়নি। সুস্থ করে স্বাভাবিক করেছি। তোমাকে মানুষ করেছি।

বড় করেছি আমাদের শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ নিতে। ওরা আমাদের মূল্যবান সম্পদ কেড়ে নিয়েছে সেটা ফিরিয়ে আনতে। ওরা কথার খেলাপ করেছে সবটার প্রতিশোধ নিতে হবে সবটা ভুলে গেছো তুমি?
খান সাহেবের কথা শুনে ওর রাগ হচ্ছে। লোকটা একটা কথার জন্য এতগুলো খোটা দিচ্ছে। মানুষ আপনার লোকের জন্য কিছু করলে কি তার জন্য প্রতিদানের আশা করে? ইমরোজ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে আসলো। নিচে থাকার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা অবশিষ্ট নেই।

বিয়ে করবে একটা না হাজারটা করবে। দাদু যতগুলা বলবে ততগুলো করবে। যে মেয়েরা আগুন নিয়ে খেলতে আসবে তাদের জন্য কোনো আফসোস নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও সিঁড়ির মাঝামাঝিতে গিয়ে থমকে গেলো। কিছু একটা ভেবে গুপ্ত দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলবে ভেবে দরজা খুঁলে হতবাক হলো। কারণ সেখানে কেউ নেই। শূন্য কক্ষ সামনে পালঙ্ক খালি পড়ে আছে। এই কক্ষে আসবারপত্র বলতে একটা পুরাতন আলমারি পালঙ্ক আর সোফা। পালানোর কোনো রাস্তা নেই।

দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা ছিল তবে মেয়েটা কোথায় গেলো? কেউ ওকে সাহায্য করেছে বাইরে যেতে কথাটা ভেবে ও ধুম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। এই কক্ষে বাইরের কেউ তেমন আসেনা। দাদু মাঝেমাঝে থাকতো। মেয়েটাকে ভয় দেখানোর জন্য আটকে রেখে লাভের লাভ কিছু হলোনা। পালাতে না পারে ভেবে গার্ডদের ফোন করে জানিয়ে দিলো। রহস্যজনক কাউকে দেখলে আটকে রাখতে। তাছাড়া এই বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে। মেয়েটা কোথায় আছে জানতে ওর অসুবিধা হবে। ইমরোজ নিজের কক্ষে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কহিনুর। ড্রেস চেঞ্জ করেছে কিছুক্ষণ আগে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটা বেশ ছোট। ভদ্রমহিলা চালাকি করে লাল রঙের গাউন পাঠিয়েছে যা হাটু অবধি লম্বা সঙ্গে পাতলা ওড়না। এই ওড়না দ্বারা আর যাইহোক নিজেকে আড়ালে রাখতে পারবে না। কি করবে ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি করে ওড়নার ওক প্রান্ত মাথার সঙ্গে বেধে বাকিটা নেকাবের মতো করে নিলো। বাসা থেকে আনা কটিটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে আগেকার আন্টি আন্টি টাইপ আর লাগছে না।

একটু বেশিই চাকচিক্যপূর্ণ লাগছে কিন্তু এছাড়া উপাই নেই। কথাগুলো ভেবে ও ফ্লরে ছড়িয়ে থাকা জুতাগুলো পায়ে পরে নিলো। বাইরে গিয়ে প্রথমে বাবাকে বলবে। বাবা জানলে নিশ্চয়ই ওকে উদ্ধার করতে আসবে। কহিনুরের মনাটা বেশ হালকা হলো। চুপচাপ বাইরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নিলো। ভদ্রমহিলার মেকাপ করতে গিয়ে ঘন্টা তিনেক অপচয় হয়েছে। উনাকে কাছাকাছি কোথাও দেখা গেলোনা তাই গটগট করে গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। লোকজন আসছে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে মিশে গেলো।

বাড়িটার বাইরে নানারকম আলোতে ঝলমল করছে। এতো সুন্দর বাড়িতে ওরকম জল্লাদ টাইপ ছেলে থাকে মানতে ওর বেশ কষ্ট হচ্ছে। মানুষ এতোটা চামার কিভাবে হতে পারে কে জানে। কহিনুর মনে মনে বকবক করছে আর হাটছে। বাগান পেরিয়ে প্রধান গেটের কাছে এসে ঝামেলা হয়ে গেলো। ওর দিকে দারোয়ানগুলো কেমন কৌতূহল নিয়ে তাঁকিয়ে আছে। কহিনুর ঢোক গিলল। যদি বুঝে যায় তবে ঝামেলা আছে।

