কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২১

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২১
লাবণ্য ইয়াসমিন

বিপদের সময় প্রিয়জনের ছায়াতলে থাকতে পারাটা পরম শান্তির। জয় পরাজয় সেতো জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।বাঁচতে হলে জীবন যুদ্ধে অংশ নিতে হয় কিন্তু সেই সময় পাশে যদি নিজের একান্ত আপনার কেউ থাকে তবে সেই যুদ্ধে খুব বেশি কষ্টের হয়না। মধ্য রাত নির্জন কক্ষে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে কহিনুর।

শরীরের তাপমাত্রা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে সেই সঙ্গে রঙ পরিবর্তন হচ্ছে। কখনও নীল সাদা আবার কখনও কালো। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে প্রেয়সীর দেখা মিলেছে কিন্তু মিলেনি স্বস্তি। পাথর কহিনুরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মেয়েটা মাঝেমাঝে অবচেতন মনে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চাইছে। পাথর প্রচণ্ড বিরক্ত সেই অগন্তুকের উপরে যার জন্য মেয়েটা এমন কষ্ট পাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো চুল পরিণাম কাউকে ছাড় দিবেনা। জন্মের মতো কালোজাদুর ইতিহাস ভুলিয়ে দিবে। কতশত প্রেমগাথা হৃদয়ের গহিনে গচ্ছিত আছে তার কিছু শোনানি হলোনা। ছোট্ট জীবনের অর্ধেক সময় চলে গেলো সুখী বিবাহিত ব্যাচেলার হিসেবে।আল্লাহ আর কত ধৈর্য নিবেন কে জানে।আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো।

রহস্যঘেরা ঝিলমিল তারকাখচিত নীল আকাশের নিচে মন মাতানো জোছনামাখা রজনীকে সাক্ষী রেখে সুদীর্ঘ সমুদ্রের তীরে চনচল জলতরঙ্গে পা ডুবিয়ে প্রিয়তমার সঙ্গে হৃদয়ের লেনদেন খুব নিবিড়ভাবে হলেও হতে পারতো। কিন্তু আফসোস তেমন কিছুই হলোনা বরং প্রেয়সীর ব্যথাতুর মুখোশ্রীর নেত্রজলের ধারাবর্ষণে আহত হতে হচ্ছে। এর থেকে নিহত হলেও ধরাধামে অন্ততপক্ষে শান্তি মিলত।

জীবন এতোটা জটিল সমীকরণে আটকে পড়েছে সেখানে হৃদয়ের চরণভূমি পুস্পশূন্য ধূধূ মরুভূমি। তৃণভূমিতে কবে পরিণত হবে আশায় আশায় দিন যাচ্ছে তবুও স্বস্তির দেখা মিলছেনা। পাথরের নেত্রপল্লব লাল হয়ে উঠেছে। কিভাবে মেয়েটার ব্যাথা কমাতে সাহায্য করবে বুঝতে পারছে না। কয়েকবার কপালে ভেজা কাপড়ের অংশ রেখেছিলো কিন্তু মনে হচ্ছেনা কাজ হবে।

উপায়ন্তর না পেয়ে ভাবলো হেকিমের সঙ্গে দেখা করতে যাবে কিন্তু কহিনুরকে এভাবে একা ফেলে যাওয়াটা মনে সাড়া দিচ্ছে না। যদি কোনো বিপদ হয় তখন ঝামেলা হবে। পাথর আনমনে কথাগুলো ভাবছিলো ঠিক তখনই হুট করে বেলকনির দরজা খুঁলে গেলো। সাঈদ হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে পালঙ্কের দিকে চেয়ে চমকে গেলো। পাথর সেদিকে চেয়ে সাঈদের হাতে ওষুধ দেখে বিরক্তির সহিতে বলল,

কোথায় ছিলে তুমি? মেয়েটাকে এভাবে ফেলে চলে গিয়েছিলে বেয়া/ক্কেলের মতো যদি কিছু হয়ে যেতো? এই তুমি কহিনুরের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছো? হাতের কাছে আসো তোমার হচ্ছে।
সাঈদ ভড়কে গেলো পাথরের রাগ দেখে। কতকাল পরে দেখা হলো অন্ততপক্ষে সামান্য আলাপচারিতা করতে পারতো কিন্তু না সরাসরি হুম/কি দিচ্ছে। সাঈদ জোর করে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,

