কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৫

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৫
সাবিকুন নাহার নিপা

রিশাব একটা বেসরকারি ব্যাংকে আছে। চাকরি টা যখন পেল তখন অনেকেই ভবিষ্যৎ বানী করেছিলেন যে এই চাকরি ওর দ্বারা হবে না। এতো আরাম, আয়েশ করা ছেলে ব্যাংকের চাকরির মতো কঠিন চাকরি করতে পারবে না। এরপর খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলে সবাই বলাবলি করতে লাগলো যে মোটা অংকের স্যালারি একাউন্টে জমা হয় বলে রিশাব দাঁতে দাঁত চেপে চাকরি টা করছে। কিন্তু আসল ব্যাপার টা ঠিক উল্টো।

ব্যাংকের চাকরি, প্রেশার, সপ্তাহে দুদিন ছুটি সব কিছুই রিশাব দারুন উপভোগ করছে। এখনো পর্যন্ত বোরিং লাগছে না। রিশাব কে সবাই ই আরামপ্রিয়, অলস ছেলে হিসেবে জানে। অথচ ও যখন যেটা করেছে সেটা পরিশ্রম করেই করেছে। কিন্তু লোকজন তা মানতে নারাজ। বিশেষ করে রিশাবের মা। সে মনে করেন যে তার এই বাচ্চাটা ব্লেসিং চাইল্ড। রিশাব অবশ্য তাতে মন খারাপ করে না। ওর সচরাচর মন খারাপ হয় না। এই বিশেষ গুন টা পেয়েছে বাবার থেকে। বাবা বলেন, দুনিয়ায় আমরা কতো অল্প সময়ের জন্য আসি। কী দরকার অহেতুক বিষয়ে মন খারাপ করে সময় নষ্ট করার! সময় টা কত দামী!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সময়ের দাম রিশাব এখন জানে। বাবাও এখন জানেন। তার সময় টা আটকে আছে হুইলচেয়ারে। বছর পাঁচেক আগে শরীরের অর্ধাংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তবুও তাকে দেখে অতোটা দু:খী মনে হয় না। সে ভালো আছেন। ঘরে থেকেও সে সমান ব্যস্ত থাকেন। সেই সঙ্গে গড়ে তুলেছেন বইয়ের সাম্রাজ্য। একটা মোটামুটি সাইজের রুম বই দিয়ে ঠাসা।
রিশাব আজ বাবার ঘরে এলো। বাবা বারান্দায় বসে বই পড়ছেন। সামনে টি পট ভর্তি চা। সকালের এই সময়ে তিনি পর পর কয়েক কাপ চা খান চিনি ছাড়া। রিশাব নি:শব্দে এসে দাঁড়ালো। বাবা বই বন্ধ করে বললেন,

“রিশু তুমি আজ এতো সকালে? ”
রিশাব হাসলো। চেয়ার টেনে বসলো। বারান্দায় দুটো চেয়ার থাকে। একটাতে বাবা বসেন, অন্যটা ওদের জন্য।
রিশাবের বাবা রেদোয়ান চৌধুরী একসময় একসময় নানান টাইপের বিজনেস করেছেন। টাকা কামানো ছিলো তার নেশা। তবে কখনো পরিবারের প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করেন নি।
রিশাব চেয়ার টেনে বাবার আরেকটু কাছে বসলো। বলল,

“আমাকেও একটু চা দাও বাবা।”
“এই চা তুমি খেতে পারবে না।”
“পারব। দাও।”
বাবা কাপে চা ঢাললেন। পিরিচে রাখা লেবু থেকে এক টুকরো লেবু দিলেন। রিশাব চা নিয়ে এক চুমুক খেয়েই বলল,
“জঘন্য চা বাবা।”
বাবা হাসলেন। বললেন,
“তুমি নাকি অসাধ্য সাধন করেছ?”
“কী আর অসাধ্য! মা তো বলল ইটস নরমাল। ”