ওকে অবাক করে লোকগুলো রাস্তা থেকে সরে গেলো। কহিনুর আর অপেক্ষা করলোনা। সোজা গিয়ে রাস্তায় উঠলো। কর্মব্যস্ত রাস্তা গাড়ির অভাব নেই কিন্তু ওর কাছে না আছে টাকা আর না আছে যাওয়ার কোনো ঠিকানা। বুক ভার হয়ে আসছে কান্নাতে। এরকম বাজে পরিস্থিতির জন্য কখনও তৈরী ছিল না। ভাবেনি এমন দিন ওর জীবনে আসবে। বাবার ছায়াতলে আদরে মানুষ হয়েছে। হঠাৎ কারো কণ্ঠ শুনে ও থমকে গেলো।

সেই কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছোনা? তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম জানতাম তুমি ঠিক বেরিয়ে আসবে। তোমার জন্য চমৎকার একটা খবর আছে।
কহিনুর হাঁটা থামিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে চাইলো। সাঈদ নামের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা লাগেজ। কহিনুর ভ্রু কুচকে ফেলল লাগেজ দেখে কারণ ওটা দুদিন আগে হারিয়ে ফেলেছিলো। একজন লোক ওকে বোকা বানিয়ে চুরি করে নিয়েছিলো। কহিনুরের মুখে হাসি ফুটলো। ও দ্রুত লাগেজের সামনে বসে পড়লো। দুহাতে আগলে নিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল,

তুমি ফিরিয়ে এনেছ আমার লাগেজ? তোমাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার উপরে আমার যতটুকু রাগ ছিল সবটা ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি ভীষণ ভালো। আমি তোমাকে লাগেজে থাকা টাকাগুলো সব দিয়ে দিবো। এটা নিয়ে তুমি ভালো কিছু করতে পারবে। পোশাকগুলো আমার ভীষণ দরকার ছিল।
কহিনুরের খুশি দেখে সাঈদ হাসলো। মেয়েটা সত্যি ওর নূরের মতোই হয়েছে। তবে এতোটা সরল কেনো হলো বুঝতে পারছে না। ওর নূর এমন ছিল না। নূরের বুদ্ধি ভীষণ ধারালো ছিল। সাঈদ চোখ বন্ধ করে কিছু ভেবে নিলো তারপর উত্তর দিলো,

আমার টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, নিবে আমাকে? প্রমিজ ভাইয়ের মতো আগলে রাখবো। বিপদে ছেড়ে যাবোনা।
কিন্তু তোমার পরিবার? ওদেরকে ফেলে আমার সঙ্গে থাকবে কেনো তুমি?
সাঈদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
আমি এতিম বাবা মা কেউ নেই। বাবার কৃতকর্মের ফল যুগের পর যুগ বহন করে চলেছি। জানিনা এই পাপ আমার জীবন থেকে কবে দূর হবে। তবে এইটুকু জানি আমার মুক্তি তোমার হাতে।
কহিনুর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো,

বুঝিয়ে বলো আমি বুঝতে পারছিনা। তোমার মুক্তি আমার হাতে কিভাবে?
মজা করে বলেছি। দ্রুত চলো। ইমরোজ খান পাথর তোমার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই পাগল হয়ে উঠবে। পাখি পালিয়েছে জানতে পারলে রাস্তায় নেমে আসবে বুঝলে?
কহিনুর মাথা নাড়ালো। ওই লোকটার সম্পর্কে জানার জন্য বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা ওর অবশিষ্ট নেই। একটা অসহায় মেয়েকে কিভাবে অসম্মান করলো নূর জীবনে ভুলবেনা।

সাঈদ উনার কথা ছাড়ো আপাতত বলো এই অচেনা শহরে আমি কোথায় থাকবো? আশ্রয়হীন মেয়েকে কে আশ্রয় দিবে? লাগেজে আমার পাসপোর্ট ভিসা আছে। চলো আমার শহরে ফিরে যায়।
কহিনুরের কথা শুনে সাঈদ চমকে উঠলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
তুমি না আমি গিয়ে তোমার বাবা মায়ের খোঁজ করবো। ওরা কোথায় আছে জানিনা তবে আমি তোমার নিরাপত্তার জন্য একটা ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারি। আপাতত সেখানে থাকো। আমি তোমার বাবা মায়ের খোঁজ নিয়ে দেখে আসবো তারপর তুমি যাবে। ওখানে গিয়ে যদি কোনো বিপদ হয় তখন?