ঔষুধ আনতে হেকিম সাহেবের দ্বারে গিয়েছিলাম। ওষুধটা ওর বড্ড প্রয়োজন। ওদিকে তন্ত্রমন্ত্রের আয়োজন চলছে। হাতে সময় কম। আকাশে চাঁদ ডুবে যাওয়ার আগেই এটা খাওয়াতে হবে। নয়তো পুরোপুরি বশে চলে যাবে।
সাঈদ হাতের ওষুধ দেখিয়ে কথাগুলো বলল। পাথর অপেক্ষা করলোনা। ওর থেকে এক প্রকার তরল উপকরণের বাটিটা ছিনিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,

গাধা এতোক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছো তবে বলছোনা কেনো? বুদ্ধি জ্ঞান নেই তোমার ? যাইহোক এসব কে করেছে জানো কিছু?
পাথর চামুচে করে ওষুধ নিয়ে সেটা যত্ন সহকারে কহিনুরের ওষ্ঠে রাখতে রাখতে কথা বলছে। সাঈদ চোখ বড়বড় করে ওকে দেখছে। মানুষটার মতলব বুঝতে ও হিমশিম খাচ্ছে। সাঈদকে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাথর বিরক্ত হলো। ওষুধ খাওয়ানো শেষ হলো। এখন অপেক্ষা করতে হবে। সাঈদ ফিসফিস করে বলল,

আপনার সবটা মনে পড়েছে? চিনতে পারছেন সবাইকে?আপনার দাদুর গোপন কক্ষে থাকতে একদিন আপনাকে ডেকেছিলাম উদ্ধারের জন্য কিন্তু আপনি শুনতে পাননি।
পাথর চিন্তিত হলো সাঈদের কথা শুনে। দাদুর গোপন কক্ষটা সাধারণ কোনো মানুষের দৃষ্টিতে পড়েনা মূলত দেখতেই পারেনা। রহস্যময় কক্ষ সেটা। সেখানে মায়ার ছড়াছড়ি। সাধারন চোখে সেটা নরমাল কক্ষ অথচ সেখানে লুকিয়ে আছে কতশত বিপদের কারণ। পাথর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,

আমার শক্তি বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বিধায় কিছু শুনতে পাইনি।তুমি কতদিন সেখানে আটকে ছিলে? আমাদের মুক্তির পরে নাকি আগেই?
আগে থেকেই। আপনার দাদুকে একজন সাহায্য করেছিল সেই আমাকে বশ করে আপনাদের মুক্তির বিষয়টা জেনে নিয়েছিলো।

উনার থেকে আমাকে আটক রাখতে মায়াবী কক্ষে বন্ধ রাখা হয়েছিলো। উনাদের বিশ্বাস ছিল কহিনুর ফিরলে আমাকে উদ্ধার করতে ওখানে পৌছাবে। আর তখন ওকে আক্রমণ করবে কিন্তু ফলাফল শূন্য। কহিনুর ওখানে গিয়েছিল ঠিকই তবে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। আপনি অজান্তেই ওকে সাহায্য করছিলেন তাছাড়া এটা ঘটার ছিল।
সাঈদ ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। পাথর রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছে ছেলেটার এমন আজব ব্যবহারে তাই হালকা ধমক দিয়ে বলল,

বেলকনিতে যাও নয়তো ঘুরে এসো বাইরে থেকে।আপাতত আমাদের একা ছেড়ে দাও। বুঝতে পারছো আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি? নাকি বুঝতে পারছোনা?আচ্ছা তোমাদের জ্বীনদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সিস্টেম নেই? আমার জানা মতে আছে আর সেটা অনেক তীব্র।তবে তুমি এমন বেকুব কেনো? নাকি অন্য কিছু?
পাথরের লাগাম ছাড়া কথা শুনে সাঈদের চোখ বড় হয়ে গেলো। খুকখুক করে কেশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলল,