“তোমার মা জীবনে এতো বড় বড় কাজ করেছেন যে এখন সবকিছু তার কাছে ছোট মনে হয়।”
রিশাব হাসলো। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই বসে আছে। ভুলেও আর চুমুক দিলো না। বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“ওদেরও একদিন আমাদের এখানে আসা উচিত কী বলো! আমি তো যেতে পারলাম না।”
“তোমার যাওয়া উচিত ছিলো বাবা।”
বাবা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“ওদের কেমন দেখলে?”
“ভালো। মিশুক।”
“আর শাওন কে কেমন দেখলে?”
“খুব ভালো। ”
কথাটা বলে রিশাব নিজেও একটু অপ্রস্তুত হলো যেন। অথচ অপ্রস্তুত হবার তেমন কারণ নেই।

পরোটার টুকরো অংশ চায়ে ভিজিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছে শাওন। আড়চোখে মুখোমুখি বসা মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। মা বসে আছেন গালে হাত দিয়ে। শাওন মিটিমিটি হাসছে। সুরমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
“হাসছিস কেন? তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। আমি কথা বলব।”
“ভাবছি চুল টা কালার করে ফেলব মা। দেখতে সুন্দর লাগবে না? আমার মুখের সঙ্গে মানাবে না?”
সুরমা বেগম চোখ বড় করে তাকালেন। শাওন কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে। ইচ্ছে করছে ঠাস করে এক চড় মারতে। কিন্তু আর কত! কত মার তো খেল! তবুও যদি একটু শোধরায়!
শাওন চা খাওয়া শেষ করলো। শেষ করে বলল,

“আজ তুমি রেস্ট নাও মা। আমি রান্না করি।”
“শাওন শোন!”
শাওন মায়ের দিকে তাকায়। মা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরনে ঢোলা একটা টিশার্ট। চুলগুলো এলোমেলো করেই মাঝখানে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। তবুও কী ভালো লাগছে। কী সরল মুখ টা! আবার মায়ের নজর ই না লেগে যায়।
সুরমা বেগম নরম গলায় বলেন,

“পলাশ কে ঠিক কোন জায়গা থেকে তোর যোগ্য মনে হয় রে মা? না আছে পড়াশোনা, না আছে চেহারা আর না আছে পরিবার। ”
শাওন হাসলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আমি জানিনা।”
আসলে কী তাই! পলাশ ওর জীবনে সেই সময়ে এসেছে যখন ও প্রেম ভালোবাসা ব্যাপার টা বোঝেনা ঠিকঠাক। রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো দেখার জন্য। বৃষ্টিতে একবার শাওন কে দেখতে গিয়ে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে মরতেও তো বসেছিল।
সুরমা বেগম বললেন,

“তোর হাবভাব আমার ভালো লাগছে না শাওন। ওই ছেলেকে বিয়ে করার চিন্তায় আছিস তুই? যদি থাকিস, তাহলে শোন আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
শাওন হেসে ফেলল। বলল,
“বাড়ি ছাড়ার হলে তুমি অনেক আগেই ছাড়তে মা। শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ!”

সুরমা বেগম হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন। এই মেয়েকে আর কিভাবে বোঝাবেন তিনি! সুহাস সংসারে টাকা দিয়েই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেন। আর ওর বাবা এতকিছু বোঝেন কিন্তু মেয়ের বিয়ের কথা বোঝেন না। তিনি মেয়েকে কিছু বলেনও না। অবশ্য বলেও কতটুকু কী শোনাতে পারতেন কে জানে!

শাওন চলে যায়। সুরমা বেগম বসে থাকেন। তার বড্ড ক্লান্ত লাগে। আগে লাগতো না। এখন লাগে! এতো হাঁসফাস লাগে। কেন যেন মনে হয় মেয়েটা বিশাল রকমের এক অঘটন ঘটাবে। সারাজীবনে কী একটুও নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।
সুরমা বেগমের বিয়ে হয়েছে কলেজে পড়ার সময়। স্থানীয় কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছেন। দুই মাস পর ই বিয়ে। পাত্রপক্ষ দেখতে এসে পছন্দ করলেন।

শাওনের দাদা, চাচা আর বাবা ছিলেন। তারা প্রস্তাব রাখলেন ওইদিন ই বিয়ে হবে। শুভ কাজ টা সেড়ে রেখে তারপর ই খাওয়া দাওয়া সহ অন্যান্য কাজ করবেন। সুরমা বেগম তখন বড় ভাই কে ডেকে বললেন, ভাইজান আমি কিন্তু কলেজের পড়াটা পড়তে চাই। আপনি ওনাদের সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন। ভালো করে কথাবার্তা হলো। শাওনের দাদা কথা দিলেন যে পড়াশোনা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। দরকার হলে শহরের নামকরা কলেজে ভর্তি করে দিবেন।
কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেল বাসর রাতেই। যখন শাওনের বাবা বললেন,