এটা ঠিক বলেছো। আমি তোমাকে ঠিকানা দিবো প্লিজ ভালো করে খোঁজ করবে। উনারা আমাকে ছেড়ে জানিনা কেমন আছে। ভীষণ মিস করছি।
সাঈদ মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিলো। গালিবের খোঁজ নিতে গিয়েছিলো কিন্তু সেখানে কাউকে পায়নি। বাড়িতে তান্ডব চালানো হয়েছে। আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অপহরণ কেস হয়েছে পুলিশ খোঁজ করছে উনাদের। শত্রুরা কহিনুরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তাইতো গালিব আর মেহুলকে তুলে নিয়েছে। কহিনুরের শক্তি ছাড়া উনাদের কাছে পৌঁছনোর কোনো রাস্তা নেই। তাছাড়া এখানে শত্রু একটা না। কতগুলো আছে ভাবনার বাইরে। ওদেরকে কে তুলতে পারে ওর ছোট মাথায় ধরছে না। নিজের শক্তির পরিসীমা খুবই অল্প তাই বলল,

নূর আমি যেখানে তোমাকে নিয়ে যাবো উনারা ভীষণ ভালো মানুষ। তুমি একটু অনুরোধ করলেই থাকতে দিবে। ওখানে তুমি ভালো থাকবে। আমি তোমাকে গেট পযর্ন্ত নিয়ে যেতে পারবো। বাকিটা একটু বুদ্ধি করে গুছিয়ে নিবে। আমি জানি তুমি পারবে।
অস্বস্তি হচ্ছে সাঈদ। আমি কখনও কারো বোঝা হয়ে থাকিনি। তুমি এখানে কোনো হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া করে আমাকে রেখে যাও। উনারা মুখের উপরে কিছু বলতে পারবেন না কিন্তু মনে মনে কষ্ট পাবেন।
সাঈদ ওর কথা শুনে হাসলো। হাসি পাচ্ছে ওর। যার জন্য মানুষগুলো এতোদিন অপেক্ষা করছে তার উপস্থিততে নাকি বিরক্ত হবে।

তুমি একা বাইরে থাকলে খারাপ মানুষের নজরে পড়বে। বিপদ হবে কিন্তু সুলতান জুবায়ের ফারুকীর বাড়িতে থাকলে বিপদ তোমার আশেপাশে ভিড়তে পারবেনা। সুলতান ভিলা তোমার জন্য সুরক্ষা কবজের মতো।
সুলতান জুবায়ের ফারুকী নামটা শুনে কহিনুরের কেমন চেনা চেনা লাগলো। এই নামটা পূর্বে শুনেছে ভেবে হঠাৎ ও চিৎকার দিয়ে উঠলো,

সুলতান আলফা ফারুকীর ড্যাড জুবায়ের ফারুকী তাইনা? আলফা ভীষণ কিউট একটা ছেলে। আমি ওকে চিনি। নিশ্চয়ই যাবো আমি তবে আমি কিন্তু ফ্রিতে থাকবোনা।
আচ্ছা যাওয়া হোক তবে?

কহিনুর লাফাতে লাফাতে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। মন খারাপ ছিল আলফার কথা ভেবে মনটা ভালো হয়ে গেলো। ছেলেটা এখন কেমন আছে জানতে ইচ্ছা করছে। ঘন্টা খানিকটা পরেই ওরা সুলতান ভিলার সামনে এসে নামলো। বিশাল বড় রাজপ্রাসাদের ন্যায় বাড়িটার গেটের কাছে প্রহরিবৃন্দ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির মালিক যে বেশ প্রভাবশালী বুঝতে বাকি নেই। এখানকার খুব কম বাড়িতে প্রহরী থাকে। সাঈদ ওকে ইশারা করলো এগিয়ে যেতে। কহিনুর ওর থেকে বিদায় নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলো। প্রহরীরা যে ওকে আটকানোর চেষ্টা করবে বুঝতে পেরেই মিনমিনে কণ্ঠে বলল,