আমার এখন বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন।মালকিনের সঙ্গে কথা আছে। আপনি থাকুন এখানে।
সাঈদ কথাটা শেষ করে অপেক্ষা করলো না। বেলকনির দিকে ছুটে গেলো।এখানে থাকলে উল্টোপাল্টা অপ্রিয় বাক্য শুনে কর্ণকুণ্ডল নষ্ট হয়ে যাবে। লোকটা মারাত্মক বেহায়া। পাথর দৃষ্টি ঘুরিয়ে কহিনুরের কৃষ্ণবর্ণ মুখোশ্রীর দিকে চাইলো। সর্বনাশা কালোতে যেনো রূপের ছটা সামান্য পরিমাণও কমেনি বরং আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

এটা মায়া নাকি মোহ কে জানে। প্রিয়জন বুঝি এমনিই হয় নিজের একান্ত আপনার।সে যেমন পরিস্থিতিতেই থাক সব সময় এক রকম লাগে।পাথর কহিনুরকে নিজের বুকের সঙ্গে আরও খানিকটা ঝাপটে ধরে চোখ বন্ধ করলো। ওষুধে কাজ করছে কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বর কমে যাবে।ভোর রাত হতে চলেছে।

চাঁদ ডুবে গিয়ে অন্ধকারে ছেয়ে আসে চারপাশ। কক্ষে আবছা আলো জ্বলছে এই আলোতে কহিনুরের মুখটা রহস্যময় লাগছে।এভাবে পূর্বে কখনও মেয়েটার এতো কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য ওর হয়েছিলো কি মনে পড়ছেনা।এভাবে অনেকটা সময় অতিবাহিত হলো। হঠাৎ পাথরের ধ্যান ভাঙলো কহিনুরের নড়াচড়া দেখে। মেয়েটা চোখের পাপড়ি পিটপিট করে নাড়িয়ে চোখ খুঁলে চাইলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল।ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে পাথরকে এখানে দেখে বেশ অবাক হচ্ছে। নিস্তব্ধ কক্ষের চারদিকে রিনরিনে কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো

আপনি এখানে কি করছেন?
পাথর মাথা চুলকে হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু হাসি আসছে না তাই ভনিতা ছাড়া উত্তর দিলো,
বউয়ের কাছে কেনো আসে স্বামীরা?তুমি বাঙ্গালী নিয়মকানুন জানোনা মানছি কিন্তু ধর্মীয় বিষয়টা কিভাবে এড়িয়ে যেতে পারো?
কহিনুর হতভম্ভ এমন আজব উত্তর শুনে।আগে নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন তাই বালিশে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বলল,

আপনার আজেবাজে বকবক বন্ধ হলে এখন আসতে পারেন। আপাতত আমি ক্লান্ত আছি ঘুমের প্রয়োজন। আপনার দাদু আপনাকে খোঁজ করছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করে আসুন তারপর আপনার সব কথা শুনবো।
পাথর মানতে পারলোনা তাই কম্বলটা টেনে নিয়ে কহিনুরের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

সরি সেদিনের ব্যবহারের জন্য।আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি তুমিতো সবটা জানতে বলো?আচ্ছা বাদ দাও গালিব আঙ্কেলের খোঁজ পেয়েছি উনাকে উদ্ধার করতে হবে। তুমি প্রহেলিকা আর আলেক্স লয়েড এই দুজনকে চিনো? উনাদের কাছে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আছে।
পাথরের কথা শুনে কহিনুর হাতের মুষ্টিমেয় শক্ত করে চেপে ধরলো।এটা এতোদিন মাথায় আসেনি কেনো বুঝতে পারছে না।কহিনুর হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছাড়তে চাইলো কিন্তু পারলোনা।পাথর ওর হাতটা ধরে ফেলল। টেনে বসিয়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে পূণরায় বলল,

দুর্বল শরীর নিয়ে উনাদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিজে বন্ধী হতে চাইছো? মাথা ঠান্ডা করো আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কতদিন পরে দেখা হলো কিছু বলো প্লিজ। তুমি না বলেছিলে দুটো হৃদয়ের লেনদেন নিশ্চয়ই হবে? তবে বিচ্ছেদ কেনো বারবার আমাকে হতাশ করে? তুমি নি/ষ্ঠুরভাবে প্রতিবার আমার হৃদয়ে খ*ঞ্জ*র চালিয়ে রক্তা/ক্ত করে দাও। আমি কষ্ট পাচ্ছি তুমি বুঝনা?