“যাও তোমার বইগুলা নিয়া আসো। কুটিকুটি করে ছিড়বা আমার সামনে।”
সুরমা বেগম দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলেন। যে জীবন সে কাটিয়েছেন সেই একই রকম জীবন শাওন, দীপা কেউ না পাক।

দুপুর বেলা রুমে এসে জামা কাপড় না পাল্টেই দীপা ঘুমালো। জ্বর কমলেও দূর্বলতা এখনো কাটে নি। ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। স্ক্রিনে সুহাসের নাম টা দেখে দীপা উঠে বসলো। ফোন ধরতেই সুহাস এক রকম চিৎকার করে বলল,
“আর ইউ ওকে? আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছ নাকি?”
দীপা ক্লান্ত গলায় জবাব দিলো,
“না। আমি ঠিক আছি ঘুমাচ্ছিলাম।”
সুহাস গম্ভীর গলায় বলল,
“বাসায় চলে আসো।”
“না। বাসায় থাকলে পড়া হয় না।”

“ওষুধ গুলো ঠিকঠাক খাচ্ছ তো? নাকি আবারও রোগ ব্যধি বাঁধিয়ে আমাদের ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করছ?”
দীপা নি:শব্দে হাসলো। সুহাস আবারও বলল,
“দীপা, বাসায় চলে আসো।”
“আপনি শুধু শুধু কেন এতো টেনশন করছেন?”
“শুধু শুধু? তুমি বিশ্রী অসুখ বাঁধিয়ে আমাদের নাম খারাপ করবে বলে ঠিক করেছ আর আমরা টেনশন করব না? ফাজলামি করছ?”

দীপা আবারও হাসলো। সুহাস আরও কিছুক্ষন কথা শুনিয়ে ফোন রাখলো। দীপা শাড়িটা ওভাবে রেখে যাওয়ার পর থেকে ও শান্তি পাচ্ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। প্রচন্ডরকম বিরক্ত লাগছে। দীপা মেয়েটাকেই এখন ওর ভীষণ বিরক্ত লাগছে। মাত্র জ্বর থেকে উঠলো আর এক্ষুনি ওর হোস্টেলে যেতে হচ্ছে। ইচ্ছে করে টেনশনে রাখছে সবাইকে। এসব করে কী এটেনশন পেতে চাইছে!

সন্ধ্যেবেলা সুহাস দীপার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৈশাখ মাসের গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। দীপাকে ফোন করে গেটের সামনে ডাকলো। দীপা সুহাস কে দেখে বিস্মিত হলো। সুহাস নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“এক্ষুনি সব গুছিয়ে নাও। সব মানে সব। বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে।”
“বাসায় থাকলে পড়াশোনা হবে না।”

“অবশ্যই হবে। পরীক্ষা পর্যন্ত আমি রুম ছেড়ে দেব। ”
দীপা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সেই চোখে হাজারো প্রশ্ন। সুহাস সেই প্রশ্নগুলো বুঝতে পেরে জবাব দেয়,
“মনিদীপা মল্লিক যতদিন আছ ততদিন ইউ আর মাই রেসপন্সিবিলিটি। আমাকে তো নিস্তার দিচ্ছো না তুমি। যাও সব গুছিয়ে নাও।”

দীপা এলোমেলো পায়ে হেটে যায়। রুমমেট রা হুমড়ি খেয়ে দীপার বরকে দেখে। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“ওয়াও দীপা, ভাইয়া কী হ্যান্ডসাম।”
দীপা দৌড়ে ওয়াশরুমে যায়। বেসিনের কল ছেড়ে হাপুস নয়নে কাঁদে।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৪

(আমি একটু ঝামেলায় আছি। পর্বগুলো একটু ছোট হবে। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়ুন। সবগুলো চরিত্র বিল্ড আপে একটু সময় লাগবে।)

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৬