আমি সুলতান আলফা ফারুকীর চেনাশোনা একজন। আমাকে ভেতরে যেতে দিন নয়তো গিয়ে বলুন, স্যাক্সন সুইজারল্যান্ড থেকে একজন মেয়ে এসেছে।
কহিনুরের কথা শুনে ওরা বিশ্বাস করে রাস্তা থেকে সরে গেলো। কহিনুর ডান পা সামনে রেখে সুলতান হাউজে প্রবেশ করলো। অধরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। দূর থেকে একটা মেয়েকে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রহরীদের হাত নাড়িয়ে ইশারা করেছে ভেতরে আসতে দিতে। নয়তো সুলতানা হাউজে প্রবেশ করা সহজ ছিল না। মেয়েটা এগিয়ে আসছে দেখে ও প্রায় দৌড়ে দৌড়ে নিচে নামলো।

বেল বাজানোর আগেই দরজা খুঁলে দিলো। কহিনুর চমকে গেছে ওর হাত এখনো কলিং বেলের উপরে রাখা আছে। সামনে সবুজ শাড়ি পরিহিত বেশ সুন্দরী একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় বয়স ছাপ দৃশ্যমান কিন্তু সৌন্দর্য কমেনি। চেহারার উজ্জ্বলতা কেমন চোখ ধাঁধানো। চোখে মুখে রঙের ছোয়া একদম নেই। কহিনুর নিজেও মেকাপ পছন্দ করেনা বিধায় কখনও এসব করে সময় নষ্ট করেনা কিন্তু মায়ের জন্য শিখতে হয়েছিলো। মেহুল পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে তার জন্য প্রচুর মেকাপ করে। পার্লারে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতো বিধায় কহিনুর নিজেই শিখে নিয়েছিলো। মা ছাড়া থাকতে কষ্ট হতো। ভেবেছিলো বাকীটা জীবন মায়ের এইকাজটা ও নিজ দায়িত্বে করবে। কহিনুরের ধ্যান ভাঙলো রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠ শুনে। ওর গায়ে কেমন কাটা দিয়ে উঠলো।

কে তুমি? বাসা কোথায় তোমার? তুমি কি আলফার ফ্রেন্ড নাকি দৃষ্টির?
এক সঙ্গে এতগুলি প্রশ্ন শুনে কহিনুর ঝটপট বলে দিলো,
আলফা বাড়িতে আছে? আন্টি ও আমাকে দেখা করতে বলেছিলো। আসলে এই শহরে আমি একদম নতুন। একটা বিপদে পড়ে এখানে আছি। ওর সঙ্গে দেখা করে তবে ফিরে যাবো।

কহিনুর ইচ্ছে করে এমন করে বলল। প্রথমেই অচেনা কারো বাড়িতে থাকার কথা বলতে কেমন লজ্জা লাগলো। অধরা ওকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে কাজের মেয়েটাকে হুকুম দিলো আলফাকে ডাকতে। কহিনুর চুপচাপ অধরাকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। ওর ধ্যান ভাঙলো চিৎকার শুনে। আলফা সিঁড়ি থেকেই চিৎকার দিয়ে উঠেছে। ছেলেটার মুখে বিজয়ীর হাসি। পারলে ওখান থেকেই লাফিয়ে পড়তো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ও একপ্রকার দৌড়ে এসে কহিনুরকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের মায়ের সামনে ছেলেটা ওকে জড়িয়ে ধরেছে ভেবে কহিনুরের ভয় লাগছে তবে অস্বস্তি হচ্ছে না। ছেলেটাকে ওর ভীষণ আপনার লাগে। কহিনুর ওর পিঠে হাত রেখেই বলল,

কেমন আছো? পা ঠিক আছে তোমার?
আলফা ওকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা ভড়কে উত্তর দিলো,
সরি কিছু মনে করোনা আসলে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি। তুমি আসবে আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। ড্যাড প্রতিদিন আমাকে অপমান করেছে তোমার ঠিকানা আনতে পারিনি বলে। এখন আর কিছু বলবে না।
কহিনুর মলিন হাসলো। অধরা বুঝে নিয়েছে মেয়েটার পরিচয় তাই অপেক্ষা করলোনা দ্রুত কিচেনে চলে গেলো। একমাত্র ছেলের জীবন রক্ষা করেছে মেয়েটা। তার কোনোরকম অযত্ন করতে পারবেনা। জুবায়ের শুনলে খুশি হবে।

ইমরোজ খানের কুচকুচে কালো চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে উঠেছে রাগে। নিজের বড় মায়ের উপরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ভদ্রমহিলা সারাদিন মেকাপ করে ঠিক আছে কিন্তু এতোটা বুদ্ধিহীন ভাবতে পারেনি। ওর বন্ধিকে কাজের মেয়ে ভেবে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মেয়েটা বড্ড চালাক কিভাবে গুছিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলে দিলো। লাল গাউন পরিহিত মেয়েটার ছবি ল্যাপটপের পর্দায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মেয়েটাকে আন্টি টাইপ ভেবেছিলো চিন্তা সেটা ওর চরম ভুল। মেয়েটা মোটেই তেমন না।