পাথর আবেগপূর্ণ হয়ে ছলছল চোখে আনমনে কথা বলছে। নির্জন এই নিশীতে প্রেয়সীর কাছে অজস্র হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা উন্মুক্ত করতে না পারলে কখনও হয়তো সেই সুযোগ আসবে না আর।তাছাড়া সময়ের কাজ সময় থাকতেই করতে হয়। কহিনুর ওর কথার উত্তর করছে না চুপচাপ শুনছে। খানিকটা সময় পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাথরের কাধে মাথা রাখলো। দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

মেয়েদের মতো কান্নাকাটি করে আমাকে দুর্বল করার তালে আছেন? সেদিন কি বলেছিলাম মনে নেই?
একদম না। আমিতো জাষ্ট আমার ফিলিংসা তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। বহুবার বলেছি এখন আবারও বললাম আর ভবিষ্যতেও বলবো। নূর তুমি খানিকটা ঘুমিয়ে নাও আমি আসছি। মনে হচ্ছে আমাকে ডাকছে আর যেতে হবে।
পাথর কথা শেষ করে সময় নষ্ট করলোনা দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো।কহিনুর কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু পারলোনা পেছন থেকে ওর ডান হাতটা কহিনুর আটকে ধরেছে। পাথর ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো। কহিনুর বাঁকা হেসে পাশ থেকে নীর রঙের আংটিটা পাথরের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে মুখটা কঠিন করে বলল,

ওখানে বিপদ আছে সাবধানে থাকবেন।
পাথর চমকে উঠল বারবার কারো ডাক ওর কানে বেজে চলেছে তাই এখানকার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দিলো,
আমাকে ডাকছে যেতে হবে।
কহিনুর মাথা নাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পাথর যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেলো। সাঈদ ডাইনিং রুমের সোফায় বসে ডিনারে বেচে যাওয়া অবশিষ্ট গরুর মাং/সের হা/ড্ডি চিবিয়ে খাচ্ছে। অনেক দিনের অভুক্ত পেট ছাড়া পেয়ে আজ বাঁধা মানতে চাইছে না।মালকিন বকাবকি করবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবছে না।

পাথর ছুটে এসেছে অদৃশ্য কারো টানে।গহীন অরণ্যের মাঝে ছোট্ট একটা কক্ষের ফ্লরে সাদা রঙের লম্বাটে ক/ফিন পড়ে আছে। ক/ফিনের ঢাকনা অর্ধেক খোলা বিধায় ভেতরে থাকা এক মানবির বিবর্ণ মুখখানা দেখা যাচ্ছে। ওষ্ঠে তাঁর রহস্যময় হাসি।সাদা টাইলসের উপরে ছোপ ছোপ র/ক্তের দাগ। এলোমেলো পচা মাং/সের ঝাঝালো গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বেলকনিতে অন্য এক রমনী পা ঝুলিয়ে গুণগুণ করে গান গাইছে। মনে হচ্ছে কক্ষের ঘটনাটা এখানে অহরহ ঘটে থাকে। সব কিছু অতি স্বাভাবিক।

মলিন মুখে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে জুবায়ের। অধরা প্রয়োজন ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলছে না। পাত্তা দিচ্ছে না এড়িয়ে চলছে।এদের দুজনের মধ্যে কি হচ্ছে জামসেদ বিষয়টা বুঝতে না পেরে ডাইনিং রুমের সোফায় জুবায়েরের পাশে এসে বসলো। বাড়িটা নির্জন হয়ে আছে। ভোরবেলা জুবায়ের কক্ষের বাইরে এসেছে এটা এই বাড়ির জন্য বিলুপ্তপ্রায় দৃশ্য। জামসেদ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,

সব ঠিকঠাক? কোনো ঝামেলা হয়নিতো?
জুবায়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ কণ্ঠে উত্তর দিলো,
আর ঠিক! কিছুই ঠিক নেই।বেঘর হয়েছি কথাটা জামাই পযর্ন্ত জেনে গেছে বুঝতে পারছো আমার সম্মানটা ঠিক কোথায় আছে? বাল্যকালে কোনো যে ভাই প্রেম করতে গিয়েছিলাম। আমার সারাটা জীবন গেলো সেই পাপ মোচন করতে করতে। বউ আমার প্রাক্তনের উপরে বিরক্ত হয়ে শাস্তি দিয়েছে। সারারাত সোফায় ছিলাম একটুও ঘুম হয়নি।কাঁধে প্রচুর ব্যাথা। কতদিন বিছানা ছাড়া কাটবে কপাল আমার।

জুবায়েরের বলার ধরণ দেখে জামসেদ শব্দ করে হেসে ফেলল। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল,
দোষ করলে শাস্তি পেতে হয় মেনে নাও। ঘরে আছে এটাইতো অনেক।আমারটা হলে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে ঘাপটি মারতো। কি এক বিদেশি মহিলার সঙ্গে ভাব জমিয়েছে। মাসের অর্ধেক সময় দুজনে মিলে শপিং করে আমার পকেট ফাঁকা করে।কিছু বললে নাকের জলে চোখের জলে এক করে আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। সেক্ষেত্রে অধরা ভালো মেয়ে। আমি ওর পক্ষে।

আচ্ছা ক্ষমা পেতে হলে এখন কি আমাকে প্রতি/শোধ নিতে জুহির খোঁজ করতে হবে? পেত্মিটাকে কোথায় পাওয়া যাবে বলোতো আমি এখুনি যাচ্ছি। ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেছে।
বাচ্চাদের মতো করছো কেনো? মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে একটু একা ছেড়ে দাও। দুদিন যেমন আছে থাকতে দাও তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবীতে বউ তোমার একার নেই। সুলতান জুবায়ের ফারুকীর সঙ্গে এসব যাচ্ছে না।
জামসেদ শেষের কথাগুলো বেশ বিরক্তি নিয়েই বলল। এমন অধৈর্য হলে চলে না। জুবায়েরের সেটা একদম পছন্দ হলো না তাই ভ্রু কুচকে উত্তর দিলো,

কিসের সময়? আমার ঘুম হচ্ছে না মন অশান্ত হয়ে আছে। যদি হার্ট এ্যাটাক করি তখন কি হবে বলো?বউ বিধবা হলে দেখতে ভালো লাগবে?আমারতো একটুও ভালো লাগবেনা। ওকে বিধবার সাজে দেখলে কষ্ট হবে।
জুবায়ের বেশ সিরিয়াস। জামসেদ মহা বিরক্ত হলো।ভাবলো বউপাগলা মানুষের সঙ্গে কথা বলাই বেকার। এদের সব কিন্তু ভাবনা ঘরে গিয়েই থামে। যেমন আছে থাক এমন। জামসেদ আর অপেক্ষা করলোনা। ঘড়িতে সকাল ছয়টা বেজে গেছে। বাইরে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। জুবায়ের সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দিয়ে বিরক্ত হলো। কফি ঠান্ডা শরবত হয়ে সেটা খাওয়ার অযোগ্য।

ঐশ্বর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আঁধার। বুকের মধ্যে তোড়পাড় করছে।যার জন্য নিজেকে শুধরে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলো সেই মেয়েটা এ নয় বরং অন্য কেউ। কিভাবে সেদিন ভুলটা করে ফেলল এখন আফসোস করতে হচ্ছে। ঐশ্বর্য হেকিমের ওষুধির দ্বারা মুখের এলোমেলো ক্ষ/তপূর্ণ জায়গা চিকিৎসা করেছে তবুও কিছু দাগ রয়ে গেছে। দেখতে আগের ন্যায় সুন্দরী বলা মুশকিল। আঁধারের সঙ্গে থাকতে ও বাধ্য। যতই চেষ্টা করুক কখনও আলাদা হতে পারবেনা। এক প্রকার শাস্তিতে থাকার মতো অবস্থা। নির্জনতা কাটিয়ে গমগমে শব্দে আঁধার উচ্চারণ করলো,