বেশ সুন্দরী তবে মুখটা দেখতে পারলে সিউর হতে পারতো। যাইহোক মেয়েটা যেমনি হোক ওর কিছু আসবে যাবে না। মেয়েটা যে ওর শত্রু পক্ষ থেকে এসেছে সেটা ও একশত ভাগ নিশ্চিত। নয়তো এমন ছদ্মবেশে কেনো এসেছিল? ঝামেলা নিশ্চয়ই আছে। এই মেয়েটাকে ওর যেভাবেই হোক দরকার। লোক লাগিয়ে দিয়েছে। এই শহরে যায় বাড়িতেই প্রবেশ করবে ইমরোজ খান সেটা জেনেই ছাড়বে। হয়তো একদিন দেরি হবে কিন্তু জানতে পারবে তখন কি হবে? এবার ধরতে পারলে মেয়েটাকে ছাড়বে না। উচিত শিক্ষা দিবে। ইমরোজের ধ্যান ভাঙলো দরজা থেকে আসা আওয়াজ শুনে সেখানে দাদুর পছন্দ করা মেয়েটা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরোজ বিরক্ত হলো তবুও কিছু কারা নেই।

হাই সুইটহার্ট,কি করছো?
ইমরোজ মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,
নাম কি?
মেয়েটা ভড়কে গেলো তবে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো,
বাহ দুদিন পরে যাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি করতে চলেছো তাঁর নামটা পযর্ন্ত জানোনা? সো স্যাড। আমি ভীষণ দুঃখ পেলাম।

ইমরোজ চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। হাত পা টনটন করছে। মনে হচ্ছে মেয়েটাকে থা/প্পড় দিয়ে দাঁত ভেঙে দিতে পারলে শান্তি লাগতো। দাদু না থাকলে কাজটা ও অনায়াসে করে ফেলতো। তাই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
জানার প্রয়োজন পড়েনি। ইমরোজ খান অপ্রয়োজনীয় কিছুতে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করেনা। অহেতুক আমাকে ঘাটিয়ে নিজের বিপদ ডেকোনা মেয়ে। এমনিতেই চটে আছি। দ্রুত বলে বিদায় হও।

আমি ঐশ্বর্য খান এই বাড়ির উত্তরাধিকারী। এই সম্পত্তির উপরে তোমার যেমন অধিকার তেমনিভাবে আমারও আছে।
তো আমার কি? এখানে সময় অপচয় না করে দাদুর কক্ষে গিয়ে উনার পা ধরে তোষামোদ করো তবেই আমাকে পেতে পারো নয়তো না। এই ইমরোজ খানকে পাওয়ার জন্য তপস্যার প্রয়োজন।

তোমার মতো ছ্যাঁচড়া টাইপ মেয়ের সৌভাগ্য দেখে এঞ্জেলও আফসোস করবে। আমাকে পাচ্ছো ভেবেছো একবার? যাও এখান থেকে ।
অপমানে ঐশ্বর্যের চোখ ফেটে পানি নেমে আসলো। লোকটার কথাতে কোনো রসকস নেই। খটখটে টাইপ। এমন একটা মানুষকে বিয়ে করতে হচ্ছে শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য। নয়তো সবটা হাতের বাইরে চলে যাবে। একজনকে শাস্তি দিতে হলে বিয়েটা অতি জরুরি। কথাগুলো ভেবে ও কক্ষ ত্যাগ করলো।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৯

বহুকাল পর ঘুমন্ত যুবকের কাল ঘুম ভাঙলো। পিটপিট করে চোখ খুঁলে চাইলো। আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে কিন্তু বুঝতে পারলোনা। বিছানা থেকে টলতে টলতে নিচে পা রাখলো। কতকাল এভাবে ঘুমিয়েছে তার হিসেবে আপাতত জানা নেই। মাথায় ভোতা যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু মনে পড়ছে না। হঠাৎ পাশে একটা বলয়ের অস্তিত্ব পেয়ে ও মাথা তুললো। হাত বাড়িয়ে ভাসমান উজ্জ্বল বলয়ের উপরে হাত রাখতেই সেটা ওর মধ্যে মিলিয়ে গেলো। দ্বিতীয় দফায় ও ধুম করে বিছানায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ১১