সবটা তোমার দোষ। কি দরকার ছিল ঘোমটা টেনে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার? দাঁড়িয়ে ছিলে মানলাম কিন্তু তরলটা মুখে ধরলাম আর অমনি খেয়ে নিলে? বুঝতে পারছো অদৃশ্য ওই লোকটা আজীবন আমাদের পাহারা দিবে? মেজাজ খারাপ হচ্ছে প্রচুর। কোথায় ভেবেছিলাম আমার জীবনে রাজকুমারী আসবে তানা র/ক্তচোষা পে/ত্নির আগমন ঘটলো।।তুমি আমার সঙ্গে ছলনা করেছিলে সবটা জেনেছি আমি। লজ্জা করলোনা অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে ডেট করতে যেতে?
ঐশ্বর্য ফুলে উঠলো। ওকে একা দোষারোপ করা হচ্ছে সেটা ও কখনও মানবেনা তাই উত্তর দিলো,

যেটা করেছি দাদুর ইচ্ছেতে করেছি। আমাকে দোষারোপ না করে নিজের কাছে প্রশ্ন করো উত্তর পাবে। মাথামোটা প্রাণী একটা। সেদিন ওটা কহিনুর ছিল যে তোমাকে বশে নিয়ে বিয়ের সময় সবটা উল্টে দিলো। তুমি গাধার মতো এসে আমাকে বাধ্য করলে ওই তরল পান করতে। নয়তো কে চেয়েছে তোমার মতো গাধাকে সঙ্গী হিসেবে পেতে?আর লজ্জার কথা বলছো? আমার কথা ছাড়ো তোমার লজ্জার কথা ভাবলে আমারই লজ্জা পাচ্ছে।লজ্জার প্রখরতাই প্রতি রাতে বারে নয়তো হোটেলে একাধিক মেয়ের সঙ্গে ডেটে যেতে তার কিছু ভুলিনি আমি। স্বাদ নিয়ে সাধু হওয়া বন্ধ কর ভাই আমি ঠিক হজম করতে পারছিনা। চুপচাপ আছি তোমার সহ্য হচ্ছে না।

ঐশ্বর্য নিজের চেহারা নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তিত তার মধ্যে আঁধারে আজেবাজে কথাবার্তা শুনে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যা মুখে এসেছে সবটা বলে দিয়ে নিশ্বাস ফেলল। বলতে পেরে পেট খানিকটা হালকা লাগছে। কিন্তু শান্তিটা বেশিক্ষণ টিকলোনা। আঁধার তেড়ে আসলো।

এই তুমি পুরাতন কথাবার্তা তুলে খোটা দিচ্ছো কেনো? সেদিন সুলতান হাউজে তোমরা সকলেই প্রাণে বাঁচতে কহিনুরের হাতে পায়ে ধরেছিলে একমাত্র আমি ছাড়া। নিজের নিয়তিকে আমি পূর্বেই মেনে নিয়েছি। ওকে পেলে ভালো হয়ে যেতাম। কিন্তু..

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২০

আঁধার আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।হুট করে কক্ষে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটলো। যার লম্বাটে শিং আর র/ক্তবর্ণ চক্ষুর চাহুনিতে দুজনেই ঘাবড়ে গেলো।কি হতে চলেছে বুঝতে বাকি নেই। আঁধার মহা বিরক্ত হচ্ছে দাদুর উপরে। যেকোনো উপায়ে এই তরলের কাহিনী খতম করতে হবে। কহিনুরের চালাকির জব্বর একটা উত্তর ওর কাছে আছে। অ/স্ত্র হিসেবে এখন সেটাই ব্যবহার করবে বলে নিজেকে শান্ত করলো।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২২